#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_২১
সকালের মৃদু মিষ্টি প্রভাত কিরণ উঁকি দিল মোলায়েম কাপড়ের পর্দার ফাঁক দিয়ে। এক মুঠো হলদে রবিকর ঔজ্বল্য এসে হানা দিল মোহরের চোখে। উপচে পড়া নরম আলোর তীক্ষ্ণতায় চোখে টোকা পড়তেই কুচকে তাকায়। সকাল হয়েছে বুঝতে পেরেই আড়মোড়া ভেঙে ধীরগতিতে উঠে বসে৷ জানালার স্বচ্ছ কাঁচটা দিয়ে নীলাভ আকাশের বুকে শুভ্রতার ছড়াছড়ির দৃশ্যটা ভীষণ প্রাণোহর লাগছে।
মুহুর্ত খানেক সেদিকেই তাকিয়ে রইলো প্রফুল্লচিত্তে। আজ মনটা কেমন হালকা লাগছে, যেন কালো মেঘের জমাট ছাড়িয়ে পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘেরা ছোটাছুটির খেলা ধরেছে অন্তঃস্থলে, বহুদিন বাদে মনের মাঝে এক পশলা শৈথিল্যের অনিল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে, অজানা কারণেই ভেতর ভেতর শিউলির ন্যায় আনন্দানুভূতির সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। এই বেওয়ারিশ অনুভূতি, রাঙা ফিতেয় মোড়ানো ব্যকুলতা ভরা চাঞ্চল্যর হেতু খুঁজে পেল না মোহর।
সিথান পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে ঘরের আশপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও মেহরাজ কে দেখতে পেল না। মেহরাজের অনুপস্থিতি মৌনতায় অবগত করে দিল মোহরকে। প্রায়ই অনেক ভোরে বেরিয়ে যায় মেহরাজ। লোকটা রাতে কখন ঘুমাই মোহর টের পাইনা, আবার হার রোজ ঘড়ির কাটার স্থানের একচুল নড়চড় হয়না তার ঘুম থেকে জাগবার। একটা মানুষ এতটা সময়নিষ্ঠবান, পাংচুয়াল কি করে হয় মোহর বুঝে পায় না।
শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে একবারে বেরোলো মোহর ওয়াশরুম থেকে। মেডিক্যালে আজ সাড়ে নয়টাতে ক্লাস। এই তো আর ক’দিন তার পরেই ইন্টার্নি শুরু হবে। স্বপ্নের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে, মনের মাঝে সযত্নে লালিত খোয়াইশকে চোক্ষের সামনে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মতো করে হাতের মুঠোয় আসতে যেন মোহর সচক্ষে দেখতে পারছে। আপ্লূত হয়ে ওঠে, স্বপ্ন পূরণের কথা ভাবতেই একরাশ প্রাণোচ্ছলতা ঘিরে ধরে মোহরকে।
চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মোহর। গায়ে জড়ানো হাফ সিল্কের কাপরের একটা লং কুর্তি। আসমানী রঙের উপরে সাদা হলুদ মিশেলের ছাপ। কাবার্ডের সিংহভাগ জুড়েই মোহরের জামা কাপড়। প্রতিটি পোশাকেই আভিযাত্য আর বহুমূল্যের ছাপ। এতো দামী জামা কাপড় আগে পড়ার সৌভ
খুব কমই হয়েছে মোহরের। জামা থেকে উঠে চোখ গেল নিজ চেহারা পানে। তামাটে বর্ণের গায়ের রঙটা আরও উজ্জ্বল হয়েছে কয়েক দিনে, হলুদের রঙ যাকে বলে। চোখের নিচের বিদঘুটে কালো দাগ গুলোও মিলিয়ে গেছে । এই কয়দিনে এতো পরিবর্তন! কই আগে তো এতো সুন্দর লাগেনি নিজেকে? এসবই কি এই দামী পোশাকের কারচুপি? নাকি সে নিজেই পরিবর্তিত হয়েছে নিজের অজান্তেই!
হুট করেই পেছনে ঘুরে তাকালো, পরমুহুর্তে নিজের বোকামিতে নিজেই ফিক করে হেসে উঠলো মোহর। সেই দিনের মতো আজও হয়তো মেহরাজ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়েছিল মোহরের। পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে, এক পাশে ঝুলানো ব্যাগ টা কাঁধে রেখে বাইরের দিকে হাঁটা দিল মোহর। দরজা দিয়ে বের হতে গিয়েও পা দুটো থামিয়ে নিল মোহর ঘার বাঁকিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো উত্তর দিকে দেওয়াল টা জুড়ে মধ্যিখান বরাবর বিশালাকৃতির ফটোফ্রেমের দিকে।
ব্ল্যাক স্যুট পরিহিত সুগম্ভীর চেহারার মানুষটার স্পীচ দেওয়ার দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করা হয়েছে। কথার তালে ঘাড় টা সামান্য বাদিকে কাঁৎ করে ধারালো চোখের নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছে। থমকে আছে চেহারা, মুহূর্ত, আর মানুষটি। সম্ভবত ছবিটা কোনো সেমিনারে স্পীচ দেওয়ার সময়কালীন। তা মেহরাজের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিশাল প্রজেক্টের আর সামনের ডায়াস দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মোহাচ্ছন্নের মতো ওভারে ঘাড় বাকিয়েই তাকিয়ে রইলো মোহর, মিনিট দুয়েক বাদে হুশ ফিরলে সপ্রতিভ হয়ে সামনে তাকিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। নিজের এমন অদ্ভুত বেখেয়ালিতে নিজের উপরেই বিরক্ত হলো মোহর।
মেডিক্যালে এসে পৌঁছে মনটা আরও প্রফুল্ল হয়ে উঠলো মোহরের। মোহরকে রেখে আবারও ধুলো উড়িয়ে হারিয়ে গেল দামী গাড়িটা নিয়ে। মেহরাজ নিজে নেই তো কি,তার উপস্তিতি প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় মোহরকে ওর প্রতিটি দ্বায়িত্ববোধ আর যত্নে। মেহরাজ নেই বলে ভেবেছিল আজ হয়তো একাই যেতে হবে কিন্তু সে ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় মেহরাজ তার উপস্থিতি ছাড়াই। বাড়ি থেকে বের হয়েই মেহরাজের কালো মার্সিডিজ টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় মোহর, তারপর মোহরের বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয় সেদিনের হাস্যজ্বল চেহারার ছেলেটা, সেই অমায়িক হাসি ঝুলানো মুখেই বলে
– স্যার জরুরি মিটিংয়ে শহরের বাইরে গিয়েছেন ম্যাডাম। তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে মেডিক্যাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।
যেখানে নিজে না থেকেও সহচর কে পাঠিয়েছে, তাই সেটায় নাকচ করার মতো দুর্বুদ্ধি আর দেখালো না মোহর।
মেডিক্যালের ক্যাম্পাসের এক কোণায় একটা রেইনট্রি। শরত হওয়া সত্ত্বেও শুকনো পাতায় বিছিয়ে আছে গাছের নিচটা। আদ্রতায় জড়ানো পাতা গুলো একটু বাতাসেই নড়েচড়ে উঠে, ঝমঝম করে লুটিয়ে পড়ে শুকনো হলুদাভ পাতা গুলো। সিড়ি বেয়ে উঠে সোজা ক্লাসরুমে ঢুকেই দেখা পেল অতি আকাঙ্ক্ষিত চেহারাটা, মোহরকে আসতে দেখে সরু হাস্য মুখে শ্রীতমা বলল
– আসলি তুই, আমি তো ভাবলাম দেরি করছিস যখন আসবিই নাহ।
মোহর কিঞ্চিৎ হেসে বলল
– এই আসলাম। না আসার তো কারণ নেই।
শ্রীতমা চোখ ছোট করে মোহরের দিকে তাকিয়ে আমুদে গলায় বলল
– ভাইয়ার জন্য দেরি হয়েছে তাই না!
শ্রীতমা হতে এহেন কৌতুক কস্মিনকালেও আশা করেনি মোহর৷ অপ্রস্তুত হয় অনেকটা, ক্ষুন্ন গলায় বলল
– ধ্যাত। এসব কি যা তা বলিস
– ওমা যা তা কেন বলবো। বর যখন আছে ঘর থেকে বেরোতে দেরি হতেই পারে।
মোহর কড়া নজরে শ্রীর দিকে তাকালে ও বোকা বোকা চেহারা করে বলল
– হেহে, থুক্কু মানে থুড়ি। মজা করলাম দোস্তো। রেগে যাচ্ছো কেন
ওদের আলাপচারিতার মাঝেই ড. ফায়াজ করিম ঢুকলেন ক্লাসে। আড়চোখে মোহরের দিকে একবার তাকিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করলেন। বেশ দীর্ঘ সময় ক্লাস শেষে একসাথে বেরোলো দুজনে। সিড়ি দিয়ে নেমে নিচের করিডর দিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছিল তখনই পেছন থেকে সুপরিচিত গলায় ঘুরে দাঁড়ালো দুজনে
– মোহর, তোমার সাথে একটু কথা ছিল। আমার কেবিনে আসতে পারবে?
মোহর দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারায় একবার শ্রী-এর মুখের দিকে তাকালো। ওর চেহারাতেও বিব্রতি থাকলেও তা সামাল দিয়ে মোহরকে চোখের ইশারায় যেতে বলে নিজে বাইরেই দাঁড়ালো।
মাঝারি আকৃতির কেবিনটার মধ্যিখানে ডেস্ক। তার সামনে কম্পিউটার, চেয়ার। মোহর দাঁড়িয়ে আছে সামনাসামনি, ফায়াজ মোহরের নিষ্প্রভ চেহারায় এক পলক চেয়ে স্বাভাবিক গলায় ই বলল
– বসো মোহর।
– ইটস ওকে স্যার, আপনি প্লিজ বলুন না কি বলতে চান
মোহরের সকপট কথায় ফায়াজের চেহারায় দুর্বোধ্য চিন্তার ছাঅ জড়ো হলো। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই অকপটে বলল
– মোহর তুমি কি যা করছো ভেবে চিন্তে করছো?
মোহর জিগাংসুক নজরে তাকালে ফায়াজ আরও স্পষ্ট করতে সুস্পষ্ট বর্ণনায় বলল
– তুমি এই অ্যাক্সিডেন্টলি বিয়েটা মেনে নিয়ে চলতে চাও? এমনটা আমি ভাবতে পারছি না মোহর। চেনা জানা নেই একজনের সাথে পাড়ার লোক ধরে বেঁধে বিয়ে দিল আর করেও নিলে? তাও যা করেছো এখন সেই মানুষটারই বউ হয়ে আছো। এখনকার মানুষ ফ্রড, মুখোশধারী ক্যারেক্টারলেস হয়।এরা তোমার কোন ক্ষতি করে ছেড়ে দেবে ভাবতেও পারবে না। তুমি এখনো কোনো স্টেপ নিচ্ছো না কেন?
মোহর এতক্ষণের কথা গুলো চুপচাপ শুনলেও এখন বেশ সকৌতুক গলাতে জিজ্ঞাসা করলো
– স্টেপ বলতে?
– ডিভোর্স। তোমার উচিত সেই লোকটা যার
সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে ডিভোর্স দিয়ে এই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সম্পর্ক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া
মোহর ফায়াজের কথা গুলো নিরুত্তর গলাধঃকরণ করলেও সে মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। কারণ টা হয়তো ও নিজেও বলতে পারবে না কিন্তু মেহরাজকে না জেনে শুনে ওর ব্যাপারে এতগুলো কটুবাক্য একেবারেই অসহ্য লাগলো মোহরের, নিজের সবচেয়ে পছন্দের আইডল, টিচারকেও ভীষণ অসহ্য লাগলো মোহরের। ননতজানু মস্তকেই অপ্রসন্ন গলায় বলল
– স্যার আপনি আমাকে ভাবেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এতসব বলছেন তা আমি জানি। কিন্তু আমার কিছু করার আছে বলে আমি মনে করিনা। বাবা মা ভাই বোন কেও ই নেই আমার। হয় মরে গেছে নয় ছেড়ে দিয়েছে। পুরো লোকসমাগমে যখন মানুষ আমাকে থুথু দিচ্ছিলো। তখন যেই মানুষটা আমার সম্মান বাঁচিয়ে নিজের ঘাড়ে দ্বায়িত্ব নিয়েছে তাকে আর যাই হোক ফ্রড বলতে পারিনা। আমাকে যদি ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হতো তবে এতগুলো দিন নিশ্চিন্তে কোনো সমস্যা ছাড়াই ও বাড়িতে থাকতে পারতাম নাহ।
ফায়াজ বিস্মিত হলো মোহরের জবাবে। এমনটা একেবারেই প্রত্যাশা করেনি ও। মোহরের কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা এখনো জানতে পারেনি ফায়াজ। তবে ওর মনে হয়েছে কার
সাথে বিয়ে হয়েছে এটার থেকে ওকে তার থেকে আলাদা করে দেওয়াই হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে মোহরের জবাবে তার ধারণা নড়বড়ে
হয়ে উঠলো। ললাটে ভাঁজ ফেলে বলল
– তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছো? তার সাথেই থাকতে চাও তুমি? এতটা বিশ্বাস করে ফেলেছো এই কদিনে?
– তাও বলিনি আমি। ডিভোর্স দিতে চাইলেও মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হবে আমায়। হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাইনা আমি। কিসমত আমাকে যেই মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে সেখানেই নাহয় অপেক্ষা করি, কোনো রাস্তা পেলেও পেতে পারি।
ফায়াজ ক্ষুন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোহর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সবিনয়ে বলল
– স্যার আপনার কথা শেষ হলে আমি আসতে পারি? এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
ফায়াজ মোহরের কথার পৃষ্ঠে জবাব দিল না। প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও ঘাড় নাড়িয়ে মোহরকে বেড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতেই দ্রুত প্রস্থান করলো মোহর। মেজাজ টা হুট করেই চড়ে গেল ওর, এমন অহেতুক রাগ হওয়ার কারণে নিজের উপরেই বিরক্ত বোধ করলো মোহর।
একদম মাঝ দুপুরের সময়। মেডিক্যাল থেকে বেরিয়েছে অনেক আগেই, তবুও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মোহর। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, ওকে জোর ক
দাঁড় করিয়ে রেখেছে শ্রী। অরুনাভ আসবে আজ শ্রীয়ের সাথে দেখা করতে আর শ্রী মোহরের সাথে দেখা করাবে বলেই ওকে ও দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
ওদের দুজনের অপেক্ষার অবসায় ঘটিয়ে অবশেষে উপস্থিত হলো টয়োটা ইনোভার সিলভার ভার্সনের গাড়িটা। অবিলম্বেই বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে শ্যাম রাঙা গড়নের, ঝাকড়া চুলের একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। পোশাক আসাক বেশ সাধারণ ধাচের হলেও গাড়িটা বেশ দামি। মোহর ভাবুক হওয়ার আগেই শ্রী কনুই দিয়ে গুতা দিল মোহরের বাহুতে, নরম গলায় বলল
– ওই যে এসে গেছে ও
শ্রীয়ের লজ্জাবরিত মুখাবয়বে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই লম্বা সরু দেহাবয়বের পুরষটা এগিয়ে এসে বিনয়ী গলায় বলল
– অনেকক্ষন অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি? আই আম সরি আসলে রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল
– না না আমার কোনো সমস্যা হয়নি। সে তো ও দাঁড়িয়ে আছে সেই কখন থেকে। তোমার সাথে দেখা করাবার জন্যেই তো ওকে ধরে রেখেছি
শ্রীয়ের কথা অনুসরণ করে মোহরের দিকে তাকালো সাধারণ চেহারার শ্যামপুরুষটি। শ্রী আবারো বলল
– ওই মোহর। তোমাকে বলেছিলাম তো
– আসসালামু আলাইকুম
হুট করেই সালাম দেওয়াই চমকে উঠলো মোহর। অরুনাভ মুখার্জি নাম ছেলেটার, হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দেখাই সাবলীল বাংলায় সালাম দেওয়া টাই বেশ অবাক হলো মোহর। তবে মোহরের বিস্ময় কাটিয়ে ছেলেটি সহাস্য গলায় বলল
– হ্যাঁ চিনেছি তো। আপনার কথা শ্রী এতবার বলেছে যে মুখস্থ হয়ে আমার। ও পরিচয় করিয়ে না দিলেও চিনতে পারবো
বলে আবারও হেসে উঠলো অরুনাভ। এবারে মোহর ও হাসলো সৌজন্য সুলভ। ছেলেটার ব্যবহার হাসি দুটোই বেশ মিশুক স্বভাবের
একেবারে শ্রীতমার স্বভাবের মতই। মোহরের ভেতরটায় হুট করেই প্রশান্তি খেলে উঠলো। শ্রীতমার মুখের হাসিটা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা মানুষের ভালোবাসা পেয়ে ও কতটা সুখপূর্ণ।
_____________________
বিকেল গড়িয়েছে বেশ আগে। সন্ধ্যা আর অপরাহ্নের মাঝামাঝি সময়। মোহর ঘরে বসে পড়ছিল, মেহরাজ এখনো ফেরেনি বাড়িতে। বাড়ি ফিরতে মোহরের প্রায় মাঝ দুপুর গড়িয়েছিল, অভিমন্যু নামক ছেলেটা ওকে নিতেও এসেছিল। যেহেতু শ্রীতমার সাথে আগে আগেই বেরিয়েছিল মেডিক্যাল থেকে, তাই অভিমন্যু ঠিক ওর ফেরার সময়টাতেই এসেছিল।
– ভাবী?
সাঞ্জের গলার ডাক শুনে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো। সাঞ্জের প্রফুল্লতায় উৎসাহিত মুখ খানা হুট করেই চুপসে গেল মোহরকে পড়তে দেখে, আফসোসের গলায় বলল
– ওমা,তুমি কি গো বিকেল বেলাতেও আবার কেও পড়ে নাকি?
মোহরের অধরে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটলো। বইটা উল্টে রেখে বলল
– তাছাড়া আর কি করবো বলো
– কি করবে মানে! কি দারুণ ওয়েদার দেখেছো? এইরকম ওয়েদারে ছাদবিলাস করতে হয় জানো না?
সাঞ্জের ছাদবিলাস কথাটা শুনে মোহর ফিক করে হেসে বলল
– ছাদ বিলাসও হয়?
– অবশ্যই হয়। চলো তুমি আর আমি ছাদ বিলাস করবো
বলে মোহরের হাত ধরে হাঁটা ধরলো। সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসতেই এক অস্থির প্রফুল্লতা ঝাপটে ধরলো মোহরকে। এই বাড়ির ছাদে এর আগে আসা হয়নি ওর। ঝকঝকে টাইলসের মেঝে করা ছাদটাতে ছোট ছোট এ্যাডযাস্টেড টব লাগানো আর তার ভেতরে নানারকম ছোট বড়ো চারা। বিশালাকৃতির ছাদটা কোনো মাঠের চেয়ে ছোট নয়। সাঞ্জে ছুটে এগিয়ে গেল, আস্তেধীরে রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো মোহর, ডানি দিকে ঘাড় ঘুরালেই তাথই কে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল
– আপা আপনি?
ছাদের কোণার দিকটাতে একা একাই দাঁড়িয়ে ছিল তাথই, ওদের আসাটা খেয়াল করেনি এতক্ষণে। মোহরকে দেখে প্রথমে ললাটে ভাঁজ ফেললেও পেছনে লাফালাফি করতে থাকা সাঞ্জেকে দেখেই কপাল প্রসারিত করে বলল
– বাঁদরটা তোমাকেও ধরে এনেছে? এই স্বভাব ওর, ছোট থেকেই একটু মেঘ বৃষ্টি করলেই লাফাতে লাফাতে ছাদে উঠে আসবে আর আশেপাশে যে থাকবে তাকেও ধরে আনবে
– আর আশেপাশের মানুষ টা তাথই ম্যাডাম ই যে নিজেও এসে লাফাতো আমার সাথে
বলে ফিকফিক করে হেসে উঠলো সাঞ্জে। মোহর ও কিঞ্চিৎ গাল এলালো। তাথই বিরক্ত হলেও মুখে আর কিছু বলল নাহ। সাঞ্জে তাথইয়ের কাছে এসে বলল
– তুই ও বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছিস তাই না রে আপু?
– একদমই না। আমি এমনিতেই ছাদে ঘুরতে এসেছিলাম।
– সে যাই হোক। এসেছিস যখন ভিঁজেই যা।কতদিন তোর সাথে বৃষ্টিবিলাস করিনা
তাথই ভ্রুকুটি করে তাকালো সাঞ্জের দিকে। কটমটে গলায় বলল
– তোর বৃষ্টিবিলাস তুই ই কর। আমার ইচ্ছে নেই এসবে
বলে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে প্রস্থান করলো। সাঞ্জে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবারও নিজের মতই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মোহরকে উদ্দেশ্য করে বলল
– ভাবী আমি একটা কবিতা পড়েছি বৃষ্টি নিয়ে শুনবা?
মোহরের ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দেওয়াই অবিলম্বেই ছন্দ মিলিয়ে বলল
– মঙ্গলে ভোর রাত থেকে হইলো শুরু, তিনদিন মেঘের গুরুগুরু। তারপর, বুধের সকালে নামলো জল বিকালে মেঘ কয় এবার চল।
বলেই হুহা করে হেসে দিল। পাঠ্য বইয়ের কবিতা শুনিয়ে নিজেই হেসে একাকার করলো। প্রকৃতির হয়তো সাঞ্জের অদ্ভুত কবিতা টা ভীষণ পছন্দ হলো, মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আকাশের বুক চিরে বিন্দু বিন্দু ফোঁটায় আদ্রিত হলো ধরণী। ছোট ছোট ফোঁটা গুলো একীভূত হয়ে বৃহৎ আকারে মুষলধারে বৃষ্টি নামালো। কয়েক সেকেন্ডের অন্তরেই ভিজে কাক ভেজা হলো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানবী। এতদিন বাদে বৃষ্টিতে ভিজে মোহরের মনটা সানন্দে ভরে উঠলো। এর মাঝেই নাজমা সাপটের ভয়ে জুবুথুবু হয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে বলল
– সাঞ্জে আপা, আপনেরে কাকলি ম্যাডাম এক্ষনি ডাকতাছে।
– কে আমাকে?
– হ্যাঁ, এক্ষুনি যাইতে কইছে। নাইলে খবর আছে কইছে
বলেই ভেতরে ঢুকে গেল নাজমা। সাঞ্জে প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুটি গুটি পায়ে নেমে গেল। কারণ মায়ের মেজাজ সম্পর্কে বেশ জানা আছে, কথা না শুনলে আবারও নাটক শুরু করবে।
সাঞ্জে চলে গেলেও মোহর ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো, মানুষের নিঃস্তব্ধতায় এখন শুধু প্রকৃতির গর্জন। নড়চড় হীনা তাকিয়ে রইলো একটু দূরের ওই বিলটার দিকে। কানে একটানা আওয়াজ আসছে একবার মনে হচ্ছে নদীর কলধ্বনি, কখনো বা মনে হচ্ছে পাতার মর্মর শব্দ। বাতাসের দাপট আর বৃষ্টির কলধ্বনি মিলে মিশে একাকার হয়ে সুর তুলেছে, সেই সুর শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে অন্তঃস্থলে স্নিগ্ধতার প্রলেপ মেখে দিচ্ছে।
মোহর ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে একদম রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। অন্যমনস্ক চোখে নিমিত্তে তাকিয়ে দেখছে গাছপালা মাঠঘাট প্রকৃতির ভেতর নতুন প্রাণের হিল্লোল। প্রাণের আনন্দে নারিকেল, আম, সুপারি, কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দুলছে।পাতাগুলো কখনো ছড়িয়ে যাচ্ছে কখনো একত্রিত হয়ে যাচ্ছে গভীর আলিঙ্গনে। চোখ তুলে তাকালো সুবিশাল বিস্তৃর্ণ আকাশের পানে। যেন ধূসর বর্ণা কোনো জাল দিয়ে মেঘ গুলো তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে রেখেছে।
তৎক্ষনাৎ মোহর নিজের পেছনে একটা উপস্থিতি অনুভব করলো, অবচেতন মন এক লহমায় আগন্তুকের পরিচয় বার্তা মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিল। কেমন এক ভাঙা চূড়া উৎকণ্ঠা অস্থিরতা ঘিরে ধরলো মোহরকে। তবুও অবাধ্য মনের নির্দেশনাতে হার মেনে ধীরস্থির ভাবে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালে লম্বা চওড়া শরীরের মানুষটার কাক ভেজা চেহারাটা সফেদ পর্দার ন্যায় চোখে বিঁধে লাগলো।
– ভিজছেন কেন মোহ?
– আপনি কখন এলেন?
– এখনি। বাড়িতে ঢোকার সময় ছাদে দেখেছি আপনাকে।
মেহরাজের কণ্ঠস্বরটা বৃষ্টির ফটিকজলের চেয়েও শৈথিল্যময় ঠেকলো মোহরের নিকট। প্রশ্বস্থ বুকে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টটায় একবার তাকিয়ে অন্যত্র ফিরে বলল
– এমনিই, ভাল্লাগছে।
মেহরাজ এগিয়ে এলো দুকদম। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো মোহর সরে যাওয়ার রাস্তা পেল না আর নাইবা ইচ্ছে করলো। বৃষ্টির ঝাপটাকে পুরোদমে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এলো মেহরাজ মোহরের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শ্রান্ত চোখে তাকালো ভিজে টকটকে হওয়া মেদুর গালে, ব্যতিব্যস্ত ভাবে কেঁপে ওঠা ওষ্ঠের পানে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো মেহরাজ।
ভ্রম ধরিয়ে দিচ্ছে মোহরের এই সদ্যস্নাত রূপ। মনের ভেতর কোনো ভাবনাচিন্তা আনতে পারলো না, শুরু টের পেল এমন এক অনুভূতি যার নির্দিষ্ট কোনো স্পষ্ট রূপ নেই। মনের এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বেসামাল হলো চোক্ষের দৃষ্টি, হাতটা এগিয়ে মোহরের মুখে উপচে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো মোহর। বাদলের হীম শীতল ফোঁটার চেয়েও মেহরাজের স্পর্শ সারা গায়ে পুলক ফুটিয়ে দিল, সরে আসতে নিলেও মেহরাজকে সরাতে পারলো না, দূরত্ব বজায় রেখেই কোমরের দুই পাশ দিয়ে রেলিঙের উপরে হাত রাখলো মেহরাজ, গায়ে কাটা ফুটানোর ন্যায় মোহান্বিত গলায় বলল
– আমার সাথে ভিজবেন মোহমায়া।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_২২
বৃষ্টির অবিরাম, অবিরল,অবিচ্ছিন্ন ধারা সারা গা ভিজিয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে দুটো শরীর। মেহরাজের কপালে উপচে পড়া চুলের আগা থেকে এক ফোঁটা পানি টুপ করে পড়লো মোহরের মুখের উপর। সমগ্র আকাশ ভরা বৃষ্টির ঢলের মধ্যে সেই বিন্দুকণা এতো স্থুল নয় যে চোখ জুড়ে যাবে, কিন্তু এতটা সূক্ষ্মও নয় যে চোখ এড়িয়ে যাবে। বরং অবিচ্ছেদ্য বাদলের বর্ষনে মেহরাজের চুল থেকে উপচে পড়া পানির ফোঁটা যেন প্রবল উত্তাপধারী। কুলধ্বনি ছিটিয়ে দিল মোহরের সর্বাঙ্গে। এক চুল নড়ার শক্তি টাও ক্ষুন্ন হয়েছে। স্বামী নামক পুরুষটির এই সামান্য নিকটত্বে জালাময়ী সুর তুলেছে মন মস্তিষ্ক জুড়ে৷
ভারি পানি কণার ভারে বুজে আসা চোখ টেনে তুলে তাকালো, বিজড়তা, আড়ষ্টতার সাথে প্রাণপণে লড়াই করে বহুকষ্টে কম্পিত দৃষ্টি তুলে চাইলো অত্যন্ত নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষের পানে। বৃষ্টির অনবরত ধারা যেন সুদর্শন মানুষটার সারা মুখে আরও অপূর্ব স্নিগ্ধতার প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে। মোহরের অনুকম্পিত ওষ্ঠাধরের দিকে অনিমেষ চাইলো মেহরাজ।
চাইলেও চক্ষুগোচর করতে পারছে না তার মোহমায়াকে। মোহরের বৈরী অগাধ রূপ, মায়ার মোহ ওকে আষ্টেপৃষ্টে ঝাপটে ধরছে যার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো রাস্তা দূর মাদ’কতার নেশার ন্যায় টেনে নিচ্ছে নিজের অতীব সন্নিকটে।
অদ্রিত ঠোঁট জোড়াও প্রবল বারিধারায় ও শুকিয়ে এলো যেন, চোখ দু’টো জ্বলে উঠছে, অস্থিরতাকে ধামাচাপা দিতে চোখ সরিয়ে নিল। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াস করেও ব্যর্থ হয়ে আবারও তাকালো মোহরের নতজানু মস্তকে।
আচানক মনের সকল নিষেধাজ্ঞাকে বিচলিত মনের আস্কারাতে ঠাঁই দিয়ে মোহরের থুতনিতে হাত রেখে সুরত খানা উর্ধ্বে তুললো। আধবোজা চোখে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিতে থাকলো নিজের ভেজা টকটকে অধর জোড়া। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়, সম্মোহনী হয়ে জমে গেল মোহরের সমস্ত কায়া,চিত্ত। আবিষ্টমন চোখ বুজে নিলো। প্রকৃতির তান্ডবে যখন সারা ধরণী যখন নতুন সজীবতার হিল্লোল বইয়েছে, ঠিক তখনি বিশাল ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন মানব মানবী নিজ অন্তঃস্থলের প্রবল উন্মাদনায় মত্ত হয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায়।
কিন্তু ওদের অসংযত হওয়া মনের উদ্দম বেসামাল অনুভূতির নিষিদ্ধ মিলনে অনাকাঙ্ক্ষিত বিজ্ঞাপনের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসলো সাঞ্জে। পরিবেশ পরিস্থিতি বিচার না করেই সিড়ি থেকেই চিল্লাতে চিল্লাতে বলতে থাকলো
– ভাবী? ও ভাবী? তোমার এখনো বৃষ্টিবিলাস হয়নি? আর কতক্ষণ ছাদে থাকবে?
বলে ছুটতে ছুটতে এলো ছাদের দিকে। সাঞ্জের গলার উচ্চস্বরে মোহর ছিটকে সরে গেল, মেহরাজ অপ্রস্তুত হতভম্বিত রূপে দাঁড়িয়ে রইলো। কি করতে যাচ্ছিল ও? কি করে এতোটা বেসামাল হয়ে গেল, সাঞ্জে না আসলে হয়তো!
– ওমা দাভাই কখন এলে? তুমিও বৃষ্টিতে ভিজছিলে?
সাঞ্জে মোহরের পাশে মেহরাজকে দাঁড়িয়ে দেখে বিস্মিতের ন্যায় বলল। মেহরাজ ভেতর থেকে অপ্রসন্ন হলেও সেই অভিব্যক্তিকে ঠাঁই দিল না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো স্থির ভাবে৷ সাঞ্জে মোহরের অস্থির,বিচলিত চেহারা টা দেখে দুষ্টু হাসলো। টুসকি দিয়ে বলল
– ইস আমি মনে হয় খুব ভুল সময়ে এসে গেছি গো। কপত কপতীর মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে গেলাম। নো প্রবলেম, চালিয়ে যাও আমি দিদা কে বলে দিচ্ছি মিস্টার এ্যান্ড মিসেস ব্যস্ত।
বলে আবারো সিডির দিকে যেতে নিলে মোহর ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে বলল
– না না তেমন কিছু না। আমিও আসছি চলো
বলে সাঞ্জের পেছন পেছন এক প্রকার দৌড়ে পালালো। মেহরাজ ওর পালিয়ে যাওয়ার দিকে নিমগ্নে চেয়ে বলল
– বুকের ভেতর ও কোন ঝড় তুলে পালিয়ে যান মোহমায়া, আপনার স্পর্শের দাবদাহে বৃষ্টিফোঁটা গুলোও জ্বলতে শুরু করেছে সারা শরীরে।
________________
– উফ দিদা তুমিই তো সব নষ্টের গুড়। তুমি যদি তখন ডাকতে না পাঠাতে তাহলে তো আর ভাবী-দাভাইয়ের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটতো না
গাল টিপে হেসে উঠলো শাহারা বেগম। মোহরের লজ্জায় নতজানু হয়ে গাল লাল হয়ে আসছে। ও পারছে না মাটি ফুড়ে ঢুকে পরতে। দিদার সামনে যে সাঞ্জে এভাবে লজ্জায় ফেলে দেবে ও ভাবতেও পারেনি। শাহারা আড়চোখে তাকালো নতমস্তকে বসে থাকা মোহরের দিকে, এক কোণায় বসে আঙুলে ওড়না পেচাচ্ছে অনবরত। মুচকি হেসে বললেন
– আমার নাতি, নাতবউকে নিয়ে একদম ইয়ার্কি ফাজলামি করবি না সাঞ্জে। বড়োদের নিয়ে এসব বলিস লজ্জা করা উচিত।
– ওর আবার লজ্জা শরম আছে নাকি যে লজ্জা পাবে
শাহারা বেগমের কথার সাথে সাথেই জবাব দিল তাথই। ড্রয়িং রুম জড়ো করে বসেছে ওরা। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। মোহর ভেজা জামা ছেড়ে সুতির একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। শাহারা বেগম বসে সন্ধ্যার জলখাবার খাচ্ছেন, সাথে সাঞ্জে তাথই ও বসেছে। নাজমা কাজ করছে আর মুখ টিপে হাসছে। সেদিকে তাকিয়ে মোহরের অপ্রতিভতা আরও বাড়ছে। এতগুলো মানুষ জনের সামনে বসে থাকতেও জান বের হয়ে যাচ্ছে ওর।
আম্বি খাতুন রান্নাঘর থেকে বেরোচ্ছিলেন, উনাকে ঘরের দিকে যেতে দেখে শাহারা বেগম ডেকে বললেন
– আম্বি, কোথায় যাচ্ছো। একটু এদিকে এসো তো
এদিকে আসার খুব একটা ইচ্ছে উনার ছিল না হয়তো। তবুও শাশুড়ীর আদেশ মতো এগিয়ে এলেন, সদা সর্বদা স্বাভাবিক মৃদু গলায় বললেন
– জ্বি মা
– কোথায় যাচ্ছো ঘরে?
– হ্যাঁ
– ঘরে গিয়ে তো সেই একা একাই বসে থাকবা। এখানে বসো আমার সাথে। মেয়েগুলোর সাথে গল্প গুজব করো ভাল্লাগবে।
– এসবের আর দরকার নাই মা। আমি ঘরেই থাকি ওরা গল্প করছে করুক না, আমি মা আমি থেকে কি করবো।
শাহারা বেগম হাত থেকে চায়ের কাপটা রেখে সুপ্রসারিত নয়নে তাকিয়ে বললেন
– তুমি মা বলেই তো থাকবে। আর কথা বলো না তো, এসো বোসো আমার পাশে
একরাশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসে বসলো আম্বি বেগম। আর তার অনিচ্ছার কারণ যে মোহর সেটা মোহর নিজেও খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে। শাহারা বেগম আম্বি খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল
– পায়ের ব্যথা কমেছে আম্বি?
– আর কমলো কই। চিনচিন করে ব্যথা করছে ঠিক করে পা টাও মাটিতে রাখতে পারছি না
– কেন? বড়মার পায়ে কি হয়েছে?
সাঞ্জের প্রশ্নের জবাবে শাহারা বেগম বললেন
– এইতো সকালেই পা মচকে গেছিল ওর। কত করে বললাম তেল জল দাও। তা তো শুনলো না
– স্প্রে করেছি মা
– সে যাই করো। তুমি কিন্তু হেলাফেলা কোরো না। ব্যথা বাড়লে ডাক্তার দেখাতে হবে।
কথার মাঝেই মোহর উঠে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে রান্নাঘর থেকে তেল গরম করে এনে আম্বি বেগমের পায়ের কাছে বসলে আম্বি বিস্মিত হয়ে বলল
– আরে কি করছো তুমি? পায়ের কাছে বসছো কেন?
মোহর আম্বির পায়ে হাত দিয়ে বলল
– আপনি শান্ত হয়ে বসুন, আমাকে কাজটা করতে দিন
আম্বি অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে নাকচ করে বলল
– কিচ্ছু করতে হবে না তোমায়, দেখি সরো তো। আমার ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে
– আম্বি ও যা করছে দাও না করতে। চুপ করে বসে থাকো তুমি
শাহারা বেগমের মুখের উপর কথা বলতে না পারায় দমে গেল আম্বি। নড়াচড়া না করেই বসে রইলো চুপ করে। মোহর বাটি থেকে গরম তেল আলতো ভাবে আঙুলের ডগায় লাগিয়ে মালিশ করতে থাকলো আম্বির পায়ের গোড়ালির ফোলা অংশের দিকে।
দপদপে ব্যথা স্থানে রসুন,সরিষার তেলের স্পর্শে বেশ আরাম বোধ করলো আম্বি। মোহর পায়ে তেল ঘষতে ঘষতে বলল
– মচকে যাওয়ার পরে কি বরফ লাগিয়েছিলেন?
– হ্যাঁ মালা লাগিয়ে দিয়েছিল একটু
অমসৃণ গলাতেই জবাব দিল আম্বি। মোহর আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ তেল ঘষে দিল বেশ অনেকক্ষণ সময় ধরে। ব্যথা স্থানে আরাম অনুভূত হয়ে নিরবে বসে রইলেন আম্বি। মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে অনেকটা স্বস্তি পেল ব্যথা কমার জন্যে।
বেশ সময় পেরোলো, রাতের বেলা একে একে সকলে নামলো ডাইনিং স্পেসে। রাতের খাবার সবাই একসাথে খেলেও মেহরাজ নামলো না। মোহর অবশ্য এর মাঝে একবারের জন্যেও উপরে যাই নি। নাজমার সাথে ও আর তাথই হাতে হাতে খাবার এগিয়ে দিল। আম্বি বেগম এতে সন্তুষ্ট না হলেও বাঁধা দেয়নি।
সব পর্ব চুকিয়ে ঘরে ফিরতে বেশ অনেক রাত হলো মোহরের। ঘরে এসেই আশপাশে চোখ বুলালো। মেহরাজ ডিভানে চিত হয়ে শুয়ে আছে মুখের উপর হাত রেখে। এই সময়ে শুয়ে থাকতে দেখে মোহরের ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ পরলো। কেননা মেহরাজ কখনোও এতো আগে ঘুমাই নাহ। পরমুহূর্তেই ভাবলো হয়তো সারাদিন বাইরে থাকার দরুন ক্লান্ত ছিল বলেই ঘুমিয়ে গেছে।
সেদিকে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করলো মোহর। ফ্রেশ হয়ে এসে লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
কৃষ্ণকায় আকাশে তারার ঝলকানি। সারা বিকেল দাপিয়ে বর্ষনের পর ফকফকে পরিস্কার নভোমণ্ডল। হাজারো তারার মাঝে দাম্ভিকতার সহিত সিংহাসনে বসে আছে রূপালি চাঁদটা। আশপাশে ঝলমল করছে তার রূপালি আভা। একবার তাকালে হয়তো মনে হবে আকাশের বুকে তার রাণী সাদরে, পরম যত্নে, আভিযাত্যে রাজ ফলিয়েছে। তার কিরণে অবগাহন করবে পুরো ধরণী। আশপাশ টা নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় আবিষ্ট। তার মাঝে সূক্ষ্ম শব্দে আলোড়ন তুললো অজানা হরেক ঝিঁঝি পোকার ন্যায় পতঙ্গ। হালকা বাতাসে ফুরফুরে আমেজ। ঝলমলে আকাশ, তার বুকে শায়িত রূপে চাঁদটা পাহারা দিচ্ছে পুরো মেদিনী।
তবে এরূপ অপরূপে ডুব দেওয়ার মানুষ শূন্য। সকলে গভীর রাতে তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাসের ফিসফিসানি ছাড়া আর কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই মানব সমাগমে।
কেমন একটা চাপা গোঙানির শব্দে ঘুম হালকা হয়ে এলো মোহরের। পুরোপুরি ঘুম না ভাঙায় ঘোরের মাঝেই ভ্রু কুচকে এলো ওর। ধীরে ধীরে ঘুমন্ত মস্তিষ্কও অনুভব করতে পারলো খুব কাছ থেকেই কারো কাকুতি শোনা যাচ্ছে।
ঘুমু ঘুমু চোখটা খুলে আশপাশে তাকিয়ে কান খাড়া করতেই স্পষ্ট কারো মৃদু কাকনি কানে এলো। উঠে বসে বেড সাইড ল্যাম্প টা জ্বালাতেই চোখের সামনে স্পষ্ট হলো ডিভানে শুয়ে মেহরাজের দীর্ঘাকার শরীর টা৷
মোহরের মনে হলো শব্দ টা মেহরাজের কাছ থেকেই আসছে। সকৌতুহলে বিছানা থেকে নেমে মৃদু পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের সিথানে। ফোস ফোস শব্দ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে মেহরাজ, ঘুমের ঘোরেই মাথা চাপছে আর এপাশ ওপাশ ঘাড় ঘুরাচ্ছে। কৌতুহল বশত মোহর নিজের হাতটা মেহরাজের কপালে ঠেকালেই বিস্মিত হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ঘরেই লাইট
জ্বালিয়ে এসে মেহরাজের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কপালে গালে বার কয়েক হাতের উল্টো পিঠ ছোঁয়ালো।
শরীরের উত্তাপে হাতের চামড়া ঝ’লসে যাওয়ার জো। জ্বরে সারা শরীর যেন পু’ড়ছে মেহরাজের। ফর্সা মুখটা টকটকে হয়ে গেছে। ঠোঁট ফাক করে ঘুমের ঘোরেই ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে মেহরাজ। মোহর আলতো স্পর্শে মেহরাজের গালে হাত রেখে বলল
– শুনছেন? উঠুন,আপনার খুব জ্বর। একটু উঠে বিছানাতে আসুন প্লিজ
জ্বরের ঘোরে বার দুয়েক ঘাড় নাড়িয়ে কিসব বিড়বিড়ালো মেহরাজ। তার অর্থোদ্ধার মোহরের দ্বারা সম্ভব হলো না। ও উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ব্যস্ত পায়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। পাত্রভর্তি করে পানি এনে আশপাশ তাকিয়ে একটা কাপড় হাতে নিল। ঠান্ডা পানির মধ্যে কাপড় চুবিয়ে তার পানি নিঃড়ে মেহরাজের কপালে রাখলো। যেন গরম তাওয়ার উপরে ঠান্ডা কিছু রাখা হলো। গায়ের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, থার্মোমিটারে মাপলে হয়তো কম হলেও ১০১/১০২° হয়ে যাবে।
মোহর বারবার কাপড় ভিজিয়ে মেহরাজের কপালে চেপে ধরলো। মেহরাজ তখনও চোখ বুজে। জ্বরের ঘোরে কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে মোহরের কাপড় চেপে ধরে রাখা হাতটার উপরে রাখলো মেহরাজ। জ্বরের উত্তাপে যেন মোহরের চামড়া টাও ভেদ হয়ে যাচ্ছে উষ্ণ স্পর্শে। মেহরাজ অস্পষ্ট আড়ষ্ট গলায় ফিসফিসিয়ে বলল
– ক্ কষ্ট লাগছে। মাথা ফেটে যাচ্ছে।
মোহর অস্থির হয়ে উঠলো। নিজ স্বভাব বিপরীত হয়ে কি করবে ভেবে পেল না। মেহরাজের জ্বরের অবস্থা একেবারেই ভালো ঠেকছে না। কেঁপে কেঁপে উঠছে সারা শরীর। মোহর উঠে গিয়ে কাবার্ড খুলে একটা জ্বরের ওষুধ এনে খাইয়ে দিয়ে আবারও মেহরাজকে ক্ষীণ স্বরে ডাকতে লাগলো
– আপনি একটু কষ্ট করে উঠুন প্লিজ। খাট পর্যন্ত অন্তত আসার চেষ্টা করুন, ডিভানে থাকলে আরও অসুবিধা হবে
মেহরাজের ভারি শরীরটা টেনে নেওয়ার মতো ক্ষমতা মোহরের নেই, আর ওকে খাটে নেওয়া টা খুব জরুরি। আরও বার দুয়েক ডাকলে মেহরাজ ঢুলু ঢুলু চোখ খুলে তাকালো। চোখের সাদা অংশটাই অস্বাভাবিক লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। মোহর মেহরাজের বাহু শক্ত করে ধরে ওকে খাট অব্দি নিয়ে গেল, খাটে শুইয়ে দিয়ে আবারও জলপট্টি দিল কপালে। আরেকটা কাপড় এনে বারবার হাত পা ভেজা করে মুছিয়ে দিতে লাগলো।
বৃষ্টিতে ভেজার কারণেই যে জ্বর এসেছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না মোহরের। তাই আজ মেহরাজ খেতেও আসেনি আর ঘুমিয়েও গেছে ওত আগে। ইস একটা বার যদি লোকটা বলতো শরীর খারাপ লাগছে তাহলে হয়তো এখন এই পরিস্থিতি আসতো নাহ। আধঘন্টা ধরে অনবরত জলপট্টি দিয়ে দিয়ে খানিকটা কমে এলো মেহরাজের জ্বর। মোহর ড্রয়ার খুঁজে ভ্যাপো রাব এনে কপালে লাগিয়ে দিতে গেলে আচানক মেহরাজ এসে মোহরের কোমর আঁকড়ে ধরলো। জড়ানো অস্পষ্ট গলায় বলল
– খারাপ লাগছে আমার, কষ্ট লাগছে। আমাকে সারিয়ে দিনি না মোহ..
এরপর আর কি বলল এটা মোহর শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারলো নাহ। এতো রাত করে কি করবে সেটাও মাথায় আসছে না। জ্বর সাময়িক কমলেও আবারও উঠবে এ ব্যাপারে মোহরের ভয়ও হচ্ছে। একটু উঠে কি কাওকে খবর দেবে? নড়েচড়ে দেখতে গেলেও মেহরাজ আরও শক্তপোক্ত করে ঝপটে ধরলো মোহরের কোমর, নরম পেটের ভেতর মুখ গুঁজে দিয়ে বলল
– কোত্থাও যাবেন না। আমার কষ্ট হচ্ছে
জ্বরের চোটে আবল তাবল বলছে বারবার মেহরাজ। মোহর আর উঠার চেষ্টা করলো নাহ। মেহরাজের এই অসুস্থ নেতিয়ে পরা মুখটা দেখে ছ্যাৎ করে উঠছে বুকের ভেতর। লোকটা এতটা অসুস্থ হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। প্রচণ্ড উষ্ণ নিঃশ্বাস ঘনঘন আঁছড়ে পড়ছে মোহরের পেটে, শূলের মতো বিঁধে ঢুকছে পেটের মধ্যিখানে। মোহর কাঁপা কাঁপা আঙুল আস্তে করে গলিয়ে দিল মেহরাজের চুলের গভীরে।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️