#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩১
#হুমাইরা_হাসান
ব্যস্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো মোহর। আজকে ফিরতে বেশ দেরীই হয়ে গেল, মেডিক্যালের শেষের দিকেটাতে এসে বেশ চাপ পোহাতে হচ্ছে। এই যেমন আজ ফিরতে এতটা দেরী হয়ে গেলো।
ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ঘরটার সামনে, দরজার নব মুচড়ে এক পা ফেললেও পরক্ষণেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে গেলো।
সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে হয়তোবা, পরনে শুধু কালো রঙের একটা ট্রাউজার। দেহের উপরাংশ পুরোপুরিই অনাবৃত, যাতে করে ফর্সা বুক টা চোখ ধাধানোর মতো উঁকি দিচ্ছে একদম স্পষ্টভাবে।
মোহর নবে হাত রেখেই থমকে রইলো, মেহরাজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। দর্পনের প্রতিবিম্বে ঘর্মাক্ত রূপসীর চেহারাটুকু চোখে বিঁধতেই ঘুরে দাঁড়ালো। চোখাচোখি হতেই মোহরের অপ্রস্তুত চেহারাটা অবলোকন করে খাট থেকে ডিপ ব্লু রঙের টি-শার্ট টা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো।
মোহর ধাতস্থরূপে ভেতরে এসে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলো, ঘামে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি লাগছে তাই ক্যাল ব্যয় না করে আলমারির দ্বার খুলে নিজের তোয়ালে আর জামাটা হাতের মুঠোয় ধরে পেছন ফিরলে মেহরাজকে সেই আগের অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে পেলো। বরং এবার দু’হাত পকেটে গুঁজেছে।
মোহর আড়ষ্টভাব নিয়েই এগোতে নিলেও থমকে গেলো মেহরাজের প্রশ্নে
– দেরী করলেন যে?
– আজ ক্লাসটাইমের ডিউরেশন বেশি ছিল
মাথা ঝুকিয়ে রেখেই জবাব দিলো। অদ্ভুত ভাবেই মেহরাজের দিকে তাকাতেও জড়তা, শঙ্কোচবোধ আঁকড়ে ধরছে। সেই রাত, সেই স্পর্শের কথাটা একটু বেশিই গাঢ় ভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে মেহরাজের চাহনি। মোহরের তটস্থ অবস্থাকে বাড়িয়ে দিয়ে মেহরাজ এগিয়ে এলো, ধীরে পায়ে এগিয়ে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।
মোহর পিছিয়ে নিতে গিয়েও পারলো না, পা দুটো যেন আঁটকে আছে ফ্লোরে, মেহরাজ সুস্থির তাকিয়ে মোহরের চেহারায়। ছোপ ছোপ ঘামে ভেজা নাক, কপাল, ওষ্ঠের নিচের অংশ। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, অনুজ্জ্বল চেহারা পানে অনিমেষ চেয়ে থেকেই মেহরাজ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল
– আপনি এতো সুন্দর কেনো মোহ? এতটা সুন্দর কেনো হয়েছিলেন আপনি? একটু কম সুন্দর হলেও তো পারতেন
মোহর ভাবক্রীয়াহীন অচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহরাজের দিকে। মেহরাজ ওর নির্বোধ, অবুঝ মুখটাতে চক্ষু স্থির রেখে আবারও বলল
– এই যে আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে সারাদিন নিজের সামনে বসিয়ে রাখতে, শুধু হা করে তাকিয়ে থাকতে। আপনাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা যে খুব পীড়া দিচ্ছে মোহ, এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল আপনাকে!
মেহরাজের কণ্ঠস্বর টা কেমন অধৈর্য, হতাশ শোনালো। মানুষটার তীক্ষ্ণ, দৃঢ়, অনড়তায় ভরপুর দৃষ্টিতে মোহরের গাল লজ্জায় ভারী হয়ে আসছে। এসব কি বলছে লোকটা! লজ্জা অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আসছে মোহর, এভাবে তাকিয়ে কেন আছে মেহরাজ ? সে কি বুঝছে না মোহর শরমে মিইয়ে যাচ্ছে! মেহরাজের এমন নীরব প্রখর দৃষ্টির পৃষ্ঠে সিক্ত মোহর আড়ষ্ঠ হচ্ছে ব্যকুলভাবে।
অধর জোড়া জড়ত্ব নিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে কিছু বলার জন্যে মুখ তুললেও কিছু বলার পূর্বেই মেহরাজ অধৈর্য গলায় বলে উঠলো
– আপনি আর তিন সেকেন্ড ও এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি হয়তো নিজের উপরেই নিয়ন্ত্রণ হারাবো মোহ..
মেহরাজের এরূপ বেলাজ কথাবার্তায় মোহর প্রচন্ডভাবে ভড়কে গেলো। মেহরাজকে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই এক ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিরতিহীন ভারী ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করলো। এই লোকটা এতো বেহায়া হয়ে যাচ্ছে কেনো দিনদিন! মোহর কথার বানে মে’রেই না ফেলে কোনদিন।
.
ওয়াশরুম থেকে ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে ঘরজুড়ে কৌতুহলী দৃষ্টি মেললো মোহর। মেহরাজের এবারের অনুপস্থিত টা ওকে ভীষণ স্বস্তি দিলো। মানুষটার আশেপাশে ভীড়তেও এখন কেমন লজ্জা করে মোহরের।
ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো মোহর। সেই সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছিল এখন প্রায় দুপুর। খিদেয় পেটে চোঁ-চোঁ করছে। ড্রয়িং রুমের পরিবেশ টা শান্ত, থমথমে। মোহর এগিয়ে গিয়ে খাবার বেরে বসতেই কোত্থেকে এসে হুট করেই পাশে বসে পড়লো মেহরাজ। মোহর ভূত দেখার মতো চমকে গেলেও থ মেরে তাকিয়ে রইলো খানিক। মেহরাজ সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে প্লেট টেনে নিতে নিতে বলল
– আপনি এতটা নিষ্ঠুর কি করে মোহ, আপনার স্বামীটা যে না খেয়ে বসে আছে সেটা একটা বার ও ভাবলেন না। পাষাণের মতো একাই খেতে বসে পড়ছেন।
মোহরের ভ্রু কুচকে এলো এবার, ভালো সে কি করে জানবে লোকটা না খেয়ে বসে আছে? অন্যদিন তো এতো আগেও আসেনা। কিন্তু মুখে কোনো প্রত্যুত্তর না করে মেহরাজের থালে ভাত তুলে দিতে লাগলো। নিজে পাশের চেয়ারটাতে বসে খাওয়া শুরু করলে কিছুক্ষণ পর ওমনিই মেহরাজের কান্ডে খাওয়া থামিয়ে চোখ প্রসারিত করে তাকিয়ে রইলো মেহরাজের দিকে, মেহরাজ মাছের টুকরো গুলো মোহরের প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলল
– আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন আছে মোহ, আপাতত খেয়ে নিন
মোহর আরও কিছুক্ষণ ওমন অনড় দৃষ্টি কায়েম রেখে অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। নিজের অজান্তেই চোখের কোণায় পানির মুক্তোদানা জমাট বাঁধলো। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে গেলো মোহরের। ইলিশ মাছ খুব পছন্দ হলেও কাঁটা ছাড়াতে পারেনা বলে খেতে চাইতো না মোহর, তখন আব্বা ওকে নিজের পাশে বসিয়ে একটা মাঝের পেটি নিজের প্লেটে তুলে কাটা ছাড়িয়ে একটু একটু করে মোহরের পাতে তুলে দিতো, ঠিক যেমনটা মেহরাজ এখন দিচ্ছে। নিজের মনের অজান্তেই মোহরের ভীষণ ইচ্ছে হলো হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে, পাশে বসে থাকা নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়ার মানুষটিকে ঝাপটে ধরে পরনের পোশাক টা নিজের অশ্রুতে ভিজিয়ে দিতে। না তো খুব কড়া গলায় ধমকে দিতে, শাসানির ন্যায় আঙুল তুলে বলতে
– কে আপনি হ্যাঁ? কোত্থেকে এসেছেন? আপনি কি আমাকে মানুষ মনে করেন নাকি বই? এভাবে আমার আপাদমস্তকটা পড়ে ফেলেন কি করে? কি করে না বলতেই সবটা বুঝে যান বলুন তোহ? এভাবে বুঝতে নেই যে কাওকে, এমন যত্ন করতে নেই তো..পাথর মনের মানুষ গুলোও যে প্রেমে পড়ে যায়,ভালোবেসে ফেলে।
কিন্তু বলা হলো নাহ। স্বামীর মাঝে যেনো প্রাণের বাবার প্রতিচ্ছবি টুকু আজ দেখতে পেলো মোহর। ও না বলা সত্ত্বেও কি করে মেহরাজ বুঝে গেলো তা যানে নাহ, কি করে বুঝলো কাঁটা ছাড়াতে পারে না বলেই ভাজি তুলে নিয়েছিল নিজের পাতে।
নিঃশব্দে খেয়ে নিলো গ্রাস গুলো। একটা টু শব্দ অব্দি করলো না, আর নাইবা মেহরাজ করলো।
খাওয়া শেষে সবটা গুছিয়ে উপরের ঘরের দিকে যেতে নিলে মেহরাজ পেছন থেকে ডেকে বলল
– মোহ
ঘুরে দাঁড়ালে অবিলম্বেই আবারও বলল
– সময় পেলে একটু আসবেন ঘরে
মোহর কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়ালো শুধু। তবে সেটা দেখার আগেই মেহরাজ পা বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। মোহর ও দাঁড়ালো নাহ, এগোলো সামনের ঘরটার দিকে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক টোকা দিলো দরজায়, জবাব এলো নাহ। মোহর আলতো ভাবে দরজা ঠেলে ফাঁক করলো
বিপরীত দিকে মুখ করে থাকায় চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গেলো না, কিন্তু তার পেছন টুকু দেখেই মোহর আঁচ করে নিলো,,নিস্তেজ, নিঃসাড় দৃষ্টি হয়তো দূর প্রান্তুরে। অবিন্যস্তত, চাকচিক্যহীন মুখটাও হয়তো ফ্যাকাসে হয়ে আছে।
আস্তেধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মোহর।
কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে হুট করেই ধ্যান ভেঙে যাওয়া স্বরূপ চমকিত হয়ে তাকালো তাথই, মোহরকে দেখে অপ্রস্তুতত হলেও তৎক্ষনাৎ তা সামলে নিয়ে ভীষণ সহবত সুলভ হাসি হেসে বলল
– তুমি কখন এলে, বসো
মোহর বসলো পাশটাতে। সামনেই ছোট্ট কাঠের দোলনা, তাতে ঘুমিয়ে ছোট্ট একটা নিষ্পাপ প্রাণ। মোহর সেদিকেই তাকিয়ে বলল
– অনেক দিন ই তো হলো, বাবুকে ওর বাবা দেখতে আসেনা যে?
এতক্ষণ মুখে টেনে রাখা কৃত্রিম হাসিটা ঝাড়বাতির মতো ধপ করে নিভে গেলো তাথইয়ের। তবুও সুপ্রসন্ন গলায় বলার চেষ্টা করলো
– ব্যস্ত থাকে।
– সত্যিই কি?
মোহরের কণ্ঠটা কেমন অন্যরকম শোনালো। তাথই ভ্রু কুচকে তাকালে মোহরের মুখাবয়বের পরিবর্তন হলো। বেশ সহজতর ভাব এনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল
– একা একাই ঘরে বসে থাকো কেন আপা বাইরে এসে মেশো না কেনো সবার সাথে?
– সবাই সবার মতো ব্যস্ত। আমার উগ্র মেজাজ দেখার সময় কার।
তাচ্ছিল্য হেসে বলল তাথই। মোহর অপলক চেয়ে রইলো সেই মুখটির দিকে। ওভাবেই চেয়ে বলল
– আমাকেই দেখো, হাতে গোনা দুই একজন বাদে সকলেরই চক্ষুশূল আমি। তবুও তো মিশি, সেদিক থেকে দেখলে এটা তো তোমারই পরিবার। সবাই তোমাকে ভালোবাসে।
তাথইয়ের মুখাবয়বের তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। চোয়াল শক্ত রেখেই বলল
– কিন্তু আমি বাসি না কাওকে।
– আসলেই কি বাসো না কাওকে?
ধপ করে বুজে গেলো রূঢ় স্বর, নরম হয়ে এলো শক্ত চোয়াল, নিগূঢ় ব্যক্তিত্বের ভীত টা যেন ক্রমেই নড়েচড়ে উঠলো। তাথইয়ের অপ্রসন্ন চেহারাটায় চোখ রেখে হাতটা সবিনয়ে ধরলো মোহর, তাথইয়ের ফিরে তাকানোটাকে ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে নরম গলায় বলল
– আর কতো চুপ থাকবে আপা? বদমেজাজি, রুক্ষ স্বভাবের আড়ালে আর কতো নিজের দুঃখটাকে আগলে রাখবে। একটা সময়ে কষ্টগুলোও আত্মচিৎকার দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাই, তুমি কতো চুপ থাকবে।
তাথইয়ের বিস্ফোরিত নয়নে যেন বিন্দু বিন্দু পানি জমতে দেখলো মোহর, কিন্তু থামলো না, হাতের করপুট আরও শক্ত করে বলল
– তোমার আশেপাশে এমন অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে যাকে তুমি নীরবে সহ্য করে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছো, অথচ নিজের ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে নিচ্ছো। কেন করছো এমন আপা? একটা বার কি তোমার মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে না?
তাথই খপ করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল শক্ত করে কড়া গলায় বলল
– কি যা তা বলছো তুমি? কি বলবো, কাকে বলবো!
– আমি কি বলছি তা আমার চেয়ে ভালো তুমিই বোঝো আপা। চুপ করে থেকো না, আর কতো এভাবে থাকবে আর কতো নিজের জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে?
তেলের মাঝে ছিটকে ওঠা মাছের মতো তেঁতে উঠলো তাথই। ধপ করে উঠে দাঁড়ালো, খানিক চেঁচিয়ে বলল
– কি বলবো, কাকে বলবো? কেনো বলবো? কেও নাই আমার কেও নাই যে শুনবে। এভাবেই থাকবো আমি। তোমাকে এর আগেও নিষেধ করেছি, আমার কথা কাওকে ভাবতে হবে না, তোমাকেও নাহ। বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে আর কোনোদিন ও আসবে নাহ
আঙুল তুলে মোহরকে বেরিয়ে যেতে বললেও মোহর স্থির রইলো। তাথইয়ের আকস্মিক চিৎকারে তোয়ার ঘুম ভেঙে গেছে, ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছে বাচ্চাটা। ওকে ধরলো না তাথই আর নাইবা মোহর ধরলো। বরং উঠে তাথইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– আছে আপা। সবাই আছে, তুমি শুধু একটা বার মুখ ফুটে সব বলো। আমি জানি তুমি সব বোঝো সব জানো। কিন্তু কেন সব মেনে নিচ্ছো? একবার সব মেনে নিয়ছো বলেই আজ এখানে এসে দাঁড়াতে হয়েছে, আর নিও না।
– কি বলবো আমি? কোন উছিলায় বলবো? কার জন্য? বাড়ির লোক কি করবে? বড়োজোর এখান থেকে তুলে আরেক নর্দমায় ঢেলে দেবে ঠিক এখানে যেভাবে দিয়েছিলো
বলেই আঁৎকে উঠলো, চোখ ফুরে পানি বেরিয়ে এলো। এবার আর থামালো না, আঁটকালো না চোখের পানি। শক্ত মুখ দেখিয়ে লুকিয়ে নিলো না নিজেকে, মুখে হাত রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মোহর এগিয়ে গিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাথইকে, টেনে এনে বিছানায় বসালো, দুহাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল
– আর কোত্থাও যেতে হবে না তোমাকে আপা। তুমি শুধু একবার মুখিয়ে দাঁড়াও, আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে। সবার মিথ্যে মুখোশ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো। তুমি আর এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না।
তাথই কিছুই বলল নাহ। নির্জীব বস্তুর ন্যায় মোহরের কাঁধে মাথা ফেলে পড়ে রইলো। মোহরের কথা গুলো বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজতে থাকলো, আর চোখের সামনে একটা চেহারাই বারবার ভেসে উঠতে লাগলো যাকে শতবার, হাজারবার ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি। আজ অব্দি ভুলিয়ে দিতে পারেনি।
___________________________
একেবারে গোসল করেই বেরোলো মোহর। আজ কেমন বিদঘুটে গরম পড়েছে। শরতের শেষে এসেও এমন অসহ্য গরমের হেতু বোঝে না মোহর। একটু হাঁটাচলা করেই শরীর ঘেমে ভিজে উঠেছিল, ঘামে অসহ্য হয়ে এই মাঝ রাতেও গোসল করে এলো।
মেহরাজ বিছানাতে আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছিলো। এক পায় আরেক পায়ের উপর তুলে বিরামহীন নাচাচ্ছে। মোহর চোখ সরিয়ে নিলো।লোকটার সমস্ত কিছুই যেনো খুব করে আকর্ষিত করতে চাই। বারান্দার পর্দাটা উড়ছে, সারাদিন গরমে দগ্ধ করে এখন হয়তো প্রকৃতি তার ধরণীকে ভেজানোর প্রয়াসে মত্ত। থেকে থেকে আকাশে চমকে ওঠা সরু আলোর বাঁক সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
– ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এদিকে আসুন।
মোহর হাতের ভেজা বস্তু টা একপাশে রেখে বিছানাতে এক কোণায় গিয়ে বসলো। ফ্লোরে রাখা পায়ের এক পাতার উপরে আরেকটা পায়ের তলদেশ চেপে ধরলো। অস্বস্তি সামলাতে এই ব্যর্থ প্রয়াসটুকুও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো মেহরাজের জড়তাহীন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বেহায়া নজর
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? কি করেছি আমি
মেহরাজের বাঁকানো ভ্রুর ভাঁজ কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো, তীক্ষ্ণ চাহনি বহমাম রেখেই অকপটে বলল
– আপনি আর কি করবেন। আমি যে একটু শান্তিমতো তাকিয়ে দেখবো সেটুকুতেও তো হাজারো প্রশ্ন।
– কেনো দেখবেন
খানিক গাল ফুলিয়েই বলল মোহর। মেহরাজ উত্তর দিলো নাহ। কিছুক্ষণ অসন্তোষ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই চাহনির অগাধ পরিবর্তন হলো। দৃষ্টি অবিন্যস্ত অথচ গাঢ় হতে থাকলো অবিলম্বেই। সূক্ষ্ম নজরের ধারালো দৃষ্টিতেই পরখ করলো প্রিয়তমার আগাগোড়া।
বাঁকা চোখেই পা থেকে মাথা অব্দি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্থিরনেত্রে দেখলো মোহরের লজ্জা, অস্বস্তিতে সিটিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকা দৃষ্টি হুট আঁটকে গেলো চুলের পানিতে ভিজে থাকা কোমর, পিঠের ভাঁজে, স্থির চিত্তে হঠাৎই সূক্ষ্ম যন্ত্রণাভূত হলো মেহরাজের বক্ষে। সদ্যস্নানে স্নিগ্ধ মোহরকে দারুণ শুদ্ধ, বিমল মনে হলো মেহরাজের।
স্থির চাহনিতেই নির্বিকার সুরে বলল
– আপনার শুকরিয়া করা উচিত আপনার স্বামী শুধু তাকিয়েই দেখে। তা না হলে এই মাঝরাতে আপনার গোসলের কারণ গরম না হয়ে অন্যকিছু হতো
লাজলজ্জা হীন কথার পৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর দূর ভয়ংকর লজ্জায় নেতিয়ে মোহর। লোকটা দিনদিন ভয়ংকর অসভ্য হয়ে উঠছে যে! মোহরকে অস্বস্তি আর লজ্জায় ফেলার বিরতিহীন প্রক্রিয়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যেনো।
চোখ মুখ খিঁচিয়েই উঠে যেতে নিলে মেহরাজ এক টান দিয়ে বসালো, পুরুষালী স্পর্শে তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়লো মেহরাজের বুকের উপরে। হয়তো এটাই মেহরাজের উদ্দেশ্য ছিলো। একটা হাতের থাবা কোমরে চেপে আরেকটা হাতের মোহরের ভেজা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল
– সবসময় পালাই পালাই করেন কেনো?
মোহর নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও একচুল নড়তে পারলো না। ছাড়া পেলো না দানবীয় শক্তির ন্যায় স্পর্শ থেকে। হেরে যাওয়া হরিণীর ন্যায় চোখে ক্লান্ত স্বরে বলল
– আপনি এতো অসভ্য কেনো?
– আপনি অসভ্য বানিয়েছেন তাই
মোহরের ভ্রু কুচকে এলো রাগে। লোকটা দিনকে দিন নয় বরং ঘন্টায় ঘন্টায় অসভ্য হচ্ছে। নির্লজ্জ মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। বেশ কড়া গলায় তেজের সহিত বলল
– আপনি ভীষণ অসভ্য, নির্লজ্জ আর বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন রুদ্ধ, ছাড়ুন আমায়
ঝড়ের বেগে বাতাস টেনে নিলো বুক ভরে, বেসামাল হৃদক্রিয়া টাকে সামলে ঠোঁট কামড়ে ধরলো মেহরাজ। অস্থির চিত্তটাকে গোগ্রাসে দমিয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলল
– এই যে আপনি আমাকে পাগল করে ফেলছেন, অসভ্য বানাচ্ছেন এর শাস্তিরূপে আপনাকে কি করা উচিত? এই যে নিজের চোখ, ঠোঁট আর কণ্ঠস্বরে আমায় অধৈর্য করে দিচ্ছেন । বাঁধ ভেঙে গেলে কি সামলাতে পারবেন আমায়?
মোহরের অবুঝ নেত্রদ্বয়ের পরিবর্তন ঘটলো ব্যাপকভাবে। ভার হয়ে আসা চোখ তুলে তাকাতে পারলো নাহ। মেহরাজের এই লাগামহীন, বেপরোয়া কথায় মিইয়ে গিয়ে নিজে যেটা বলতে চেয়েছিলো সেটাই ভুলে বসলো।
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️
#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩২
#হুমাইরা_হাসান(যবনিকাংশ)
– কিসের জন্যে এখনো অপেক্ষা করে বসে আছেন ভাইজান, আগাছা যত তাড়াতাড়ি উপড়ে ফেলা যায় ততই ভালো, না তো সেটা ধীরে ধীরে পুরোটাকেই নিজের লতা পাতায় গ্রাস করে ফেলবে!
নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় সামনের ব্যক্তিটির কয়েকটি বাক্যবাণ টা পিনপতন নীরবতা চূর্ণ করে ঝংকার তুললো মস্তিষ্কে। চায়ের পেয়ালাতে লম্বা চুমুক দিয়ে কাউচের হেডসাইডে মাথা এলিয়ে দিল। চোখ বুজে এলো গভীর চিন্তায়। হাতের তর্যনীতে ঠকঠক জাতীয় শব্দ করলো কাউচের হাতলে। মৌনতা বজায় রাখা অবস্থাতেই আবারও সামনের কণ্ঠস্বরটা ব্যপক উৎকণ্ঠা মিশিয়ে বলল
– কয়েক মাস আগের কথা কি ভুলে যাচ্ছেন ভাইজান? মাহবুবের জন্য কি ঝামেলাটাই না পোহাতে হয়েছিল, শুধুই কি ঝামেলা ও তো বি’ষের মতো উঠেপড়ে লেগেছিল সব ধ্বং’স করে দিতে। ঠিক শেষ মুহুর্তের আগেই যদি ওকে শেষ না করে দিতাম তাহলে ফলাফল টা কি হতো বুঝতে পারছেন? বাইশ বছর ধরে যেটাকে আড়ালে রেখে সামলে চলেছি, যার জন্যে আজ এতো কিছু তার রহস্যভেদ হলে কোথায় পৌঁছাতাম ভাবতে পারছেন?
– তুমি তাহলে কি করতে চাইছো?
– সাপের রক্ত থেকে সাপ ই তৈরি হবে, বিষদাঁত গজানোর আগেই উপ’ড়ে ফেলেন ভাইজান।
– যাকে উপ’ড়ে ফেলার কথা বলছো সে কার আয়ত্তে, কার হাতের মুঠোয় আছে সেটা কি করে ভুলে যাচ্ছো? তার সম্পদে হাত দেওয়ার দুঃসাহস দেখাবো বলছো?
– ওকে এতোটা কেনো ভয় পাচ্ছেন কি করবে ও..
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই চোখ খুলে তাকালো, ঠেস দেওয়া শরীর টা সোজা করে বসে দুহাতের মুষ্টি দৃঢ়তর করলো, শক্ত চোয়ালে চোখে চোখ রেখে বলল
– ভয় কেনো পাচ্ছি ভুলে যাচ্ছো? মাজহাব কে ভুলে গেছো? ওর ক্ষমতা দাপটকে এতো দ্রুত মন থেকে মুছে ফেললে? বাঘের ঔরসে বাঘ ই জন্মায়
– যাকে বাঘ বলছেন তাকেও কিন্তু আমরাই শেষ করেছি। ক্ষমতা, শক্তি থেকেও যেটা ভয়ংকর সেটা হলো কূটনীতি। আমার মনে হয় না ও তেমন কিছু করতে পারবে।
– সেই পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি আকাশ পাতাল তফাৎ। চল্লিশ ভাগ শেয়ারে তিনজন কি করবে?
– ওটা তো জনসম্মুখ ঠেকানোর চেহারা মাত্র। আসল ব্যবসা টা তো এতো সহজে ভেস্তে যেতে দিতে পারিনা ভাইজান। আপনি পারলেও আমি পারবো না। আমার কাছে সম্পদের চেয়ে বেশি কেও না, এটা হাসিল করার পথে যেই সামনে আসবে আমি তাকেই গোড়া থেকে উ’পড়ে ফেলবো। আপাতত এই চুনোপুঁটিকে সরাতে হবে
– পেনড্রাইভ টা কিন্তু এখনো আমরা হাত করতে পারিনি! ওটার জন্যেই আমি শান্ত হয়ে আছি। খোদা না করুক ওটা যদি একবার হাত লেগে যায় যাকে চুনোপুঁটি বলছো বিষদাঁত বসাতে এক বিন্দু ছাড় দেবে নাহ। ওর মুখে আমি ঔদ্ধত্য দেখেছি, ভয়হীনতা দেখেছি। বছর খানেক আগে যেই জৌলুশ, দাপটের জন্য দমে যেতে হয়েছিল আমাদের লক্ষ কোটির কারবার সেই দুঃসাহস আমি ওর চোখে দেখেছি। যতটা সহজভাবে নিচ্ছো ততটাও নাহ
কথা গুলোর স্বর আস্তে আস্তে আরও ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো। শীর্ণা শ্রবণশক্তি ওতটা ঠাওর করে উঠতে পারলো না। তবে শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে যতটুকুই এসেছে তা পরিস্থিতি বুঝতে কাফি।
খুব আস্তেধীরে ধীর পায়ে সরে এলো দরজা থেকে। নিঃশব্দে প্রস্থান করে হটে এলো। ঘরে এসেই খিল তুলে ধরলো। অস্থিরতা, দুঃশ্চিন্তায় দরদর করে ঘাম ছুটছে দূর্বল শরীর বেয়ে, বছর খানেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা আবারও বুকের মাঝে হানা দিচ্ছে।
এবার শুধু একটা খু’ন না, রক্তারক্তির তাণ্ডব হবে। দীর্ঘকালীন স্মৃতিতে আড়ষ্ট মস্তিষ্কে খেঁই গুলো বারংবার বিদ্যুতের ন্যায় ঝলকানি দিচ্ছে, বিড়বিড় করে অস্পষ্ট গলায় বারবার আওড়ালো
– ম’রবে, তোমরা সবাই ম’রবে। কেউটে ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছো যতো সহজে সে যে শঙ্খচূড় হয়ে দংশ’ন করবে খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবে। চোখের সামনে তিনটা মাসুম কে ম’রতে দেখেছি। পাপের ষোলোকলা পূর্ণ হবে তোমাদের এবার, নিয়তি কোথায় ফেলবে হাড়েহাড়ে বুঝতে পারবে পাপী’ষ্ঠের দল।
_________________________
দীর্ঘায়িত রজনী টার যেনো চোখের পলকে অবসান হলো। এই তো মাত্র যেনো চোখ দু’টো লেগেছিলো, কিয়ৎকালের ব্যবধানে যেনো ঘুমটা ছুটে গেলো।
ঘুমের মাঝে নড়েচড়ে উঠলো মোহর,
টিপটিপ করে নেত্রদ্বয় খুলে তাকালো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে পাশে তাকালেই আঁখিদ্বয় সুস্থির হলো অতিশয় সুপুরুষের পানে।
প্রশস্ত পিঠ মেলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, নীলচে-কালো রঙের টি-শার্টটা কুচকে লেপ্টে আছে পুরুষালি শরীরে। মোহরের বিপরীতে মুখ ঘুরিয়ে রাখায় মুখটা স্পষ্ট না দেখতে পেলেও ঘাড়ের পেছনে দৃষ্টিকর্ষনীয় লালচে তিলটা একেবারে চুম্বকের ন্যায় চোখে বিঁধে গেল মোহরের। মেহরাজের যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য মোহরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তার মধ্যেই একটি ঘাড়ের এই লালচে তিলটা।
কেমন যেনো দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিয়ৎক্ষণ জহুরি নেত্রে চেয়ে রইলো মোহর, পরক্ষণেই নিজের অজান্তেই ঝুঁকে এলো খানিক। মেহরাজের শরীরের কড়া ঘ্রাণ টা খুব নিকট থেকে মোহরের নাকে লাগছে। ঝট করেই গতরাতের কথা মনে পড়ে গেলো মোহরের, মেদুর গালখানা অচিরেই লালাভ টকটকে আভায় রক্তাভ হয়ে উঠলো। মানুষটার বৈশিষ্ট্য, চরিত্র যতটাই শান্ত সমুদ্রের ন্যায়, তার পাগলামি কথা গুলো ঠিক সেই সমুদ্রেরই উপচে পড়া উথাল-পাথাল ঢেউয়ের ন্যায়।
কেমন মোহাচ্ছন্নের ন্যায় আলতো ভাবে মোহরের আঙ্গুল ছুঁয়ে দিল মেহরাজের ঘাড়ের তিলতুল্য লালচে বিন্দু টা। শরীর জুড়ে অনবদ্য অনুভূতি গুলো বিস্ফোরণের স্বরূপ ছুটতে লাগলো।
অযাচিত অনুভূতি গুলোর অবাধ্যতা দেখে নিজেকে দূর্বশ ইচ্ছে গুলো প্রাণপণে আগলে নিলো মোহর।
সরে আসতে নিলেও টান পড়লো ওড়নাতে, ওড়নার টান পড়া অংশটা অনুসরণ করে তাকালেই অকল্পনীয় দৃশ্য টুকু দেখে থমকে গেলো হৃদস্পন্দন। মেহরাজ নিজের হাতের মুঠোয় ওড়নার একাংশ মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে, বন্ধনটা এতটাই দৃঢ যে হাতের ফাঁকফোকর দিয়ে বাতাস ও ঢুকছে কি না সন্দেহ।
মোহর আলতো ভাবে বার কয়েক চেষ্টা করলো ওড়নাটা ছাড়িয়ে নেওয়ার কিন্তু মেহরাজের দৃঢ়মুষ্টির সাথে পেরে উঠলো নাহ। ঘুমের মাঝেও কেও এতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারে!
মোহর ওড়না টা ওভাবেই রেখে উঠে কাবার্ড খুলে অন্য একটা ওড়না পরে ফ্রেশ হতে গেলো।
_____________________
– এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি দোস্ত?
– আরে সিগনেচার না করিয়েই চলে যাবো নাকি!
– আচ্ছা আমি দাঁড়াচ্ছি নিচে। তুই ঝটপট সাইন টা করে নিয়ে চলে আই
মোহর ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলে শ্রীতমা। তড়বড় করে নিচে নেমে গেলো। মোহর দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজের কেবিনটার সামনে। হাতে চেপে রাখা বেশ মোটা সোটা একটা ফাইল।
ফাইল নয় অ্যাসাইনমেন্টের পেপারস। যার সাইন করানো গতদিনই শেষ। কিছু কারণ বশত মোহর যথাযথ সময়ে কমপ্লিট করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আজকে সাইন করাতে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে কারণ অন্য সেকশনের প্রফেসর এসে গল্প জুড়েছে ফায়াজের সাথে।
বেশ অনেকক্ষণ সময় পার করে বেরোলো সে, অবিলম্বেই মোহর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠকঠক জাতীয় শব্দ করলো করলো দুবার।
ফাইল গুলো গুঁছিয়ে মাত্রই চেয়ার ছেড়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ফায়াজ, শব্দের উৎসটা খেয়াল করে দরজা বরাবর তাকিয়ে বহুকাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখেই এক পলকের জন্য থমকে গেলেও পরমুহূর্তে চোয়াল শক্ত স্বাভাবিক করে নেয়।
– আসতে পারি স্যার?
কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে অনুমতি দিলো ফায়াজ। চেয়ারটাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। মোহর এগিয়ে এসে হাতের ফাইলটা ফায়াজের সামনে রাখলে সেদিকে ভ্রুক্ষেপণ না করেই সোজা তাকিয়ে বলল
– এটা কি?
– স্যার লাস্ট মান্থের ক্যাম্পিং’র ইনফরমেশনের অ্যাসাইনমেন্ট।
– এটা জমা দেওয়ার ডেট এক্সপায়ার্ড মিস মোহর।
মোহর বিব্রত হলো নাহ। উত্তর জানা সত্ত্বেও ফায়াজের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তা ওর জানা। অকপটেই উত্তর করলো
– স্যার লাস্ট মান্থ আমার মায়ের ডেথ আর কিছু পারসোনাল ইস্যুর কারণে লম্বা সময় গ্যাপ পরেছে যার আওতায় এই ক্যাম্পিং টাও ছিল। যেহেতু আমি নিজে পার্টিসিপ্যান্ট করতে পারিনি তাই অন্যদের থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে প্রিপেয়ার করতে একটু বেশি সময় লেগে গেছে। আমি দুঃখিত।
ফায়াজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মোহরের দিকে খানিক। মেয়েটার চেহারা যেনো আরও উজ্জ্বল, আরও স্নিগ্ধ হয়েছে দিনকে দিন। তাকালে তাকিয়েই থাকতে মন চাই, তবুও সেই অযাচিত ইচ্ছে টাকে দমিয়ে প্রত্যুত্তর হীনা ফাইলটা এগিয়ে নিলো। পৃষ্ঠা উলটে সই করতে করতে আড়চোখে তাকালো নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পানে।
– থানা থেকে ফোন এসেছিল মোহর!
আচানক যেনো ফায়াজ আগের রূপে ফিরে এলো। সেই আগের ন্যায় উৎকণ্ঠিত গলায় বলল কথাটা, মোহর ঘাড় তুলে তাকালেও কথাটির মর্মার্থ টুকু মস্তিষ্কে হানা দিতেই চোখ ভরে এলো, কিন্তু তা প্রকাশ করলো না। তথাকথিত ছাত্রীর ন্যায় নিয়মনিষ্ঠ ভাবে বলল
– স্যার থ্যাঙ্কিউ সাইন করে দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে দেরী হবে না আশা করছি।
– তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছো মোহর?
বেশ উচ্চরবে বলল ফায়াজ। কণ্ঠে একরাশ হতাশা আর বিহ্বলতা। মোহর সেদিকে মনোনিবেশ না করার ন্যায় বলল
– আপনার কথাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো অকৃতজ্ঞ আমি নই। আমি শুধু বিষয় টাকে এড়িয়ে যাচ্ছি
– কেনো এড়িয়ে যাচ্ছো? তুমি কি সব ভুলে যাচ্ছো? কোথায় গেলো তোমার জেদ তোমার ন্যায়, সত্যতা? নাকি বিয়ে সংসার করে নিজে অতীত টা ভুলে যাচ্ছো? ভুলে যাচ্ছো তোমার লক্ষ্য প্রতি…
– স্যার প্লিজ! অনুরোধ করছি এই বিষয় টা আমার সামনে তুলবেন নাহ। আমিতো চেষ্টা করেছি? কমতি তো রাখিনি, ফলাফল কি? শূন্য!
আমি জানি আমি যতই দৌড়াই চিৎকার, চেঁচামেচি করি তা কারো কান অব্দি যাবে না কারণ আমার না আছে কোনো ক্ষমতা নাইবা যোগ্যতা। এই সমাজ আমাদের মতো গরীব মানুষের প্রতি সহানুভূতি, ন্যায়পরায়ণতা দেখায় না স্যার। তাই আমি ছেড়ে দিয়েছি। সবটা ছেড়ে দিয়েছি খোদা তায়ালার উপরে। শুধুমাত্র তার উপরেই বিশ্বাস করে বসে আছি। কারণ আমি জানি আমার রব ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।
একসাথে এতগুলো কথা বলে দম ছাড়লো মোহর। না চাইতেও কান্নাগুলো উগড়ে বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। চোখ ফুড়ে দুফোঁটা গড়িয়েও পড়লো। ফায়াজ এগিয়ে এলো চেয়ার ছেড়ে মোহরের সামনে এসে দাঁড়ালে মোহর দুকদম পিছিয়ে গেলো। হাত সামনে বাড়িয়ে অনুরোধের স্বরে বলল
– আপনি আমাকে শুরু থেকেই অনেক সাহায্য করেছেন স্যার। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। শুধু আরেকটা অনুরোধ এই কথাটা আর কোনোদিন ও তুলবেন না আমার সামনে। আমি সহ্য করতে পারিনা।ওদের বলবেন কে’সটা আমি আর এগোতে চাইনা। যা হয়েছে ওখানেই ডিসমিস। খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছি, শক্ত করেছি। আর ভাঙতে পারবোনা
কথার সাথে ফুঁপিয়ে উঠলো। ফায়াজের বুকের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো মোহরের চোখের পানি দেখে। এগিয়ে এসে পরম যত্নে হাতটা মোহরের মাথার উপরে রাখলো, স্নেহমিশ্রিত গলায় বলল
– ঠিকাছে, আর বলবোনা। যা কিছু তোমাকে কষ্ট দেয় তা আমি কখনো তোমাকে ছুঁতে দেবো নাহ। আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে, সরি!
মোহর শান্ত হলো। চোখের পানি মুছে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল
– আমি কষ্ট পাইনি স্যার। আমার কোনো কষ্ট নেই।
ফায়াজ জবাবে মৃদু হাসলো। টেবিলের উপর থেকে চশমাটা তুলে মোহরের সামনে এসে বলল
– চলো এগোয়। আমিও বেরোবো।
মোহর জবাব হীনা বেরিয়ে এলো। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেইটের সামনে এলে ব্যাগ থেকে ফোনটা ভেজে উঠতেই হাঁটা গতি কমিয়ে ফোন টা বের করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে শ্রীতমার কণ্ঠস্বর।
– ভাবীই আমি এইদিকে..
বলে এক ছুটে দৌড়ে এলো সাঞ্জে। মোহর এক হাতে কানে ফোনটা ধরেই সামনে তাকিয়ে সাঞ্জেকে থামতে বলার আগেই মোহরের পাশ কাটিয়ে ফায়াজ এগিয়ে বের হতে নিলে একদম সাঞ্জের সামনে এসে পড়লো।
অকস্মাৎ দৌড়ের গতি থামাতে গিয়ে বেতাল হয়ে ধাক্কা লাগলো ফায়াজের বুকের সাথে। ধড়াম করে পড়লো রাস্তার উপরে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মোহর এখনো থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের ওপাশ থেকে শ্রীতমার ‘ হ্যালো? হ্যালো’ বলা চিকন কণ্ঠটা কানে এলেও মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারলো নাহ। এগিয়ে গিয়ে শ্রীতমাকে ধরতে গেল।
– ঠিক আছেন আপনি? আই’ম সরি আমি খেয়াল করিনি আপনাকে
ভরাট ধীরস্থির কণ্ঠে সাঞ্জে হা করে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে কি হলো এটুকু বুঝে ওঠার আগেই একটা লম্বা চওড়া ছেলে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে হাত বাড়িয়ে ধরলো। আগামাথা না বুঝেই হাত বাড়িয়ে দিলো আগন্তুকের দিকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়ই পুরুষটি আবারও বলল
– ঠিক আছেন? কোথাও লেগেছে?
সাঞ্জে হতবুদ্ধির ন্যায় ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে না বলল। হাতের আইসক্রিম টা মাটিতে পিষে হাতের কনুই আর জামাতে লেপ্টে গেছে। ফায়াজ সেদিকে লক্ষ্য করে পকেট থেকে টিস্যুর ছোট প্যাকেট বের করে সাঞ্জের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
– আপনার হাতটা মুছে নিন
ততক্ষণে মোহর এগিয়ে এলো সাঞ্জের কাছে। ওকে ধরে ব্যস্ত গলায় বলল
– সাঞ্জে কোথাই লেগেছে দেখি? তুমি যে কি করো না, কেনো যে দৌরাতে গেলে!
বলে সাঞ্জের জামা হাতে ঝেরে দিতে লাগলো। সাঞ্জে তখনও সুস্থির নেত্রে তাকিয়ে ফায়াজের দিকে, যার কৌতুহলী নজর একবার সাঞ্জে কে দেখছে তো একবার মোহরকে।
– ও তোমার পরিচিত মোহর?
ফায়াজের প্রশ্নে মোহর ব্যস্ত স্বরেই বলল
– জ্বি স্যার ও
– আপনি যাকে মোহর বলছেন সে আমার ভাবী।
নরম প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে এবার প্রসারিত নয়নে তাকালো কিশোরী চেহারায়। বেশ গোলগাল ধাচের চেহারা, উজ্জ্বল বর্ণ। পরনে লম্বাটে ফ্রকের ন্যায় পোশাক । চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করা। মায়াভরা চেহারাটায় একবার তাকালে চোখে পড়ার মতন।
– ওহ। আমি দুঃখিত মিস। আমার একটু খেয়াল করা উচিত ছিলো।
– সরি। আমিই রাস্তায় না দেখে ছুটোছুটি শুরু করেছি। এমনটা করা উচিত হয়নি আমার।
অপরাধীর ন্যায় চেহারা করে বলল সাঞ্জে। মুখটা বাচ্চাদের মতো ছোট করলো। ফায়াজ মৃদু হাসলো সাঞ্জের মুখাবয়ব দেখে।
– নেক্সট টাইম থেকে দেখে ছোটাছুটি করবেন তাহলে।
বলেই ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো নিজের গাড়িটির উদ্দেশ্যে। পেছনে একটা বারও না ফিরে চোখের আড়াল হয়ে গেলো নিমিষেই। ফায়াজের যাওয়ার পানে একধীমে চেয়ে সাঞ্জে টেনে টেনে বলল
– উনি আমাকে দেখে হাসলো কেনো ভাবী
– ওটা তোমার দেখতে হবে নাহ। তুমি একা কেনো একা আসতে গেলে বলো তো। এসো,চলো
বলে সাঞ্জের হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। সাঞ্জে হাঁটতে হাঁটতে বলল
– বাড়িতে একা বোর হচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম রায়হান আঙ্কেল যখন আসছে তোমাকে নিতে আমিও আসি। আমি কি জানতাম নাকি যে ধপ করে ধাক্কা লেগে থপ করে পড়ে যাবো
.
.
.
চলমান।