#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_২৩
মেহরাজ দুহাতে মোহরের কোমর ঝাপটে ধরে মুখ গুঁজে রেখেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে প্রবল উত্তাপ শুলের ন্যায় বিঁধে যাচ্ছে মোহরের কোমলমতি উদরে। ভেতরের তান্ডব কে আস্কারা না দিয়ে ধাতস্থ হলো বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে।
দুহাতে আলতো ভাবে মেহরাজের কপালে গালে হাত রাখলো। আগের চেয়ে তুলনামূলক কম তবে এখনো হয়তো জ্বরের পারদ একশোর নিচে নামেনি।
পাশ থেকে ভেজা কাপড় টা নিয়ে আবারও মেহরাজের কপালে চেপে ধরলো।
বা হাতটা মেহরাজের মাথার নিচে রেখে বেড সাইড টেবিল থেকে পানির বোতয়ল টা নিয়ে ছিপি খুলে মেহরাজের খরার জমির ন্যায় শুষ্ক পিপাসায় কাঁতর ঠোঁটের কাছে ধরলো মোহর।
ঢকঢক করে পানি খেলো মেহরাজ। পিপাসায় উত্তপ্ত শ্রান্ত দেহাভ্যন্তরস্থ উত্তাপে যেন এক পশলা শৈথিল্যের স্পর্শ পেল। পুরো বোতলের পানি টা একবারে নিঃশেষ করে ফেলল কয়েক মুহূর্তে। বোতল টা রেখে কপাল থেকে ভেজা কাপড় টা তুলে আবারও পানির মধ্যে ভেজালো। শরীরের উত্তাপে ভেজা জবজবে কাপড় টাও গরম হয়ে গেছে। চিপড়ে বাড়তি পানিতে নিংড়ে নিল। ব্ল্যাংকেটের আস্তরণ টা সরিয়ে উন্মুক্ত করলো জ্বরে কম্পিত সুবৃহৎ দেহাবয়ব টা। গায়ে জড়ানো হালকা অলিভ রঙের টি-শার্ট টা কুচকে লেপ্টে আছে শরীরে। বাঁহাতের উপর উত্তপ্ত ঘাড় টা রেখে ডান হাতটা গলিয়ে দিল মেহজারের পাতলা টি-শার্টের ভেতরে।
প্রশস্ত পিঠটাতে নিজের চিকন আঙুলের চালনা করে পিঠময় শীতল স্পর্শে ভিজিয়ে দিতে লাগলো নিঃশব্দে। যেন প্রবল উত্তাপের আব্রুতে বেষ্টিত দেহখানায় শীতলতার আরাম ঢেলে দিল। সর্বাঙ্গে শিথিলতায় পরিপূর্ণ আবেশবোধ হলো মেহরাজের। ও তখনো এক হাতে ঝাপটে রেখেছে মোহরের কোমর। আরেক হাতটা নির্জীব হয়ে অসাড়তার কাছে হার মেনে পরে আছে অবহেলায়।
মোহর পিঠ থেকে ভেজা কাপড় টা বের করে রাখলো মেহরাজের সেই হাতটার তালুতে। আধো হুশে পরে থাকা দূর্বল আঙুল গুলো মেহরাজ একত্রিত করে চেপে ধরলো মোহরের হাতটা, অত্যুষ্ণ হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো মোহর, যেন জ্বরের উত্তাপটা চামড়া ভেদ করে ওর হাতটাকেও পুড়িয়ে দিচ্ছে। ইসস একটু খানি স্পর্শেই যখন মোহরের এমন লাগছে না জানি জ্বরের তোপে অসাড় হয়ে যাওয়া মানুষটার কত না কষ্ট হচ্ছে!
মেহরাজের ঘাড় হতে কোমর অব্দি শরীর টা তখনও মোহরের অঙ্কদেশে পরে আছে। এক হাতে কোমর টা আরেক হাতে মোহরের হাতটা দূর্বল স্পর্শে চেপে ধরে বলল
– মাথা টা, মাথা টা খুব ধরেছে মোহমায়া। বুকের ভেতরে খুব ব্যথা করছে।
বলে ভীষণ দুর্বলচিত্তের অবীর হাতে মোহরের হাতটা নিয়ে নিজের বুকের বাঁ পাশটায় রেখে বলল
– এইখানটায় খুব যন্ত্রণা করছে মোহ, এখানকার জ্বরটা সারিয়ে দিন না! ভেজা সিক্ত স্পর্শ ছুঁয়ে এইখানটার উত্তাপ ও কমিয়ে দিন। এতটা তো সহ্য করতে পারছি না
নরম হাতের তালুর নিচে মাংসল পিন্ডটা কাঁপছে। অবিরাম, অন্তহীণ স্পন্দন গুলো খুব করে টের পাচ্ছে মোহর, কেমন এক ঘোরের বশে নিজের অজান্তেই চিকন লম্বা আঙুল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলো, মুচকি হেসে উঠলো মেহরাজ।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে রুগ্ন ফ্যাকাশে মুখ, শুষ্ক ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হলো। অপলক চেয়ে রইলো মোহর, নিশুতি রাত্রির অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার ডাকের সূক্ষ্ম অস্তিত্ব ও যেখানে বিলীন সেখানে নিজের বক্ষস্থলকে ব্যগ্র করে ঝংকার তোলা সুরটা স্পষ্ট শুনতে পেল।
মনের ভেতরে আনাগোনা করা বিচ্ছিন্ন এলোমেলো অনুভূতি, শব্দ গুলো কোনো ভাষায় রূপ দেওয়ার মতো সাধ্যি হয়তো ওর নেই।
হুট করেই মনটা যেন সদ্য যৌবনে পা ফেলা কিশোরীর মতো অধিকন্তু, আরত্ত হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা উন্মাদনা গুলো স্ব স্ব গন্ডি ছাড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে ছুটতে লাগলো।
মেহরাজের মাথায় আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কতটা সময় পেরিয়ে গেল তা মোহরের হিসেব, অবধারণার বাইরে। ঘড়িতে সময় তিনটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। জ্বরে কাতরে বুদ থাকা দূর্বল শরীর টাকে আলতো ভাবে ধরে কোল থেকে নামিয়ে বালিশে রাখলো। খাট থেকে নেমে কাবার্ডের ড্রয়ার হাতরে ছোট্ট জিনিসটা বের করে আনলো। ক্যাপটা খুলে যন্ত্রটার চোখা মুখটা উত্তপ্ত ওষ্ঠের মাঝে গুঁজে দিল মোহর ।
মিনিট খানেক বাদে মুখ থেকে বের করে টেম্পারেচার দেখে স্থুল দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাজের দিকে। ডিজিটাল থার্মোমিটারে কাটকাট বয়ান দিচ্ছে এখনো জ্বর একশো দুই ডিগ্রি। চিন্তায়, উৎকণ্ঠায় ললাটে পুরু ভাঁজ ফেলল। রাত গভীর, কাকে ডাকবে? হসপিটালেও নেওয়ার কথা ভাবছে না।
সুরাহা একটাই, তা হলো মোহর নিজে! ওকেই যা করার করতে হবে। মোহর ভেবে পাইনা ক্যাম্পিং, ফিল্ড ওয়ার্কে এমন হাজারো মানুষের অসুখ দেখেছে, কিন্তু মেহরাজের অসুস্থতা যেন ওকে জাত মতো কাবু করে ফেলে, সামান্য থার্মোমিটার টা ধরতেও হাত কাঁপে।
মেহরাজের গায়ের উপর থেকে কম্বল টা সরিয়ে দিল মোহর, এই মুহুর্তে একটাই উপায় আসছে মোহরের মাথায়। হয় স্পঞ্জ নয়তো কোল্ড শাওয়ার। জ্বরের উত্তাপ যখন মেডিসিন বা সাধারণ টোটকা তে নামতে চাইনা তখন রোগীকে ডিপ স্পঞ্জ নয়তো স্ট্রেইট ব্যাথ করানো ই একমাত্র পন্থা। এতে শরীরের তাপ নেমে যায়।
– শুনছেন? একটু উঠতে পারবেন প্লিজ? আপনার উঠা টা খুব দরকার। এভাবে শুয়ে থাকলে জ্বর কমবে না।
শ্রান্ত চোখ দু’টো আধবোজা রেখেই খুললো মেহরাজ। মোহর নিজের চিকন হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনে চেপে ধরলো। টলমলে পায়ে ওয়াশরুমে এসে দাঁড়ালো। মোহর ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে অবলম্বেই শাওয়ারের নব টা মুচড়ে দিল।
কৃত্রিম বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি এক দুই তিন করে অসংখ্য স্পর্শে মেহরাজের অত্যুষ্ণ শরীর ছুঁয়ে দিল। অদ্ভুত প্রশান্তিতে শরীর শিথিল হয়ে আসলো দেহটা। এতক্ষণের প্রাণঘাতীর ন্যায় উত্তাপটা যেন নিজ দেহকে ছারখার করে দিচ্ছিল মেহরাজের। পানিতে ভেজা চোখে সিক্ত চাহনিতে চেয়ে সম্মোহনী মুখটা দেখল। অতিশয় ব্যগ্র রূপে যে নিষ্পলক চেয়ে আছে এক হাতের বাহু ধরে।
দুজনের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ব্যবধান। তা হয়তো পানির ঝাপটা থেকে বাঁচার প্রয়াস। মেহরাজ তাতে তোয়াক্কা করলো না,খুব নির্মল কায়দায় দূর্বল হাতের এক টানে মোহরকে এনে দাঁড় করালো নিজের সামনে। মোহর পানির বিরতিহীন সিঁচে চোখ খুলে তাকাতে হিমশিম খাচ্ছে। মোহরের অপ্রস্তুত, অস্থির ভাবাবয়ব দেখে তেমন অভিব্যক্তি দিল না মেহরাজ।
ড্যাবড্যাব করে খানিক তাকিয়ে থেকেই ঘাড় নামিয়ে আনলো, দীর্ঘ আশ্লেষের ছোঁয়ার সহিত কপাল টা ঠেকালো মোহরের কাঁধে। দুহাতে কোমর পেচিয়ে ধরে ঘাড় গলার আরও গভীরে মুখ ডুবিয়ে দিল। বাহুডোরের রাজ্যে পুরোপুরি বন্দিনী করে ফেলল মোহরকে। বিহ্বলিত মোহর কোনো অভিপ্রায় আনার সুযোগ টুকুও পেল না। কম্পিত হাতে মেহরাজের প্রশস্ত পিঠে হাত রাখলো। পরনের টি-শার্ট টা খামচে সরিয়ে দিতে গেলে বাহুডোরের বন্ধন আরও দৃঢ়, শক্ত, অভঙ্গুর হয়ে উঠলো। ঘাড়ের মাঝে মুখ খানা শক্তভাবে চেপে অস্পষ্ট গলায় মেহরাজ বলল
– হুসস, নড়বেন না মোহমায়া। শান্তি লাগছে, এই শীতল পানির বর্ষণের চেয়ে আপনার আলিঙ্গনের বর্ষণ টা অনেক বেশিই প্রয়োজন আমায় আরোগ্য দান করতে৷
মোহর টু শব্দটি তো দূর একচুল নড়াচড়ার প্রয়াস করলো না। তা স্বেচ্ছায় নাকি মেহরাজের স্পর্শে বন্দী হয়ে তা নিজের কাছেও অস্পষ্ট। শুধু বর্ষার ন্যায় অবিরাম পানির মুষলধারায় ভিজে গেল দুজন। দুটো শরীরে মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ফাঁক রইলো না, পানির বিন্দুগুলো সানন্দে হৃদয়ে প্রাণসঞ্চার করে ভিজিয়ে, মিশে গেল দুটো মানব মানবীর শরীরে।
.
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে আশপাশ জুড়ে। নিকষ আধারের বুক চিরে সদ্য ফুটে ওঠা মুকুলের মতো সূর্যটা পূর্বদিক থেকে খিলখিলিয়ে উঠবে খানিক বাদেই। আজানের কুলুধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে রাতের পরিবেশ। গভীর, অশেষ নির্জনতাকে ছুটিয়ে দাপটের সহিত বেজে উঠলো মসজিদের মাইক গুলো। সুমধুর ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হলো ভূপৃষ্ঠ। গাছগাছালী দীঘল সময় ধরে কয়েদির ন্যায় মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার রাত পার করে গা এলিয়ে নড়েচড়ে উঠলো খানিক,তার সাংকেতিক হিসেবেই মৃদু কিচিরমিচিরের ঠুনকো শব্দ তুলল পাখিদের ছানারা।
মোহর ফজরের নামাজ শেষ করেই, নিচে নেমে এলো। রান্নাঘরে খুব একটা আসা হয়না, তা অবশ্য সেই মানুষটারই নিষেধাজ্ঞা। তৈজসপত্র রাখা অজ্ঞাত স্থানগুলো হাতিয়ে সবজি,তেল, পাত্র সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সামগ্রী বের করে নিল।
বেশ খানেক সময় ব্যয় করে বাটি ভরে স্যুপ
নিয়ে বেরোলো। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকেই উজ্জ্বল আলোয় আবেষ্টি ঘরটার বিশাল বিছানায় শুয়ে থাকা মেহরাজের দূর্বল শরীর টা চোখে বিঁধলো। মৃদুমন্দ পা ফেলে এগিয়ে এসে বসলো নরম বিছানাটার প্রান্তে। পাশেই পরিচিতার উপস্থিতি অনুভব করে চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে প্রসারিত চোখে তাকালো মেহরাজ সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরিহিত স্নিগ্ধ একটা চেহারার দিকে। চুলগুলো ভেজা, নির্ঘুম একটা রাত পেরিয়েও ক্লান্তি বা অবসাদ যার মুখে হানা দিতে পারেনি।
মোহর ঘুরিয়ে বসলো মেহরাজের সামনা-সামনি। ওকে ধরে উঠিয়ে আধশোয়া করে দিল। গরম স্যুপের বাটিতে চামচ নেড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে মেহরাজের মুখের সামনে ধরলো। মেহরাজ ক্লান্ত, ফ্যাকাশে চোখে মুখে তাকিয়ে আছে, আদও দেখছে কি না বুঝছে না মোহর, মেহরাজ সারাটা রাতই এমন চোখের খোলা বন্ধের অনবরত ধারাতেই ছিল। জ্বরের ঘোরে অনেকেই এভাবে তাকিয়ে থাকলেও আসলে তাদের হুঁশ থাকে নাহ।
তবে মেহরাজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো। ওর মুখের সামনে চামচ টা ধরতেই বাধ্যগত বাচ্চার মতো কোনো বাহানা ছাড়াই হা করে মুখে পুরে নিল তরল জাতীয় খাবারটা। সারাদিন না খাওয়া,আবার রাতের জ্বরে একেবারেই নির্জীব অবস্থা। মোহর স্যুপটা খাইয়ে দিয়ে ওষুধ ও নিজ হাতেই মুখে পুরে দিল মেহরাজের। সবশেষে অনুগত শিশুর মতো চুপটি করে শুয়ে পড়লো মেহরাজ। লোকটা যে বাধ্য, কোমলমতি একটা বাচ্চার ন্যায় আচরণ ও করতে জানে তা হয়তো অসুস্থ না হলে মোহর কোনো দিনও বুঝতো না।
__________________
– মেহরাজ? বাবু কি হয়েছে?
আচানক উচ্চস্বরে কারো আতঙ্কসুলভ বাক্যে চট করে ঘুম ছুটে গেল মোহরের, চোখ খুলে তাকাতেই একদম সামনেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা মেহরাজের শরীর টা দেখতে পেল। ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই আবারও শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর, এবং এবার তা আরও নিকট থেকে
– বাবু?
আম্বি বেগম ছুটে এসে মেহরাজকে ধরতে গেলে মোহর ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– দাঁড়ান। ধরবেন না উনাকে প্লিজ।
আম্বি সকৌতুকে রুষ্ট চাহনিতে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল
– এখন কি নিজের ছেলেকে ধরতেও তোমার পারমিশন লাগবে? কে তুমি, দুইদিন এসে আমাকে এভাবে বলার সাহস হয় কি করে?
মহিলার বিরতিহীন কথার বানে মাথা ধরলো মোহরের। সারারাত পেরিয়ে ভোরের পরেই চোখটা লেগে এসেছিল, বিছানায় এক কোণাতেই ঘুমিয়ে গেছিল ঘাড় কাৎ করে। তবে ভোর হতেই যে আম্বি বেগম ছুটে আসবেন এটা খুব ভালো মতো জানা ছিল মোহরের। কেননা ভোরে স্যুপ বানানোর সময় মালা এসেছিল রান্নাঘরে। ও-ই সব শুনেছে মোহরের কাছ থেকে, এবং ভোর না হতেই যে সব রটাবে এসব ও জানতো মোহর।
– সারারাত জ্বরের চোটে শান্তি পাননি উনি, এই ভোরের দিকেই ঘুমিয়েছে। জ্বর, ঠান্ডার ওষুধ দিয়েছি তাই এমনিতেই ঘুমাবে। আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। উনারও ঘুম ভেঙে যাবে আপনিও ক্লান্তু হয়ে যাবেন
– এই মেয়ে আমার ছেলের রাতভর জ্বর আর আমি কি না এখন জানতে পারছি। আর তুমি বলছো শান্ত হতে। আহারে আমার বাবু
বলে এগিয়ে গিয়ে মেহরাজের সিথানে বসলো। মোহর জানতো আম্বি বেগম ঠিক এভাবেই রাখতে অস্থির হয়ে পড়বে তাই ই জানাতে চাইনি রাত করে। ও স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
– উনি এখন ভালো আছে৷ অনেকটা, শুধু একটু রেস্ট প্রয়োজন। জ্বর নেমে গেছে, এখন একটু ঘুমিয়ে থাকলে শরীর টা ভালো হবে।
আম্বি খাতুন এসব ব্যাপারে মোহরকে অবশ্য গালমন্দ করেন না। কারণ ওর চিকিৎসার হাতে তার নিজেরও বিশ্বাস আছে। তবে উঠলোও না ওখান থেকে। চুপচাপ ছোট মুখ করে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
বেলা বাড়লে একে একে সকলেই আসলো মেহরাজের ঘরে ওকে দেখতে। তবে সকলেই ভীষণ সাবধানে নীরবতা পালন করলো। যাতে কোনো ভাবেই মেহরাজের ঘুম না ভাঙে। আর যাই হোক মেহরাজ হলো এ বাড়ির মধ্যমণি। ওর যেকোনো কিছুতে সকলে অনেক বেশি উদ্বীগ্ন হয়ে ওঠে।
প্রায় সকলেই মোহরকে ধন্যবাদ জানালো, আজহার মুর্তজা কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তার একমাত্র ছেলের অসুস্থতায় সেবা করার জন্য। শাহারা বেগমের মতে এতে কৃতজ্ঞতা হওয়া মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়, কেননা মোহর মেহরাজের সহধর্মিণী। ওর সুখে দুঃখে, ভালো মন্দে সবসময়ই মোহরই পাশে থাকবে সাহায্য করবে। এসব কথা নিয়ে অবশ্য মোহর ওতটা মাথা ঘামায়নি। আপাতত মেহরাজ সুস্থ হওয়া নিয়েই ওর যত চিন্তা।
বারংবার ভয়ভয় করছে, দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে আবারও যদি জ্বর বাড়ে। মোহর কেন যে রাতের দৃশ্য গুলো ভুলতেও পারছে না। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মেহরাজের রুগ্ন, ফ্যকাশে পাণ্ডুর মুখটা। ইশশ কতটায় না কষ্ট হয়েছে ওর? ভাবতেই মোহরের বুকে চিনচিনে ব্যথার আবির্ভাব হচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে বসলো মেহরাজের পাশে।
ঘর এখন ফাঁকা, সবাই যাওয়ার পরে গিয়েছে আম্বি বেগম, তিনি নিজে জান নি, সাঞ্জে আর কাকলি মিলে ধরে নিয়ে গেছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে বসে ছিল তিন ঘন্টা ধরে।
বেলা গড়িয়ে সাড়ে দশটা বেজেছে। মেহরাজ এখনও ঘুমে বুদ। মোহর অনিমেষ, নিমজ্জিত চাহনি স্থির রেখে চেয়ে রইলো মেহরাজের মুখ পানে। লোকটা কেমন অদ্ভুত কান্ড করে যাচ্ছে দিনদিন। এভাবে হুটহাট কাছে চলে আসে কেন? সে কি জানে না এতে মোহরের ছোট্ট হৃদবক্ষে প্রচণ্ড তুলকালাম ওঠে। অশান্তির ঝড়ের তান্ডব বয়ে যায়! তবুও কেন এমন করে!
মোহরের আরও মনে হয়, আচ্ছা! কাল রাতে যে ওইভাবে কোমর আঁকড়ে ধরলো, ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল, জড়িয়ে ধরলো, অদ্ভুত কিসব কথা বলল ওসব ই কি জ্বরের ঘোরে বলেছে? নাকি বাস্তবেই? আচ্ছা লোকটা ওত কঠিন কঠিন কথাও জ্বরের ঘোরে কি করে বলে দিল?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে, হাতটা তুলে মেহরাজের কপালে স্পর্শ করলো মোহর। জ্বর কমে গেছে অনেকটা। মোহর প্রাণপণে চাইলো আর যেন ওমন যন্ত্রণাদায়ক অসুখ টা না করে মানুষটাকে। খুব দ্রুতই যেন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখনি মোহরের সকল ধ্যান ধারণা ভেঙে, সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজে কলকাঠি নেড়ে দূর্বল গলায় মেহরাজ বলল
– মোহমায়া!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️
#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_২৪
– আপনি কাল সারারাত জেগে ছিলেন মোহ?
ললাটে বলিরেখার ন্যায় পুরু ভাঁজ পরলো মোহরের। ঘুম ভেঙেই এমন একটা প্রশ্ন করবে এটা নেহাৎ চিন্তার বাইরে ছিল,
– এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন আপনি?
– আমি কাল রাতের কথা ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না
মোহর হতভম্ব হলো হয়তো খানিক, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
– আপনি মাত্র জাগলেন, এর মাঝেই মনে পড়ছে কি না এসব ভাবতে লেগে গেলেন?
মেহরাজ কনুইয়ে ভর দিয়ে আস্তেধীরে উঠে বসলো। দূর্বল শরীরে পিঠ টা এলিয়ে দিল বিছানার হেডবোর্ডে। ঘনঘন দুই তিনবার নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে, মোহর খুব মনোযোগী ভাবে খেয়াল করলো অসুস্থতা সত্ত্বেও মেহরাজের চোখ দু’টো এখনো জ্বলজ্বলে, স্বচ্ছ, প্রগাঢ়।
– একটু পানি দিতে পারবেন?
মোহর উঠে এসে সাইড টেবিলের জগ থেকে পানি ঢেলে মেহরাজের সামনে গ্লাসটা ধরলো। মেহরাজ কয়েক চুমুক দিয়ে আবারও রেখে দিল গ্লাসটা। মোহর নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল
– এখন শরীর কেমন লাগছে?
মেহরাজ বার দুয়েক ঘাড় নাড়ালো, ঠান্ডায় দেবে যাওয়া গলায় বলল
– ভালো লাগছে।
– বৃষ্টিতে ভিজলে যখন জ্বর এসে যায় তাহলে ভিজলেন কেন
মেহরাজ দৃষ্টি প্রসারিত করে তাকালো, মোহরের মেদুর গালের জিজ্ঞাংসুক কৌতুহল অবলোকন করে ধীমি গলায় বলল
– এর আগে তো ভিজিনি তাই জানতাম নাহ।
মোহরের প্রত্যুত্তরের আগেই আবারও নিজেই বলল
– আপনিও তো ভিজেছিলেন, আপনার জ্বর হয়নি
– আমি ঠিক আছি,সুস্থ আছি৷ এসবে আমার কিছু হয়না
– হবেও না
মেহরাজের কথায় মোহর ভ্রুকুটি করে বলল
– আপনার কেন মনে হচ্ছে হবে না
– ডক্টর নিজেই যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে আমাদের মতো অসহায় মানুষ গুলোর কি হবে। তাই কিছু হবে না
মোহর জবাব দিল না। বরং বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ব্যস্ত গলায় বলল
– আপনি রেস্ট করুন।
বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে মেহরাজ তড়িৎ গলা বাড়িয়ে বলল
– কোথায় যাচ্ছেন?
মোহর পা থামালো। পুরোপুরি না ঘুরে শুধু ঘাড় কাৎ করে বলল
– একটু কাজ আছে নিচে।
মেহরাজের খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো ‘ যাবেন না,এখানেই থাকুন আমার পাশেই। আপনাকে কেন সবসময় নিজের কাছে রেখে দিতে পারিনা বলুন তো, এতো কাছে থেকেও আপনি কেন দূরত্বমা হয়ে থাকেন। ‘
কিন্তু কিছুই বলা হলো না। মোহর ‘ আসছি ‘ বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মেহরাজ বিছানার হেডবোর্ডে ঘাড় টা এলিয়ে দিল। নির্জীব দৃষ্টি স্থবির হলো সিলিংয়ের দিকে। তীব্র জ্বর, বিমার যাকে দমাতে পারেনি সেই দৃষ্টি মুহুর্তেই নিস্তেজ, নিষ্প্রভিত হলো৷ ধূসর চোখ জোড়ায় ভর করলো অজস্ব মলিনতা। আচ্ছা! এমনটা কেন হয়? নির্দিষ্ট একটা মানুষকে ঘিরে এইযে অস্থিরতা বেচ্যাইন হয়ে যাওয়া, অন্তঃস্থলে ভূকম্পনের ন্যায় তীব্র কাঁপুনি দিয়ে ওঠা এসব আগে তো হয়নি? আগে তো কারো দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি টলমলে, বেহায়া হয়ে ওঠেনি। আর নাইবা কণ্ঠনালী এমন শব্দের দারিদ্র্যতায় মিইয়ে পড়েছে। সদা স্পষ্টভাষী, কাঠকাঠ বাচনভঙ্গি, স্ট্রেইটকাট ব্যক্তিত্বের ভীত এমন কঠিন ভাবে নাড়িয়ে দিল শুধুমাত্র একটি চেহারা? একটি উপস্থিতি?
নাহ,কোনো উত্তর নেই? কোনো সমাধা, জবাব আসেনা ভেতর থেকে। শুধু আসে একঝাঁক দীর্ঘশ্বাস, ভারী প্রশ্বাস।
নিচে নেমে আসতেই ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসে থাকা শাহারা বেগমের পৌঢ়া চেহারটাই চোখে পড়লো। মোহর দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতে নিলে শাহারা ওকে দেখেই বললেন
– মোহর, এদিকে আই তো।
মোহর সেদিকেই যাচ্ছিল। দিদার আদেশে গিয়ে পাশে বসলে, বৃদ্ধা বললেন
– আমার দাদুভাই কেমন আছে রে? জ্বর কমেছে?
– হ্যাঁ দিদা কমেছে। আমি উনার জন্যেই নাস্তা বানাতে যাচ্ছি
– ঘুম ভেঙেছে ওর?
মোহর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল, দুয়েকটা কথাবার্তা সেরে উঠে এলো সেখান থেকে। রান্নাঘরে তখন কেও নেই। সকলের নাস্তা করা অনেক আগেই শেষ। মোহর ফ্রুট সালাদ, ডিম সিদ্ধ, টোস্ট করে নিল। তার সাথে অ্যাভোকাডো জুস। মেহরাজ ভারি খাবার খুব কম খায়, সকালে তো কখনোই না। আর অসুস্থ অবস্থায় মোহর ওকে কোনো রিচ ফুড দিতেও চাইনি।
বেশ ঘন্টা খানেকের আগেই সব প্রস্তুত করে ট্রে হাতে বেরিয়ে এলো। বসার ঘর পেরিয়ে আসতেই কলিং বেলের শব্দ এলো কানে।আশেপাশে কেও নেই মোহরের হাত দুটোও জোড়া খাবারের ট্রে তে। তাই ভাবলো ট্রে টা নামিয়ে রেখে দরজা খুলে দিবে কিন্তু তার আগেই সিড়ি বেয়ে সাঞ্জে কে নেমে আসতে আসতে বলল
– ভাবী, কিছু লাগবে তোমার?
মোহর ট্রে টা নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল
– কলিং বেল বাজছে, দরজায় কেও দাঁড়িয়ে আছে। খুলে দাও তো আমার হাত দুটোই ফুল তাই যেতে পারছি না
– আরে প্যারা নাই। তুমি যাও আমি দেখছি
মোহর স্মিত হেসে উপরে উঠে এলো। ঘরে ঢুকলেও বিছানায় মেহরাজকে দেখতে পেলো নাহ। তার পরিবর্তে একগাদা প্যান্ট, শার্টের স্তূপ করা। বিস্মিত হয়ে এক পা এগিয়ে যেতেই হুট করে একটা শার্ট উড়ে এসে মুখের উপর পড়তে নিলেই এক হাত তুলে ধরে ফেলল মোহর। শার্টটা হাতে ধরে বিব্রতকর চেহারায় বাঁ দিকে তাকালে চোখ মুখ মুদে এলো মোহরের।
মেহরাজ খালি গায়ে শুধু তোয়ালে পেচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফর্সা গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে সেই সাথে ভেজা চুলগুলো তেও। চুলের পানি টপকে পড়ছে ঘাড়, কানের পেছন আর কলির দিক থেকে। মোহর হতভম্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই মেহরাজ দরজার দিকে তাকালো, মোহরের আড়ষ্টতায় ভরা মুখটা দেখে তড়িঘড়ি করে গায়ে একটা শার্ট জড়িয়ে নিল। তবে ভাবাবেগের খুব একটা পরিবর্তন হলো না, মোহর নিজেই বলে উঠলো
– আপনি এসব কি করেছেন?
– আমার প্যান্ট টা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছে, কখন থেকে খুঁজছি।
মোহর জড়তায় আড়ষ্ট জিহ্ব ঠেলে বাধা বাধা গলায় বলল
– আ আপনি সরুন আমি দেখছি
মেহরাজ আবারও কাবার্ডের ভেতর থেকে একটা একটা করে পোশাক বের করতে করতে বলল
– আপনি খুঁজে পাবেন না। আমিই দেখছি
– আপনাকে এদিকে আসতে বললাম তো। আমি দেখছি আমার কি চোখ নেই
মোহরের এহেন কড়া গলায় সশব্দে চমকে উঠলো মেহরাজ। ঘাড় ঘুরিয়ে অদ্ভুত ভাবে তাকালো মোহরের দিকে। মোহর খাবারের ট্রে বিছানার উপরে রেখে এগিয়ে গেল, মেহরাজের দিকে না তাকিয়েই ডার্ক ব্রাউন রঙের কাঠজাতীয় পদার্থের তৈরি কাবার্ডের এক পাশের বন্ধ থাকা দ্বারটা খুললো। সেখানে একপাশে হ্যাঙারে স্যুট ঝুলানো। তাকের উপরেই রাখা ভাঁজ অপসৃত করা টানটান ইস্ত্রিযুক্ত শার্ট,আর তার পাশেই ধোপদোরস্ত প্যান্টের স্তূপ।
– এগুলো খুঁজছেন তো?
মেহরাজ থমকে রইলো খানিক। নিজের থুতনি সমান উচ্চিতায় ফিট্ খানেক দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর শুকনো গলায় বলল
– হ হ্যাঁ এগুলো।
মোহর একটা প্যান্ট নিয়ে মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
– ওদিকে যাব এবার
মেহরাজ বাঁকা বাঁকা চোখ কুচকে তাকিয়ে সরে গেল। মোহরের কণ্ঠে স্পষ্ট দাম্ভিকতা , শাসনের কড়া রেশ। ভ্রু যুগল ও কুঞ্চিত। মেহরাজ বাধ্যগত অনুচরের ন্যায় চুপচাপ সরে গেল। মোহর নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা কাপড় গুলো তুলে এক এক করে আবারও ভাঁজ করতে লাগলো। ততক্ষণে মেহরাজ প্যান্ট শার্ট পরে প্রস্তুতপ্রায়। মোহর ওর সামনেই পিঠ করে রেখে কাজ করছে৷ মেহরাজ এক পলক তাকালো বিছানাতে রাখা খাবারের ট্রে-এর দিকে। তক্ষুণি রিনিঝিনি কণ্ঠের গম্ভীর শব্দগুচ্ছ কানে এলো
– খাবার গুলো খেয়ে নিন।
একে একে সব কাপড় গুলো আবারও প্রত্যাবর্তন করলো সুসজ্জিত অবস্থায়। কাবার্ডের দ্বারদুটি খটাশ শব্দ করে বন্ধ করে পেছনে ঘুরে তাকালে দেখলো মেহরাজ ফোন নিয়ে বসেছে,সামনেই খাবার গুলো আগের ন্যায় পড়ে আছে। মোহর ক্রুদ্ধিত হলো, একে তো অসুস্থ শরীরে সকাল বেলায় গোসল করে রেডি হয়ে বসেছে তার উপর এতক্ষণ ধরে খাবার গুলো রেখেছে মুখে অব্দি তোলেনি।
– আপনি না খেয়ে ফোন ধরছেন কেন?
মোহরের ঝাঝালো গলার স্বরে হকচকিয়ে চোখ তুলে তাকালো মেহরাজ। একদম সামনেই দাঁড়িয়ে লম্বা, চিকন, মোহিত চেহারার মেয়েটা। চেহারা জুড়ে যার বিরক্তি, ক্রুদ্ধতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ টা প্রচুর চড়া, কিন্তু কোনো একটা কারণে তা সূক্ষ্মভাবে দমিয়ে রেখেছে। মেহরাজ অতি স্বাভাবিক গলায় বলল
– অনেক ইম্পর্ট্যান্ট একটা প্রজেক্টের গ্রাফ তৈরি করার কথা ছিল কাল৷ আজ দুপুরেই লাগবে। অসুস্থতার জন্যে কিছুই কমপ্লিট হয়নি। তাই অভিম..
পুরোটা শোনার মতো ধৈর্য হয়তো মোহরের এখন নেই। ভীষণ কড়া ভাবেই বলল যে
– তো হয় নি যখন এই কয় মিনিটেও তো হবে না নিশ্চয়। এক তো অসুস্থ শরীরে সকালেই গোসল করলেন, এখন খাবার না খেয়েই রেডি হয়ে ফোন নিয়ে বসেছেন। এবার কি না খেয়েই চলে যাবেন?
একদমে বললেও দমে গেল না। খাবারের ট্রে টা হাতে তুলে এনে বসলো মেহরাজের পাশেই। খপ করে হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানার উপরে রাখলো। ফর্কের চোখা মুখে ফ্রুটস গুলো বিঁধিয়ে তুলে মেহরাজের মুখের সামনে ধরলে মেহরাজ এক মুহূর্ত কাল ব্যয় না করেই হা করলো।
একবারে পুরোটা খাবার শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো মোহর। জুসের গ্লাসটা মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বেড়িয়ে গেল।
মিনিট খানেকের মধ্যে আবারও এলো ঘরে। তবে এবার ফাঁকা হাতেই এসেছে। ড্রয়ার থেকে ওষুধ গুলো বের করে মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিল। ততক্ষণে মেগরাজ গায়ে ব্লেজারটা জড়িয়ে বের হবার প্রস্তুতি নিয়েছে। ওষুধ ও খেলো মেহরাজ চুপচাপ। বেরিয়েই যাচ্ছিল, কি একটা ভেবে দরজার সামনে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়িলো। এক হাত পকেটে গুঁজে শরীর বাঁকিয়ে ফিরে বলল
– আমি কি আসতে পারি মিসেস?
মোহর বিহ্বলিত হয়ে তাকালো মেহরাজের দিকে। ওর চেহারাটা দুষ্টু হাসিতে ভরা, অধর যুগলের কোণায় কিঞ্চিৎ বাঁক ধরানো হাসি। চঞ্চল চোখ দু’টো নাড়িয়ে বলল
– আজ প্রথম মনে হলো আমি বিবাহিত। তাই, বউ যখন আছে বের হওয়ার সময় তার অনুমতি নেওয়াটাও তো প্রয়োজন, নয় কি?
মোহরের জড়তাকে বাড়িয়ে আবারও বাঁকা ঠোঁট প্রসারিত করলো মেহরাজ। চোখে মুখে কৌতুকতা। মোহর বিব্রত হলো, আসলে তখন কিভাবে যে ওমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল ওটা নিজেও বুঝতে পারেনি। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল তখন আর বিব্রতি প্রকাশ করার অবকাশ ছিল না।
এখন মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভুল করে ফেলেছে। মেহরাজের চেহারায় উপচে পড়া দুষ্টুমিপূর্ণ আভাস এটাই বোঝাচ্ছে মোহরকে।
কোনো কথা ছাড়াই ধপ করে উঠে বারান্দার দিকে চলে গেল মোহর, তা অবশ্যই মেহরাজের এহেন দৃষ্টি আর পরিস্থিতি থেকে পালাতে।
অস্থির, উচাটন মনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেও মেহরাজ হয়তো ক্ষান্ত হলো না। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলে বাড়ির ইয়ার্ড টা স্পষ্টভাবেই দেখা যায়, সেখানেই পিচ ব্ল্যাক রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতে খুলতে তাকালো একদম সোজাসুজি বারান্দার দিকে, এক হাত উঁচিয়ে টাটা দেওয়ার মতো করে হাত নাড়িয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে বসলো মেহরাজ। মুহূর্তেই তীব্র শব্দ তুলে ইঞ্জিনের দাপটে ছুটিয়ে নিল গাড়িটা।
মোহর না চাইতেও লজ্জায়, জড়তায় দৃষ্টি নামিয়ে নিল, পাতলা ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরলো সজোরে। লজ্জা, ভীষণ লজ্জা শরম ঘিরে ধরলো ওকে। মেহরাজের শরীরের মন মাতানো কড়া সুবাস টা এখনো ওর গায়ে লেগে আছে, তার সাথে প্রকৃতির উচ্ছ্বাসিত আনল আর মেহরাজের অদ্ভুত কর্মকাণ্ড গুলো যেন মোহরকে আচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত। পায়ের তলার সাদা ঝকঝকে টাইলস টা কড়া হীম শিরশিরানি তুলে পা থেকে বুক অব্দি কামড়ে ধরছে যেন।
প্রাণপণে চেষ্টা করেও উপেক্ষা করতে পারলো না প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় সম্বেদন। মনের বেপরোয়া বেহায়া ইচ্ছে গুলো যেন ক্রমেই নির্লজ্জ, ভিত্তিহীন চাহিদা করে বসলো। নিজের অজান্তেই গায়ের জামার গলার অংশটাতে নাক ঠেকিয়ে বুকভরে প্রগাঢ় নিঃশ্বাস টেনে নিল। নাসারন্ধ্র ভেদ করে মস্তিষ্কে মিশে গেল অত্যাধিক মাদকময়ী পুরুষালী ঘ্রাণটা। অবিচ্ছেদ্য স্পর্শানূভুতি, এক অন্যরকম উৎকণ্ঠা, তটস্থতায় জর্জরিত হতে থাকলো প্রাণোমন্দির। মোহর হয়তো বুঝতেও পারছে না ওর সমস্ত মন,মস্তিষ্ক, অনুভূতি, সমস্ত সত্তা জুড়ে একটা মানুষের প্রভাব বিষক্রিয়ার ন্যায় শিরা উপশিরায় ছুটে চলেছে বিদ্যুতের বেগে, যার অনুসারের নূন্যতম আন্দাজও হয়তো নেই কারো।
______________________
সন্ধ্যার সময়ে নিউ মার্কেটের পরিবেশ জুড়ে ঝিকিমিকি লাইটের চাকচিক্য। মানুষ তটস্থ, ব্যস্ত পায়ে নিজেদের চাহিদা যুগিয়ে বিকিকিনির প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।
বড়ো একটা বেকারি শপ, এই বেকারির কেক পুরো শহর জুড়েই বিখ্যাত। দুই পাউন্ডের একটা চকলেট ফ্লেভারের কেকের বক্স নিয়ে বেরোলো শ্রীতমা। ভেতরে ভেতর ভীষণ উচ্ছ্বাস, অস্থিরতা জমে আছে তা ওর প্রাণোচ্ছল চেহারাতেই স্পষ্ট।
বেকারি থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু এই হলো বিপদ, রাস্তা পার হতে ওর ভীষণ ভয় করে। একা একা আদও রাস্তা পার হয়নি কখনো। এখন কি করবে? ইস একা একা কেক নিতে আসাটাই হয়তো ভুল হয়েছে। কিই বা করতো মোহরটাও তো এলো না আর মেডিক্যালে। আসলে নাহয় ওর সাথেই আসা যেত। রাত ও হয়েছে বেশি দেরি করলে ওর রুমমেট দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরবে। অদ্ভুত মেয়ে একটা নয়টা না বাজতেই ঘুমে তলিয়ে যায়,এ কি করে রাত জেগে পড়ে মেডিক্যালে অ্যাডমিশন পেয়েছে ওই জানে।
শ্রীতমার ভাবনার মাঝেই হুট করে একজন পাশে এসে দাঁড়ালো, কানে ফোন ধরে রেখেই এদিক ওদিক একবার করে তাকিয়ে রাস্তায় পা রাখলো। শ্রীতমা কোনো দিক না তাকিয়েই পেছন পেছন হাঁটা ধরলো ছেলেটির। এই ওর কাজ একা থাকলেই যার তার পিছু ধরে রাস্তা পার করে ফেলে।
পুরো রাস্তা টা নির্দ্বিধায় পার করে একদম এপাশে চলে এলো। এমনিতেই কাল একটা স্পেশাল দিন, মনটা খুশি খুশি। আর লোকটার জন্য রাস্তাটাও পার হয়ে গেল, শ্রীতমার ইচ্ছে হলো লোকটাকে একটা ধন্যবাদ জানানো। খুশিয়াল মনে উৎফুল্লতা সহিত ধন্যবাদ বলার জন্য মুখ খুলেছে ঠিক তখনি ছেলেটা কি ভেবে ধপ করে ঘুরে দাঁড়ালো, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকায় শ্রীতমার হাতের সাথে ধাক্কা লেগে কেক টা ঠাস করে রাস্তার মধ্যে পরে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শ্রীতমা, বিস্ফোরিত চোখে একবার রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকা কেক বক্সের দিকে তাকালো আবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। পরপর তিনবার এমন ঘাড় ঘুরাঘুরির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলে ওকে থামিয়ে দিয়ে পুরুষালী গলা টা বলে উঠলো
– আরে মাথা ঘুরে যাবে তো,থামুন
শ্রীতমার চোখে এবার ক্রুদ্ধতার অগ্নি ফুটলো। ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে বলল
– আপনিইই, কে আপনি!
শ্রীতমার এহেন উত্তেজিত হওয়ায় ও অপরপাশের মানুষটির কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল না। বরং শ্রীতমার রাগ তড়তড় করে বাড়িয়ে দিয়ে ও হতবুদ্ধির মতো বলল
– আমি? আমি অভিমন্যু
– সে আপনি অভিমন্যু হন আর ভূত হন আমার কি। আপনি আমার কেক ফেলে দিলেন কেন
অভিমন্যু বিব্রতকর চোখে তাকালো কেকের বক্সটার দিকে। কেমন আলসে গলায় বলল
– আসলে আমি খেয়াল করিনি, সরি
– সরি? সরি বলছেন? তাও এভাবে? আপনি যে আমার কতো বড়ো ক্ষতিটা করে দিলেন আপনার চেহারাতে কোনো অনুতপ্ততায় নেই। আবার বলছেন খেয়াল করিনি, বেক্কল বেডা ছেলে
বেক্কল বেডা ছেলে! এটা আবার কি। বিড়বিড়িয়ে বলল অভিমন্যু। কথাটার মানে না বুঝলেও মেয়েটির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো প্রসংশাবাণী সে বলেনি, তবে এমন রাস্তার মাঝে চেঁচামেচি করার জন্য অভিমন্যুর বেশ রাগ হলো এবার
– আরে থামুন। আপনি নিজে দেখে হাঁটতে পারেননি? আমার পেছনে কি করছিলেন? আবার একটা সামান্য কেকের জন্য রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করছেন!
– আপনি আসলে একটা বেহুদা, আজাইরা, অসভ্য মানুষ। এক তো অপরাধ করেছেন আবার পায়ে পা মাড়িয়ে ঝগড়া করছেন?
– আমি কখন ঝগড়া করলাম, আপনি নিজেই তো চেঁচাচ্ছেন। দয়া করে চুপ করুন আশেপাশের লোকজন দেখছে। গলা তো না মাইক একটা
অভিমন্যুর এহেন কথায় আরও তেঁতে উঠলো শ্রীতমা। এক আঙুল তুলে কিছু একটা বলবে তার আগেই অভিমন্যু ওর আঙুল চেপে ধরে বলল
– সাট আপ। আরেকবার ও চেঁচাবেন না রাস্তার মাঝে। আপনার কোনো প্রেসটিজ না থাকলেও আমার আছে। কেক পড়ে গেছে তো? এনে দিচ্ছি আমি
বলে শ্রীতমাকে কিছু বলার সুযোগ টাও না দিয়ে হনহন করে রাস্তা পার করে বেকারিতে ঢুকলো। শ্রী রাগে ফোসফাস করে বলল
– অসভ্য, বেদ্দপ, কানা বেডা ছেলে। আমার সাধের কেকটা। এখন আমি কি করবো!
__________________
পুরোটা দিন কেমন চাপা একটা অস্থিরতা নিয়ে পার করেছে মোহর। অদ্ভুত একটা উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ বুকের ভেতরে বিক্ষোভ তুলেছে। ক্ষণে ক্ষণে মানুষ টার কথা মনে পড়ছে। বারবার মনে হচ্ছে সময় টুকু যেন পেরোচ্ছেই না! সেই কখন বেরিয়েছে। এখনও কি বাড়িতে ফেরার সময় হয়নি? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডিজিটাল ওয়াল ক্লকের দিকে। ঠিক আটটা বেজে সাতাশ মিনিট। এখনো আসছে না কেন? অনেকদিন তো বিকেলেও চলে আসে,তাইলে আজ আসছে না কেন?
– ভাবী তুমি দাভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছো?
সাঞ্জের গলায় এহেন কথা শুনে অন্যমনস্কটা ছুটে ব্যস্ত চোখে তাকালো। বিজড়িত গলায় বলল
– কই না তো
– সেই তখন থেকেই তো একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছো একবার দরজার দিকে। তো এ বাড়িতে যার জন্যে তুমি অপেক্ষা করবে এমন মানুষ তো দাভাই ছাড়া আর কেও নেই
মোহর অপ্রতিভ হলো। বেশ অপ্রস্তুত ও বোধ করলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল
– নাহ তেমন কিছু না। তাথই আপা কোথায়?
সাঞ্জে টিভির দিকে তাক করে রিমোট টা চাপতে চাপতে বলল
– ওর কথা বাদ দাও। মহিলা আবারও দরজায় খিল দিয়ে বসেছে। ওর তো কাজই একটা
অন্যসময় হলে হয়তো কিছু বলতো। কিন্তু মোহরের অন্যমনস্ক মনে আর কিছু আসলো না। ঠোঁট গোল করে শুধু ও বলল। ঠিক তখনই কলিং বেলের ধাতব শব্দটা জোরসে বেজে উঠলো। তৎক্ষনাৎ ব্যগ্র হয়ে উঠলো মোহরের বক্ষস্থল। যার জন্যে অপেক্ষা করছিল তার আগমনী আভাসে বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো। সাঞ্জে দুষ্ট গলায় বলল
– নাও তোমার হাসব্যান্ড এসে গেছে, যাও যাও দৌড়ে দরজা খুলে দাও। ফিল্মি স্টাইলে গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু টুমু ও দিয়ে দিতে পারো
নিজের চেয়েও অনেকটা ছোট মানুষটার মুখে এসব কথা শুনে অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আমি একটু দিদার ঘরে যাচ্ছি তুমি দরজা টা খুলে দিও তো
বলেই তড়িঘড়ি করে উঠে গেল। এখানে আর এক মুহূর্ত ও থাকতে পারবে না, ওই লোকটার চেহারার দিকে তাকালেও হয়তো শরমে গলে যাবে মোহর।
.
রাতের সকল পাঠ চুকিয়ে এখন সকলে যে যার ঘরে ঘুমাতে গেছে। মোহরকেও এখন ঘরে ফিরতে হবে, মেহরাজের শরীর টা ভালো না দেখে শাহারা বেগম যেন একটু আগেই পাঠিয়ে দিল ওকে। মোহরের ভেতর টাও আনচান করছিল মানুষটার চেহারা টুকু একটা বার দেখার তাগিদে, কিন্তু এখন যতই এগোচ্ছে ততই ব্যগ্র উৎসুকতায় কামড়ে ধরছে বুকের মাঝে।
আস্তে করে দরজা টা ঠেলে ফাঁক করলো। ঘরের ভেতর ঢুকে মেহরাজকে কোথাও দেখতে না পেয়ে যেন একটু স্বস্তি পেল মোহর। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে ঠিক তখনই মেহরাজ বারান্দা থেকে ঢুকলো ঘরের ভেতর। একটা বারের জন্য চোখাচোখি হতেই মোহর দৃষ্টি নামিয়ে নিল। হাত মুখ মুছে বিছানার গোছাতে গোছাতে আড়চোখে তাকালো মেহরাজের দিকে, মেহরাজ কুশান টা ঠিক করে ডিভানে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ টা কোলের উপর রাখলো। যার ঘর তাকেই ডিভানে থাকতে দিয়ে নিজের বিছানাতে শুতে খুব একটা ভালো লাগে না মোহরের, তার উপর অসুস্থ অবস্থায় ওই সরু জায়গাটাতে তাকে শুইয়ে নিজে বিছানাতে আরাম করে শোবে এটাও দৃষ্টিকটুর চেয়ে বিবেকে বেশিই বাঁধলো।
কিন্তু বলবেও না কিভাবে, লোকটার দিকে তাকাতেও অপ্রস্তুত লাগছে। বিছানাতে এসে নিজের পাশে শুতে বলবে কিভাবে! তবুও নিজের সমস্ত বাধ, জড়তা, অপ্রিতিকর উৎকণ্ঠা দমিয়ে জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে ধীমি গলায় বলল
– আপনি বিছানাতে এসে শুয়ে পড়ুন
মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে, না শোনার অভিব্যক্তির ন্যায় চোখ কুচকে জিজ্ঞাংসুক দৃষ্টিতে তাকালে মোহর আবারও বলল
– আপনি বিছানাতে আসুন। আজ আমি ডিভানে ঘুমাবো
মেহরাজ মুখ ঘুরিয়ে নিল। ল্যাপটপের কীবোর্ডে আঙুলের চালনা পুনরায় অব্যাহত করে বলল
– নো নীড। আপনি বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ুন। আই আম ওকে
– না, আমি বলছি তো আপনি বিছানাতেই ঘুমাবেন
মেহরাজ স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে, এবার বেশ ঘুরে সুরেই তাকিয়েছে, মোহর তখনও ভ্রুকুটি করেই আছে। মেহরাজ মোহরের সমস্ত জোর নিভিয়ে দিয়ে বলল
– আজকাল আপনার ব্যবহার বেশ বউ বউ লাগছে মোহমায়া।
মোহর খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিভে গেল কথা শুনে। তবে দমলো নাহ। জেদি গলায় বলল
– এসব শুনতে চাচ্ছিনা। আপনি এসে নিজের বিছানাতে ঘুমান। নয়তো আমিই চলে যাচ্ছি ওই ঘরটাতে। আপনি একাই থাকুন ঘরে কাওকে ডিভানে শুতে হবে না
বলে পা বাড়াতে নিলে মেহরাজ বেশ গম্ভীর গলায় বলল
– ওই ঘরে যাচ্ছেন? থাকতে পারবেন তো? না৷ মানে যদি আবারও
মেহরাজের কথা সম্পূর্ণ না হতেই থেমে গেল। মোহর অসহায় মুখ করলে মেহরাজ স্মিত হেসে উঠে দাঁড়ালো। বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বলল
– আপনি যখন বলছেন ঠিকাছে থাকছি আমি বিছানাতে, ও ঘরে যাওয়ার দরকার নেই।ভয় পাবেন জানি
মোহর ও দ্বিতীয় শব্দটি করলো না। চুপচাপ ডিভানে এসে শুতে গেলে মেহরাজ আবারও বলল
– এমনিতে কোনো সমস্যা নেই,তবে ডিভানের একদম সামনেই ব্যালকনি তো রাতে কিছু শব্দ শুনলে বা দেখলে তাকাবেন নাহ।
মোহর ভয়ার্ত চেহারায় একবার তাকালো বারান্দার দিকে। একেবারে খা খা করছে। বাতাসে গাছ গুলোর নড়াচড়া টাও কেমন ভয়ংকর লাগছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে মেহরাজের দিকে তাকালো। মেহরাজ ওকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল
– আমি তো জানিই এমন হবে। কিন্তু কি করবো আপনিই জেদ ধরলেন ডিভানে ঘুমাবেন, আর আমার পাশে থাকতে বললে তো ভাববেন আমি সুযোগ..
পুরোটাও শেষ করতে পারলো না। মোহর তড়িঘড়ি করে উঠে এসে বিছানাতে বসে অপ্রস্তুত গলায় বলল
– মাঝখানে বালিশ দিলেই হবে
.
.
.
#চলমান