ফানাহ্ পর্ব-২৫+২৬

0
1273

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৫
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান

সূর্যের মনোরম নরম রোদ্দুর, বাবুই পাখির কলকলানি, বৃষ্টি ফোঁটার উপর উপচে পড়া রোশনাইয়ে মুক্তোর ন্যায় ঝিলিক। প্রাসাদতুল্য বাড়িটার থেকে মিটার খানের দূরত্বে হৃদের ঢেউগুলো বাতাসের ছলকানিতে ছোঁয়াছুঁয়ির অসম খেলায় মেতেছে।
সুবহে সাদিকের প্রহর পেরিয়ে বেলা হওয়ার সাথে সাথে চাঞ্চল্যে মেতে ওঠে আড়মোড়া ভাঙা পরিবেশ। খুব ভোরে ঝরে পড়া শিউলি গুলোতেও মরিচার ন্যায় রঙ ধরতে শুরু করেছে।

ঘরটার মাঝে এসির শৈথিল্যের স্পর্শ কাটা দিচ্ছে শরীরে, বারান্দার স্লাইডিং ডোর ভেদ করে এলোপাতাড়ি তীর্যক আলো গুলো উপরে পরছে ঝকঝকে ফকফকে টাইলসে। প্রকৃতির এরূপ উন্মত্ত সৌন্দর্য, নতুনত্বের অবগাহন, সুসজ্জিত তটস্থ রূপ সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে প্রেমিকের নির্জীব, নিস্তেজ দৃষ্টি বিমোহিত তার প্রিয়তমার চোখে, মুখে,ঠোঁটে, সব খানে।
পদ্মলোচন দুটি আঁখি, কিশলয়ের মতো কোমল দুটি অধর। দুধে আলতা গায়ের রঙ ছাড়াও যে কারো গড়ন এতোটা আকর্ষণীর হয় তা মেহরাজের জানা ছিল না। আসলেই কি এতটা দৃষ্টিনান্দনিক! নাকি ওর চক্ষের ভ্রম? কেন একই চেহারায় হৃদয় খানা বারবার আত্মভোলা হয়ে যায়। এই রূপ, এই চেহারাতে তাকিয়ে যেন জন্ম জন্মান্তর পার করে দেওয়া যায়! আখিপল্লবের পাতলা আবরণে অসংখ্য বার ওষ্ঠ ছুঁয়ে ভুলে যাওয়া যায় এক জীবনের দুঃশ্চিন্তা, পরাজয়, গ্লাণি।

এক হাত তুলে লম্বা আঙুলের স্পর্শে উষ্ণ পরশে কপাল থেকে চুল গুলো আস্তেধীরে একটা একটা করে সরিয়ে দিল মেহরাজ। এতটুকু অধিকারেই যেন মনের গহীনে সুখানলের তান্ডব শুরু হয়, প্রকৃতির ন্যায় বিশাল স্বর্গীয় তৃপ্তিতে ভরে ওঠে অন্তঃস্থল। ক্লান্ত মুখখানার দর্শনে আসক্তিতে অবচেতন হয়ে ওঠে সমস্ত কায়া। বুকের ভেতরে কোনো এক সুপ্ত, গোপন জায়গা থেকে বারংবার অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে সূক্ষ্ম শব্দের কতটি লাইন, মনে মনেও মেহরাজ অসংখ্য বার আওড়ালো

” আমার প্রিয়তমা, প্রাণসঞ্চারিকা ! আপনি আমার কোমল আলোকিত চাঁদ, মৃত্যু অবধারিত জেনেও পতঙ্গ যেভাবে ছোটে আগুনের পানে, তার চেয়েও অধিক পিপাসু হৃদয়ে আমি মরিয়া হয়ে ছুটি আপনার হৃদয়ের কোণে একটু জায়গা পাবার তরে। আমার এক জীবনের প্রেম, ঐশ্বর্য, স্বর্গীয় মাদকতা আমার চন্দ্রাবতী আজীবন আমৃত্যু আমি শুধুই আপনার। যদি কখনো, কোনো ভাবে, কোনো কারণে একটা বার মনে চাই শুধু একবার ডাকবেন, এই অধম শুধু তারই অপেক্ষায়। ”

নড়েচড়ে উঠলো মোহর। ঘুমেও ঘোরেই টের পেল শরীরে একটা উষ্ণ স্পর্শের পরশ। যান্ত্রিক শীতলতায় শিথিল হয়ে আসা শরীর আরেকটু ওমের লোভে সরে এলো নিকটে।
সম্পূর্ণ নিজের চেতনের অজান্তেই মেহরাজের বুকের মাঝখানে মুখ গুঁজে দিল, এক হাতে খামচে ধরলো প্রচণ্ড বেগে কম্পমান মাংশল পিণ্ডটাকে আবৃত চামড়ার উপরে। আধো অবচেতনেই শুনতে পেল প্রবল কম্পমান যন্ত্রটার ধুক ধুক শব্দ। ভ্রু কুচকে এলো ঘুমের মাঝেই।
ওর তর্যমায় বর্ণনা করলে হয়তো হার্টবিট প্রচণ্ড ফাস্ট, হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিক রেট সিক্সটি টু হান্ড্রেড কে ছাড়িয়ে হয়তো ওয়ান থার্টি পর্যন্ত ওঠেছে,যেটা মোটেও নিয়মমাফিক শমিত নয়

খানিক নড়েচড়ে হাতড়ে হাতটা এদিক ওদিক সরাতে হাতের নরম তালুতে ধারালো কিছু বিঁধলো। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে ঘুমের রেশ। অর্ধ নিমজ্জিত আঁখিযুগল একটু একটু করে খুলতেই নিজের চেয়ে মাত্র ইঞ্চি তিনেক দূরত্বে আবিষ্কার করলো শুভ্র,গৌড়বর্ণের মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন একটা চেহারা। ঘুমে ঢুলু ঢুলু লালাভ চোখের অর্ধ প্রসারিত দৃষ্টিতে একধীমে তাকিয়ে আছে তার পানে।
ধারালো চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চাহনির প্রখরতা আজ বড়ই বিলুপ্তিত, ধূসর বর্ণা চোখে যেন মোহর আজ অন্যরকম নেশা, অনুরক্তির তীব্র ছাপ দেখতে পেল । ঠিক কতক্ষণ নিষ্পলক চাহনি স্থির রইলো তা মোহরের হিসেবের বাহিরে। নিজের হাত, পা, দেহের অবস্থানটুকু উপলব্ধি করতে পারলো না অপার্থিব মায়ায় মজে।
মিনিট খানেক বাদে ধপ করে হুঁশ ফিরলো মোহরের, ভয়ার্ত সংকুচিত চাহনিতে একবার মাথা উপর নিচ করে নিজ দেহখানির অবস্থান টুকু অনুভব করতেই অদ্ভুত শিহরণ কম্পিত করে তুললো সমস্ত দেহাবয়ব। ঝিমঝিম করে কোনো একটা প্রখরত্ব অনুভূত হলো, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় ঝলসে উঠে সরে এলো মোহর।
উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ফিরে তাকালো। উঁচু বিছানার পায়ার কাছে ফ্লোরে লুটিয়ে আছে মাঝখানে রাখা বালিশ দুটি। বালিশ দুটির অবস্থান তার দিকেই তার মানে নিশ্চয় ও নিজেই ফেলে দিয়েছে ঘুমের ঘোরে, তবুও অস্বস্তির গলায় খানিক তেজ মিশিয়ে বলল

– আ আপনি আমার জায়গাতে কেন এসেছিলেন? কেন ধরেছেন আমাকে?

মেহরাজের স্থৈর্য দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটলো নাহ। কনুইয়ে ভর করে উঠে বসলো। হাঁটুতে কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে তার উপর হাত রেখে ঘাড় বাকিয়ে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল

– আসলেই কি আমি ধরেছি?

উহু! মোটেও নাহ। মোহর ঘুমে বুদ হয়ে কখন নিজের মাথার অবস্থান টা বালিশ থেকে পরিবর্তন করে মেহরাজের বুকে চাপিয়েছে, নিজের চিকন আঙুলের ভারি দৃঢ়মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরেছে স্বামী নামক পুরুষটির বক্ষস্থলের বাঁ পাশের পোশাকের একাংশ সেটুকু ওর ও বোধগম্যের বাহিরে৷
নিজের ভুল টা বুঝতে পেরে হের যাওয়া হরিণীর ন্যায় টানা টানা আঁখির অবিন্যস্ত নজরে বাঁকা চাহনি দিয়ে বলল

– আমি জানি নাহ

বলে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল সশব্দে। মেহরাজ শুষ্ক অধর ছড়িয়ে অকৃত্রিম মায়াভরা এক হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বলল

– জানতে হবে নাহ, শুধু রোজ একটা বার করে বুকের মাঝে ওই হাতের অস্তিত্ব টুকু ছুঁইয়ে দিয়েন, বেহায়া মন আর কিচ্ছু চাইবে নাহ

.

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে মেহরাজ কে ঘরে না দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেলেও কেমন একটা কৌতুহল জাগলো। ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকিঝুকি দিল বারান্দার দিকে। দীর্ঘাকার লম্বাটে শরীর অবয়ব টা বারান্দায় মৃদু রোশনাইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে। ফর্সা ঘাড়ে লাল টুকটুকে ছোট্ট তিলতুল্য ছোট বিন্দুটি চোখ ধাধানোর মতো চিকচিক করছে। মোহরের মনে অদ্ভুত সব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আচ্ছা লোকটার সবকিছু এতটা নিখুঁত কি করে? নাকি কৃত্রিম? ছেলেরা কি প্রাকৃত ভাবেই এতো সুন্দর হয়! মোহরের মনে হয় আজ অব্দি মেহরাজের মতো সুদর্শন পুরুষ ও কোথাও দেখেনি। সরু, সুতনু মুখাবয়ব। ছয় ফিট্ এর অধিক উচ্চতা, কাটকাট অভ্যাসের পরিসীমা, স্ট্রেইট কাট বাচনভঙ্গি এতকিছুই কি পারফেক্ট হয়?

– আপনি চাইলে কাছ থেকেও দেখতে পারেন, চুরি করে নজরদারি করার দরকার নেই

চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো মোহর। মেহরাজ বাঁকা হেসে ডান পাশে রদ্দুরে ছায়া টার দিকে তাকিয়ে বলল

– এখানে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় জন নেই মোহ। আসতে পারেন

মোহর এ পর্যায়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। তার চেয়েও বেশি বিরক্ত। এই লোকটার কি পেছনেও দুটো চোখ আছে? বুঝলো কি করে? এখন বুঝেই যখন ফেলেছে পালিয়ে আর কি করবে। অগত্যা গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের পাশে কাঁচের রেলিং ঘেঁষে।
মেহরাজের হাতে মাঝারি সাইজের একটা সিজার। টবের ছোট ছোট গাছগুলোর নেতিয়ে যাওয়া পাতা গুলো ছেটে স্টিলের একটা ঝাঁঝরি তুলে পানি দিতে থাকলো। মোহর আশপাশে তাকিয়ে কৌতূহলী গলায় বলল

– বাগানে এতো গুলো বিদেশি ফুলের মাঝে একটা মাত্র হলুদ গোলাপ গাছ কেন?

ঝাঁঝরি টা হাত থেকে নামিয়ে একটা স্প্রে বোতল হাতে নিল, পাতায়, ফুলে স্প্রে করতে করতে বলল

– যেমন অনেকগুলো পছন্দের মাঝে একটা মাত্র প্রিয় থাকে ঠিক তেমন।

– মানে হলুদ গোলাপ আপনার প্রিয় বলছেন?

মোহরের সকৌতুক স্নিগ্ধ চেহারাটায় এবার মেহরাজ পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে তাকালো। শরতের মলিন বাতাসে তখন শিউলির নরম ঘ্রাণ, চুলগুলো উপচে উড়ছে এদিক ওদিক। খানিক যান্ত্রিক নজরে চেয়ে থেকে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করে বলল

– উহু, হলুদ গোলাপের সাথে প্রিয় একটা জিনিসের মিল খুঁজে পাই।

– গোলাপের সাথে মিল মানে?

মেহরাজের অধরে তখন রহস্যময়ী হাসির রাজত্ব। মোহরের দ্বিধাদ্বন্দে ভরা চেহারাটাকে আরেকটু বিব্রত করে দিয়ে মেহরাজ মন্থন কণ্ঠে বলল

– হ্যাঁ মিল। গোলাপের নরম পাপড়ি, সুমিষ্ট ঘ্রাণ, নির্মল রূপে কোনো একটা মানুষের সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। যেন মানুষটার প্রতিকী স্বরূপ গোলাপটাকেই শুধু মানায়

মোহরের ললাটে বিস্তর ভাঁজ পরলো। না চাইতে ভেতরে কেমন তীব্র একটা ক্ষোভ জাতীয় অনুভূতির অনুপস্থিতি টের পেল। মেহরাজ নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের কথা বলছে? তাহলে মোহরের ধারণাই সত্য? মেহরাজের কোনো প্রেমিকা ছিল? তার স্মরণেই এখনো ফুলগুলো কে তারই প্রতিকী বলছে? না চাইতেও কেমন একটা অসূয়া খলবলিয়ে উঠলো মানষিক চিত্তে।

– ওহ। আচ্ছা আসছি

বলেই সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিজের দ্বেষ টুকু স্পষ্টরূপে বুঝিয়ে দিয়েই প্রস্থান করলো। তবে মোহর কথাটা বলেও মুহূর্ত খানেক অপেক্ষা করছিল যেন মেহরাজ ওকে থামিয়ে আরও কিছু বলবে। কিন্তু মোহরের সেই প্রত্যাশায় জল ঢেলে ফুলগাছে জল ঢালতে থাকলো মেহরাজ, এমনকি প্রত্যুত্তরের বদলে একবার ঘুরেও তাকালো নাহ।কোন্দল প্রবর্তক চিত্তে গটগট পা ফেলে বেরিয়ে এলো মোহর। সকাল করেই মন মেজাজ কেমন বিগড়ে গেল। যার কোনো সুস্পষ্ট হেতু বোধগম্য হলো না ওর নিজের ও।

রেডি হয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্য নিচে নেমে এলো মোহর। এখনো ক্লাস শুরু হতে ঘন্টা সময় দেরি। কিন্তু ও ঘরে থাকার নূন্যতম ইচ্ছে করছিল না বলেই নিচে নেমে এসে কাউচে বসে রইলো।

কাকলি বেগম সোফাতে বসে তাথই এর বাচ্চা অর্থাৎ তোয়াকে কোলে করে দোলাচ্ছে। শাহারা পাশেই বসে তসবিহ গুণছে।

– অরুন এসেছিল কাল?

কথাটা তাথইয়ের উদ্দেশ্যে নিঃসৃত হলেও তাতে যে ওর কোনো রা নেই তা ওর নির্লিপ্ত ভাবে রুটি ছিড়ে মুখে পুরার অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। কাকলি বেগম হয়তো আগে থেকেই জানতেন এরূপ অভিব্যক্তিই পাবে মেয়ের কাছ থেকে, তাই বিরক্তি হীনাই পুনরাবৃত্তি করলো

– অরুন এসেছিল কাল? তোকে নিতে এসেছিল?

মৃদু ঘাড় নাড়ালো তাথই। কাকলি বেগম অবিলম্বেই আবারও জিজ্ঞাসা করলেন

– তোদের মাঝে কি হয় বল তো? কিসের এতো রেষারেষি? আমি তো অরুন ছেলেটার কোনো দোষ দেখি না। বরং ও ভদ্রছেলে বলেই তোর এতো তেজ সহ্য করেও বারবার তোকে নিতে আসে, তবুও এতো কিসের গড়িমা বল তো। নিজের বাচ্চাটাকে তো ওর ও দেখতে ইচ্ছে হয়

কাকলির কথায় মোহরের নিকট স্পষ্ট হলো যে কাল সকালে কলিং বেল বাজানো ব্যক্তিটি তাথই এর স্বামী ছিল। যাকে অরুন বলেই মন্তব্য করছে কাকলি।

– হ্যাঁ তো দেখতে তো আমি নিষেধ করিনি?

– নিষেধ করিস না বলিস ও তো না। আজ তো ছেলেটার জন্মদিন শুনলাম। অন্তত ওকে বাড়িতে ডেকে কিছু রান্না করেও তো খাওয়াতে পারিস

তাথইয়ের কথার পৃষ্ঠে আবারও বললেন কাকলি বেগম। সাঞ্জে চুপচাপ ফোন দেখছে আর খাচ্ছে। তাথই এবার বেশ বিরক্ত গলায় বলল

– ও তো কোনো বাচ্চা নয় যে পায়েস রেধে জন্মদিন পালন করবো আমি! বাড়িতে কি খাইনা? আর তুমি ইনিয়েবিনিয়ে কি বলতে চাও? আমাকে ওর বাড়িতে পাঠাতে চাও তাই তো? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো আমি আশরিয়া তাথই, এই বাড়ি আমারও। আমি যতদিন না চাই ততদিন আমাকেও কেও বের করতে পারবে না কেও না

বলে খাবারের প্লেট টা সরিয়ে দিয়ে উঠে সিড়ির দিকে গেলেই মেহরাজের সামনা-সামনি পড়লো। মেহরাজ তাথইয়ের অস্থির রক্তচক্ষু চেহারা দেখে ভ্রু কুচকালো, কৌতুহল ভরা গলায় বলল

– আশু? কি হয়েছে?

ভাইয়ের এইটুকু স্নেহপূর্ণ কথায় যেন পাথর মন তড়বড় করে গলে গেল। মিইয়ে গেল সুরত, কণ্ঠে ভার করলো হাজারো অশ্রু।
বোনের অশ্রু টলমল চোখ দেখে মেহরাজ ওর দুগালে হাত রেখে বলল

– ভাইয়া কে বল কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? কে কি বলেছে তোকে?

তাথই মেহরাজের আদরভরা কথায় নিস্তেজ হয়ে গেল। কান্না গুলো উগড়ে এসে কণ্ঠনালিতে ভর করলো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মেহরাজ বোনকে দুহাতে আগলে ধরে শান্ত চোখের ধারালো নজরে তাকালো উপস্থিত মানুষ গুলোর দিকে।
আজহার মুর্তজা ঘর থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছিলেন, এহেন দৃশ্যে তিনিও থেমে গেলেন। কাকলি বেগম মেহরাজের রুষ্ট চাহনি দেখে বলল

– তোমার বোনকে কে বা কি বলবে? ওকে কিছু বলা যায়? এতদিন হলো এ বাড়িতে এসেছে না ও বাড়িতে যায় নাইবা কারো সাথে যোগাযোগ করে, কিছু বলতে গেলে তো ঝাঝের তুবড়ি ছোটে।

মেহরাজ বুক থেকে তাথইকে তুলে ওর চোখ মুছে দিল। এক হাতে জড়িয়ে ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমের মাঝ বরাবর এগিয়ে এসে বলল

– আমার বোন যতদিন চাই যেভাবে চাই যেখানে চাই সেখানেই থাকবে। ওর যদি সারাজীবন ও এখানে থাকতে ইচ্ছে করে তবে তাই থাকবে। এ নিয়ে যেন এতো সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না তো?

আম্বি বেগম নিশ্চুপ থাকলেও মেহরাজের এরূপ কথায় সায় দিতে পারলেন নাহ। প্রতিবাদ স্বরূপ গলায় বলল

– তা বললে কি করে হয় বাবু। বোনকে বিয়ে দিয়েছি যখন ওকে তো শ্বশুড়বাড়ি থাকতেই হবে। এখানে আসতে বা থাকতে তো কেও নিষেধ করেনি। কিন্তু এভাবে কারো সাথে যোগাযোগ, সহবত, কথাবার্তা ভুলে ঘরে বসে থাকলে, রুক্ষ মেজাজ করলে কি করে হবে? দিন দিন ওর আচরণ অনেক বেশিই দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে না? ওর শ্বশুড়বাড়িতে কি জবাব দেব আমরা? ওর তো আমাদেরকে সমস্যা টা স্পষ্টভাবে জানানো উচিত

মেহরাজ তাথই কে হাত ধরে এনে খাবার টেবিলে আবারও বসালো। নিজে হাতে নতুন করে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল

– উপযুক্ত সময়ে ওর সমস্যা বা মতামত টা তো কেও স্পষ্টভাবে জানতে চাওনি? তাহলে আজ কেন?

থমকে গেল আম্বি বেগম, কাকলি বেগম ও কথার পৃষ্ঠে কিছু বলল না। আজহার এগিয়ে এসে টেবিলে বসে বলল

– আমাদের মেয়েদের মতামত তো আমরা সবসময়ই মেনে নেই। ওদের কোনো অসুবিধা তো হতে দেই না তাহলে..

– তাহলে থাক। এবার ওদের ব্যাপার টা আমায় দেখতে দাও। আপাতত আমি চাইনা তাথই কে কেও কোনো ভাবে বিরক্ত করুক। অরুনের সাথে আমি কথা বলে নেবো

বলে চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। মোহর খেয়াল করলো বাকিদের মুখে আধার নামলেও শাহারা বেগমের মুখে সন্তুষ্টির ছাপ, ওদের কথাবার্তা অনেকটাই জড়ানো পেচানো। তবে এটুকু মোহরের মস্তিষ্ক খুব সূক্ষ্ম ভাবেই ধরতে পারলো যে তাথই হয়তো ওর বৈবাহিক সম্পর্কে খুশি না বা বিয়েতে ওর মত ছিল না। এমন কিছু।

এর মাঝেই হুট করে কলিং বেলের ধাতব শব্দটা নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট শব্দ তুললো। মোহর নিজে থেকেই উঠে গিয়ে দরজা টা খুললেও ওর স্বাভাবিক মুখাবয়বের প্রবল পরিবর্তন ঘটলো। কোনো বিস্ময় বা খুশি না বরং সামনের চেহারা টা দেখেই সেদিনের অপমান, নোংরা কথা গুলো মন মেজাজে নিমিষেই রুষ্টভাবাপন্ন বিরক্তি ঢেলে দিল

– কে এসেছে?

আম্বি খাতুনের কথায় মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, দরজা ছেড়ে সরে এসে আগের জায়গাতে বসে পরলো। সকলের কৌতুহলী দৃষ্টিতে একঝাঁক দূরকল্পনার রেশ ঢেলে ছোট খাটো একটা স্যুটকেস হাতে প্রবেশ করলো তিয়াসা।
ব্লু জিন্স আর পাইন গ্রীন রঙের একটা টপস পরিহিত শরীরের মুখ জুড়ে ছোট হাসি। তবে তা বিস্তর নয়। ওকে দেখে অন্যেরা বিস্মিত হলেও কাকলি খাতুন পূর্বোবগতের ন্যায় হেসে বললেন

– তিয়াসা আসো আসো। দেরি করলে যে!

– আসলে ঘুম থেকে উঠতে একটু লেট হয়ে গেছে।

বলে আরও দুকদম এগিয়ে এলো। আম্বি খাতুন টেবিলের কাছ থেকে সরে এসে বললেন

– তিয়াসা তুমি হঠাৎ

– কেন আন্টি আমি কি আর এ বাড়িতে আসতেও পারিনা?

– কেন পারবে না, অবশ্যই পারবে। এসো আমার কাছে বসো

বলেই কাকলি বেগম সকলের উদ্দেশ্যে বলল

– তিয়াসার বাবা মা দুজনেই শহরের বাইরে গেছে। অত বড়ো বাড়িতে মেয়েটা একা থাকবে তাই আমিই ওকে ডেকেছি। সাঞ্জেও আছে ভালো লাগবে সবার

– তোমার লাগতে পারে, আর কারো লাগবে না

মুখ ভেংচে বিড়বিড় করে বলল সাঞ্জে। তিয়াসা ওর মেকাপের প্রলেপে ঢাকা কৃত্রিম চেহারায় মৃদু হেসে বলল

– আমি আসাতে হয়তো কেও খুশি হয়নি। এই জন্যেই আমি আসতে চাইনি। আপনি শুধু শুধু আমাকে ডাকলেন আন্টি

কাকলিকে উদ্দেশ্য করে বললেও। আজহার মুর্তজা এবার বললেন

– না না। কি বলছো।তুমি তো এ বাড়িতে আজ নতুন আসছো না। কাকলি ভালই করেছে। তোমার বাবা মা না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকো তুমি

তিয়াসা সামান্য হাসলো। সকলের দৃষ্টির অগোচরে মোহাচ্ছন্ন নজরে তাকালো একদম সম্মুখ বরাবর পুরুষটির দিকে, এসে থেকে একটা বারের জন্যেও যার নজরে আসতে পারেনি। ডিপ গ্রে শার্ট, কনুই অব্দি গুটানো হাতা, সিলভার ওয়াচটার চিকচিক করা আলোর থেকেও ফর্সা হাতের লোমগুলো বেশি চোখ ধাধাচ্ছে।
তিয়াসার এই ঘোর লাগা দৃষ্টি সকলের চক্ষু এড়াতে পারলেও পারেনি একজনের চোখে আড়াল হতে। সদা সর্বদা শান্ত চোখের স্বভাব উগড়ে দিয়ে ধারালো হলো দৃষ্টি। রেষপূর্ণ, তীর্যকভাবে একবার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে একবার মেহরাজকে অবলোকন করলো মোহরের তীক্ষ্ণ চাহনি
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৬
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান

– আরে কি হয়েছে বলবি তো? এভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকলে বুঝবো কি করে আমি?

– বোঝা লাগবে না তোর

মোহর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে টানটান চোখে তাকালো। আজকে ক্যাম্পাসে আসতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে, তার কারণ অবশ্যই সকালের ঘটনা গুলো। এখন এসে থেকে শ্রীতমার ভার করা মুখ টাই দেখে যাচ্ছে। মেয়েটা না কিছু বলছে নাইবা তাকাচ্ছে, এভাবে গোমড়া মুখে থাকলে বুঝবে কি করে!

– আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না, এখন বল কি হয়েছে!

শ্রী ফুলিয়ে রাখা মুখটা সেভাবেই রেখে ঘুরে তাকালো। মোহরের দিকে তর্যনী তুলে ফ্যাসফ্যাস করে বলল

– তুই খুব খুব খুব খারাপ। তুই আমার বান্ধবীই না। কাল কেন আসলি না তুই বল, আবার আজ এসেছিস তো দেরীতে। এখন কেন শুনতে চাচ্ছিস আমার কথা, আমি কে আমি তো কেও না। কেও আমার খোঁজ খবর রাখে না আমার সাথে দেখা করার দরকার ই নেই তো। আমি আর কে

বলতে বলতে টুপ করে এক ফোঁটা পানি টপকে পড়লো চোখ থেকে। মোহর আবারও মুখ চিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটার ঠিই এই স্বভাব টার কারণে মোহর ভয়ে থাকে কখন কি ধরে মুখ ফুলিয়ে বসে।
এগিয়ে এসে বসলো শ্রীয়ের নিকটে। হাতের তালুতে ওর চোখ দু’টো মুছে দিয়ে স্নেহমহী গলায় বলল

– আচ্ছা আর কখনো এমন করবো না। ঝড় হোক তুফান হোক আগে আমি আমার কাঁদুনি বান্ধবী টার কাছে এসে সব কথা শুনবো তারপর বাকি সব। এবার বল তো কি হয়েছে?

– অরুনাভের জন্মদিন আজ, আমি কাল রাতে ওর জন্য স্পেশাল কেক ও অর্ডার দিয়েছিলাম। তুই ছিলি না বলে সন্ধ্যায় একাই গেছিলাম মার্কেটে ওটা আনতে কিন্তু রাস্তার মাঝে একটা হাম্বার সাথে ধাক্কা লেগে কেকটা নষ্ট হয়ে গেছে

– হাম্বার সাথে?

– হ্যাঁ হাম্বা নয়তো কি, অসভ্য টার সাথে ধাক্কা লেগে আমার কেকটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আজ আমি ওকে কিভাবে সারপ্রাইজ দেব, মাসের মাঝামাঝি সময় আমার কাছে টাকাও তো নেই।

শ্রীতিমার শুকনো মলিন মুখটা দেখে মোহরের ভীষণ খারাপ লাগলো। ওর কাছে টাকা থাকলে নিশ্চয় কিছু একটা রাস্তা বেরোতো। কিন্তু ওর সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস, যাতায়াত সবকিছুই মেহরাজ নিজ দ্বায়িত্বে সামলাই এক্ষেত্রে ওর টাকার প্রয়োজন একেবারেই নেই। আর সেই মানুষ টার কাছে চাওয়ার মতো জড়তাহীনতা ওর কল্পনাতেও হয়নি এখনো

– মন খারাপ করিস না, কেও তো আর ইচ্ছে করে ফেলেনি তাই না

– ইচ্ছে করে ফেললো কি অনিচ্ছায় সে দিয়ে এখন কি হবে বল, ও আমাকে দুইদিন আগেও এই চেন টা দিয়েছে দেখ অথচ আমি ওর জন্য একটা কেক ও নিতে পারলাম না।

বলেই গলায় হাত দিয়ে সোনালী রঙের চিকচিক করা আকর্ষণীয় জিনিসটাকে দেখালো। পুরু, চওড়া ফিতার ন্যায় জিনিসটার বহুমূল্যতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

– মোহর একটা কলম হবে তোমার কাছে?

পাশের বেঞ্চের মেয়েটির কথায় মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হ্যাঁ বোধক ইশারা করে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কলম বের করতে নিলে হাতে কাগজের ন্যায় স্পর্শ হলো কিছু একটা। ভ্রু কুচকে কলমটা বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে কৌতূহল বশত ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজের মতো জিনিস গুলো বের করলো।
গুণে গুণে ঠিক ছয়টা হাজার টাকার নোট, এতগুলো টাকা ওর ব্যাগে কি করে এলো! ওর কাছে তো কানাকড়ি ও ছিল না। তাহলে? তাহলে কি মেহরাজ রেখেছে! থ মেরেই বসে রইলো খানিক মোহর।
অন্যসময় হলে হয়তো নিজ আত্মগড়ীমাকে দাম্ভিকতার সহিত আগলে সসম্মানে টাকা গুলো মেহরাজের নিকট ফিরিয়ে দিত মোহর, কিন্তু বর্তমানে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর মুখে হাঁসি ফুটানো ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসলো না।

একটা ক্লাস শেষ করে শ্রীতমা আর মোহর দুজনে মিলে নিউমার্কেটে আসলো। শ্রীতমা না চাইতেও মোহর জোর করে ওর পছন্দ মতো একটা কেক কিনে দিল।

– তুই আমার সাথেই চল

বলে মোহরের হাত ধরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো,মোহর একেবারে রাজি না ওদের মাঝে যাওয়ায়। দুজন কপত-কপতীর মাঝে ও কাবাবে হাড্ডি ছাড়া কিছুই না। তীব্র ভাবে নাকচ করে বলল

– শ্রী আমার কথা টা শোন। তোরা দুজন একসাথে পারসনাল টাইম স্পেন্ড করবি এখানে আমি গিয়ে কি করবো বল তো।

শ্রীতমা তীব্র বিরোধ করে বলল

– কি করবি মানে। তোকে ছাড়া আমি কিভাবে কি করবো

– যেভাবে প্রেম করছিস সেভাবেই করবি

মোহরের টুসকি দেওয়া কথায় শ্রীতমার মুখে হুট করেই লজ্জার বর্ষণ ঘটলো। ধবধবে ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে এলো। মাছি তাড়ার ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে বলল

– যাহ, কিসব বলিস

– ঠিকই বলেছি বাচ্চু। যাও প্রেম করো। আমারে এর ভিতরে নিও না। আর এমনিতেও এক্ষুনি গাড়ি এসে যাবে,ক্লাস বাদ দিয়ে অন্য কোথাও ঘুরছি দেখলে হিতে বিপরীত ভাববে

– হ্যাঁ আমাকে তো ভালোই শোনাচ্ছিস। তোর বর যে এক বেলা তোকে একা ছাড়তে চাইনা, ড্রাইভার না তো অ্যাসিস্ট্যান্ট পাঠিয়ে দেয়, তোরা মনে হয় প্রেম করছিস নাহ

শ্রীতমার বোকা বোকা কথা গুলোতে হুট করেই থমকে গেল মোহর। কথাগুলো যেন ওর সুপ্ত অনুভূতি গুলোর কাছে কৈফিয়ত চাইলো, যার উত্তর ওর কাছে নেই। অস্বস্তি আগলে সপ্রতিভ হয়ে সহাস্যমুখ করে মোহর বলল

– মোটেও নাহ। তুই পকপক বন্ধ করে যা তো, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর আমিও যাই। দুজনে মিলে খুব করে প্রেম কর কেমন

বলেই শ্রীতমার বাহুতে টুস করে একটা চিমটি কে’টে দৌড়ে নিচে নেমে এলো, শ্রীতমা অসহায় চোখে চেয়ে থেকে নিজেই হাঁটা দিল ভেতরের দিকে।
মোহর সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে দ্রুতপায়ে মল থেকে বের হচ্ছিল, তখনি আচানক কারো সাথে ধাক্কা লাগলে হতবিহ্বলিত হয়ে চাইলো মোহর,
ওর বিব্রতিকে তড়বড় করে বাড়িয়ে দিল সামনের মানুষটা, মোহর খানিক হতবুদ্ধির ন্যায় বলল

– সরি স্যার, আমি খেয়াল করিনি

ফায়াজ তখনও যথাবৎ ভাবে খেয়াল করেনি মোহরকে, চেনা পরিচিত কণ্ঠে সুপ্রসারিত নয়নে তাকালে মোহরকে দেখে বেশ বিস্মিত হলো, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত গলায় বলল

– মোহর তুমি এখানে? এখনও তো তোমার ক্লাস টাইম শেষ হয়নি?

মোহর অপ্রস্তুত হলো। বাঁ হাতের আঙুল গুলো ডান হাতে গলিয়ে কচলাতে কচলাতে বলল

– আসলে একটু কাজ ছিল আরকি

ফায়াজ ভ্রুদ্বয় প্রসারিত করলো। আশপাশে তাকিয়ে সকৌতুকে মোহরের অস্বস্তি ভরা মুখ পানে চেয়ে বলল

– এই সময় কাজ? তুমি ক্লাস বাদ দিয়ে মলে এসেছো এটাও দেখতে হচ্ছে?

পরমুহুর্তেই কিছু একটা ভেবে বেশ রম্য করা গলায় বলল

– ওহ, হাসব্যান্ড এর সাথে এসেছো তাই তো? তা কোথায় সে বউকে ফেলে একাই শপিং করছে?

মোহর অপ্রসন্ন হলো। কেন যেন মনে হলো ফায়াজ ওকে খোঁচা দিয়ে বলল কথাগুলো। বেশ গম্ভীর করে বলল

– শ্রীয়ের সাথে এসেছিলাম স্যার। একটু দরকার ছিল

ফায়াজ ভ্রুকুটি করলো। দুইহাত সামনে গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল

– তার মানে দুজনেই ক্লাস ফাঁকি দিয়েছো?

মোহর অপরাধীর ন্যায় মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। ফায়াজ ডায়ে বায়ে মাথা নেড়ে বলল

– শেষ সময়ে এসে এরকম ফাঁকিবাজি করা মোটেও ভালো নাহ। আর তো মাত্র কয়েকদিন, তার পর থেকে ইন্টার্নি। এই সময়টা খুব সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করতে হবে। তোমার পারফরম্যান্স বলবে তুমি কোন হসপিটালে চান্স পাবে। বুঝছো?

মোহর সদা সর্বদা বাধ্য ছাত্রীর পরিচয় দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ফায়াজ আশপাশ তাকিয়ে বলল

– তা সে কোথায়। তুমি একা ছুটে বেড়াচ্ছো কেন?

– ওর একটু কাজ আছে। আমার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে তাই চলে যাচ্ছি।

তারপর খানিকটা নীরব থেকে বলল

– তাহলে আসি স্যার?

– দাঁড়াও!

সৌজন্য সুলভ কথা টুকু বলেই পা বাড়াতে নিয়েছিল মোহর। তক্ষুনি ফায়াজের ডাক পড়লো। ইতস্তত নিয়ে দাঁড়ালে ফায়াজ এগিয়ে এসে বলল

– একাই ফিরছো?

– জ্বি স্যার

– চলো আমি পৌঁছে দেই

মোহর বিব্রতবোধ করলো। ভেবেছিল সেদিন এতগুলো কথার পর হয়তো ফায়াজ ওর উপর রেগে যাবে, আগের মতো কথা বলবে না। কিন্তু ফায়াজের ব্যবহারে খুব একটা পরিবর্তন দেখতে পেল না মোহর।

– আমি একাই ফিরে যেতে পারবো স্যার

– আমি ড্রপ করে দিলে সমস্যা? নাকি এখন বিবাহিত বলে আমার গাড়িতে আর ওঠা যাবে না?

মোহর লজ্জিতা স্বরূপ অনুবলে বলল

– নাহ তা নয় স্যার। আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে।

– ঠিকাছে ভুল বুঝবো না। চলো আমার সাথে

বলেই সামনে ইশারা করে হাঁটতে লাগলো ফায়াজ। গোলগাল চশমা পরা মুখটাতে সীমাহীন গাম্ভীর্য। এর পরেও নাকচ করাটা হয়তো সরাসরি অপমান হবে তাই মোহর নিরাভরণ অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা নিয়েই পেছন পেছন হাঁটতে থাকলো।

এই দৃশ্য টা যে একেবারে নতুন তা নয়, মোহরকে এর আগেও বহুবার ফায়াজ গাড়িতে করে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছে। পার্থক্য টা শুরু বাড়ির ভিন্নতার। তখন মোহর শুধু ফায়াজের ছাত্রী, মোহর শিকদার ছিল। এখন মোহর মেহরাজ আব্রাহামের স্ত্রী তার সহধর্মিণী। এখন সে চাইলেই যার তার সাথে উঠতে বসতে পারে না অনুমতি হীনা । আর চলমান মুহূর্তে এই কথাটা বোঝানোই হয়তো সবচেয়ে দুর্বোধ্য কাজ মোহরের নিকট।

গাড়িটা পুরোটা পথ নিঃশব্দে এলো। শুরু দিকনির্দেশনা নিতে ফায়াজ বার দুয়েক প্রশ্ন করেছিল এই আরকি। ফায়াজ হার হামেশাই শান্ত স্বভাবের অমায়িক ব্যক্তিত্বের একটা মানুষ। মোহরকে এসএসসির পর থেকেই প্রাইভেট পড়াতো,তখন ফায়াজ মেডিক্যালের ব্রাইট স্টুডেন্টদের একজন ছিল। কোনো এক জিডি করার ব্যাপার নিয়ে মোহরের বাবার সাথে ফায়াজের পরিচিতি।
খুব অদ্ভুত ভাবেই মানুষের সাথে বন্ধুত্ব এড়িয়ে যাওয়া মোহরের বাবা ফায়াজকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতে শুরু করে। এমনকি তার মা ও। মোহরকে ফায়াজের জিম্মায় দিয়ে তারা যেন নিশ্চিন্তের আব্রুতে থাকতেন। সে এখন ঢাকা শহরের নামকরা হসপিটালের ডক্টর। সেদিক থেকে মোহরের উপরে ফায়াজের অধিকার খাটানো টা নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার স্যাপার।
তবে মেহরাজের সেদিনকার বাচনভঙ্গি যাকে বলে শান্ত স্বরের হুমকি মোহরের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে অন্য কিছুর বীজ বুনেছে। মেহরাজের ভীষণ শান্ত স্বভাবের বৈশিষ্ট্য টা অনেকটা কার্বন মনোক্সাইডের ন্যায়। খুব ধীরে ধীরে প্রক্রিয়া, বিক্রিয়া ঘটায় যার ফলাফলে ঘাত সুনিশ্চিত।
এই কয়দিনে একই ছাদের নিচে থেকে অন্তত এটুকু বেশ পাশবদ্ধ করেছে মোহরের মস্তিষ্ক। আর এটাই তার সমস্ত দুশ্চিন্তার কারণ।
খুব একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপার মোহরকে বেশ ভাবায়, কিছু একটা আঁচ করতে গিয়েও যেন পারে না। কিছু একটা দেখতে গিয়েও দেখে না।

ও যেন একটা ব্যাপার অনুভব করতে পারে যে কিছু একটা আছে যা খুব চাতুর্য আর নৈপুণ্যের সহিত মোহরের চক্ষুর অগোচরে রাখা হয়। কিন্তু তা কি? কি এমন ব্যাপার যা মোহরকে বারংবার ভাবায়, কৌতুহলের অসহিষ্ণু বীজ ফাঁপরে তোলে অন্তঃস্থলে অসংখ্যবার!

– আমি যদি ভুল না হই এটাই তোমার বর্তমান ঠিকানা মোহর

চেনা পরিচিত আকণ্ঠ গলার স্বরে ধ্যান ক্ষুণ্ন হলো মোহরের। বিহ্বল চোখে একবার ফায়াজের দিকে তাকিয়ে আবার কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। অতঃপর মুখে সামান্য হাসির রেখা টানার প্রচেষ্টায় বলল

– থ্যাংক ইউ স্যার, আসি।

ফায়াজ প্রত্যুত্তর করলো নাহ। ওর অস্থূল,কৃশ দৃষ্টি তখন সামনের প্রাসাদতুল্য বাড়িটি আর সুস্পষ্ট ভাবে চক্ষুগোচর হওয়া নেইম প্লেটের দিকে। মোহর গাড়ি থেকে বেরিয়ে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফায়াজ ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ না মোহর দর্শনশক্তি থেকে গূঢ় না হয়।
লমস্ত চোখের দৃষ্টি বিচিত্র যা শমিতের তুলনায় অত্যাধিক বিপরীত। বেশ মুহূর্ত খানেক অতিবাহন হলো সেই অপলক দৃষ্টির মানসে। তার পরেই ইঞ্জিন টা প্রচণ্ড শব্দে গুঙিয়ে উঠে ছুটিয়ে নিল চার চাকার সত্তয়ারি।

স্টিয়ারিংয়ে এক হাত ঘুরাতে ঘুরাতে অন্য হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো, গ্যালারি তে ঢুকলে খুব যত্নসহকারে একটা আলাদা করে রাখা ফোল্ডারের অপশন টাতে আঙুলের স্পর্শ পেতেই একঝাঁক ছবি ভেসে উঠলো সারিবদ্ধভাবে। ফায়াজ খুব যত্ন নিয়ে ফোনটা ছুঁয়ে একটা ছবিকে জুম করলো, ষোড়শী অথবা সপ্তদশীর এক কিশোরীর সাধাসিধে, অকৈতব ছবিটি।
দুই বেণী দুইপাশে ঝোলানো, দুই ওষ্ঠভাঁজের মাঝখানে কলম আঁটকে ধরে রেখেছে। অপলক চাহনির আহেল নজরে চেয়ে রইলো ফায়াজ। এক, দুই,তিন করে অসংখ্য মুহুর্ত কাটিয়ে দিল সে ছবির দিকে তাকিয়ে। দুই অধরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে শুধু দুটো লাইন ই বেরিয়ে আসলো

– কথা দিয়েছিলাম, হারাতে দেবো না

___________________

– সাঞ্জে, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো?

চাহনিটা ছোট্ট শরীরের নিষ্পাপ চেহারাতে আবদ্ধ রেখেই বলল মোহর। সাঞ্জে তাকালো না ওর দিকে, গ্রীবার কাছ দিয়ে হাত রেখে তাতে ভর করে রাখা মুখটা দূর রাস্তায় স্থির রেখেই বলল

– হ্যাঁ বলো

মোহর দ্বিধা বোধ করলো বেশ, এহেন প্রশ্ন করাটা ওর উচিত হবে কি না জানে নাহ কিন্তু জানাটা ওর দরকার, খুব ই দরকার।
অস্বস্তি ঠেলে স্বাভাবিক গলায় বিনয়ীতা ঢেলে বলল

– তাথই আপাকে কি জো’র করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল? বা উনার কি এ সম্পর্কে কোনো সমস্যা আছে যার কারণে শ্বশুড়বাড়ি বা সেখানকার মানুষের কথা শুনলেই এমন রেগে যায়

সাঞ্জে মিনিট খানেক চুপ রইলো। মোহর ওর নীরবতাকে উত্তর দেবার অনিচ্ছায় ধরে নিল। ঠিক তখনি নীরবতার বুক চিরে শোনা গেল সাঞ্জের দীর্ঘশ্বাস , প্রাণোচ্ছল গলায় একরাশ খেদোক্তি মিশিয়ে বলল

– জো’র করে দেওয়া হয়েছে কিনা জানি নাহ, তবে আপি মনের উপরে জোর করেই বিয়েটা করেছে

মোহর ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সাঞ্জের দিকে তাকালো। ওর জিজ্ঞাংসুক চেহারাটা সাঞ্জে না তাকিয়েও উপলব্ধি করতে পারলো। তাই অবিলম্বেই আবারও বলতে লাগলো

– এই যে রাগচটা, গম্ভীর, বদমেজাজি, খিটখিটে তাথই কে দেখছো না? আমার আপি কখনোই এমন ছিল নাহ। আমার এই চঞ্চলতা, অস্থির স্বভাব তো আমি আপির থেকেই শিখেছি। সারাটা সময় বাড়িঘর মাথায় করে রাখা সবাই কে বিরক্ত করে ফেলা মাতামাতি,প্রাণোচ্ছলতা এসবে আপি আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল নাহ। আর পাঁচজনের মতো ওউ হাসতো,খেলতো,গল্প করতো, আনন্দ করতো, আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতো। কিন্তু জীবনে খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মোড় ঘুরে ওর ব্যক্তিত্বটাকে দুমড়ে মুচড়ে একটা পাথর বানিয়ে দিয়েছে।

মোহর এইটুকু শুনেই যেন অনেকটা আঁচ করতে পারলো। সাঞ্জের হাতটা এক হাতে ধরে বলল

– তাথই আপা অন্য কাওকে ভালোবাসতো?

সাঞ্জের চোখ টলমলিয়ে উঠলো। মনে পড়ে গেল মাত্র বছর তিনেক আগের কথা, বোনের উচ্ছ্বসিত, আনন্দ,প্রফুল্লতায় ভরা চেহারাটা চোখের বিকল্পনায় ভেসে উঠলো। দমে যাওয়া গলায় বলল

– বাসতো। আপুর প্রথম প্রেম, ভালোবাসা, অনুভূতি সবটাই ছিল। দাভাইয়ের একটা বন্ধু ছিল। বন্ধু কম ভাই বেশি। দাভাই যতটা গম্ভীর, সিরিয়াস স্বভাবের তার বন্ধুটা ঠিক ততটাই রসিক আর চঞ্চল স্বভাবের ছিল।
এ বাড়ির একটা সদস্যের মতই সম্পর্ক ছিল সবার সাথে। স্কুল,কলেজ, ভার্সিটি সবটা একসাথেই পড়েছে দুজন। তাথই আপাও তখন কিশোরী বয়সের। এ বাড়িতে রোজ রোজ আসতে আসতে কখন যে তাথই আপা আর ইয়াসির ভাইয়ের মাঝে একটা বন্ধন,মায়া, টান হয়ে গেল এটা হয়তো ওরাও বুঝতে পারেনি।
আমি তখন অনেক ছোট, সবে হাই স্কুলে উঠেছি। উনাদের যত প্রেমপত্র বিনিময়, দেখা সাক্ষাৎ সবকিছুতেই আমার হাত ছিল। তবে এটা আমি আপি আর ইয়াসির ভাই, এই তিনজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি দাভাই ও জানতো না। ইচ্ছে ছিল ইয়াসির ভাই পড়াশোনা শেষ করে সেটেল্ড হলেই বাড়িতে জানাবে। হয় তো তাই হতো , ইয়াসির ভাই জার্মানির একটা নামি দামি ভার্সিটি পড়ার স্কলারশিপ পায়। কথা ছিল পড়া শেষ করে এলেই বিয়ের কথা বলবে বাড়িতে। কিন্তু ভাইয়া জার্মানিতে যাওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই চাচ্চু আর বাবা মিলে হুট করেই একদিন আপুর বিয়ে ঠিক করে ফেলে অরুণ ভাইয়ার সাথে । হুট করে ব্যাপারটা তো আমাদের কাছে ছিল আসলে অরুণ ভাইয়ার বাবা চাচ্চুদের বিজনেস ফ্রেন্ড। তারা অনেক আগেই বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। তাথই আপা অনেক চেষ্টা করেছিল ইয়াসির ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে ফোন কল, ম্যাসেজ কিছুতেই পাইনি। হাজারো চেষ্টা করেও একটা বারের জন্য যোগাযোগ করতে পারেনি। পারিবারিক চাপ, সম্মান আর নিজের বাবাদের ব্যবসায়িক লাভ সবকিছুর বিবচনায় হেরে গিয়ে অন্তরদাহ করে রাজি হয়েছিল আপি বিয়েতে। অনেক চেষ্টা করেছে মানিয়ে নেওয়ার।
বিয়ের কিছুদিন অব্দি ও ভালোই ছিল। তার পরেই ধীরে ধীরে ঘরকোণাচে, একগুঁয়ে, রূঢ় হয়ে গেছে। আগে আমাকে অনেক কিছুই বলতো এখন তাও বলে নাহ, জানি না আপুর মাঝে কি চলে বা কি হয়েছে। অরুণ ভাই আদও যেমন ভালোবাসা দেখায় তেমন কি না তাও জানি নাহ

সুদীর্ঘ কথাগুলো বলে দম ছাড়লো সাঞ্জে। চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়ালেও খুব সাবধানে তা মুছেও নিল। মোহর শুধু নিষ্প্রভ তাকিয়ে রইলো কোলের মাঝে গুটিয়ে থাকা বাচ্চাটার দিকে।

আচ্ছা পরিস্থিতির কাছে হেরে গেল তাথই আপা, পারিবারিক সম্মানটা অক্ষত রইলো, যাকে ভালোবেসেছিল সেও দূরেই চলে গেল। এর মাঝে বাচ্চাটার কি দোষ? ও তো কারো ক্ষতি করেনি? তাহলে কেন এতটুকু বাচ্চা মায়ের স্নেহ, পিতার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মায়ের কোল জুড়িয়ে দেওয়া প্রশান্তিময় সন্তান টাও মায়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে? এতে এই ছোট্ট প্রাণটার কি আদও কোনো দোষ আছে?

__________________________

রাতের প্রায় মধ্যিভাগ। মেহরাজ আজ বাড়িতে ফিরেছে বেশ দেরিতে। মোহরের সাথে শেষ সাক্ষাত টা ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে। মেহরাজ নয়টার দিকে বাড়িতে ফিরলেও সেসময় মোহর তাথইয়ের ঘরে ছিল। অনেকটা চেষ্টা করে যেটুকু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিল, গতদিন অরুণ নামক মানুষটা আসার পর থেকে আরও বিগড়ে গেছে সবটা।
তাথইয়ের জীবনের ছোট্ট অংশটুকু শোনার পর থেকেই মন জুড়ে একরাশ আকুলিবিকুলি ছেয়ে আছে। মোহরের মনে হচ্ছে আরও কিছু আছে, আপাতদৃষ্টির অন্তরালে আরও অনেকটা আছে যা সকলের চক্ষের অগোচরে । যা একটা মানুষকে ক্রমেই অসুস্থ, অস্বাভাবিক করে তুলছে।

মোহরের ভাবনার মাঝেই খট করে দরজাটা খুলে গেল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো লম্বাটে গড়নের মানুষটা। খুব সুধীরভাবে নব মুচড়ে লক করে দিল ডিজিটাল লক সিস্টেমের দরজাটা। মোহর আড়চোখে চাইলো। সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা থেকে বইটা ধরা হয়নি বলেই বসেছিল ভারী মোটা বইটার পৃষ্ঠা খুলে।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরেও বই থেকে মুখ তুললো না মোহর, নেত্র দুটি নিচে স্থির রেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো মেহরাজ স্থির দাঁড়িয়ে আছে কাবার্ডের সাথে হেলান দিয়ে, তার তীক্ষ্ণ চাহনি বদ্ধ শুধুমাত্র মোহরের দিকে।

বেশ খানিক অস্বস্তি নিয়ে মোহর সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেহরাজের দিকে। সুস্থিত চেহারার মানুষটা আজ যেন একটু বেশিই স্থির। মুখাবয়বের স্থৈর্যতা টাতে যেন কেমন সূচালো আঁশ অনুভব করলো মোহর। খপ করে বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। অদূরের সেল্ফের তাকে গিয়ে বইটা রেখে পেছনে ঘুরতেই নিজের অত্যাধিক সন্নিকটে মেহরাজের চেহারাটা দেখে অকস্মাৎ ভয়ে সিটিয়ে গেল সেল্ফের গায়ে, মুখ দিয়ে মৃদু চিৎকার তোলার আগেই মেহরাজের ভারী,ঠান্ডা হাতটা চেপে ধরলো মোহরের ওষ্ঠাধর।
ঘনঘন তপ্ত নিঃশ্বাসে বুকের ওঠানামা টা বৃদ্ধি পেল। আড়ষ্ট হাত তুলে মেহরাজের হাতটা সরিয়ে দিতেই ও আরও এগিয়ে এলো মোহরের সন্নিকটে, ব্যগ্রতায় মুখ খিঁচিয়ে নিয়ে অন্যদিকে ফেরালে মেহরাজ ওর থুতনিতে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো। পুরুষোচিত গলার আকণ্ঠে তীব্র ভার মিশিয়ে বলল

– আমি আপনার কি হই মোহ?

আচানক এহেন আচরণ আর প্রশ্নে ভড়কে গেল মোহর। কম্পান্বিত চোখে তাকালো মেহরাজের গাঢ় ধূসর চোখে। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় চাহনিটা আরও রুষ্ট হয়ে উঠলো। এতদিনেও মোহর মেহরাজের এহেন চাহনির শি’কার হইনি।

– কি হই আমি আপনার?

ভড়কে গেল ভীষণ ভাবে,বিবশ গলায় শুকনো ঢোক গিলে বলল

– স্ স্বামী

দৃষ্টির পরিবর্তন হলো নাহ, ভরাট অপলক চাহনি মেলেই বলল

– তাহলে কি আপনার উচিত না স্বামীর বাধ্য আর অনুগত থাকা?

মোহর কোনো প্রকার অভিব্যক্তি ঠাওর করতে পারছে নাহ। কিন্তু মেহরাজের এহেন চাহনি ওকে ভীষণ জর্জরিত করছে। কোনো কিছু না ভেবেই প্রত্যুত্তরে ঘনঘন মাথা নাড়ালো। অবিলম্বেই পুরুষোচিত কণ্ঠ বলে উঠলো

– আমি যখন নিষেধ করেছি, তার পরেও ডক্টর ফায়াজের সাথে এক গাড়িতে কেন বসেছেন? আপনার জন্য কি আমি গাড়ি সময়মত পাঠাইনি?

– আ আসলে…

স্বরতরঙ্গ ভেদ করে আসা আধো বুলি টুকু সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। লম্বা, কঠিন পাঁচটা আঙুলের স্পর্শ এসে ঠেকলো মোহরের গ্রীবা আর কণ্ঠনালীর মাঝে। অনেকটা হিসহিসানির ন্যায় কণ্ঠে হাতের মালিক টি বলল

– আপনার প্রতিটি সুবিধা অসুবিধা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা খারাপ লাগার খেয়াল যদি আপনার স্বামী খুব যত্নসহকারে রাখতে পারে তাহলে আপনি কেন তার একটা কথা রাখতে পারলেন না মোহ?
.
.
.
চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে