ফানাহ্ পর্ব-২৯+৩০

0
1263

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৯(প্রথমাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

ভীষণ ধীর পায়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে এগোচ্ছে মোহর। টুং টাং একটা শব্দ কানে আসছে,আর তা খুব স্পষ্টভাবে। খুব ক্ষীণ গতিতে পা ফেলে এগিয়ে দাঁড়ালো দোতালার একদম কোণার দিকের ঘরটার কাছাকাছি ।
মেহরাজের ঘরের পরেই এই ঘরটি, এতদিনেও এদিকে আসা হয়নি এমনকি আসার প্রয়োজনটুকু বোধ করেনি মোহর। ঘরটার দরজা আজ অব্দি খোলা দেখেছে বলে মনে হয়না। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় ভিড়িয়ে রাখা, ক্ষীণ একটা আলোর রেখা দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে বাইরে উপচে পড়েছে।
মোহর ধুকপুক করা বক্ষের উথাল-পাতাল ছন্দে তটস্থ মনটা শান্ত করার প্রয়াসে অধর ফাঁক করে বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল
যান্ত্রিক শব্দটা থেকে থেকে বেজে উঠছে ছন্দহীন ভাবে, মোহর আরেকটু এগিয়ে এসে একদম দরজা ঘেঁষে দাঁড়ালে ভেতর থেকে বহুকাঙ্ক্ষিত
কণ্ঠের গম্ভীর ধ্বণি ভেসে আসলো

– ভেতরে আসুন মোহ

ধক্ করে উঠলো মোহরের বুকটা, লোকটা কি করে বুঝলো ও এসেছে? ও তো দরজার সামনে যাইনি,আর নাইবা ওকে ভেতর থেকে কোনো ভাবে দেখতে পারার সুযোগ আছে। তাইলে কিভাবে বুঝলো লোকটা? এই লোকটা কি মানুষ, নাকি অন্যকিছু? প্রতিটা সময় মোহরের ভেতর টাকে এভাবে পড়ে ফেলে যেন একটা উন্মুক্ত প্রতিলিপি। যার প্রতিটি লাইনের ভাঁজ সে সযত্নে নজর আওড়ে নেয়, প্রতিটি দাড়ি কমার অবস্থান ও তার ঠোঁটস্থ। যেসবের অবস্থান গুলো মেহরাজ দেদারসে বলে দিতে পারে না দেখেই।

মোহর দ্বৈধীভাব আর সঙ্কোচ নিয়েই দুকদম এগিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে, হাতটা এগিয়ে পুরোপুরি খুলে দিলো কাঠের ভারী দুয়ারখানা।
তৎক্ষনাৎ উন্মোচন হলো প্রতীক্ষিত চেহারাটা, যাকে একবার দর্শন করার দায়ে অবাধ্য বেহায়া মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।

– আসুন।

ছোট্ট শব্দের ব্যবহারে অনুমতি টুকু দিয়ে এক পলক দরজার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় মুখ ফিরিয়ে নিলেও ওই স্বল্প সময়ের দর্শনে আশ্চর্য কিছু দেখায় ন্যায় আবারও মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডান দিকে।
ততক্ষণে মোহর অনেকটা কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে।

চোখ দু’টো স্থির,অনড় হয়ে গেল মেহরাজের। বুকের ভেতর ঝোড়ো হাওয়ার প্রকপে নিজেকে স্থির রাখাটাও দায় হয়ে যাচ্ছে। উথাল-পাতাল জলোচ্ছ্বাসও হয়তো হার মানবে বক্ষস্থলের এই ছোট্ট নরম জায়গাটুকুর উচাটন ঢেউয়ের কাছে। পলক ফেলা দূর ওমনেই চোখ দু’টো নিশ্চল করে দাঁড়িয়ে রইলো মোহরের দিকে।
এ কোন সাজ,কোন রূপে এসেছে ওর সামনে মোহর! মেয়েটা কি ওকে মে’রেই ফেলতে চাই!

মোহর অনেকটা এগিয়ে এলেও মেহরাজের এরূপ অগাধ দৃষ্টিতে চেয়ে ওউ থমকে গেলো। দুজনের অবস্থা থমকে যাওয়া ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো আঁটকে গেল। বহু কষ্টে যেই জড়তা টুকু সাগ্রহে সামলে উঠছিল সে আত্মবিশ্বাস আর স্বাভাবিকতার ভীত কে চুরচুর করে গুড়িয়ে দিচ্ছে মেহরাজের এই নির্লজ্জের ন্যায় উদ্ধত চাহনি। আবারও সেই তীব্র অস্বস্তিটা জোঁকের মতো চি’মটে ধরলো।
মেহরাজের চোখ, চাহনি..ওই নিষ্পলক নেত্র কোনোটাই স্বাভাবিক লাগছে নাহ। লোকটাকে এমন কেন লাগছে? দুপুরের সেই শার্টটাই এখনো গায়ে জড়ানো অথচ মেহরাজ কখনও দিনের পোশাক টা রাতে গায়ে রাখে না। এলোমেলো চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে আছে প্রসস্থ ললাটের মাঝে। শুভ্র শার্টটার স্লিভ গুটিয়ে রেখেছে কনুই অবদি, বুকের কাছে অনেকটা অংশ উন্মুক্ত,সেই ফাঁকে ফর্সা বুকটা চোখ ধাধানোর মতো উঁকি দিচ্ছে মোহরের চোখে৷ কালো প্যান্টের সাথে ঝকঝকে সাদা শার্টে যেন মেহরাজকে আরও, আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।

ফট করে চোখ নামিয়ে নিল মোহর, শাড়ির
আঁচলটার উপরে সমস্ত অস্বস্তি ঢেলে দিয়ে নির্দয়ভাবে মোচড়াতে লাগলো আঙ্গুলের ভাঁজে।
ঘরের টিমটিমে হলদেটে আলোটা সম্পূর্ণরূপে মোহরের মুখের উপর উপচে পড়ছে। গায়ের রঙটা অদ্ভুতভাবে চোখ ধাধাচ্ছে মেহরাজের। অবিন্যস্ত শাড়ির ভাঁজ খুলে খুলে গেছে, আধখোপা করা চুলটা ঘাড়ের কাছে নেতিয়ে পড়ে আছে, ছোট ছোট চুলের গোছাটা কানের পেছনে গুঁজে রেখেছে। ঘুম থেকে উঠার দরুন চোখ আর ঠোঁট দুটো ফোলা ফোলা, শাড়ির কুচিটা খুলে মেঝে পর্যন্ত ছুঁয়েছে। আঁচল টা ভাঁজ করে কাঁধে ফেলে রাখায় যে পাতলা, সরু, বাঁকানো পেট আর নাভীর অর্ধেকাংশ উন্মুক্ত হয়ে মেহরাজের চোখদুটো চুম্বকের মতো আঁটকে ফেলেছে সেখেয়াল হয়তো মোহরের নূন্যতম নেই।
মোহরের দুরুদুরু কম্পিত বুকের ওঠানামা, আর কামড়ে রাখা ঠোঁটে নতজানু মুখটা মেহরাজকে ঘায়েল করার জন্যে একটু বেশিই যথেষ্ট যেন!

মেহরাজ কামড়ে ধরা ঠোঁটের ওই দৃশ্যটুকু দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিল। মাথাটা নিচু করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস করলো। তুমুল অস্থিরতাকে উৎস করে যে ঝড়টা উঠেছিল তাকে আস্তেধীরে সন্তপর্ণে সামলে নিল। শুকনো ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বলল

– এখানে বসুন

বলে হাতের যন্ত্রটা পাশে রাখলো। মোহর লক্ষী মেয়েটির মতো এসে বসলো সোফার মতো নরম গদিটিতে। ড্যাবড্যাব করে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো পুরো ঘরটা।
এই বাড়িতে এমন একটা ঘর ও থাকতে পারে এই ধারণা টুকুর নিম্নভাগও ছিল না মোহরের। ছোটো খাটো একটা ঘর। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতার বুকে ছোট ছোট নানান সৌপিচ আর আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। আর খুব অদ্ভুতভাবে সবগুলো বস্তুই যে অনেক পুরাতন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
হলদেটে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে ঘরের মাঝে,সামনেই ফুলদানিতে কতগুলো আর্টিফিশিয়াল হলুদ গোলাপ দিয়ে সাজানো। সমস্ত ঘর জুড়ে আগ্রহী, কৌতূহলী নজর বুলিয়ে এবার মোহরের নির্মল চোখ দু’টো স্থির হলো মেহরাজের কোলের কাছে রাখা বস্তুটাতে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়ই মেহরাজ বলল

– এতো রাত করে ঘুম থেকে উঠলেন যে?

– আপনি ছিলেন না ঘরে

মেহরাজ পিছিয়ে গেল, হেলান দিল নরম তুলোর হেডসাইডের দিকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল

– আমি নেই বলে ঘুম ভেঙেছে? ঘুমিয়ে থাকতে কি আমাকে প্রয়োজন?

মোহর একথার প্রেক্ষিতে উত্তর খুঁজে পেল নাহ। আবারও ঘরের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলল

– সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছিলাম তাই ভেঙে গেছে। ঘুম ভেঙে দেখি আপনি ঘরে নেই, তাই কৌতূহল বশত এদিকটায় এসেছিলাম

মেহরাজ ঘাড় কাৎ করে তাকিয়েই রইলো মোহরের দিকে। কি করে এই বেহায়া চোখ দু’টো ফেরাবে আবার! নির্মল আঁখি দুটি তো আঁটকে গেছে কাজলের সরু রেখা লেপ্টানো মোহরের চোখ দু’টোয়। মেহরাজের ভীষণ ইচ্ছে হলো ওই চোখের কাজল টা আরেকটু লেপ্টে দিতে। ঠোঁট দুটো? ঠোঁটে কি লিপস্টিক লাগিয়েছিল নাকি এতক্ষণ কামড়ে ধরেছিল বলে এমন টকটকে লাগছে তা মেহরাজ ঠাওর করতে পারলো না, তবে বেহায়া মনটা ঠোঁট দুটিকেও ছাড় দিতে চাইলো না। বুকের মাঝে চলন্ত তান্ডবলীলায় বারবার খায়েশ জাগলো ওই টকটক করা ভেঁজা ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরতে, ওষ্ঠাধরের রঙ টা লেপ্টে দিতে৷ চুলগুলো একটানে খোপা ছাড়া করে দিতে

– এই গিটার টা কি আপনার?

মেহরাজের অবাধ্য অনুভূতির ফুলকিতে লাগাম দিল মোহরের ঘুম জড়ানো পাতলা কণ্ঠস্বর। মেহরাজ ঘাড় নাড়িয়ে বলল

– জ্বি আমার।

মোহরের কৌতূহলী নজরটা তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে কালচে ধূসর রঙের গিটারটার দিকে। একোস্টিক গিটারটির গায়ে খোদাই করে কিছু একটা লিখা হয়তো। মেহরাজ মোহরের এতো আগ্রহ চাহনি দেখে গিটার টা এগিয়ে দিয়ে বলল

– দেখতে চান?

মোহর মাথা উঁচু নিচু করে সম্মতি দিয়েই গিটার টা খপ করে হাতে নিল। কলের উপর রেখে খুব যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
ওর ভীষণ ইচ্ছে ছিল গিটার বাজানো শেখার, কিন্তু কোনো ভাবে সুযোগ হয়নি, বা সময় পাইনি। বাবা বলেছিল একটা গিটার খুব তাড়াতাড়িই কিনে দেবে মোহরকে, কিন্তু তার আগেই তো সে না ফেরার দেশে পারি দিল। মোহরের আর গিটার কেনাও হয়নি, বাজানো শেখাও হয়নি।
গিটারের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে সেই ছোট লেখাটাই হাত থেমে গেল, ইংরেজি পেঁচানো শব্দের ন্যায় ছয়টি লেটারে লেখা ‘ Ruddho ‘
খুব আস্তেধীরে ঠোঁট নাড়িয়ে বার দুই আওড়ালো নামটা মোহর, রুদ্ধ! এই নামটা তো মেহরাজেরই

– এইখানে রুদ্ধ লেখা কেন?

মেহরাজ হাসলো মুচকি, ভীষণ আদুরে দৃষ্টিতে গিটারের দিকে তাকিয়ে বলল

– আমার আটতম জন্মদিনে আমার আম্মা এই গিটারটা আমায় গিফট করেছিলেন, সাথে তার দেওয়া নামটি।

মোহর ললাটে ভাঁজ ফেলে তাকালে মেহরাজ নিজেই বলল

– রুদ্ধ নামটা আম্মা দিয়েছিলেন। এই নামটাতে উনিই সবচেয়ে বেশি ডাকতেন। আর গিটার বাজানো আমার ছোট থেকেই অবসেশন ছিল, তাই মা নিজে এটা বানিয়ে এনে দিয়েছিলেন আমায়।

মোহর স্মিত হেসে তাকিয়ে রইলো গিটারটির দিকে। মেহরাজ ওর হাত থেকে নিয়ে, নিজের কোলের উপর রেখে বলল

– গান শুনবেন মোহ?

মোহর যেন অপ্রস্তুত হলো। মনের ভেতর এই ইচ্ছে টুকু কখন থেকে আকুপাকু করছিল। শুধু জড়তার খাতিরে মুখ আব্দি আনতে পারেনি।
তবে না চাইতেই যখন মেহরাজ নিজেই সুযোগ দিয়ে বসলো ওটা আর হাতছাড়া করলো না, মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলে।
মেহরাজ গিটারের সিলভার রঙের তারে আঙুল টুকে টুং করে একটা শব্দ তুলল। সেই শব্দে মোহর প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে ঘুরেসুরে বসলো। মাথা ঝুকিয়ে মেহরাজ গিটারে ব্যস্ত হাত বুলালো। বহুদিন এই গিটারে সুর তোলা হয়না, আদও ঠিকঠাক হবে কি না জানা নেই। গিটারের টুংটাং শব্দ টা বার কয়েক বাজিয়ে আসল সুরটা তুলে ফেলল, নিস্তব্ধ পরিবেশ টা মুহুর্তেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো মেহরাজের কণ্ঠে। আস্তে আস্তে গহিন কণ্ঠে গাইতে থাকলো

” কি যায় আসে মন খারাপে,সব হারা রা আর কি হারাবে!আচমকা ভাঙা মন, পেলে ছোঁয়া নরম এতো ভাববে নাকি তুমি ভাবো! অবশেষে ভালোবেসে চলে যাবো,, অবশেষে ভালোবেসে চলে যাবো। ”

এটুকু বলে থামলো মেহরাজ, হাতের আঙুলে তখনো গানের সুর বাজছে, ঘাড় বাঁকিয়ে মেহরাজ ঝুকে এসে ফুঁ দিয়ে মোহরের মুখের উপর উপচে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল।
মোহর বিমোহিত, গাঢ়, অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহরাজের আদুরে চোখ দু’টো যেন ওকে বারবার বোঝাচ্ছে গানের প্রতিটি লাইন যেন শুধু মোহরকেই উৎসর্গকৃত। মেহরাজ আবারও গাইতে শুরু করলো

” মিলছে পায়ে পা, চোখ যায় জুড়িয়ে। ভাগাভাগি করে নেবো পাবো যা কুড়িয়ে। তুমি দেখো আমি আমার ভাগটাও দিয়ে দেবো,শুধু দেওয়ার ফাঁকে তোমার হাতটা ছুঁয়ে নেবো,,অবশেষে ভালোবেসে চলে যাবো। অবশেষে ভালোবেসে চলে যাবো। ”

মোহর নিষ্পলক চেয়ে আছে, শুধু দেখেই যাচ্ছে মেহরাজকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেন আপাদমস্তক মেহরাজকেও মুখস্থ করে নিচ্ছে। স্নিগ্ধ চোখ যাতে এক আকাশ তৃষ্ণা, ঠোঁটের কোণঘেঁষা মুগ্ধ করা বাঁকা হাসি, কণ্ঠে মাদকতা। পাতলা চুলগুলো জানালার ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু উড়ছে। কতই না মোহিত লাগছে মানুষটাকে! মোহরের খুব স্বাধ জাগলো একটা বার, ইশ শুধু একটা বার যদি ওই মুখটা ছুঁয়ে দেখতে পারতো!
মোহরের ভাবনার মাঝেই চোখ প্রসারিত করে তাকালো মেহরাজ। মোহর সম্মোহনী চোখে চেয়েই বলল

– এত সুন্দর গান করেন আপনি!

– পছন্দ হয়েছে আপনার মোহ?

মোহর যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। চোখে মুখে অদ্ভুত এক ঝিলিক, চঞ্চলতা দেখতে পেলো মেহরাজ। সেই চাঞ্চল্য কণ্ঠে মিশিয়ে মোহর বলল

– খুউউব। জানেন আমার খুব শখ ছিল গিটার বাজানো শেখার কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে হয়ে ওঠেনি।

– এখনও শিখতে ইচ্ছে করে? আপনি চাইলেই আমি শেখাতে পারি।

মোহরের উচ্ছ্বাস যেন দ্বিগুণ হলো। খুশিয়াল গলায় বলল

– সত্যিই? আপনি শেখাবেন?

মেহরাজ মুচকি হাসলো। বাঁকা অধরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।

– শেখাবো তবে একটা শর্তে

মোহরের ভুদ্বয় কুঞ্চিত হলো। আধো হাসি মুখের বুলিতে জিজ্ঞাসা করলো

– কি শর্ত?

– এই যে আমি এখন গান শোনালাম। এর পরিবর্তে আমার উপহার চাই। যদি দিতে পারেন তাহলে গিটার বাজানোও শেখাবো।

মোহর বিব্রত হলো। মেহরাজকে সে কি উপহার দেবে? সে নিজেই তো মেহরাজের উপহারেই চলে। কুণ্ঠিত মুখে বলল

– আমি? আমার কাছে তো উপহার দেওয়ার মতো কিছুই নেই।

– আছে।

মোহর কৌতূহলী হয়ে বলল। কি আছে? বলুন, থাকলে নিশ্চয় দেবো।

– সত্যিই দিবেন তো?

– হ্যাঁ সত্যিই দেবো।

মোহরের অকপট সম্মতির পর খানিক নীরবতা বইলো স্তব্ধ ঘরটা জুড়ে। সেই নীরবতা চিরে মেহরাজ অদ্ভুত নে’শাক্ত কণ্ঠে বলল

– আপনার হাতটা ছুঁয়ে দিতে দিবেন মোহমায়া?

ধক্ করে উঠলো বলাটাও হয়তো কম হবে মোহরের বুকে আচঁড়ে পড়া আচানক ঝড়টার সংজ্ঞাতে। যেন কেঁপে উঠলো সমস্ত দেহ। অবলীলায় বলে দেওয়া মেহরাজের অকপট আবদারটি মোহরের কানের নরম পর্দা ভেদ করে মন মস্তিষ্কে প্রবল জোয়ার তুলে দিল।
আড়ষ্ট নজরে মেহরাজের দিকে তাকালে মেহরাজ বলল

– আপনি কিন্তু বলেছিলেন অবশ্যই দিবেন, দিবেন না মোহ? হাতটা একটু ছুঁয়ে দিতে দিবেন না?

মোহরের মনেও যে বাধ ভাঙা অনুভূতিরা মেহরাজের সঙ্গ বা স্পর্শ চাইনা তা একেবারেও না। কিন্তু মুখ ফুঁটে নিজেকে স্পর্শ করার কথা কিভাবে বলবে ও। কম্পিত চাহনি নিচে ঝুকিয়েই রাখলো। তবে মেহরাজ মোহরের নিস্তব্ধতায়ই যেন সম্মতি খুঁজে পেল।
গিটার টা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলো মোহরের সন্নিকটে। নিজের পুরুষালী হাতটার আঙ্গুল গলিয়ে দিল মোহরের হাতের ভাঁজে, আস্তে আস্তে কঠোর হলো হাতের বন্ধন, শক্ত হলো করপুট। মোহরের চিকন হাতটা সজোরে চেপে ধরলো যেনে একটু ছাড়া পেলেই হাতের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যাবে।
মোহর প্রবল বিতৃষ্ণা ভরা অস্থিরতা সামলাতে না পেরে চোখ বুজে নিল। ঠকঠক করে কাঁপতে রইলো সম্পূর্ণ সত্তা। মেহরাজ নিজের সমস্ত অনুভূতি টা যেন ওই দুহাতের বন্ধনের মাঝে ঢেলে দিল। যতটা আদর,অনুভূতি, ভালোবাসা যায় সম্পুর্ণ মিশিয়ে দিল ওর স্পর্শে।
তবে মহাসমুদ্রের ন্যায় প্রবল জোয়ার এই ছোট্ট বাধটাও মানলো নাহ। ঘনঘন হলো তপ্ত উষ্ণশ্বাস। হাতের মাঝের চিকন হাতটা তুলে মুখের কাছে আনলো। মোহরের হাতটা টান করে তালুতে নিজের প্রচণ্ড উষ্ণশীতল মিশ্রিত ওষ্ঠাধর গাঢ় ভাবে ছুঁইয়ে দিল। নাক টেনে ভরে নিল বুক ভরা শ্বাস। দীর্ঘ..দীর্ঘক্ষন ওই অধরজোরা শোষোক্তের ন্যায় গরম হাতের তালুতে ঠোঁট চেপে গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিল।

মোহরের সমস্ত দুনিয়াটা ওই একটা স্পর্শে থমকে গেল যেন। দিন দুনিয়ার সবকিছু মূর্ছা গেল মুহুর্তেই। কোনো কিছুই মস্তিষ্কে ঠাওর পাচ্ছে না। শুধু ওর আশপাশ জুড়ে আছে মেহরাজের শরীরে মিষ্টি সুবাসটা। আচ্ছা অনুভূতির ও কি সুবাস হয়? নাহলে এখন কেন এতো গাঢ় ভাবে লাগছে সুগন্ধি টা? যেন নাসারন্ধ্র ছেড়ে মস্তিষ্ক ভেদ করে ঢুকছে এই মাদ’কতার ন্যায় সুবাসটা।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে, তৃষ্ণায় বুক গলা কাঠকাঠ হয়ে আসছে।
যেন দুজনের মধ্যবর্তী এই দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে শরীরটা ঢলে পড়তে চাইছে মেহরাজের প্রশস্ত বুকে।

চোখ দু’টো এখনো আটকে ধরে রেখেছে মোহর। মেহরাজ লম্বা একটা সময় নিয়ে হাতের তালুতে অসংখ্য উষ্ণ অধরের স্পর্শ মাখিয়ে মুখ তুললো। ঘোর লাগা নজরে তাকালো রক্তিম মুখখানায়। অজস্র বিব্রতকে ঠেলে আরও গাঢ় করে দিতে নিজের মুখখানা এগিয়ে আনলো, একদম মোহরের কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে বলল

– কাঁপছেন কেন মোহ? শীত করছে? উষ্ণতা চাই?

ভ্রম ধরানো শরীরের অচেতনতা, আর পায়েল তালুর জ্বলনে অস্থির হয়ে পড়লো মোহর। দিকবিদিক ভুলে দূর্বল শরীর টা ঢলে পড়লো মেহরাজের প্রসস্থ বুকের মধ্যিখানে। একটা হাত তো এখনো মেহরাজের আঙুলের ভাঁজে, আরেকটা হাতের দূর্বল স্পর্শে চেপে ধরলো বুকের অংশের শার্টটা।
বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় ঝাঝরে উঠলো মেহরাজের চোখ দু’টো। খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। বুকের মাঝে মিশে যাওয়া শরীরটাকে এখনো দু’হাতে জড়িয়ে ধরেনি। ভয় হচ্ছে, স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আসলেই ওর স্বপ্নচারিনী ওর অদ্বিতীয়া ওর দূরত্বমা ওকে জড়িয়ে ধরলো! বুকের মধ্যিখানে কি ওর মোহমায়া টা-ই?
অসম্ভব দুর্ভেদ্য ঝড়টাতে বারংবার নিঃশ্বাস টেনে নিপাত করার ব্যর্থ প্রয়াসে অস্ফুটস্বরে বলল

– মোহ?

এই ডাক টুকু যেন মোহরের অস্থি তরুনাস্থি গুলোকেও চুরচুর করে দিল। ফলাফল স্বরূপ আরও তীব্র হলো খা’মচির দাপট। মেহরাজের ও যেন আর সহ্য হলো না, প্রচণ্ডভাবে জড়িয়ে ধরলো মোহরকে দু’হাতে। বুকের মধ্যিখানে যেন পি’ষে ফেলতে চাইলো পাতলা শরীর টা। এতদিন, আদও কতদিন তা বেহিসেবী, এতদিনের অগাধ প্রচণ্ড অব্যক্ত ইচ্ছেটাকে বুকের মাঝে পেয়ে আর সহ্য হলো না মেহরাজের। ঝাপটে ধরে, উষ্ণ মুখটা চেপে ধরলো বুকের মাঝে।
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৯(শেষাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

ছুটে ঘরে এসে ধপ করে বিছানার উপরে বসে পড়লো মোহর৷ হৃদপিণ্ড বিদ্যুতের গতিতে দৌড়াচ্ছে। মাইল খানেক দৌড়ে এলেও হয়তো এতটা অস্থির লাগবে নাহ। প্রবল উন্মত্ততায় শিরশিরানি টা হৃদপিণ্ড ভেদ করে ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। অসম্ভব বেগে ছুটন্ত যন্ত্রটার ধুকপুকানির শব্দ কানের নরম পর্দাটাও ভেদ করে ফেলছে। ধুকপুক ধুকপুক করে বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেছে। বেতাল,বেসামাল, বেগতিক হারে ছুটছে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিতৃষ্ণা ধরে যাচ্ছে মোহরের, নিঃশ্বাসের পাল্লা অচিরেই ভারীই হচ্ছে।
ও ঘর থেকে পালিয়ে এলেও বুকের মাঝের জ্বালাতন, বুদবুদ অবস্থাটা এক লহমার জন্যেও কমেনি। সেই দম বন্ধ হয়ে আসা পরিস্থিটা এখানো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে মুহূর্ত খানেক আগের দৃশ্য

…লজ্জার সমস্ত সীমা পেরিয়ে নিজেকে আড়াল করতে, অসমীচীন সন্ধিক্ষণটুকুতে নিজেকে সামলাতে না পেরে মেহরাজের বুকটার মধ্যে ঝাপিয়ে পড়া টা কতখানি অপ্রিতিকর ছিল তা যতক্ষণে মোহর ঠাওর করতে পেরেছে ততক্ষণে শক্তপোক্ত বাহুডোরের কারাগারে অসহায়রূপে বন্দিনী হয়ে গেছে নরম শরীরটা। একচুল নড়া তো দূর মেহরাজ পারেনি ওকে চামড়া ভেদ করে নরম মাংসল ধুকপুকানির যন্ত্রটার সাথে মিশিয়ে নিতে। মোহর নির্বাক,নিস্তব্ধ, অনড় হয়ে পড়ে ছিল উষ্ণ স্পর্শের শীতলতার মাঝে। যেন চেতনাশূন্য এক নির্জীব পাখি।
মেহরাজ হয়তো বুঝতে পেরেছিল এটা তাণ্ডব শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তের নীরবতা। নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় বিরাজ করা মোহরের অন্তর্ভেদী বেসামাল প্রক্রিয়া টুকু হয়তো নিঃশ্বাসের ফিসফিসানির শব্দেই ও আঁচ করে ফেলেছিলো।

কয়েক লহমা বুদ্ধিবৃত্তিহীনায় মেহরাজের বুকের মধ্যিখানে মিশে থাকলে, অবশেষে ওর দুই বাহু ধরে সোজা করলো মেহরাজ। ডান হাতটা এগিয়ে নিয়ে চারটা আঙুল ওর গালে বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলিটা ওর ঠোঁটের আশেপাশে গালের বুলিয়ে দিতে দিতে তাকিয়ে রইলো মোহরের লঘুমস্তিষ্কের অসাড়,টকটকে মুখটার দিকে।
গায়ের আঁচলটা সরে গিয়ে এলোমেলো অবস্থা, কাজলখানি যেন আরেকটু লেপ্টে গেছে ঠিক যেমনটা মেহরাজের সাধ করেছিল।
গাল, থুতনি আর ওষ্ঠের আশেপাশে মেহরাজের আঙ্গুলের এমন অবাধ্য বিচরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে সমস্ত মোহর নিজেই।

অসামঞ্জস্য ভাবে হৃদবক্ষটার ধড়াস-ধড়াস শব্দ ভীষণ বেকায়দায় চলতে লাগলো। নিঃশ্বাসের প্রখরতার ফিসফিসানি এমন বেয়ারা ভাবে ছুটছে যেন তা পরিবেশে অন্যকিছুরই উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মেহরাজ নিজের মুখটা আরও কাছে এগিয়ে আনলো মোহরের, ওর নরম গালে হাত বুলাতে বুলাতে চোখ দু’টো আঁটকে রইলো পাপড়ির ন্যায় অর্ধভেজা ওষ্ঠভাঁজের দিকে।
ওর উন্মত্ত, বেপরোয়া, অস্থির করা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গুলো হড়বড়িয়ে আঁছড়ে পড়ছে মোহরের মুখে। ক্ষান্ত চোখের দূর্বল চাহনিতে তাকালো মোহর মেহরাজের মুখের দিকে।
এবার আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলোনা মোহর,নাইবা পারলো চোখ দু’টো সজোরে খিঁচিয়ে ধরতে। বরং তাকিয়েই রইলো। মেহরাজের ওই সমুদ্রের ন্যায় শান্ত আঁখিদুটি আজ ওকে বড্ড টানছে, বাকচিন্তার খেঁই হারিয়ে ফেলেছে নিজের। পুরুষালী তপ্ত শ্বাসের প্রখরতা ক্ষণে ক্ষণে দামামা তুলছে শরীর মনের ভাঁজে ভাঁজে।
মেহরাজের গায়ের ওই ফুল চন্দন মিশ্রিত নির্যাসের ন্যায় সুগন্ধিটা পুরোপুরি সম্মোহন করে ফেলেছে ওকে। তীব্র ভাবে নাসারন্ধ্র ভেদ করছে মেহরাজের গায়ের সুমিষ্ট ঘ্রাণ টা।

উষ্ণ-শীতল স্পর্শের মাঝে মোহর পুরোপুরি বশীভূত। খুব নিকটে মেহরাজের মুখ খানা এগিয়ে আসলেও মোহরের ঠোঁটে নিজের ভেজা স্পর্শটুকু মেখে দিলো না, দীর্ঘসময় নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাসের প্রবল সন্ধি ঘটলেও মোহরের অধর জোড়াকে উন্মাদের মতো আঁকড়ে ধরলো না মেহরাজ। বরং খোঁচা খোঁচা দাঁড়িবৃত গালটা এগিয়ে বার দুয়েক ঘঁষে দিল মোহরের গালে, কানের লতিতে ওর কোমল ঠোঁট দুটি ছুঁয়ে ফিসফিসিয়ে বলল

– আপনাকে পুরোপুরি নিজের ভেতর মিশিয়ে নিতে না পারলে শান্তি পাচ্ছিনা মোহ!

ঝনঝনিয়ে উঠলো মোহরের সমস্ত চিত্ত,কায়া। উদ্দীপিত ক্রোড় সামলাতে না পেরে হাতের নখ সজোরে বিঁধিয়ে দিলো মেহরাজের ঘাড়ে।
চোখা নখ মাংস ভেদ করে ঢুকে গেলো ফর্সা চামড়ায়।
মেহরাজ মুখ তুলে তাকালো মোহরের মুখে, বাঁ কাধ থেকে আঁচলটা অনেকখানি নেমে গেছে, সেদিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালো মেহরাজ। অযাচিত ভয়ে ঘাবড়ে মোহর আতঙ্কিত হয়ে উঠলেও ওর সমস্ত দুর্ভাবনাকে শাই করে উড়িয়ে দিয়ে মেহরাজ ওর আঁচল টা টেনে কাঁধে তুলে দিলো।
এক লহমা আর ব্যয় না করে মেহরাজ সরে এলো মোহরের কাছ থেকে। ওকে নিজের বাহুবন্ধনী থেকে মুক্ত করে দিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মোহর ধপ করে বুজে যাওয়া আগুনের ছায়ের মতো অধজলন্ত নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে মেহরাজ ওর জলদগম্ভীর গলায় বলল

– চলে যান মোহ। সাময়িক আবেগের বশীভূত হয়ে আমি এমন কিছুই করতে চাইনা যাতে রাত পোহালে আমার দিকে তাকাতে আপনার অস্বস্তি হয়। শরীরের জন্য পুরোটা জীবন পরে আছে, আপনার নরম মনটাতে আমি এখনি আমার পুরুষোচিত আঁচড় কা’টতে চাইনা। সঠিক সময় আসেনি, চলে যান

এতো গুলো কথা সম্পূর্ণ নিস্তেজ, নিস্তব্ধ বাকরুদ্ধ অবস্থায় শুনে এক মুহূর্তও সময় নিলো না মোহর। কোনো রকমে ছুটে পালিয়ে এলো ছোট্ট ঘরটা থেকে।

ধপ করে চোখ খুলে তাকালো মোহর। সেই ঘটনা টুকু ঘরে আসার পরেও মন,মস্তিষ্ক কোনো টাই ভুলতে পারছে না। নাক,মুখ,বুক সব রুদ্ধশ্বাসে প্রাণশক্তিহীন হয়ে আসছে। অস্ফুটস্বরে বার দুয়েক উচ্চারণ করলো

– র্ রুদ্ধ…রুদ্ধ!

যেন নামটা তার চরিত্রের সাথে একেবারে খাপখাওয়াতে মিলিয়েই রেখেছিল তার আম্মা। একটা মানুষের স্পর্শ, কণ্ঠ, ঘ্রাণ, চাহনি বারংবার মোহরের রুদ্ধশ্বাস তুলে দেয়। এতটা অস্থিরতা, উন্মত্ততা আর কিছুতেই নেই কিচ্ছুতেই নাহ।

__________________________

– ভাবী? ও ভাবী? আর কতো ঘুমাবে ওঠো না

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়েলী একটা ডাক মোহরের কানে আসছে। কিন্তু ঘুমের চোটে আঁখিদুটি মেলে তাকাতে পারছে না।

– ভাবী শুনছো??

এবারের ডাকটা তুলনামূলক বেশ জোরে হওয়াই চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মোহর। আশপাশ তাকিয়ে ধাতস্থ হতে বেশ সময় লেগে গেল। পাশে সাঞ্জে দাঁড়িয়ে হাস্যজ্বল মুখে। মোহর বিচলিত চেহারার অস্থির নজরে তাকালে সাঞ্জে বলল

– ইশ,তুমি কতো ঘুমকাতুরে গো ভাবী। পাঁচ মিনিট ধরে ডাকছি। একটা বার হুহা শব্দও করোনি। নাকি রাতভর ঘুম হয়নি হু?

সাঞ্জের কথায় যতটা না অপ্রস্তুত হলো তার চেয়ে বেশি অবাক হলো ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে। নয়টা বেজে বিশ ত্রিশ মিনিট, এতক্ষণ ঘুমালো কি করে!

– হায় খোদা, কত বেজে গেছে আমার ক্লাস আছে দশটায়।

বলেই হুড়মুড়িয়ে উঠতে গেলে সাঞ্জে ওকে শান্ত করে বলল

– আস্তে আস্তে, তুমি আগেই হাইপার হচ্ছো কেন। এখনো আধঘন্টা সময় আছে তো। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে চট করে ফ্রেশ হয়ে আসো শুধু। দাভাই এখনো যায়নি। তুমি রেডি হয়ে আসো তিনজনে একসাথেই বেরোবো।

মোহর সাঞ্জের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেও অস্বস্তি ঘিরে ধরলো মেহরাজের কথা মনে পড়ে। কাল প্রায় ভোর চারটা পর্যন্ত মোহর দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।
প্রাণপণে ফরিয়াদ করছিল যাতে মেহরাজ কিছুতেই এ ঘরে না ফেরে। ওর মুখামুখি হওয়ার মতো মনোবল যেন এতটুকুও নেই মোহরের মাঝে। তবে মোহরের খুব করে চাওয়াটা মেহরাজ বিফলে দেয়নি। ওর চাওয়াটা পরিপূর্ণ করে ও সারাটা রাত ওই স্টাডিরুমেই পার করে দিয়েছে। ভোর ভোর হয়ে এলেই মোহরের চোখ দু’টো লেগেছে, তাই ঘুম ভাঙতে এতো দেরী।

এক প্রকার পারাপারী করেই মোহর মিনিট দশেকের মধ্যে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো। ওয়াশরুমে আগে থেকেই তোয়ালে আর একটা সবুজ রঙের লঙ ড্রেস রাখা ছিল। মোহর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সাঞ্জে তখনও বসে, ম্যাগাজিন জাতীয় কিছু একটা পড়ছে। মেয়েটার পরনে মেরুন রঙের কুর্তি আর সাদা রঙের গ্যাবাডিন প্যান্ট।
তৈরি হয়েছে আজ সকাল করে, একটু আগে যেন বলল কোথাও বেরোবে। তবে সেদিকে মাথা না দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সাঞ্জেকে উদ্দেশ্য করে বলল

– ওয়াশরুমে কি তুমি আমার জামা কাপড় রেখেছিলে সাঞ্জে?

ম্যাগাজিন থেকে ব্যস্ত মুখটা তুলে তাকালো সাঞ্জে। ভ্রুকুটি করে বলল

– কই না তো।

মোহর চিরুনি নামিয়ে পেছনে ঘুরে বলল

– আমিও তো রাখিনি। তোয়ালে, ড্রেস দুটোই রাখা ছিল তো!

– ওহ, দাভাই রেখেছে মনে হয়। আমাকেই তো বলল তোমার নাকি ঘুম ভাঙতে দেরী হবে হয়তো তাই ডেকে দিতে।

বলে আবারও পত্রিকার ন্যায় কাগজের পৃষ্ঠাগুলোতে মুখ গুঁজলো। মোহর খানিক থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সাঞ্জের কথা শুনে, একরাশ হীম হাওয়া বইয়ে দিল ঘাড়, পিঠ জুড়ে।
মানুষটা সকালে এসে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেছে, মোহরের উঠতে দেরী হবে বলে জামা কাপড় টাও নিজ দ্বায়িত্বে ওয়াশরুমে রেখে গেছে, ঘুম ভাঙাতেও সাঞ্জেকে পাঠিয়েছে। সব গুলো কাজই খুব নিখুঁত ভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে পরোক্ষপদ্ধতিতে সেরেছে,অথচ কতটা যত্ন দিয়ে। শুধুমাত্র মোহরকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনা বলে!

মোহরের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, শ্রীতমার বলা কিছু কথা এখন স্ফুলিঙ্গের ন্যায় কানের পর্দায় ঝনঝনিয়ে বাজছে, অবচেতন মস্তিষ্কে কিছু একটা নিমিষেই ছেয়ে যাচ্ছে।

.

তিয়াসা বেশ কিছুক্ষণ ধরে থ মেরে বসে আছে। হাতের শুকনো টোস্ট আঙুলের চাপে মুচড়ে চুরচুর করে প্লেটের উপরে ঝরে পড়ছে। অথচ সেদিকে কোনো ধ্যান ই নেই ওর। জলন্ত চোখের ক্ষুব্ধ হিংসাত্মক দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকিয়ে আছে শুধু মেহরাজের দিকে।

– তিয়াসা, খাচ্ছো না কেন? সেই কখন থেকে একটা টোস্ট হাতে বসে আছো, খাবার ভালো লাগেনি? অন্যকিছু করে দেবো?

আম্বি খাতুন কাজ করতে করতে ব্যস্ত স্বরে কথা গুলো বলল, তিয়াসা সম্বিত ফিরে পেয়েও যেন পেলো নাহ, আধো ধ্যানে আনমনা হয়ে বলল

– না না, আন্টি। সব ঠিকাছে, খাচ্ছি আমি।

আম্বি খাতুন সরে গেলেও সরলো না তিয়াসার নজর। বেহায়ার মতো চেয়ে আছে জলপাই সবুজ রঙের একটা শার্টের সাথে পিচ ব্ল্যকের মিশ্রনের ফরমাল স্যুট পরিহিত সুপুরুষটির দিকে।
প্রায় আধঘন্টা ধরে টেবিলে বসে আছে, অথচ একটা বারও তিয়াসার দিকে তাকাইনি,যেখানে তিয়াসা এক মুহুর্তের জন্যেও চোখ সরাতে পারতে নাহ।
আপাদমস্তক আকর্ষণীয় একটা পুরুষ,যার কথাবার্তা অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টি, চোখ, মুখ,ঠোঁট সবকিছুই মারাত্নক।এর থেকে চোখ ফেরানো দায়। তিয়াসা আরো একবার ঘড়ির দিকে তাকালো,ঠিকঠাক নয়টা বিয়াল্লিশ বাজে অথচ মেহরাজের বেরোতে নয়টা ছাড়িয়ে নয়টা পাঁচে যায়না ঘড়ির কাটা।

– তুমি কি কারো জন্যে অপেক্ষা করছো রাজ? অনেক বেজে গেছে এখনো অফিসে যাচ্ছো না যে!

– হ্যাঁ

ছোট্ট একটা জবাব,অথচ দৃষ্টির নড়চড় হলো নাহ। তিয়াসা আরও কিছু বলতে যাবে তখনি মেহরাজ সিড়ির দিকে তাকানোর জন্য বাঁ দিকে ঘাড় কাৎ করলে দুটো লালাভ রেখার ন্যায় দাগ দেখতে পেলো ঘাড়ে। তৎক্ষনাৎ ভ্রুদ্বয় কুচকে এলো তিয়াসার ব্যপকভাবে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো নখের আঁচ’ড়। ফর্সা ঘাড়ে দগদগে ক্ষতের ন্যায় স্পষ্ট নজর কাড়াচ্ছে দাগ দুটো। স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলো চোখ দু’টো। কোনো ঘটনার কাঠকাঠ লক্ষণ দেখে জ্বলে উঠলো ওর শরীর। বেশ কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করলো

– তোমার গলায় আঁচড়ের দাগ কিসের রাজ?

মেহরাজ খানিকের জন্য স্থিত হলো যেন, তবে তার স্থায়িত্ব নিতান্তই ক্ষণকাল। তিয়াসা জবাবের অপেক্ষা না করেই আবারও বলল

– বউ পেয়ে এতো কিছু? এখন তার দেওয়া আঁচড়ের দাগ ও ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছো? কই আমাকে তো কখনো ধরতে দাওনি, যেন আমি ছুঁয়ে দিলে তোমার ফোসকা পরে যায়!

বেশ জোরেসোরেই বলল তিয়াসা কথাগুলো। মেহরাজ চোখ তুলে ভীষণ শান্ত নজরে তাকালো তিয়াসার দিকে। মোহর সবেমাত্র সিড়িতে পা দিয়েছে নামতে, তখনি কানে এলো মেহরাজের অতীব শান্তস্বরের স্বীকারোক্তি

– বউটা যেহেতু আমার, তাই তার দেওয়া আঁচর,ঘা সবটাই আমার। একে আমি ঘাড়ে করে কেন আমার ব্যক্তিত্ব জুড়েও বয়ে বেড়াতে পারি। এর কৈফিয়ত কাওকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিনা। আর কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করার আগে যে পারমিশন বা ম্যানারস্ দরকার এতটুকুও জানো না অথচ তুমি কি না ডক্টর হয়েছো?

জলন্ত অগ্নির ন্যায় জ্বলে উঠলো দুচোখ তিয়াসার। মেহরাজের শরীরে অন্য কারো স্পর্শের দাগ, আর বউকে ঘিরে ওকে অপমান সূচক কথাগুলোতে ওর দেমাগে লাগলো। খিটখিট করে বলে উঠলো

– দুদিন বিয়ে করে এতো বউ বউ করো কেন? আমার সাথে যে চার বছর ছিলে? তোমার জন্যে যে সারাটা জীবন অপেক্ষা করে গেলাম সে বেলায়? নাকি এখন আমাকে পছন্দ হয়না নতুন কাওকে পেয়ে, স্বাদ মিটে গেছে!

মেহরাজ শান্ত চোখে তাকিয়েও হিংস্রাত্মক হয়ে উঠলো। পেপারটা হাতের করপুটে মুচড়ে ধরে বলল

– আমি ভদ্রভাবে আছি বলে ভেবোনা এভাবেই থাকবো। আমাকে ঠিক চেনা আছে তোমার। মুখ খুলতে বাধ্য করো না তিয়াসা, তুমি কি করেছো আর কি করছো কোনো টাই কিন্তু আমার অজানা নয়। আর লাস্ট বারের মতো বলছি তোমার ওই নোংরা মুখটার ব্যবহার আমার সামনে করবে না, আমায় এমন কিছু করতে বাধ্য কোরো না যাতে পরবর্তীতে ওই মুখের ব্যবহার করতেও তিনবার ভাবতে হয়।

বলেই চট করে উঠে দাঁড়ালো। মোহর থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকেই চারিপাশে চোখ বুলালো। আপাতত ড্রয়িং রুমে কেও নেই। ভাগ্যিই সাঞ্জে ওর ফোনটা আনতে ঘরে গেছিলো। তা না হলে হয়তো এসব..

– ভাবী এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন চলো?

সাঞ্জের উচ্চবাক্যে উপস্থিত তিনজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মোহর অপ্রস্তুত চিত্তে কিছু বলবে তার আগেই মেহরাজ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাইরের দিকে যেতে যেতে বলল

– তাড়াতাড়ি আই সাঞ্জে, দেরী হচ্ছে আমার।

সাঞ্জেও আর অপেক্ষা করলো নাহ। মোহরের হাত ধরে নেমে এসে দ্রুতপায়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলো। মোহর নিশ্চুপ ভাবে ড্রয়িং রুমটা পেরিয়ে এসে দরজার সামনে যাওয়ার সময় সন্তপর্ণে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তিয়াসার দিকে, মোহরের সরু চোখের চাহনি তিয়াসার ভেতরের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলো, ধপধপ করে জ্বলে উঠলো ওর হিংসাত্মক চাহনি।

_____________________

মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে গেইট পেরোতেই থমকে গেলো মোহরের পা দুটো। শ্রীতমা মোহরের হুট করে দাঁড়িয়ে পড়া দেখে বলল

– কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লি যে!

মোহর মুখে কিছু না বললেও ভ্রুদুটো কিঞ্চিৎ উঁচু করে সামনে ইশারা করে তাকালে শ্রীতমা সেদিকে তাকিয়ে চুপ বনে গেলো। কুচকুচে কালো দামী গাড়িটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চশমা আর মাস্ক আবৃত চোখ মুখ দু’টো স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যে সেটা ব্যগ্র হয়ে মোহরের অপেক্ষায় ওর দিকেই আঁটকে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো নাহ।
আর সে চাহনিটাই কোনো শব্দহীনা বুঝিয়ে দিলো ভীষণ লম্বা চওড়া, সৌষ্ঠব, গৌড় বর্ণের লোকটি তার বান্ধবীর স্বামী। শ্রী আড়চোখে মোহরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে যেতে বলল, মোহর ভ্রু কুচকালে ও ফিসফিসিয়ে বলল

– একদম উতপাত করবিনা, যাহ চুপচাপ। এমনিতেও অরুনাভ আসবে আমি গেলাম

বলে পাশের গলির ফাঁক দিয়ে সুরুত করে ঢুকে গেলো। মোহর জড়তা, আড়ষ্টতা নিয়েই গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে দাঁড়ালো মানুষটার সামনে। এক’হাতে কাঁধের ব্যগটি মুঠিতে শক্ত করে ধরলো। অবিলম্বেই গাড়ির দরজা টা খুলে দিয়ে ভেতরে বসতে ইশারা করলো মেহরাজ, মোহর মাথাভর্তি দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই ঢুকে বসলো ফ্রন্ট সীটে।
এতদিন শুধু ড্রপ করে দিয়ে যেত, ফেরার পথে হয় বাড়ির ড্রাইভার এসেছে নয় অভিমন্যু নিয়ে গেছে। আজ মেহরাজের এভাবে তোড়জোড় করে আসার হেতু বোধগম্য হলো নাহ। তবুও সকৌতূহলে জর্জরিত মনটা স্থির রাখার চেষ্টায় চুপচাপ বসে রইল। মেহরাজ এসে গাড়িতে বসেই উইন্ডো গ্লাস তুলে দিয়ে মুখের মাস্কটা খুলে ফেলল। মোহর জিহ্বা ঠেলে ধীর গলায় বলল

– মাস্ক পড়েছিলেন কেনো?

মেহরাজ স্কেলেটরে পায়ের চাপ দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে ঘাড় কাৎ করে মুহুর্তের জন্যে মোহরের দিকে তাকালো, আবারও চশমায় ঢাকা চোখ দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল

– কারণ আপনি বাদে পুরো শহরটাই চেনে আপনার স্বামীকে।

মোহর চুপ করে গেলো। এ বিষয়টা নিয়ে ও নিজেও লজ্জায় পড়েছে বার কয়েক। যেখানে মেহরাজের ব্যবসায়ীক খ্যাতি আর পারিবারিক পরিচয়ে পুরো শহর ওকে চেনে সেখানে মোহর কখনো ওর নামটাই শোনেনি।
বেশ কিয়ৎকাল চুপ থাকলেও বাইরের অচেনা দৃশ্যে ললাটে ভাঁজ পরলো।
মোহর ভেবেছিল মেহরাজ হয়তো ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই অজানা অচেনা একটা রাস্তা। এদিকে কেনো নিয়ে যাচ্ছে ওকে মেহরাজ, বিচলিত মনে বিব্রত গলায় বলল

– এটা কোন রাস্তা? কোথায় যাচ্ছি?

মেহরাজের মুখাবয়বের কোনো পরিবর্তন হলো না। যেন আগে থেকেই অবগত ছিলো এরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে বলে।

– ভয় পাচ্ছেন মোহ?

মেহরাজের দায়সারা ভাবটা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলো মোহরের মনে। এভাবে উত্তরটা এড়িয়ে কেনো যাচ্ছে লোকটা!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল

– কোথায় যাচ্ছি জানতে পারিনা?

– নাহ, ইট’স সারপ্রাইজ।
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩০
#হুমাইরা_হাসান

চোখ বয়ে দুফোঁটা অশ্রু কখন নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো মোহর নূন্যতম আঁচ করতে পারলো নাহ। স্তব্ধ, স্তম্ভিত, বিহ্বলিত মুখাবয়বে স্পষ্টত ভেসে উঠেছে পীড়ন আর মর্মবেদনার ছাপ। ঠিক কতটা, ঠিক কিভাবে প্রকাশ করলে মোহর বোঝাতে পারবে ওর বুকের ভেতরে কোনো দহন চলছে, ঠিক কোন ভাষায় বললে বোঝানো যাবে কতটা ভেঙে পড়েছে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে।
গাড়িটা যখন এখানে এসে থামালো মেহরাজ, মোহর তখনও বুঝতে পারেনি এতো বড়ো একটা চমক ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। মেহরাজ সারপ্রাইজ বলে এভাবে ঝলকে দেবে মোহর কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি।

এতদিনে নিজেকে একটু একটু করে বুঝিয়ে নেওয়া, সামলে নেওয়, গুছিয়ে নেওয়া সত্ত্বা টা যেনো ক্রমশই চুরচুর করে দিলো সামনের ব্যক্তি।
এক লহমা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না মোহর। নিগূঢ় অভিমান, অভিযোগ, সকল ব্যথা ভুলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জনমানবহীন জায়গাটার পরিবেশ টাও যেন হাহাকারে বুদ হলো মোহরের করুনাময়ী কান্নায়।

– তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই রে। আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। আমি কিভাবে তোকে ভুল বুঝলাম। তোর উপরে ওমন জঘন্য একটা অপবাদ দিতে পারলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোর এই নিষ্ঠুর বোনকে ক্ষমা করে দিস পুতুল।

মিথিলা ভেবেছিলো নিজের করা জঘন্যতম ভুলটার কারণে হয়তো আর মুখ ফিরে পাবে না , আদরের বোনটাকে চিরতরে হারাবে স্নেহের ছায়াতল থেকে, ভেবেছিল এই অপরাধী মুখটা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, মোহর মুখ ফিরিয়ে নিবে, সেদিনের অপমান দুর্ব্যবহার মনে গেঁথে রেখে সিটিয়ে নেবে মুখ।
কিন্তু এভাবে সব ভুলে এসে বুকের মাঝে আঁছড়ে পড়বে এটা ভাবেনি, নিজেকে নিষ্ঠুরতম, নিচুস্তরের অপরাধী মনে হচ্ছে এখন মিথিলার। আদরের বোনটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথায় পরপর দুইবার স্নেহের পরশ মিশিয়ে বলল

– আমি কি করবো বল, কি করলে প্রায়শ্চিত্ত হবে আমার। আমি পাপ করেছি রে, এই পাপের ক্ষমা আমার নেই। আমি তোকে ভুল বুঝে সবার সামনে অপমান করেছি গায়ে হাত তু’লেছি,বের করে দিয়েছি। মায়ের শেষ যাত্রা টাও চোখ ভরে দেখতে দেইনি। কি করে আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো বোন, কি করলে আমি ক্ষমার যোগ্য হবো বলে দে আমায়।

মোহর অশ্রুসিক্ত মুখটা তুলে তাকালো, রক্তাভ চোখে বোনের দুহাত ধরে বলল

– এভাবে ক্ষমা চাস না বুবু, আমার তোর উপর কোনো রাগ নেই। আমি জানি ওই সময় তোর উপরে কোন ঝড় চলছিলো। আমারই দোষ সেদিন যদি আমি বাইরে না যেতাম নাইবা এতকিছু হতো নাইবা মা এতো কষ্ট পেয়ে চলে যেতো। শেষ মুহূর্তে মায়ের পাশে কেও ছিলো না বুবু কেও না, কতটা না কষ্ট পেয়ে মায়ের দম বন্ধ হয়েছে। তোরাই ঠিক ছিলি আমি থাকলে তো এমন হতো না মা ও আমাদের সাথেই থাকতো।

নোনাপানিতে আনন ভিজে জবজবে, কান্নার দাপটে হিচকি উঠে আসছে, গলার ভেতরে শব্দ গুলো কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। অবিরাম অশ্রুধারায় চোখ দুটি রক্তাভের ন্যায় পরিণত হয়েছে। এতগুলো দিন, ঠিক কতগুলো দিন পরে প্রাণপ্রিয় মানুষটাকে দেখতে পেলো। বুবু মোহরের আদরের আশ্রয়াস্তল, আর মোহর হলো মিথিলার চোখের মণি ওর পুতুল। পরিস্থিতি সাপেক্ষে বাবার পরেই মাকে হারিয়েই মানসিক বিকৃতি ঘটেছিল মিথিলার , সেদিন বাড়ি এসে মায়ের ম’রা মুখটা দেখে এতো বড়ো ধাক্কা পেয়েছিল যে কষ্ট আঘাত গুলো ক্ষোভ হয়ে উপড়ে পড়েছিল মোহরের উপরে।

– এভাবে বলিস নাহ। মায়ের শরীর যে লাস্ট স্টেজে ছিল তা তো ফায়াজ অনেক আগেই বলেছিল, তুই তো তবুও নিজের সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছিস মাকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু নিয়তি তো তা চাইনি। প্রকৃতির নিয়মে সাঁয় দিয়ে মা চলে গেছে, এতে তোর তো ভুল নেই। ভুল তো আমার। আমার যখন ছাঁয়া হয়ে তোর পাশে থেকে আগলে রাখার কথা ছিল আমি অমা’নুষিক ব্যবহার করে তোকে তাড়িয়ে দিয়েছি।

মোহরের দুই চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল মিথিলা। আজ মাস ধরে অপরাধ, গ্লাণি, দুঃখবোধে জর্জরিত অন্তঃসত্ত্বা কুরে কুরে খাচ্ছিলো নিজেকে। সবচেয়ে আদরের স্নেহময়ী মুখটা এতদিন পর দেখলো, কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না মিথিলা। ছোট্ট বোনটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পারিয়েছে, নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে সেই বোনটাকে আজ এতগুলো দিন চোখের সামনে পাইনি। নিজের দোষে,অন্যায়ে এতটা দূরে ঠেলে দিয়েছিলো।
অসংখ্যবার মোহরের কপালে গালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করে দিলো মিথিলা। অনুরক্তির গলায় বলল

– পারলে নিজের বোনটাকে ক্ষমা করে দে পুতুল। আমি আর কখনও তোকে ভুল বুঝবো না, দূরে সরিয়ে দেবো নাহ। এবারের মতো আমায় মাফ করে দে না

– কিসব বলছিস বুবু, আমার তোর উপরে কোনো রাগ নেই। আমিতো তোকে মিস করেছি অনেক। এখনো করি, তোকে ছাড়া যে আমার চলে না তুই কি জানিস নাহ। কখনো রাগ করে থাকতে পেরেছি আমি!

মিথিলা কান্নার মাঝেও হেসে দিলো। দু’হাতে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরলো মোহরকে। চুলের মাঝে হাত রেখে পরম স্নেহে বুলিয়ে দিলো। ঠিক কতটা আনন্দ, প্রশান্তি লাগছে সেটার পরিমাপ হয়তো ও নিজেও করতে পারবে নাহ। বুকের উপরের সবচেয়ে ভারী বোঝা টা যেন নেমে গেলো। মোহরকে বুক থেকে তুলে পাশে তাকাতেই চোখ গেলো কড়ই গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষ টির দিকে।
মিথিলা বুঝতে পারলো না ঠিক কোন শব্দন্তরে ধন্যবাদ জানাবে, কোন পদ্ধতিতে শুকরিয়া করলে পরিপূর্ণ ভাবে কৃতজ্ঞতা টুকু প্রকাশ করতে পারবে। নিজের চরম দুর্ভোগের ন্যায় বিষণ্ণ সময়ে একফালি আনন্দ প্রশান্তির টুকরো এনে দিয়েছে মেহরাজ ওকে।
মোহর কে ছেড়ে ও মেহরাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– ঠিক কিভাবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো আমি জানি নাহ। কিভাবে শুকরিয়া আদায় করলে তা যথাযথ হবে তা হয়তো আমার জানা নেই। শুধু এইটুকুই আমি বলতে পারবো আমি আপনার কাছে ঋণী। আজীবন, চিরকাল ঋণী-ই রইবো।

– নিজেকে আমার কাছে ঋণী করে পর করে দিচ্ছেন বুবু?

মেহরাজের মুখ থেকে বুবু নামটা শুনে মিথিলা কয়েক লহমার জন্যে হয়তো থমকে গেলো। মিথিলার অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তিটা মেহরাজের ঠাওর করতে অসুবিধা হলো না একেবারেই, মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল

– আপনি মোহের বুবু হলে আমারও তো বুবু হন তাই না? নিজের বড়ো বোন থাকলে কি তার জন্য আমার কোনো দ্বায়িত্ব থাকতো না? আমি তো শুধু সেটুকুই করেছি।

মিথিলা না চাইতেও চোখ ভরে এলো। মেহরাজকে যেন সাক্ষাৎ দূত মনে হলো। একজন রঙিন দূত যে সাতরঙা রঙে রাঙিয়ে দিতে এসেছে ওর বোনের জীবনটা, অথচ এই মানুষটাকে নিয়েই কতটা বিপরীত, জঘন্য কথা ভেবেছিল মিথিলা।

– আপনি কিভাবে আমার ঠিকানা বের করে যোগাযোগ করলেন জানি নাহ ভাই, আপনি আজ আমায় জীবনের সবচেয়ে বড়ো দায়টা পরিপূর্ণ করিয়ে দিয়েছেন। মোহরের কাছে ক্ষমা না চাইলে আমি মরেও শান্তি পেতাম নাহ। আজ যদি আপনি ওকে আমি পর্যন্ত না এনে দিতেন তাহলে আমি ওকে কখনো নিজের সামনে পেতাম নাহ, লজ্জা অপরাধবোধ নিয়েই আড়ালে কুরে কুরে শেষ হতে হতো আমার।

মেহরাজ এক পলক তাকালো মোহরের অর্ধভেজা মুখের দিকে, যার অনিমেষ চোখের দৃষ্টিটা এখন তার উপরেই নিবন্ধিত। অধর কোণে বাঁকা হাসিটা মেলে রেখেই বলল

– মোহরকে আমি জনসম্মুখে সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি। ওর দ্বায়িত্ব নিয়ে বউ রূপে যখন গ্রহণ করেছি তখন সুখ, দুঃখ সেসবের খোঁজ রাখাটাও তো আমারই দ্বায়িত্ব তাই নয় কি? বোনকে ছাড়া ও মোটেও ভালো নেই। আমি শুধু ওর মুখের হাসিটুকুই চেয়েছি। আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে লজ্জিত করবেন নাহ।

মোহর অনড়,স্থির রূপে চেয়ে রইলো মেহরাজের মুখের দিকে। বিমুগ্ধতা, ভালোলাগা, অদ্ভুত আলোড়নে ছেয়ে গেলো অন্তঃস্থল।
এই মানুষটা কি করে ওর মনের অবস্থা বুঝলো? কি করে ওর ভেতরটা শুভ্র কাগজের মতো পড়ে ফেলে ম্যাজিকের মতো মনের সুপ্ত খায়েশ টুকু পরিপূর্ণ করে দিলো? দক্ষিণা বাতাসের ন্যায় চাঞ্চল্যকর নির্মল একটা আবেশ ছুঁয়ে গেল মোহরের অন্তরস্থ। যা ওকে মুখস্থ পাঠের ন্যায় বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মানুষটা কি,কেমন কিচ্ছু জানে না ও! শুধু এইটুকুই যানে যে মানুষটা ক্ষণে ক্ষণে, প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সমস্ত ব্যবহার কথাবার্তা, আচরণ দিয়ে মোহরের মনে তীক্ষ্ণ তীর গেঁ’থে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে মোহরের সমস্ত জীবনটুকু ওই মেহরাজ নামক ব্যক্তিটির পরশে মিইয়ে পড়ছে। খুইয়ে পড়ছে সমস্ত আত্মকাহিনী, অন্তঃসত্ত্বা। শুধু এই একটা মানুষ, তার চেহারা, তার ঘ্রাণ শরীরে প্রতিটি শিরা উপশিরা দিয়ে বাহিত হয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, অত্যাধিক সুদর্শন চেহারার মতোই সুদর্শন আবহে পুরো অন্তর টাই মেহরাজময় হয়ে পড়ছে, চক্ষে চক্ষে তৃষ্ণার মারণসম গুণের ন্যায় বর্ণসঙ্করিত হচ্ছে মেহরাজ, মেহরাজ আর মেহরাজ-ই।

প্রায় ঘন্টা খানেক সময় অতিবাহিত করে গাড়িতে উঠে বসলো মোহর। ফুলে থাকা চোখ দু’টো আবারও অশ্রু ফোয়ারাতে টসটসে রক্তাভ প্রলেপ মেখে গেল। এতটা সময় বুবুর সাথে থেকেও এখন বিদায় জানাতে মন চাইনা। কিন্তু কিছুই করার নেই। ফিরতে তো হবেই, সেই সুদূর গ্রাম থেকে এসেছে একা শুধুমাত্র বোনের সাথে দেখা করতে।

মোহর জানতে পারলো মিথিলা তার স্বামী সংসার সমেত বেশ কিছুদিন ধরেই ওর শ্বশুড়বাড়িতে আছে। বাচ্চাটার শরীর খুব একটা ভালো না। মিথিলা নিজেও যে সুস্থ নয় তা ওর ফ্যকাসে পান্ডুর চেহারা দেখেই মোহর বুঝেছে। কিন্তু কারণ জিজ্ঞাসা করলে মিথিলা খুব সূক্ষ্ম ভাবেই এড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে বলেই মন না চাইলেও বাসে উঠে গেল মিথিলা। বাসে উঠে তা ছেড়ে দেওয়ার পর চোখের সামনে থেকে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্তই দাঁড়িয়ে ছিল মোহর, এতটা দিন পর বুবুর দেখা পেয়ে আবারও দূরে সরে যাওয়ায় ঠিক কতটা কষ্ট লাগছে তা হয়তো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নাহ। যাওয়ার সময় মোহরের হাতে একটা র‍্যাপিং করা বেশ ভারী বর্গাকৃতির একটা বস্তু ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘এটা তোত জন্যে, বাড়ি গিয়ে খুলে দেখিস’

মেহরাজ গাড়িতে বসেই স্টার্ট দিলো। বেলা ডুবতে শুরু করেছে প্রায়। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো। বাড়ি থেকে এই জায়গা টা বেশ দূরবর্তী, তাই অবিলম্বেই দ্রুতবেগে টেনে নিলো চার চাকার গাড়িটি।
শব্দশূন্য গাড়িটির নিস্তব্ধতায় শুধু থেকে থেকে মোহরের ফোঁপানির আওয়াজ টাই কানে আসছে। মেহরাজ স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বার দুয়েক তাকালো মোহরের দিকে, কোলের উপরে মিথিলার দেওয়ার উপহার টা ধরে মাথা নামিয়ে বসে আছে।
একহাতে টিস্যুবক্স থেকে দুটো বের করে মোহরের সামনে ধরলো। ফলাফল শূন্য, মোহর আজ হয়তো ঠিকই করে রেখেছে শুধু কাঁদবেই। এসে থেকে কেঁদে যাচ্ছে, ওকে কাঁদতে দেখতে চাইনা বলেই এতো কিছু করলো আর সেই কিনা বন্যা বইয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। মেহরাজের ভ্রু কুচকে এলো, মনে মনে রুষ্ট ও হয়েছে হয়তো, সামনের দিকে তাকিয়েই ভরাট গলায় রসকষহীন ভাবে বলল

– কাঁদতে কাঁদতে চোখ, ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলেছেন মোহ, ওটা যে ছুঁয়ে দেখতে মন চাইবে না সেই গ্যারান্টি কিন্তু আমি দিতে পারছি না।

ধপ করে কান্না থামিকে ঘুরে তাকালো মোহর। হতবুদ্ধির ন্যায় খানিক চেয়ে রইলো৷ চোখ মুখের অভিব্যক্তি ধপ করে বুঝে যাওয়া মোমবাতির মতো ভোঁতা। মেহরাজের কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পাক্কা দুই মিনিট লেগে গেলো ওর।
ঠিক এই মুহূর্তে, ওর পাশে বসে মেহরাজ এরূপ কথাও বলতে পারে তা ওর কল্পনাতীত ছিল। মোহরের গ্রস্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ভীষণ নরম স্পর্শে ওর ডান হাতটা নিজের বাঁহাতের মুঠোয় পুরে নিলো মেহরাজ। উদ্বেগ ভরা চোখে শানিত স্বরে বলল

– কাঁদবেন না মোহ। আপনার চোখে আর এক ফোঁটা পানিও দেখতে চাইনা আমি, এতকিছু করার বদলে এক টুকরো হাসিও কি আমি ডিজার্ভ করিনা? তা না হলে চোখের পানি থামাতে আমি অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করবো যেটার জন্যে হয়তো আপনি এখন মোটেও প্রস্তুত নন।

মেহরাজের কথার প্রথম তিন লাইনে আবিষ্টরকম হলেও শেষোক্ত বাক্য দুটি কান ঝিনঝিন করে তুললো মোহরের, কান্না থামিয়ে নীরব স্থির মাথা ঝুকিয়ে নিলো। এই কথাটির পৃষ্ঠে কোনো উত্তর হয় কি না ওর জানা নেই, তবে এর মর্মার্থ টুকু ওকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য একটু বেশিই যথেষ্ট হয়তো।
মোহরের নতজানু মুখটা দেখেও হয়তো ক্ষান্ত হলো না মেহরাজের চুপসানো মনটা। আদ্র জবানের স্পর্শে ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে নিলো। নিরতিশয় আলতো স্পর্শে মোহরের কাঁধে হাত চেপে ওকে নিজের কাছে সরিয়ে আনলো, নিজের বুকের কাছে সঞ্চাপিত করে মাথা টা আগলে রাখলো মোহরের, নিমগ্ন গলায় বলল

– আপনার চোখে আমি তখনই অশ্রু সহ্য করবো যখন তা আনন্দের হবে। আর কখনো কাঁদবেনা না মোহ, আপনি কাঁদলে আমার কোনো একটা লুকায়িত জাগায় খুব কষ্ট হয়,যন্ত্রণা হয়। একটা বার শুধু মুখ ফুটে বলবেন কি চাই আপনার, আমি মেহরাজ আমার সবটুকু এনে হাজির করবো আপনার সামনে। তবুও কাঁদবেন না মোহ এটা আপনার কাছে আমার প্রথম অনুরোধ।

জবাবে নিরুত্তর রইলো মোহর। নাইবা একচুল নড়ার চেষ্টা করলো। নিষ্প্রভ, অক্লিষ্ট হয়ে পড়ে রইলো মেহরাজের বুকের সাথে। চোখ বুঁজে শুধু হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন টাই শুনতে থাকলো, তার সাথে কানে বেজে উঠলো বাসে উঠার সময় মিথিলার বলা কথা গুলো

” খুব ভাগ্য করে এমন একটা মানুষ পেয়েছিস পুতুল, তোকে ঠিক পুতুলের মতই আগলে রাখবে দেখিস। তোদের মাঝে সম্পর্কটা ঠিক কেমন আমি জানি না, তবে মানুষটা তোকে ভীষণ যত্ন করে ভালোবাসে, ওর চোখ দুটোই বলে দেয় তুই ঠিক কতখানি ওর জন্যা। আগলে রাখিস, এমন মানুষ হারাতে নেই ”

_________________________

– ভাবী বলছি দেখো না এই জামাটা কেমন লাগবে?

কথাটি বলে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা ভারী পুথির কাজ করা গাউন টা গায়ের সাথে মেলে ধরলো সাঞ্জে। মোহর তাকিয়ে অবিচলিত গলায় বলল

– খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে

– ধ্যাত্ আমি যেইটা ধরছি সেটাতেই তো একই কথা বলছো তুমি, বুঝবো কি করে

– কারণ তোমাকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে সাঞ্জে

মোহরের সুমিষ্ট কথাটিতেও মনটা শান্ত হলো না সাঞ্জের। এক এক করে জামার পাহার তুলে ফেলেছে সোফার উপরে। সকালে মোহরকে ড্রপ করে সাঞ্জে কে নিয়ে শপিংমলে গিয়েছিল মেহরাজ। কাল বাদে পরশু সাঞ্জের জন্মদিন, বড়োলোক বাড়ির মেয়ে অবশ্যই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই সেলিব্রেশন করবে। তার জন্যেই এতো কেনাকাটা। বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্যেই জামাকাপড় এনেছে। সেটাই এক এক করে দেখাচ্ছে আর এলোমেলো করছে সাঞ্জে।

– এসব কি করছিস বল তো? রাত কতো হলো সে খেয়াল আছে, এগুলো তো কাল ও দেখানো যায়।

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলল তাথই। সাঞ্জে জোর করেই বসিয়ে রেখেছে জামা দেখাবে বলে। কিন্তু না ওর কোনোটা ঠিকঠাক পছন্দ হচ্ছে আর নাইবা কাওকে উঠতে দিচ্ছে।
খুঁজতে খুঁজতে হুট করেই সোনালী রঙের একটা ভারী ব্যাগ বের করলো। ভেতর থেকে হালকা গোলাপি রঙের জরজেটের নজরকাড়া একটা শাড়ি বের করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল

– এই পেয়েছি! ভাবী এই দেখো এটা তোমার জন্যে নিয়েছি। কি সুন্দর তাই না, কি যে মানাবে তোমাকে!

বলে শাড়িটা টান করলো। হালকা রঙের উপর ভারী কাজ করা শাড়িটি আসলেই ভীষণ নজরকাড়া। যে কেও পছন্দ করবে। মোহর শাড়িটির ধরতে হাত বাড়ালেই হুট করে এক টানে সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল

– ওয়াও, সো প্রিটি! এই শাড়িটা না আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে সাঞ্জে, আমার ওরেঞ্জ কালার টা তুমি রেখে দাও, এটা আমি নেই হ্যাঁ?

বলেই নিজের গায়ে শাড়িটা মেলে ধরলো তিয়াসা। উপস্থিত চোখ জোড়া সব ওর দিকেই বিব্রতভাবে তাকিয়ে। সাঞ্জে অপ্রসন্ন গলায় বলল

– এই শাড়িটা আমার না আপু, এটা ভাবীর জন্যে কেনা।

তিয়াসা হাস্যজ্বল মুখটা ছোট করে মোহরের দিকে তাকালো। মেকি দুঃখিত হওয়ার ভান করে বলল

– ও, তোমার। তাইলে আর কি। নাও দিয়ে দিলাম

বলে শাড়িটা মোহরের কোলের উপরে রেখে দিয়ে সরে যেতে নিলে মোহর ওকে পেছন থেকে ডেকে বলল

– দাঁড়াও আপু। শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে তুমিই রেখে দাও। তুমি তো এ বাড়ির মেহমান, তোমার পছন্দ হয়েছে আর ওটা আমি নিয়ে নিলে হয়! এমনিতেও শাড়ি খুব একটা পরিনা আমি। এটা বরং আমি তোমাকেই গিফট করলাম এই বাড়ির পক্ষ থেকে

বলে ভীষণ হাসিমুখে তিয়াসার হাতে শাড়িটা ধরিয়ে দিল। মোহরের সূক্ষ্ম কথার ভাঁজে তিয়াসাকে নিজের অবস্থা টা বুঝিয়ে দেওয়া উপস্থিত কারোই ই বুঝতে অসুবিধা হলো নাহ। তাথই ও মোহরের সুর ধরে বলল

– মোহর যখন ভালোবেসে দিচ্ছে রেখে দাও। এমনিতেও তো তুমি এটাই পছন্দ করেছো।

তাথইয়ের সাথে সাঞ্জেও তাল মিলিয়ে বলল। অগত্যা উপায়হীন হয়ে তিয়াসা মেকি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে গটগট করে প্রস্থান করলো ওখান থেকে।
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে