#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৪
#হুমাইরা_হাসান
কিছুক্ষণ আগেই এসে হাজির হওয়া মানুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জহুরি নেত্রে দেখছে মোহর। লম্বায় মেহরাজের মতো না হলেও বেশ অনেকটাই। চেহারা উজ্জ্বল, ভাসা ভাসা চোখ। মুখের হাসিটা অমায়িক। দেখে মেহরাজের বয়সী ই মনে হলো, কিন্তু মোহর নিজেই তো মেহরাজের বয়স জানে নাহ। তবে একটা বিষয়ে মোহর বেশ অবাক,আর তা হলো আম্বি বেগমের এই ছেলেটার প্রতি আচরণ। এতটা আদর যত্ন করছে যে বোঝাই যাচ্ছে না, লোকটা মেহরাজের বন্ধু না সহোদর।
আম্বি বেগম থাল ভরে ভরে নাস্তা এনে সামনে রেখে স্নেহমহী গলায় বলল
– পৃথক তুমি এসেছো এবার আমি নিশ্চিন্ত। তোমার এই হেয়ালিপনায় ভরা বন্ধুটাকে একটু বোঝাও, আমার কোনো কথায় তো শুনতে চাইনা
মৃদু কেশে উঠলো পৃথক, মেহরাজের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল
– আমি আর কেনো আন্টি, এখন তো সাহেবের বউ এসে গেছে, সেই সামলে নেবে
আম্বির মুখটা চুপসে গেলো না, আর নাইবা কালো হলো। শুধু চুপ করে গেলেন। মোহর একটা অদ্ভুত জিনিস খুব ভালো মতো লক্ষ্য করেছে যে আম্বি খাতুন সবার সামনে যতটা খারাপ ব্যবহার করে আড়ালে ততটাও করেন নাহ। শুরুতে অনেক অহেতুক গালমন্দ করলেও এখন সে আচরণ একেবারেই ক্ষীণ, যতটুকুই বা করে সকলের সামনেই যেনো বেশি।
মোহর এক কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষটার সাথে কিরূপ সম্ভাষণ করবে তা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে ডুবে আছে। মোহরের বেশ রাগ হলো নিজের উপর, কেমন মাথামোটা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন আগে তো নিজের সব কাজ নিজেই করতে হতো এখন মেহরাজকে বলার আগেই সব হাজির করে ফেলে তাই হাত পা দুটো গুটিয়ে রেখে রেখে বুদ্ধি, চঞ্চলতায় ধুলোবালি জমে গেছে।
মোহরের নিজের উপরে বিরক্ত হওয়ার রেশ টুকু গিয়ে পড়লো এবার মেহরাজের ওপর, মনে মনে একই কথা বারবার আওড়ালো ‘ সব দোষ এই গম্ভীর লোকটার, সবকিছুতেই বেশি বেশি আগ বাড়িয়ে প্রত্যেকটা কথায় বুঝে যায়। আমাকে না কিছু বলার নাইবা কিছু করার সুযোগ দেয়,এই করে করে আমার আলাভোলা ছকিনা করে ফেলছে দিনদিন ‘
মেহরাজ কে মনে মনে একশো বার হাবিজাবি কথাতে কটাক্ষ করে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালো সোফার দিকে। যতটা বিরক্তি আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো ঠিক ততটাই আচ্ছন্ন হলো নান্দনিক দৃশ্য টুকু চোখে দেখে, মেহরাজকে এতো স্বচ্ছল হাসি, বা খোলামেলা গল্পগুজব করার চরিত্রে ওর আগে কখনো মনে হয়নি, সবসময় কাজ আর অফিস নিয়ে থাকা দুর্বোধ্য চরিত্রের এই প্রাণোচ্ছল হাসিটুকু একঝাঁক মোলায়েম আচ্ছাদনে পরিতৃপ্ত করে দিলো মোহরের ভেতরটা।
_________________________
বিছানাভর্তি জামা কাপড়ে স্তূপ করে ফেলেছে সাঞ্জে। ঘরে জিনিসপত্র উলটে জুবুথুবু করে ফেলেছে সব। এতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করলেও কাকলি বেগম চটে গেলেন এবার ব্যাপকভাবে, ঘরের এলোথেলো অবস্থাটায় বিরক্তি ভরা চাহনি দিয়ে বলল
– সাঞ্জে তুই আর একটা জামাও যদি আলমারি থেকে বের করে ছিটিয়েছিস তাহলে আর একটা মাইর ও মাটিতে পড়বে না বলে রাখলাম। কি পেয়েছিস টা কি তুই, রাণী ভিক্টোরিয়া হয়েছিল যে সবাই তোর ইন্টারভিউ নিতে আসবে তাই তোকে বেস্ট লুক নিতে হবে!
– মা এমন করছো কেনো? আমারই তো জন্মদিন তাই না? আমাকে তো সুন্দর লাগতেই হবে, কতো গেস্ট আসবে বলো তো। আর আমিতো পড়ার মতো একটাও জামা খুঁজে পাচ্ছি না।
আলমারিতে অর্ধেক শরীর চিপকে ছামা কাপড় ছড়াতে ছড়াতে বলল সাঞ্জে। কাকলি বেগম ক্ষুব্ধ হয়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে সরিয়ে আনলেন। বিছানায় ছড়িয়ে রাখা জামা গুলোর মধ্যে থেকে একটা গোলাপি রঙের জামা বের করে বললেন
– এইটার কি হলো? এটা না তুই নিজে গিয়ে কিনে আনলি মার্কেট থেকে, এখন কেনো পড়বি না এটা?
– এটা তো কিনেছিলাম কিন্তু এখন এটার সাথে ম্যাচিং করা কোনো স্টিলেটো নেই আমার তাই
মুখটা একেবারে ছোট করে বলল সাঞ্জে। কাকলি প্রচণ্ড বিরক্তিতে গর্জে উঠে বলল
– এক চ’ড়ে তোমার দাঁত গুলো ফেলে দেবো মেয়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো সব গেস্ট রা আসতে শুরু করেছে অথচ এখনো তুমি জামা নিয়ে নাটক করছো। দশ মিনিটের মধ্যে যদি তৈরি না হও তাহলে আজ তুমি আমার হাতে বেদম মা’র খাবে বলে দিলাম
সাঞ্জের চোখটা নিমিষেই ভরে এলো মায়ের এমন রূঢভাষায়। ছেলেমানুষী মনটার জন্মদিনকে নিয়ে ঘেরা চাঞ্চল্য গুলো ধপ করে নিভে গেলো। মোহর সবে ঢুকেছিলো ঘরটাতে, সাঞ্জের বিষন্ন মুখটা দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলো না, এগিয়ে গিয়ে সাঞ্জের একটা হাত ধরে সরিয়ে বলল
– ওকে বকবেন না চাচী, ছোট তো মন খারাপ করে ফেলবে।
– মা কে আঁটকানোর কোনো দরকার নেই মোহর, ও আসলেই বেশি করে ফেলছে সবটা। এতো ঘটা করে জামা কাপড় কিনে আনলো অথচ এখন নাকি ওর একটাও পছন্দ হচ্ছে নাহ। মা ওকে বারবার করে বলেছিলো কোনটা পড়বে আগে থেকে ঠিক করে রাখতে তাও ও এখনও একই নাটক করে যাচ্ছে।
বিছানায় বসতে বসতে বলল তাথই। কাকলি বেগম প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চাইলেও মোহরকে কিছু বললেন না, তাথইয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল
– ও বাড়ি থেকে মেহমান এসেছে। তোদের দেখতে চাইছে
তাথই কোলের মেয়েকে কাকলি বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
– তোয়াকে নিয়ে তুমি যাও। আমি রেডি হয়েই নামছি একবারে।
কাকলি বেগম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। মোহর সাঞ্জের ফ্যাকাসে করে রাখা মুখটাতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নরম গলায় বলল
– দেখি এদিকে তাকাও তো,একদম মন খারাপ করবে নাহ। এসো আমার সাথে আমি জামা দেখিয়ে দিচ্ছি
বলে জামা কাপড়ের ভেতর থেকে একটা হালকা সবুজ রঙের গাউন বের করে সাঞ্জের গায়ের সাথে ধরে বলল
– বাহ এটা বেশ মানিয়েছে তো! আর তোমার তো এই কোয়ালিটির কালারের একটা স্টিলেটোও আছে।
সাঞ্জে উৎসুক মুখে জামাটা গায়ের সাথে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সিল্ক কাপড়ের সাথে পাতলা নেটের সংমিশ্রণে ভারী পাথরের কাজ করা গাউন টা গায়ের সাথে মন্দ লাগছে নাহ। বরং এখন এই জামাটাই যেনো সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো সাঞ্জের।
উচ্ছ্বসিত হয়ে জামাটা নিয়েই পড়ার জন্য দৌড় ধরলো। মোহর মৃদু হেসে তাথইয়ের দিকে তাকালো, মোহরের সাথে চোখাচোখি হতেই তাথই বলল
– তুমি কি আজও সালোয়ার ই পড়বে নাকি? শাড়িটাও তো সেদিন তিয়াসাকে দিয়ে দিলে।
– আলমারিতে অনেক জামা কাপড় অযথাই এনে রেখেছে, ওর ভেতর থেকেই একটা পড়ে নেবো ভাবছি।
বলে আর কয়েক মুহুর্ত বাদে মোহর ও বেরিয়ে এলো। ঘরের ভেতর এলেও মেহরাজের দেখা মিললো নাহ। মোহরের রাগ হলো কিঞ্চিৎ আজ দেখি লোকটা বন্ধু পেয়ে তাকেই ভুলে গেলো? সেই যে সকাল থেকে দুজন গল্প করছে, মাঝে শুধু একবার দেখা হয়েছিলো। মোহর নিজেও অবশ্য আজ ঘরে খুব একটা আসেনি।
ঘরে ঢুকে সোজা কাবার্ডের দিকে গেলো মোহর, কাঠের ভারী দ্বার-টা টান দিয়ে খুলতেই সুসজ্জিত ভাবে ভাঁজ করে রাখা জামাগুলোর সামনেই একটা টকটকে রঙের শপিং ব্যাগি দেখতে পেলো। সকৌতুক দৃষ্টিতে চেয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভেতরে হাত দিয়ে বের করে আনলো আগ্রহ ভরা জিনিসটা।
কিছুক্ষণ এক ধীমে চেয়ে রইলো পাতলা জরজেটের উপরে ছোট চকচকে পাথর বসানো বেরী ব্লু রঙের একটা শাড়ির দিকে। বিমুগ্ধ হয়ে মোহর শাড়িটার ভাঁজ খুলতেই ভেতর থেকে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো খপ করে মৃদু শব্দ তুলে মেঝেতে পড়লে উৎসুক চাহনিটা সেদিকে অগ্রসর হলেই অবিলম্বে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো। হাতের মুঠোয় দু’হাতের আঙ্গুলে নীলচে কাগজ টার চারটি ভাঁজ খুললে সেখানে জেল কালিতে লেখা গোটা গোটা শব্দের লেখাটি বিড়বিড়িয়ে পড়লো মোহর
-‘ বিবিজানের জন্য জানটুকু যত্নে রেখে দিয়েছি, আপাতত শাড়িটি পড়ে আমার অস্থির চোখ দুটোকে একটু শান্তি দিলে কৃতজ্ঞ হই ‘
না চাইতেও পাতলা ঠোঁট দুটো বেঁকে গেলো। স্মিত হাসিটার প্রসারণ উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকলো। একসময় কিঞ্চিৎ শব্দ বেড়িয়ে এলো ওষ্ঠভাঁজ থেকে। ফিক করে হেসে দিয়ে মোহর শাড়িটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
.
রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে মনোযোগচ্যুত হলো মেহরাজের, তবুও সেটা অগ্রাহ্য করে ব্লুটুথ ডিভাইসটার উপরে আঙ্গুল চেপে ব্যস্ত গলায় বলল
– হ্যালো? অভি? শুনতে পাচ্ছো?
ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তরের শব্দটা এবারও কানে পৌঁছাতে পারলো নাহ মেহরাজের৷ প্রথমত গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে নেটওয়ার্ক নামক অদৃশ্য বস্তুটার ব্যাগড়া দেওয়াটাতে মেজাজ টা উচ্চমাত্রায় চটে আছে, তার উপর রিনিঝিনি শব্দটার ঝুমঝুম কলধ্বনি একটু বেশিই কানে বিঁধছে। বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করলো।
চড়া মেজাজে অপরপক্ষের বাক্যটুকু সম্পূর্ণ করার সুযোগ টাও অগ্রাহ্য করে পাওয়ার বাটন টার উপরে কিঞ্চিৎ ক্রোধ ঝেরে লাইনচ্যুত করলো। শব্দের উৎসটাকে উদ্দেশ্য করে ঘরের ভেতর ঢুকলো দ্রুত পায়ে।
ঠিক যতটা বিরক্তি আর ত্রস্ততা নিয়ে প্রবেশ করেছিলো ঠিক ততটা ঝটকা লেগেই থমকে গেলো। কত হবে ঠিক? শরীর জুড়ে যেনো ৪৪০ ভোল্টেজের শক-টা ঝিম ধরিয়ে দিলো।
লম্বা আঁচল টা বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। জানালার কাঁচের পারদের ফাঁক দিয়ে চিকন ফাল হয়ে আসা বাতাসটা দমকা হাওয়া হয়ে এলোমেলো করে দিলো যতটা না এলোকেশ গুলো, তার চেয়ে দ্বিগুণ স্বয়ং মেহরাজকে। নে’শাক্তের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে এগিয়ে যায় মেহরাজ সামনের দিকে, অটোমেটিক স্লাইডিং ডোরটা হুট করেই বন্ধ হয়ে যায়, পিঠ থেকে চুলগুলো সরে ব্লাউজ আর পেটিকোটের মধ্যবর্তী অঞ্চল টার মেদুর প্রলেপ ভ্রম ধরিয়ে দিলো মেহরাজের চোখে। পিঠের ব্লাউজের ফিতাটা হাট করে খোলা, সেই ফাঁকে উন্মুক্ত অর্ধেকাংশ উন্মত্ত করে দিলো সম্পূর্ণ মেহরাজকে। এই মানুষটার রূপে কতবার,ঠিক কতবার থমকে যায় মেহরাজ হিসেব নেই,প্রতিবারই যেনো প্রথমবার লাগে। রোমন্থন পায়ে এগিয়ে আসলো মেহরাজ।
মুখের উপর উঁপচে পড়া চুলগুলো দারুণ বিরক্তির সহিত পেছনে ঠেলে দিলো মোহর। হাতভর্তি কালো আর নীল রঙের রেশমি চিকচিক করা চুড়ি গুলো, গুচ্ছ গুচ্ছ করে কালচে নীলের মিশেলে ধারাবাহিক ভাবে সাজানোর প্রয়াসে মত্ত রমণীর নূন্যতম ধারণাও নেই তার এই অতি সাধারণ অথচ অসাধারণ রূপে কারো চামড়ায় আবৃত নরম হৃদযন্ত্রটা পু’ড়তে শুরু করেছে। লম্বা পায়ের ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে এলো মেহরাজ, অনড় চোখ দুটি স্থির রেখেই হাঁটু ভাঁজ করে ধপ করে বসলো ফ্লোরের উপর। ব্যস্ত মুখাবয়ব টার নিমিষেই বিরক্তি পালটে একরাশ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হলো মোহরের। চঞ্চল চোখের বিস্মিত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে ধূসর চোখ দুটি সবিনয়ে স্থির রইলো একটা চেহারা পানেই। হাত থেকে চুড়ি গুলো নিজের এক হাতের মুঠোতে আগলে নিলো, আরেক হাতটা সযত্নে দখল করে নিলো চিকন হাতটার কবজি। এক এক করে চুড়িগুলো পরিয়ে দিতে লাগলো হাত দুটো ভরে। মোহর তখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে অতিমাত্রায় সুপুরুষের সংবদ্ধ নজরে, অস্ফুটস্বরে বলল
– আ আপনি
তার আগেই লম্বা আঙ্গুলটার চাপ পড়লো পাতলা ঠোঁটে। হাঁটু মুড়ে বসে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়ালো, ঠোঁট থেকে আঙ্গুল নামিয়ে দুবাহুতে এসে থামলো দুহাতের থাবা, কিঞ্চিৎ গাঢ় করলো স্পর্শ।চিকন শরীরটাকে নিজের আরও নিকটে টেনে আনলো, মোহরের কম্পমান ঠোঁট, ব্যকুলতা। ভয়ে আড়ষ্ট চাহনি সবটাকে অগ্রাহ্য করে ঠিক সেদিনের মতো ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত গলিয়ে দিলো পিঠের দিকে, দুটো শরীর একেবারে কাছাকাছি সরে এলো।
ঘাড়ের দুপাশের শক্ত বেড়িবাঁধ টা পেঁচিয়ে ধরলো দারুণভাবে। পিঠের দিকে মেহরাজের শীতল হাতের বিচরণ টা ক্রমেই অস্থির, অসহ্য করে ফেললো মোহরকে, ব্লাউজের ফিতা দুটোয় টান পড়তেই মোহর চোখ খিঁচিয়ে নিলো, বুক ভরে নেওয়া শ্বাসবায়ুটায় উচ্চ তরঙ্গ খেলে আঁটকে গেলো।
মেহরাজ ঘাড়টা ঝুকিয়ে এনে কপালে কপাল ঠেকালো, ব্লাউজের ফিতাটা লাগিয়ে দিলেও বেশ রয়েসয়ে হাতটা সরালো মোহরের ঘাড় থেকে, কপালে জড়ো হওয়া একগুচ্ছ চুল তর্জনীতে ঠেলে কানের পেছনে গুঁজে দিলো। হীম অনিলে সিক্ত হলো মোহরের সমস্ত বদন, ঘাড়টা আরও ইঞ্চিখানেক নামিয়ে আনলো মেহরাজ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শটা প্রচণ্ড অস্থির করে মোহরের পাতলা আবরণী গালটা ছুঁয়ে গেলো। তপ্ত শ্বাসটুকু বেসামাল ভাবে ফেলে মুখ তুলে নিলো নিবিড় কণ্ঠে বলল
– মোহ?
– জ্ জ্বী
রয়েসয়ে কাঁপা কাঁপা উত্তর মোহরের। অবিলম্বেই মেহরাজ একই কণ্ঠে বললো
– এই যে আপনার আপনিময় মোহে, আর আর অতল মায়ার মিশ্রণের ‘মোহমায়ায়’ ডুবিয়ে মারছেন এর শাস্তিটা কতখানি ভাবতে পারছেন?
সারা পিঠ জুড়ে মেহরাজের প্রশস্ত হাতের বিচরণ, আরেকটা হাত কোমর ঝাপটে ধরে। মোহরের অস্থির, কম্পমান কণ্ঠের উত্তর টাকে ছিনিয়ে মেহরাজ নিজেই বলল
– এতো সুন্দর কেনো লাগছেন মোহ? এখন যে এভাবে বাইরে যাবেন ভীড়ের সিংহভাগের দৃষ্টি আপনাকে কেন্দ্র করেই অচল রইবে, আমার কেমন লাগবে বলুন তো? আপনাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই কেনো বিবিজান?
মেহরাজের অনুভূতি, অনুরক্তি জড়ানো কণ্ঠস্বরটা ক্রমেই অসাড় করে ফেলছে নির্জীব একটা দেহ। অপরপক্ষের অস্থিরতার পারদটাকে একটা মাত্রায় স্থির রেখেই সরে এলো মেহরাজ। পুনরায় স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে ফিরে ভ্রু কুচকে বলল
– আপনি এতো খাটো কেনো মোহ, ঘাড়টা তো ব্যথা হয়ে গেছে আমার?
ঘাড়ের পেছনে হাত বুলাতে বুলাতে সরে গেলো মেহরাজ। বিছানা থেকে ব্লেজার টা তুলে গায়ে জড়ালো। মোহর ভীষণ অসন্তুষ্ট একটা রূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে আছে, নিজেকেই এখন পাগল মনে হচ্ছে ওর। পাঁচ ফিট্ পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা সমান একটা মেয়েকেও খাটো মনে হয় এই লোকটার?
তবে প্রত্যুত্তর করলো নাহ। মুখ বাকিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আঁচলটা ঠিক করতে লাগলো, মেহরাজ মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেও থমকে গেলো, পকেটে হাত দুটো গুঁজেই দেহটা বাঁকিয়ে বলল
– মোহ?
সেই একই ভ্রম ধরানো কণ্ঠে মোহর ফিরে তাকালো বিজড়িত নেত্রে, মুখে ঝুলানো রহস্যময়ী হাসি, চোখ দু’টোর নজর অনড়, স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছতার প্রগাঢ় ছাপ কণ্ঠে ফেলে মেহরাজ বলল
– স্যেনি সেভ্যিও’রুম
কথাটার অর্থ মোহরের মস্তিষ্ক ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো। কিন্তু বিনিময়ে প্রশ্ন করার সুযোগ টা পেলো নাহ। তার আগেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করেছে মেহরাজ।
__________________________
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা, আব্রাহাম ম্যানসনের সামনের ইয়ার্ডে লোকসমাগমে পরিপূর্ণ। ব্যবসায়ীক, পারিবারিক, বন্ধুবান্ধবদের আসড়ে অন্যরকম চাকচিক্য আর জৌলুশময় পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগেই কেক কেটে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছে। আপাতত সকলের আপ্যায়ন, সমাদরে ব্যস্ত মানুষের ভীড় থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো তাথই।
তোয়াটা ভীষণ কান্না শুরু করেছে, সেই বিকেলের পর থেকে বাচ্চাটাকে কিচ্ছু খাওয়ানো হয়নি, বুকের সাথে চেপে দ্রুত পায়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো তাথই। তোয়াকে বিছানায় শুইয়ে ফ্ল্যাক্স থেকে গরম দুধ ঢেলে ঠান্ডা করে ফিডারভর্তি করে মুখে ধরতেই চুকচুক শব্দ করে ক্ষুধার্ত শরীর টা চুষে নিলো সবটা। মিনিট খানেকের মধ্যে দুধ সম্পূর্ণ শেষ করে হাফিয়ে উঠলো নরম শরীরটা।
অবিলম্বেই তলিয়ে গেলো ঘুমে, তাথই বিছানায় তোয়াকে শুইয়ে দিলো। মানুষ জনের ভীড়ে আবারও ফিরতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না, দুকদম এগিয়ে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালো, লোকসমাগমের ভীড়৷ হরেক রকমের লাইটিং সহ আরও নানান চাকচিক্যতায় সাজানো পরিবেশ টায় চোখ বোলানো অবস্থায় পেছন থেকে দুটো হাত চেপে ধরলো তাথইয়ের কোমর, ঘাড়ের পাশ থেকে চুল সরিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দিলো। দীর্ঘ সময় পরে মুখ তুলে বলল
– একা একা কি করছো?
তাথইয়ের কোনো অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা গেলো নাহ। ঠাঁই দাঁড়িয়ে পাথরমূর্তির ন্যায়। যান্ত্রিক গলায় উত্তর করলো
– তোয়া কাঁদছিলো তাই ওকে খাওয়াতে এসেছিলাম। এখন যাবো
বলে পেছনে ঘুরে সরে এগোতে নিলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো অরুণ। দুহাতে তাথইকে ঝাপটে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে ওর গালে হাত দিয়ে বলল
– কোথায় যাবে? এখানেই থাকো। কতদিন কাছে পাইনা তোমাকে
বলে পরপর দুটো চুমু দিলো তাথইয়ের গালে। বিরক্তিতে গা গুলিয়ে এলো ওর। দুইহাত দিয়ে সরাতে গেলেও পারলো না, রুক্ষ গলায় বলল
– অরুণ বাড়িভর্তি লোকজন। নিচে ওরা হয়তো খুঁজছে, ছাড়ো আমায়
– কেও খুজছে না, চুপ করো তো
বলে শাড়ির ভাজে তাথইয়ের উন্মুক্ত পেটে হাত গলিয়ে দিলো অরুণ। ওকে বাঁধা দেওয়ার বারংবার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এক পর্যায়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অরুণকে, চেঁচিয়ে বলল
– ছাড়তে বলছিলাম নাহ? এসেই আর ধৈর্য হচ্ছিলো নাহ? আমি নিষেধ করছিলাম তো
মুহুর্তেই অরুণের ফর্সা মুখটা ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো, ক্ষেপাটের ন্যায় তেড়ে এসে তাথইয়ের গাল চেপে ধরে বলল
– কিসের এতো দেমাগ হ্যাঁ? বিয়ে করা বউ তুমি আমার। আমি ধরতে গেলেই কিসের এতো ফোস্কা পড়ে যাই তোমার, আমি কাছে আসলেই যতো গাঁইগুঁই শুরু হয় তাই না, নাকি অন্য নাগর ধরেছো যে আমায় আর মনে ধরেনা
তাথই এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো নাহ, কোনো কিছু না ভেবেই ঠাস করে থা’প্পর বসিয়ে দিলো অরুণের গালে। রাগটা যেনো এবার মাথায় চড়ে গেলো, তাথইয়ের চুলের মু’ঠি ধরে টে’নে এনে বিছানায় এক ধাক্কায় ফেললো অরুণ।
নিচে ভিড়ভাড়ের মধ্যে থেকে সরে এসেছিলো ফোনে কথা বলতে, চাপা একটা আর্তনাদ শুনেই সজাগ মস্তিষ্কে চারপাশে চোখ বুলালো। পরপর দুবার চিৎকার টা কানে আসতেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। আরেকটু এগিয়ে আসতে প্রথম ঘরটার সামনে এসেই থমকে গেলো পা দুটো।
অরুণ তাথইকে বিছানাতে ফেলেই প্রচণ্ড রাগে অগ্নি হয়ে দরজার দিকে এসে লাগাতে গেলেই কিসে একটা বাঁধা পড়লো, বার দুয়েক ধাক্কা দিয়েও লাগাতে না পারলে দরজাটা পুরোপুরি খুললেই একটা চেহারা স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
– কে আপনি?
– পৃথক ইয়াসির
.
.
.
চলমান
#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৫
#হুমাইরা_হাসান
– কোথায় ছিলেন খুঁজছি আপনাকে?
পেছন থেকে আসা অকস্মাৎ কথাটি কর্ণগোচর হলে হকচকিয়ে তাকালো মোহর। ওর অপ্রস্তুত চেহারাতে চেয়ে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে মেহরাজ বলল
– কি হয়েছে মোহ? কোনো সমস্যা?
মোহর ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না বলল। মেহরাজ ঘাড় ঝুকিয়ে মোহরের মুখ বরাবর মুখ এনে স্নেহভরা গলাতে বলল
– অস্বস্তি হচ্ছে মোহ?
মোহর অসহায় চোখে তাকালো মেহরাজের চোখে, এতসব লোকের ভিড়ে ওর যে সত্যিই কেমন অস্বস্তি আর জড়তা কাজ করছে এটা মুখ ফুটে কি করে বলতো ও। মেহরাজ দূর দুরান্তর হতে আসা মেহমানদের স্বাগতম জানানোর দ্বায়িত্ব পালন করছিলো, তাই আর মোহর এগিয়ে যায়নি। এক কোণায় এসে দাঁড়িয়েছিল মুহূর্ত খানেক আগেই। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হচ্ছে এই শাড়িটা সামলাতে, তার সাথে স্টিলেটো। তাছাড়া অন্য কোনো পায়ের জোড়া মানাচ্ছিলো ও না শাড়ির সাথে। এখন বুঝতে পারছে এটা পড়া টা কতো ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিলো।
– কি হয়েছে মোহ? আমাকে বলুন
– কিছু হয়নি, আসলে এতো অপরিচিতের ভিড়ে একটু আনইজি লাগছিলো
স্টিলেটোর কথাটা খুব সাবধানে এড়িয়ে অন্যটা দিয়ে বুঝ দিলো মোহর। মেহরাজ খানিক এক ধীমে চেয়ে মৃদু হাসলো, মোহরের আঙ্গুলের মাঝে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে চেপে ধরে বলল
– সব-ই তো আপনার। বরং আপনিই সবার অপরিচিত। আসুন
বলে মোহরের হাতটা ধরে এগিয়ে এলো। ঝকমকে ডেকোরেশন করে ফুল দিয়ে সাজানো জায়গাটিতে, সাঞ্জে মোহরকে দেখে উৎসুক মুখে বলল
– ভাবী তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আপিটাও তো নেই এখানে। আমার একা একা একদম ভাল্লাগছে না।
মোহর এগিয়ে গিয়ে সাঞ্জের পাশে দাঁড়ালে হুট করে অভিমন্যু এসে মেহরাজের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললে মেহরাজ মোহরকে উদ্দেশ্য করে বলল
– তোমরা এখানে বসো, আমি আসছি
মেহরাজ যেতেই সাঞ্জে মোহরের হাত ধরে ওকে বসিয়ে বলল
– এই ভাবী, তাথই আপি কোথায় গেলো গো? এখানেই তো ছিলো
– আমিও তো দেখিনি? এই আশেপাশেই আছে হয়তো
সাঞ্জে মুখটা মলিন করে বলল
– ভালোই তো ছিলো। অরুণ ভাইয়া আর উনার পরিবারের লোকজকে দেখে আবারও ওমন মুখটা চুপসে নিলো।
মোহর উৎসুক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। কিন্তু তাথই কে কোথাও দেখতে পেলো না। জিজ্ঞাংসুক গলায় বলল
– আচ্ছা অরুণ ভাইয়া কোথায়? উনাকে আমি একবার ও দেখিনি?
– ওমা দুলাভাই কে তুমি আজও দেখোনি?
মোহর ঠোঁট উলটে ডানে বামে মাথা নাড়ালো। সাঞ্জে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল
– এদিকেই তো ছিলো। আচ্ছা এবার আসুক, তোমার সাথে উনার দেখা করিয়েই ছাড়বো। বড়ো ভাবী হয়ে কি না তুমি ননদের বরকেই দেখোনি আজও
মোহর মৃদু হেসে কিছু বলবে তার আগে একটা সাঞ্জে উৎফুল্লচিত্তে বলল
– এই মিউজিজ অন করেছে আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে গো,চলো না ভাবী তুমি আর আমি নাচবো
বলে মোহরের হাতটা ধরলে মোহর চোখ পাকিয়ে বলে
– পাগল নাকি, আশেপাশে কতো লোকজন দেখেছো? এত বড়ো মেয়ে হয়ে এভাবে নাচতে দেখলে লোকে কি ভাববে বলো তো!
সাঞ্জে কিছু মুহূর্ত চুপসানো মুখে থাকলেও পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে বলল
– আচ্ছা ভাবী একটা প্রশ্ন করবো তোমাকে?
মোহর আগ্রহী নজরে তাকালে সাঞ্জে বেখেয়ালি গলায় বলল
– ভাবী তোমার ওই স্যারটার কথা মনে আছে? কি যেনো নাম,ওই যে আমার সাথে ধাক্কা লেগেছিলো?
– ফায়াজ স্যার?
– হ্যাঁ হ্যাঁ সেই। ওই ফায়াজ স্যারকে আমার খুব চেনা চেনা লাগে জানো তো। আমি কোথায় যে দেখেছি উনাকে মনে করতে পারছি না
মোহর ভ্রু কুটি করে সকৌতুকে বলল
– দেখেছো? কোথায় আবার দেখবে, হয়তো রাস্তায় বা অন্য কোথাও দেখেছো
– না না ভাবী। দেখেছি বলতে আমি মনে হয় উনাকে চিনি বুঝছো? আমাদের রিলেটিভসদের সাথে মেবি উনার লিংক আছে
মোহর বেশ অবাক হলো। ফায়াজ স্যারের সাথে সাঞ্জেদের কেমন আত্মীয়তা থাকতে পারে? ফায়াজ তো মেহরাজ কে চেনে না অব্দি। খানিক নিঃশব্দে ভেবে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি একটা হাত ওর সামনে কেও বাড়িয়ে ধরলো, হাতের মালিককে উদ্দেশ্য করে তাকালে হাস্যজ্বল চেহারাটি সাগ্রহে বলল
– উইল ইউ বি মাই ডান্স পার্টনার?
মোহর অনেকটা তাজ্জব বনে যাওয়ার ন্যায় হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, নোমান এখনো হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে মোহরের দিকে, মোহর ইতস্তত হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই আরেকটা হাত মোহরের দিকে এগিয়ে এলো। কোনো প্রকার অনুমতির অপেক্ষা হীনায় মোহরের হাতটা ধরে দাঁড় করিয়ে বলল
– বিবিকে নিয়ে আমি আবার অনেক পজেসিভ জানিস তো নোমান, আমার বিবিকে অন্য কেও ছুঁয়ে দিলে আমার সহ্য হবেনা। তুই বরং অন্যদিকে তাকা।
বলে মোহরের হাতটা ধরে অন্যদিকে হাঁটা দিলো। নোমান মেহরাজ আর মোহরের প্রস্থানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় সাঞ্জে নরম গলাতে বলল
– ভাইয়া চলো না তুমি আর আমি নাচি।
নোমান ভ্রু জড়ো করে তাকালো সাঞ্জের উৎসুক চেহারাটার দিকে। মুচকি হেসে বলল
– তাই,নাচবি বলছিস?
সাঞ্জে ঘনঘন মাথা দুলালো। নোমান হাত এগিয়ে দিলে ও উচ্ছ্বসিত হয়ে ঝাপটে ধরলো দুহাতে।
.
– আপনি ওভাবে টেনে আনলেন কেনো?
– টেনে কোথায় আনলাম। আমিতো আদর করেই হাতটা ধরে আনলাম।
মেহরাজের হেয়ালিপনা উত্তরে মোহর চোখ ছোট করে তাকালো। বলার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই পা টা বেঁকে মচকে গেলেই আঃ করে ছোট আর্তনাদ করে উঠলো।
– কি হলো, কোথায় ব্যথা পেলেন?
– নাহ ব্যথা পাইনি
কাচুমাচু মুখ করে মোহর বললেও মেহরাজের বিশ্বাস হলো না, ঝুকে এসে এক হাতে গোড়ালির দিক থেকে মোহরের শাড়িতা কিঞ্চিৎ উঁচু করে তাকালো। ঘাড় তুলে ভীষণ অসন্তুষ্ট চোখে মোহরবে দিকে চেয়ে বলল
– আপনি আবারও এই উঁচু জুতা পড়েছেন?
মোহর মুখটা ছোট করে নিলো। থুতনিটা চিবুকে গিয়ে ঠেকলে মেহরাজ এক হাতে কপাল চুলকে বলল
– এসব পড়তে কে বলেছিলো আপনাকে,এসব তো ছোট খাটো মানুষের জন্য
– আপনিই তো বললেন আমি নাকি খাটো
কথাটা বেশ তেজ দিয়েই বলল মোহর। পরমুহূর্তে নিজের কণ্ঠের উঁচুখাদ টা উপলব্ধি করে মিইয়ে গেলো। মেহরাজ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে বলল
– তাহলে আপনি আমার সমান বড়ো হওয়ার জন্যে স্টিলেটো পড়েছিলেন?
মোহর প্রচণ্ড জড়তা, আর আড়ষ্টতা নিয়ে মাথা উঁচু নিচু করলো। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসছে ওর, ঠিক এভাবে অপ্রস্ততকর পরিস্থিতিতে পড়বে বুঝতেও পারেনি, মেহরাজ নিঃশব্দে হাসলো, যে হাসির শব্দ না হলেও আভাস টুকু ঠিকই নতজানু করে রাখা মেয়েটার অন্তরস্থলে পৌঁছে গেছে।
মেহরাজ মোহরের লজ্জা রাঙা মুখটা বেশ সময় নিয়ে দেখলো, ওরা দাঁড়িয়ে আছে ইয়ার্ডের এক কোণার দিকে, এদিকে লোকজন একেবারেই কম। মেহরাজের একবার ইচ্ছে করলো বিবিজানের লজ্জাটা আরেকটু বাড়িয়ে টসটসে গাল দুটোতে বার কয়েক ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু আপাতত নিজের বেকাবু ইচ্ছেটাকে দমিয়ে বলল
– আমার সমান হতে হলে এই স্টিলেটো পড়ে কিছুই হবে না, এর জন্য অন্য পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করতে হবে বিবিজান।
মোহর মুখ তুলে অবুঝ নেত্রে তাকালো। বোকা বোকা মুখ করে বলল
– অন্য কি পদ্ধতি।
মেহরাজ এগিয়ে এসে বলল
– বলবো। তবে এখন নাহ। আগে এইটা খুলুন তো,এটা পড়ে থাকলে আবারও চামড়া ছড়ে যাবে।
– আচ্ছা আমি তাহলে এটা চেঞ্জ করে আসি, তারপর কিন্তু পদ্ধতিটার কথা আমাকে বলতেই হবে।
মোহরের শিশুসুলভ আবদার আর আগ্রহে চোখের কোণা কুচকে এলো মেহরাজের। চাপা হাসিটা বহমান রেখেই বলল
– আচ্ছা বলবো। চলুন এটা পালটাবেন
মোহর আগাতে নিলেও মেহরাজের কথা শুনে পা বাড়ালো নাহ। চোখ ছোট করে রাগী রাগী কণ্ঠে বলল
– আপনি কোথায় যাবেন। আপনার সাথে আমি কোত্থাও যাবো না
মোহরের এমন উচ্চবাক্য আর জেদি আচরণে মেহরাজ বেশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিব্রত স্বরে বলল
– কেনো কি হয়েছে?
– কি আবার হবে, আপনি আমাকে একটা কিচ্ছু করতে দেন না, সবকিছু ভুলিয়ে আলাভোলা বানিয়ে রাখতে চান, সব কিছুই আপনাকে করে দিতে হবে কেনো বলুন। আমি কি কিছুই পারি না? অবশ্যই পারি, আপনি খবরদার আমার কোনো কাজ করতে আসবেন নাহ,সরুন।
বলেই গজগজ করে প্রস্থান করলো। মেহরাজ ওর যাওয়ার পানে নিষ্পলক চেয়ে থেকে নিজের আনজানেই হেসে ফেললো। মেয়েটা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি! হুট করে একটা মোলায়েম অনুভূতির পাখা আগলে ছুঁয়ে দিলো মেহরাজের বুকটা। ওকে দেখে জড়তা, আড়ষ্টতায় সিটিয়ে থাকা মেয়েটাও এখন খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে, পরিস্থিতির চাপে হারিয়ে যাওয়া চাঞ্চল্যেতা যখন আবার ফিরে আসে তার চেয়ে অমায়িক দৃশ্যটি মনে হয় না দুটি হবে।
_____________________
– এভাবে হুট করেই কারো ঘরের সামনে এসে দাঁড়ানো কোন ধরনের ভদ্রতা?
– এখানে ভদ্রলোকের মতো কোনো আচরণ হচ্ছে বলে তো মনেও হচ্ছে নাহ
বলেই এক পলক আড়চোখে তাকালো তাথইয়ের আতঙ্কিত চেহারাটার দিকে। ঘামে,চোখের পানিতে জবজবে মুখটা দেখে বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো পৃথকের। এতগুলো বছর পর সেই প্রিয় চেহারাটার এরূপ অবস্থা একেবারে বুক চিরে আঘাত করলো পৃথকের। সমস্ত রাগ, ক্রোধ মিশিয়ে তাকালো সামনের ছেলেটার দিকে।
– কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? কে আপনি? আগে তী দেখিনি এই বাড়িতে
– দেখার প্রশ্নও আসেনা, কারণ এ বাড়িতে আমি যখন ছিলাম তখন আপনার ছায়া টাও চিনতো না এই বাড়িকে
তুঙ্গে ওঠা মেজাজ টা আরও তরতর করে বেড়ে গেলো অরুণের৷ বেশ চড়াও গলায় বলল
– আপনি কে কি এসব জানার দরকার নেই। এখান থেকে যান তো
– আপনি ওর সাথে জোরজ’বরদস্তি করছেন কোন সাহসে
পৃথক বেশ উচ্চস্বরে বললো অরুণের দিকে তাকিয়ে। তাথই অজানা আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে উঠে এলো বিছানা থেকে। পরনের শাড়িটা ঠিক করে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল
– আপনি এখানে কেনো এসেছেন? এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যপার, ব্যক্তিগত ঘর। এখানে বাইরের মানুষের আশাটা শোভা পায়না একেবারেই।
– আশু এই লোকটা তোমার সাথে জোর জব’রদস্তি করছিলো। আর তুমি আমাকেই…
অর্ধেক কথায়ই থামিয়ে দিলো তাথই, এক হাত উঁচিয়ে বলল
– আপনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান প্লিজ। আমাদের পারসোনাল ইস্যুতে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে নাহ
পৃথক ভঙ্গুর, ব্যথাতুর নজরে তাকালো তাথইয়ের দিকে। বুকের ভেতর ঠিক কতটা আঘাত লাগলো কি করে বোঝাবে ও। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরুণের তিক্ত কথা গুলো কানে বিঁধলো
– আশু মানে? এই ছেলে আশু কেনো বলছে তোমাকে? একে চেনো আগে থেকে? কে হয়! ওর সাথে কিসের পিরিত তোমার
বিশ্রিরকম পরিবেশে অরুণের এহেন বাজে উক্তিটা মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো যেনো, নিজেকে সংযত রাখার অদম্য চেষ্টায় তাথই বলল
– ভুলভাল বকবেনল না। আর বাজে কোনো কথা না জেনেই আমাকে ভুলেও বলবে না
– কি করবে হ্যাঁ? এই জন্যেই আমাকে সহ্য হয়না তাই তো? এই জন্যেই আমি ধরলে ফোস্কা পড়ে যাই তোর?
অরুণের এরূপ আচরণ যেনো এবার পৃথকের সকল ধৈর্যের বাধ ভেঙে দিলো। সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাধ ভেঙে ছুটে গিয়ে অরুণের কলার চেপে ধরলো। চেঁচিয়ে বলল
– নিজের বউকে সম্মান করতে পারিস না? এই রকম আচরণ তো অমানু’ষেও করবে নাহ শা**
.
পায়ে অসহ্য ধরানো বস্তু টা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটছে মোহর। পথিমধ্যেই তাথইয়ের আর্তনাদ মিশ্রিত চিৎকার কানে আসতেই থমকে গেলো পা দুটো। কৌতুহল বশত দুই পা এগিয়ে করিডোরের ভেতরের দিকের ঘরটার দরজার ফাঁকে উঁকি দিলে সামনের দৃশ্যে চোখ দুটি স্থির হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত সময় নিতে পারলো না, হাতের বস্তু জোড়া ছিটকে পড়ে গেলো, দরজাটা পুরোপুরি খুলে ছুটে গেলো ভেতরে।
অরুণ আর পৃথকের এক প্রকার ধস্তা’ধস্তি শুরু হয়েছে। দুজনের হাতের মুঠোয় নিজেদের শার্টের কলার চেপে একে অপরকে আ’ঘাত করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তাথইয়ের দুজনকে ছাড়ানোর ব্যাপক প্রচেষ্টা করলেও দুটো পুরুষালি শক্তির সাথে কোনো ক্রমেই পেরে উঠলো না।
মোহরকে দেখেই ঘন অন্ধকারে এক চিমটে প্রদীপের ন্যায় আশা নিয়ে ছুটে এলো। অস্থির হয়ে বলল
– মোহর ওদেরকে থামাও, আমার কোনো কথা শুনছে না। কেও দেখলে সর্বনাশ হবে মোহর ওদেরকে আঁটকাও
মোহর এক ছুটে এগিয়ে গিয়ে পৃথকের কাঁধে হাত চেপে বলল
– ভাইয়া, উনাকে ছেড়ে দিন। কি করছেন ছাড়ুন ভাইয়া
পৃথক শুনলো না বরং কে ধাক্কায় অরুণ কে ফেলে দিয়ে বলল
– এইটাকে আমি মে’রেই ফেলবো। ওর ভাষা শুনেছো। শা’লা রাস’কেল বউয়ের সাথে জব’রদস্তি করে
বলে আবারও অরুণের উপরে ঝাপিয়ে পড়তে নিলে মোহর পেছন থেকে হাতটা দুহাতে চেপে ধরে অস্থির গলায় বলল
– ভাইয়া অনুরোধ করি আপনাকে। উনাকে ছেড়ে দিন। বাড়ির কেও এ দৃশ্য দেখলে অনাচার হয়ে যাবে। মেহরাজ দেখলে কি হবে ভাবতে পারছেন?
.
.
.
চলমান