ফানাহ্ পর্ব-১৭+১৮

0
1726

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৭

– অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি তাই না?

– নাহ আমি মিনিট দুয়েক আগেই এসেছি

বলে সৌজন্য সুলভ হাসি দিল মোহর। ড. ফায়াজ করিম আরও দুই কদম এগিয়ে এসে মোহরের সামনাসামনি দাঁড়ালো, মুখের হাসিটা আরও বিস্তর হলো, শ্যামলা চেহারায় অমায়িক হাসি টেনে বলল

– যাই হোক, অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ। আসলে আমি এক সপ্তাহের জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কালই ফিরেছি।

ঠোঁট গোল করে ও বলল মোহর। পরমুহূর্তেই জিজ্ঞাসা সূচক গলায় বলল

– স্যার কিছু বলতে চেয়েছিলেন?

– হ্যাঁ অবশ্যই। তবে এখানে নাহ, আমার সাথে এসো

মোহর কিঞ্চিৎ বিব্রত হলো। খানিক বিজড়িত চেহারায় দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল

– কোথায় যাবো স্যার?

ফায়াজ এগোতে গিয়েও থেমে গেল। আবারও হাসলো খানিক। আশ্বস্ত করা গলায় বলল

– বেশি সময় নেবো না। ডন্ট ওয়ারি, এসো আমার সাথে

বলে এগোতে লাগলো। মোহর দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারায় পেছন পেছন আসলো গুটি গুটি পায়ে। ক্লাস শেষ হয়েছে মিনিট দশেক আগে। নিজের কাজ সম্পূর্ণ করে বেড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল।

শ্রীতমা আজ তারাতাড়িই বেড়িয়ে গেছে। ওর মনের মানুষের সাথে দেখা করবে নাকি। শান্তশিষ্ট, ধীরচিত্তের মেয়েটার চেহারায় পালটে গেছে। এখন কেমন সমসময় অস্থিরচিত্তে থাকে, মুখভরা শুধু একটা মানুষেরই গল্প। মোহরের শুনতে বেশ লাগে। অরুনাভ নামক মানুষটাকে নিয়ে যখন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে, কত না আনন্দ হয় ওর। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুঁড়ে ওঠে।। ফর্সা গাল দুটো রক্তাভ বর্ণ হয়ে ওঠে। মোহর অপলক চেয়ে দেখে শ্রীতমার সদ্য প্রেমে পড়া ষোড়শী কিশোরীর ন্যায় অস্থিরতা।

– এদিকে আসো মোহর

পুরুষালী গলার ডাকে ধ্যান ভঙ্গুর হলো মোহরের। ঘাড় তুলে আশপাশের পরিবেশ টা দেখলো। একটা ক্যাফেতে এসেছে তারা৷ মেডিক্যাল থেকে স্বল্প দূরত্বেই ক্যাফেটা। ফায়াজ নিজে এগোতে এগোতে মোহরকে ইশারায় অনুসরণ করতে বলল।
একদম কর্নারের দিকে একটা জায়গা দেখে বসলো। বুক ভরা অজস্র কৌতূহল আর জড়তা দমিয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বসলো মোহর। যদিও ডক্টরকে নিয়ে তার কোনো ভয় বা সন্দিহা নেই তবুও এভাবে একজন ডক্টর স্টুডেন্টকে একান্তে দেখলে ব্যাপারটা ছড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না।

– কফি নাকি চা খাবে?

– আমি কিছুই খেতে চাইনা স্যার। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আপনি কথাটা বললে ভালো হয়

মোহরের নাকচ সত্ত্বেও ফায়াজ দুই কাপ কফি আনালো। নিজের কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভঙ্গিমায় ফায়াজ বলল

– দেখো মোহর আমার সঙ্গে তোমার পরিচয় টা আজ দুদিনের নয়। তোমার বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাকে ভীষণ ভরসা করে তোমার পড়াশোনার দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর তোমার পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটুকু শুধু পড়াশোনা নিয়েই তো সীমাবদ্ধ ছিল না। তোমার বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা ভীষণ আন্তরিক ছিল৷ সে মারা যাওয়ার পরেও আমি চেষ্টা করেছি তার ভরসা রক্ষা করার, তবে তোমার মায়ের মৃত্যুটা নিছক অজানা ছিল আমার কাছে। যখন জানতে পেরেছি ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। আর তোমার সাথে দেখা হওয়ার পরেই হুট করেই ক্যাম্পের ডেট দিয়ে দিল যে আমি কথা বলার সুযোগই পাইনি

মোহর নির্লিপ্ত শ্রোতার মতো ফায়াজের কথা গুলো শুনে যাচ্ছে। ডক্টর ফায়াজ নাকের ডগার উপর থেকে চশমা ঠেলে আবারও বলল

– তোমার বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম আমি। সেখানে তুমি নেই। তাছাড়া আর কিছু জানতে পারিনি৷ তোমার ফোনটাও তো হারিয়ে গেছে

এ পর্যায়ে মোহর ছোট জবাবে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলল

– বাড়ির কারো সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই স্যার।

– তোমার আপুর সাথে আমার তেমন পরিচয় নেই। তুমি কি মিথিলার সাথেই থাকছো এখন?

– বাড়ির কারোর সাথে যোগাযোগ নেই, এই বাড়ির লোকগুলোর মধ্যে সেও আছে

ফায়াজ অবাক হলো খানিক। মুখাবয়বে তা সুস্পষ্ট। হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল

– তাহলে কোথায় আছো তুমি? শ্রীতমার সাথে? মেসে?

দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর করলো মোহর। ফায়াজ আরও সচকিত হয়ে বলল

– তুমি কি আমাকে একটু ক্লিয়ারলি বলতে পারবে মোহর, আমি তোমার কথার মর্মার্থ বুঝছি না। কোথায় আছো কার সাথে আছো তাহলে?

– আমার বিয়ে হয়ে গেছে স্যার

মোহরের যান্ত্রিক ভঙ্গিমাতে বলা কথাটা ফায়াজের নিকট একটু বেশিই অপ্রত্যাশিত ছিল হয়তো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বেশ জোর গলায়ই বলে উঠলো

– হোয়াট! কি বলছো? বিয়ে? কবে, কার সাথে?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। একাই ফিরেছে ও,নিজেই মেহরাজকে নিষেধ করেছিল গাড়ি পাঠাতে। এতদিন সাদামাটা জীবন যাপন করে হুট করেই মার্সিডিজ এসে দাঁড়িয়ে থাকলে সহপাঠীদের বাঁকা চাহনি মোহরের ভালো লাগে নাহ। তাছাড়াও একা একা যাতায়াতে তো কোনো সমস্যা নেই।
ক্লান্ত ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকলো মোহর। স্বভাবতই ড্রয়িং রুম এখন ফাঁকা। দুপুর হলেই আব্রাহাম ম্যানসন টা প্রায় সুনসান নীরবতায় ছেয়ে যায়। এ সময় যে যে যার যার ঘরে ভাতঘুমে বুদ থাকে।
সিড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠে এলো মোহর। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখেই কাবার্ড খুলে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। বেশ লম্বা সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরোলো। এখন বেশ শান্তি লাগছে, মাথা মুছে তোয়ালে টা মেলে দিয়ে বারান্দার দিকে গেলো।

অসম্ভব সুন্দর এই জায়গা টা। এতো সুন্দর ব্যালকনি হয়তো টিভির পর্দায় দেখেছিল মোহর। ব্যালকনিতর অর্ধেকাংশ জুড়েই ফুলগাছ। সবগুলোই প্রায় বিদেশি চারা। সিলভার ফার্ণ,বার্ডস,নেস্ট ফার্ণ, রিবন সহ আরও জেনারিয়াম, অ্যান্থোরিয়াম, অ্যালপিনিয়ার মতো রংবাহারী ফুলে সাজানো। এর মাঝেমাঝে কতগুলো সাদা আর হলুদ গোলাপের কুড়িও মুখ তুলে উঁকি দেওয়ার চেষ্টায়।
বিমহচিত্তে তাকিয়ে রইলো মোহর অনিন্দ্যসুন্দর ফুলগুলোর দিকে।

বেশ খানিক বাদেই নিজের পেছনে কারো উপস্তিতির অনুভব করলো মোহর। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো কারো উপস্থিতির গাঢ়তা। মানুষটা কে তা ফুল চন্দন মিশ্রিত নির্যাসের ন্যায় সুগন্ধিটাই প্রখর ভাবে বুঝিয়ে দিল মোহর কে।

– আজকে বাড়ি ফিরতে দেরি করলেন যে মোহমায়া?

মোহরের পাশ বরাবর দাঁড়িয়ে বলল মেহরাজ। মোহর বিব্রতবোধ করলো কিঞ্চিৎ। কারণ মেহরাজ হার রোজ সন্ধ্যার পর বাড়িতে ফেরে, খুব তাড়াতাড়ি হলেও বিকেলের আগে নয়। মোহর কখন ফেরে এটা ওর জানার কথাও নয়।

– একটু কাজ ছিল

সকৌতুকে বেড়ে ওঠা কৌতুহল দমিয়ে নিচু গলায় জবাব দিল মোহর। তারপর কিয়ৎকাল পিনপতন নীরবতা ছেয়ে রইলো, এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পাশাপাশি দুজন শুধু ভর দুপুরের নিস্তব্ধতায় একে অপরের দীর্ঘশ্বাস টুকুই গুনতে পারলো। খামোশি ভাঙলো মেহরাজের সমুদ্রের ন্যায় শীতল কণ্ঠে, বেশ জিজ্ঞাসুক গলায় বলল

– ডক্টর ফায়াজ করিম তো আপনাদের মেডিক্যালের প্রফেসর, তাই না?

অপ্রত্যাশিতভাবে মেহরাজের মুখে ফায়াজের নাম শুনে বেশ অবাক মোহর। পরমুহূর্তেই সেটাকে নিতান্তই স্বাভাবিক প্রশ্ন ভেবেই জবাবে শুধু বলল

– হ্যাঁ

– আপনার পরিচিত?

মোহর বিব্রত হলো বেশ। মেহরাজের এহেন প্রশ্নের মর্মার্থ দুষ্কর ঠেকলো। ডক্টর ফায়াজ মোহরের পরিচিত এ কথা নিশ্চয় তার জানার কথা নয়!
মোহরের বিহ্বলতা আরও ক্রোশ বাড়িয়ে মেহরাজ আবারও বললো

– ডক্টর ফায়াজ কি আপনার খুব কাছের কেও?

মোহর বিস্ময় নিয়ে তাকালো মেহরাজের শুভ্র চেহারার দিকে। ধূসর বর্ণা চোখের অভিব্যক্তি ঠাওর করতে পারলো না ঠিক। সুগভীর দৃষ্টি স্থির সামনে অদূরেই অবস্থিত বিলটার দিকে, যার একাংশ এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বিলের বুকে নদীর ন্যায় উথাল-পাতাল ঢেউ উঠেছে আজ, শরতের প্রস্ফুটিত আবহাওয়া আজ বৈরী রূপে সজ্জিত ।
বিরতিহীনা অবিন্যস্ত অনিলে মেহরাজের চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে, উপচে পড়ছে প্রশস্ত কপালে। খানিক অপলক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল মোহর। রসকষহীন গলায় বলল

– হঠাৎ এই প্রশ্ন?

– শুধু প্রফেসর আর স্টুডেন্ট সুলভ সম্পর্ক থাকলে তো কফিশপে বসে টাইম স্পেন্ড করার কথা নয়। তাই জিজ্ঞাসা করলাম

মোহর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে থ মেরে রইলো কয়েক লহমা। মেহরাজ কি করে জানলো সে ফায়াজের সাথে ছিল? আজ তো গাড়িও আসেনি। সে সময়ে মেহরাজ অফিস ছাড়া অন্য কোথাও ছিল বলে তো মনে হয় নাহ

– আপনি কি আমার উপরে নজরদারি রেখেছেন?

প্রশ্নের জবাবে প্রশ্নে মেহরাজ হাসলো খানিক। তবে সে হাসিতে আনন্দ বা স্বাভাবিকতা নেই, নির্জীব যান্ত্রিক হাসি। মুহূর্তেই ধক করে উঠলো মোহরের অন্তঃস্থল। তবুও কণ্ঠের খাদ বহাল রেখে বলল

– বলুন? আমি কোথায় যায় কি করি এসবের সবকিছুর খোঁজ খবর রাখেন আপনি?

মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কদম খানিক এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একদম মোহরের নাক বরাবর লম্বদূরত্বে। পকেটে গুঁজে রাখা হাত দুটির দিকে চোখ গেল মোহরের, এইরকম পরিস্থিতিতেও মোহরের দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ হলো অবাধ্যের মতো। অপলক তাকিয়ে রইলো ফর্সা হাতের কনুই অব্দি গুটিয়ে রাখা ডার্ক ব্রাউন রঙের শার্টের হাতা টা। তবে মোহরের এ স্বচ্ছ দৃষ্টিতে এক ফালি জড়তা ঢেলে মেহরাজ এগিয়ে এলো আরেকটু নিকটে। মুহুর্তেই একরাশ হীম অনিল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মোহরকে, মেহরাজ আজ অব্দি এতটা কাছে তার কখনো দাঁড়িয়েছে বলে মনে পড়েনা।

– আমার বাগানের প্রতিটি ফুলগুলোর অবস্থান ও আমি মুখস্থ করে রাখি, সেখানে আমার স্ত্রী’র প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে কি আমার অবগত থাকা টা কি স্বাভাবিক না?

মোহর এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকালো নিজের চেয়েও অনেকখানি লম্বা শরীরের মানুষটার দিকে। মোহরের মাথাটা একদম থুতনির নিচ বরাবর দুরত্বে, এতটা কাছে সরে আসায় মোহরের সমস্ত অস্থিতিশীল দশাকে অগ্রাহ্য করে মেহরাজ মোহরের দুপাশে হাত রেখে ঝুকে আসলো খানিক, জলদগম্ভীর গলার শান্ত স্বরে বলল

– বিয়েটা যেভাবেই হোক,আপনি আমার বউ। মেহরাজ আব্রাহাম তার একান্তই নিজের জিনিসগুলোর প্রতি একটু বেশিই যত্নশীল। এখানে কারো হস্তক্ষেপ বা ভাগ বসানো গুরুতর অন্যায়। যে জিনিস একবার আমার অস্তিত্বের নিকটে এসেছে তা আমি যতদিন চাইবো ততদিন আমার,শুধুই আমার। মোহমায়া, বুঝেছেন?

কাঁপা কাঁপা নজর তুলে তাকালো নিজের চেয়ে ইঞ্চিখানেক দূরত্বে অবস্থিত লোকটার দিকে। মেহরাজ আরও খানেক ঝুকে এলো, দুজনের মুখ একেবারে সমানে সমানে দাঁড়িয়েছে এবার। মেহরাজের মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর চেহারা টা ভীষণ নিখুঁত মনে হলো মোহরের। ধূসর বর্ণা চোখ আর কড়া সুগন্ধি টা নিমিষেই মাতোয়ারা করে ফেলছে ওকে। প্রত্যুত্তর করার অবকাশ টা যেন নেহাৎ ভুলে বসেছে।
বুকের ভেতর চলমান তুফানের একাংশ ছাপ পড়লো মেদুর গালে। মোহরের ভীষণ অস্থির মুখ খানায় কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে সরে আসলো মেহরাজ। ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মোহর, এতক্ষণে দম ফিরে পেলো হয়তো। কোন অজানা কারণেই ওর মুখটা যেন তালাবদ্ধ হয়ে ছিল, নিঃশ্বাস ছাড়তেও যেন প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল মেহরাজের নিকটত্বে।

– আমার বউ অন্য একটা ছেলের সাথে একান্তে বসে থাকবে এটা কখনও এক্সেপ্টেবল না মোহ, আপনার আশেপাশেও যেন আমি কাওকে না দেখি,সে যেই হোক । আশা করি বুঝতে পেরেছেন

থতমত খাওয়া চেহারায় তাকিয়ে আমতা-আমতা করে কিছু একটা বলতে নিলেও মেহরাজ সেটা শুরু হওয়ার আগেই ফুলস্টপ বসিয়ে বলে উঠলো

– কাল থেকে গাড়ি বাদে যাওয়া আসা করবেন নাহ

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের শুরু হয়েছে, মাগরিবের নামাজ পরে মোহর এসে বসেছে শাহারা বেগমের ঘরে। পাশে তাথই ও আছে, তাকে অবশ্য জোর করেই আনা হয়েছে। আপাতত সে সদা সর্বদার মতই কঠোর মুখাবয়বে বসে আছে। শাহারা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো

– মাজার ব্যথাটা যা বেড়েছে না, একবার ডাক্তার খানা ঘুরে আসা দরকার

– ডাক্তার খানা কি দরকার, পাশেই তো ডাক্তার বসিয়ে রেখেছো ওকে বলনা সারিয়ে দিতে।

কথাটা বলেই আবারও চুপ করে গেল তাথই। খোঁচা দিয়ে কথা বলার স্বভাব টা ইদানীং মোহরের উপরেই বেশি খাটায় যেন। শাহারা বেগম মৃদু হাসলেন, মোহর বলল

– তাহলে কালই নাহয় চলুন আমিই নিয়ে যাবো হসপিটালে৷

শাহারা বেগম কিছু একটা বলবে তার আগেই ধপ করে দরজা টা খুলে গেল, কিছু বুঝে উঠার আগেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেই ঝাপটে পরলো শাহারা বেগমের উপর, গলা ঝাপটে ধরে বলল

– দিদা…দিদা দিদা..আই মিসড ইউউ? কোথায় ছিলে তুমি এতদিন আমার খোঁজ ও নাওনি

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মোহর। কি হলো কিছুই বুঝলো নাহ। শাহারা বেগম নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন

– ওরে বাবা আমার মাজা যেটুকু ছিল সেটাও ভেঙে দিক এই মেয়ে

বলে নড়েচড়ে উঠে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল

– হ্যাঁ রে তুই কি ধীরস্থির হবি না কখনো। যতবার আসিস একটা না একটা দূর্দশা করেই দিস আমার

কপট রাগ দেখিয়ে বললেন। মোহর স্থির তাকিয়ে রইলো গোলগাল শরীরের মেয়েটির দিকে। বয়স হয়তো একেবারেই কম, গোলগাল উজ্জ্বল চেহারা। পরনে একটা কুর্তি আর জিন্স। মেয়েটা চেহারার মতই বাচ্চা গলায় বলল

– আমি এতদিন পরে এসেছি,কই আমাকে কোলে তুলে আদর করবে তা না খোটা দিচ্ছো। থাকবো নাহ আমি

– এতবড় ধিঙ্গি মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অকালে পটল তুলবে নাকি। ন্যাকা শেষ হয়না তোর তাইনা

মেয়েটা এবার তাথই এর দিকে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলে তাথই দূরে সরে গিয়ে ওর দিকে আঙুল তুলে বলল

– এই খবরদার, আমাকে ধরবিও না। তোর শরীরে ঘামের বিশ্রি গন্ধ।যা দূরে সর

মেয়েটা একটুও রাগল না। বরং উল্টো তাথই কে মুখ ভেংকে দিয়ে বলল

– ঘামের গন্ধ বলিস নাহ, এটা পারফিউম বুঝলি

নাক সিটিকালো তাথই। এবার মোহরের দিকে মেয়েটা তাকালে ভ্রু জড়ো হলো। ওর কৌতুহলী চেহারা দেখে শাহারা বেগম নিজেই বললেন

– ও মোহর। চিনতে পেরেছিস কে?

ধপ করে এসে মোহরকে ঝাপটে ধরলো মেয়েটা। আচানক তাল সামলাতে না পেরে প্রায় পরে যেতে নিলো মোহর। মেয়েটা ওকে ছেড়ে সুহাস্য গলায় বলল

– কেন চিনবো নাহ। এই কয়দিন তোমার মুখে গল্প শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। মাইসেল্ফ সাঞ্জে ভাবি।আপনার একমাত্র ননদিনী।

মোহর কিংকর্তব্যবিমুঢ় চেহারায় খানিক তাকিয়ে রইলো। প্রচন্ড চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে এটা আগমন দেখেই বুঝে গেছে। বিব্রতকর চেহারায়ই সৌজন্যে সুলভ হাসলো মোহর। সাঞ্জে আরও কিছু বলবে তার আগেই তাথই বলল

– এই তুই আগে ফ্রেশ হয়ে আই তো। দেখে মনে হচ্ছে রাস্তা থেকে একটা বিন্দি চলে এসেছে। যা শিগগির বেরো। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে তবে আসবি আনহাইজেনিক কোথাকার

তাথইয়ের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বিছানাতে ঠেস দিয়ে বসলো সাঞ্জে৷ শাহারা আর মোহরের সাথে খোশগল্প জুড়ে দিল। যেন মোহর ওর কতদিনের চেনাজানা। সাঞ্জেকে অবশ্য ভীষণ মনে ধরলো মোহরের। অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটা ভীষণ মিশুক। অল্প কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই মনে হচ্ছে কত কালের চেনা।
পাক্কা আধ ঘন্টা ধরে গল্প করলে তাথই ওকে ঠেলে ঠুলে ঘরে পাঠালো ফেশ হতে। ও যেতেই শাহারা বেগম বললেন

– এবার তোর শান্তি মুশকিল হবে রে মোহর। এই বাঁদর টা এক মিনিট কাওকে স্থির থাকতে দেয় নাহ।

আজ আর রাতে মোহরের পড়তে বসা হয়নি। সন্ধ্যার পর ঘরে আসার সুযোগ ই হয়নি।সারা সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা অব্দি গল্প করেছে আজ সাঞ্জের সাথে। মেয়েটা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে, যেগুলো শুনলে না হেসে পারা যায় না। আজ অ অবশ্য তাথই ও ছিল, ওকে ও নড়তে দেয়নি মেয়েটা। রাতের খাওয়া দাওয়া আজ সকলে এক টেবিলে করেছে, সাঞ্জে মোহরকে পাশে বসিয়ে খাইয়েছে।
এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম যেন মোহরের মনে হলো এটা একটা একান্নবর্তী পরিবার। না তো যে যে যার যার কাজেই ব্যস্ত থাকে। মনটাও যেন অনেকটা হাল্কা হয়ে আছে মোহরের।
তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ ঘরের সামনে এসে দরজা টা কিঞ্চিৎ ফাঁক করলেই মেহরাজের মুখটা সামনে স্পষ্ট হলো। গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো মোহর। মেহরাজ রাতভর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে বারান্দায় বসে, তাই ওর ঘরে আসার আগেই মোহর ঘুমিয়ে পড়ে। তবে আর ঘরেই বসেছে ডিভাবে। দুপুরের পরে আর তেমন মুখামুখি হতে হয়নি মেহরাজের, শুধু রাতে খাবার টেবিলেই দেখা হয়েছিল তাও দূর থেকে।

মোহর জড়তাগ্রস্ততা ভেতরেই দমিয়ে রেখে প্রথমেই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। মুখ মুছে বিছানার দিকে গেলে মেহরাজের আওয়াজ কানে এলো

– এদিকে আসুন কথা আছে।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৮

হিলিয়ামের জলন্ত গ্যাসপিণ্ডটা দাপটের সহিত মাথা চারা দিয়ে উঠেছে বেশ অনেক্ষণ আগেই। আকাশের বুকে তার কমলা রশ্নীর তেজ ছড়াচ্ছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। দেওয়াল ঘড়িতে সময় আটটা বেজে পনেরো মিনিট।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো মোহর। পরনে হালকা হলুদ রঙের সুতির জামা। তার উপর রঙিন সুতির এ্যামব্রয়ডারি করা। পাতলা লম্বাটে শরীর টার সাথে লতার মতো পেচিয়ে আছে জামাটা। ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মোহর।

বার কয়েক পানির ঝাপটা চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ছুটে গেল মেহরাজের। ঘুমের চোটে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দু’টো খুলে তাকালে সামনের দৃশ্যে দৃষ্টি আটকে গেল মেহরাজের। মুহূর্তেই সকল ঘুম অলসতা কর্পূরের মতো উবে গেল, সাথে ভীড় করলো একরাশ বিমহ। স্থিরচিত্তে তাকালো চোখ দু’টো সম্পূর্ণ প্রসারিত করে।
মোহরের কোমর ছড়ানো চুলগুলো টপকে বিন্দু বিন্দু করে পানি পড়ছে মেঝেতে, হলুদ রঙের জামাটা যেন মোহরের গড়নের সাথে মিশে গেছে। বাগানের সদ্য ফোঁটা হলদেটে গোলাপের চেয়েও আবেদনময়ী লাগছে মেহরাজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে।
চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত থাকার কারণে মোহর এতক্ষণেও খেয়াল করেনি মেহরাজের এহেন স্থৈর্যদৃষ্টি। অপলক নিষ্প্রভ ভাবে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে। মেহরাজ উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘাকার শরীরে লেপ্টে থাকা শুভ্র কাপড়ের টি-শার্ট টা হাত দিয়ে টেনে সোজা করলো। কোনোরূপ শব্দ বা প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেল, দাঁড়ালো আয়নাটার সামনে, একদম মোহরের পেছনে এক হাতেক দূরত্বে।
হাত রেখে চিরুনি টা রেখে পেছনে ঘুরতেই মেহরাজকে দেখে তীব্রভাবে ভড়কে গেল মোহর। মৃদু চিৎকার করে উঠলো আতঙ্কে। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো, পরমুহূর্তেই মেহরাজকে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও জড়তা কাটলো নাহ। সকাল বেলা করে এভাবে ভয় দেখানো কোনো মানেই বুঝে উঠতে পারলো না মোহর, এভাবে মূর্তির মতো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয়!

মেহরাজ অ্যাডিডাসের পিচ ব্ল্যাক রঙের ট্রাউজার টার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভীষণ পরিপাটি ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে এখনো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহরের সর্বাঙ্গে কাঁটা বিঁধলো যেন। ঘুম ঘুম লালাভ চোখের ধূসর বর্ণা চাহনিতে একরাশ তৎপরতা ঢেলে দিল মোহরের সমস্ত চিত্তে। শুকনো ঢোক গিলে বলল

– এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি?

– দেখছি

– কি দেখছেন৷ যখন তখন এভাবে হুট করে পেছনে এসে দাঁড়ান কেন। এটা আবার কেমন স্বভাব

মেহরাজ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ডলে আবারও পকেটে হাত ঢোকালো। মোহরের এবার বেশ রাগ হলো। সবসময় এভাবে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়!

– আপনি কি একটু শব্দ করে চলাফেরা করতে পারেন নাহ। এভাবে চমকে দেওয়ার কি দরকার আজব, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়

ফোস ফোস করে একদমে কথাগুলো বলল মোহর। মেহরাজ ওর এমন রণচণ্ডী রূপী কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেল। চোখ প্রসারিত করে তাকালো দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। বেশ চটে গেছে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মোহরের যে ভূতে একটু না অনেকটাই ভয় এটা ও মুখে স্বীকার না করলেও মেহরাজ খুব ভালো মতই বুঝতে পারে৷
মোহরের বিব্রতবোধ টাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে মেহরাজ বাঁকা হেসে তাকালো। এহেন রহস্যময়ী হাসি আর সূক্ষ্ম চাহনির অর্থোদ্ধার করতে পারলো না মোহর, জিজ্ঞাংসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
মেহরাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে একদম মোহরের সামনে এসে দাঁড়ালো, মোহর ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল

– আ আপনি এগিয়ে আসছেন কেন।

মেহরাজ উত্তর করলো নাহ। মোহর ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠলো মেহরাজের নিকটত্বে, আবারও জড়ানো কণ্ঠে বলল

– সরে যান, আমার কাছে কেন আসছেন।আসবেন না।

ওর সমস্ত অপ্রীতিকর, বেখেয়ালি চিন্তাভাবনাকে মুহূর্তেই ভুল প্রমাণিত করে মেহরাজ বিছানার উপরে পরে থাকা জরজেটের হলুদ ওড়নাটা তুলে ওর দু’কাঁধের উপর বিছিয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে রোমহ্নন গলায় বলল

– আপনি বারবার কেন ভুলে যান যে এ ঘরে আরও একজন থাকে, একটু সামলে চলাফেরা করুন মোহ, না তো আপনার সাথে সাথে অন্য কারোর ও বারবার বুক কেঁপে উঠতে পারে, ভয়ে না হোক হয়তো কারণে!

বলেই সরে এলো। কাবার্ড খুলে একটা তোয়ালে বের করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। এর মাঝে আর একবারও তাকালো না মোহরের দিকে। মোহর বিহ্বল ভাবে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে, একটা টু শব্দ অব্দি করতে পারলো নাহ। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো যেন। দুরুদুরু বুকের কম্পন গায়ের লোমগুলোতেও শিরশিরানি ধরিয়ে দিল। তাই তো! এতটা বেখেয়ালি কি করে হলো! ঘরে যে আস্তো একটা পুরুষ মানুষ আছে সেটা কি করে ভুলে যায় ও বারবার। ছিছি, লজ্জা লজ্জা। নিজের এমন বিশ্রি কর্মকাণ্ডে নিজেরই নাক কা’টা যাচ্ছে মোহরের।

– ভাবী শোনো না, বলছি আজকে না গেলে হয়না?

মোহর অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সাঞ্জের দিকে। মেয়েটা এতো আদুরে যে এর একটা কথাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। কাল এসে থেকে ভাবী ভাবী করে অস্থির হয়ে উঠেছে। ওর ব্যবহার টা ঠিক এমন যেন আগে থেকেই ঠিক ছিল মোহ-রাজের বিয়েটা। ওকে দেখে মনেই হয়না ও এ বাড়িরই সদস্য। এতগুলো গম্ভীর মানুষ গুলোর মধ্যে একটা মাত্র চঞ্চল প্রাণোচ্ছল চেহারা।

– ভাবী বলোনা, আমি কাল মাত্র আসলাম।আর আজই তুমি আমাকে রেখে বেরোচ্ছো

– তো তোকে কি কোলে করে রাখতে হবে নাকি। ওর ক্লাসে ও যাবে না? তুই এসেছিস বলে কি ধেই ধেই করে নাচবে

– বড়পু তুই প্লিজ চুপ কর। তুই এখানে কেন এসেছিস বল তো। যা তো তুই তোর ঘরে গিয়ে খিল এঁটে বসে থাক।

তাথই ভ্রুকুটি করেই মুখ ফিরিয়ে নিল। সকাল বেলা করে এই মেয়েটার ন্যাকামি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে৷ শাহারা বেগম পান চিবাতে চিবাতে বলল

– আরে এই যাবে আর আসবে। দুপুরের আগ দিয়েই চলে আসবে ও

তবুও ক্ষান্ত হলো না সাঞ্জে। গোলগাল মুখটা আরও ফুলিয়ে বসলো। আম্বি খাতুন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাঞ্জের হাতে নুডলস এর বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলল

– কেন রে সাঞ্জে। আমাদের কি পছন্দ হচ্ছে না তোর? এসে থেকে ভাবী ভাবী করে তো মাথা টা নষ্ট করে দিচ্ছিস

সাঞ্জে মুখ ভরে নুডলস পুরে আড়চোখে তাকালো। খেতে খেতে বলল

– হ্যাঁ তো করবই। একটা মাত্র ভাবীকে পেয়েছি। ভাবী ভাবীই তো করবো

আম্বি খাতুন নির্লিপ্ত চোখ মেলে আবারও নিজের কাজে ধ্যান দিল। বড়রা এখনো নামেনি ঘর থেকে। মোহর শাহারা বেগমের পাশেই সোফাতে বসা। তাথই এর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে। এত আদুরে মিষ্টি বাচ্চাটা যে সারাদিনই কোলে করে রাখতে মন চাই। গায়ের রঙটা বেশ উজ্জ্বল, তাথই এতটা ফর্সা না, হয়তো ওর বাবার মতো গায়ের রঙ পেয়েছে।
মোহর বসে বসে খেলতে লাগলো ছোট্ট হাত দুটি ধরে । এর মাঝেই মেহরাজ একেবারে রেডি হয়ে নেমে এলো সিড়ি বেয়ে। সেদিকে একবার চোখ যেতেই অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল মোহর। মেহরাজ এসে বসলো একদম সাঞ্জের পাশের চেয়ারটাতে, ওকে দেখেই সাঞ্জে আহ্লাদী গলায় বলল

– দাভাই তুমি এসেছো। বেশ হয়েছে , তুমি একটু বোঝাও না।

মেহরাজ জিগাংসু চোখে তাকালে সাঞ্জে বিরতিহীন বলে

– ভাবীকে বলো না আজ বাড়িতেই থাকতে। আমি ভাবীকে নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বেরোবো

– বেরোবি তো বিকেলে,তাহলে এখন তো যেতেই পারে

মেহরাজের জবাবে মুখটা শুকিয়ে এলো সাঞ্জের। চুপ করে গেলে মেহরাজ ওর মাথায় হাত রেখে বলল

– আরে মন খারাপ করার কি আছে। আজ মোহর তাড়াতাড়ি চলে আসবে । এই দুই তিন ঘন্টার ভেতরেই। কি মোহর, আসবেন না?

মোহর কে উদ্দেশ্য করে বলে তাকালো মেহরাজ। মোহর শুরুতে থতমত খেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে বলল

– হ্যাঁ। আসবো তো। তুমি মন খারাপ করো না। আমি দুপুরের আগেই চলে আসবো।

ধীরে ধীরে নাস্তার প্লেট গুলো সাজিয়ে দিলে মেহরাজ নাস্তা শুরু করলো। সাঞ্জেও আর কথা বাড়ালো নাহ।
মোহর ব্যগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মেহরাজ নাস্তা সেরে উপরে গেছিল আবারও, এই ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে ও। আজ একাই যাবে বলে ঠিক করেছে। ওই লোকটার সামনেও পরতে ইচ্ছে করছে না। অস্বস্তি ঘিরে ধরে খুব, তার উপর সকালের ঘটনাতে মোহর অনেক বেশিই লজ্জিত।
তড়িঘড়ি করে গেইট থেকে বের হতে নিলেই ওর সমস্ত পরিকল্পনাতে জল ঢেলে দিল পেছন থেকে আসা সুপরিচিত কণ্ঠস্বর

– দাঁড়ান

না চাইতেও পা দুটো থামালো মোহর। পেছনে না ঘুরেই বুঝতে পারলো দ্রুত পদক্ষেপ টা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে

– কোথায় যাচ্ছেন?

মোহর শুকনো মুখে বলল

– মেডিক্যালেই যাচ্ছি,আবার কোথায়

– একা কেন বেরিয়েছেন? আপনাকে তো বলেছি একা আসা যাওয়া করবেন না!

– গাড়ি নেই। আরহাম আংকেল নিয়ে বেরিয়েছে সকালে

কোনো রকমে বাহানা দেখাতে এলোথেলো ভাবে বলল মোহর। মেহরাজ অবিলম্বেই কাঠ গলায় বলল

– আমাকে বারবার নিজের উপস্থিতি টা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে কেন হয় বলুন তো । এতো লম্বা চওড়া হয়েও কি আপনার চোখে পরিনা কখনো? আমাকে কি পছন্দ হচ্ছে না?

বলেই বিরক্তমুখে চশমাটা চোখে লাগিয়ে গ্যারাজের দিকে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চকচকে কালো গাড়িটা হাওয়া উড়িয়ে থামলো মোহরের সামনে৷ ভেতর থেকে আপনা আপনিই দরজা টা খুলে গেলে কোনো প্রশ্ন হীনা-ই উঠে বসলো মোহর। তৎক্ষনাৎ প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা চলতে শুরু করলো।
আড়চোখে দু একবার মেহরাজের দিকে তাকালো মোহর। মেহরাজ ভীষণ গম্ভীর মুখ করে আছে। গায়ের ব্লেজার টা উরুর উপরে রেখেছে। আইভরি রঙের শার্টের হাতাটা কনুই অব্দি ফোল্ড করা। কালো রঙের প্যান্টের সাথে চোখের চশমাটা একদম একই লাগছে।

বাঁকা নজরে আপাদমস্তক দেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিল মোহর। নাহ এর দিকে তাকানোই যাবে না,
না জানি আবারও কখন কি বলে বসে। কিন্তু খুব অজানা কোনো কারণেই মেহরাজের সামনে আসলেই মোহরের ভেতর বাহির দুটোই বেহায়া হয়ে ওঠে। অবাধ্য নজর বারংবার নিষেধাজ্ঞাকে সকপটে বেপরোয়া করে চুম্বকের মতো একই দিকে তাকাতে চাই। এই যে এখন যেমন বারবার চোরা দৃষ্টিতে তাকাতে যাচ্ছে। প্রচন্ড বারণ সত্ত্বেও লোকটাকে আগাগোড়া পরখ করার বড্ড কৌতূহল জাগে, বাঁকা চোখেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মোহর। গায়ের গৌড়বর্ণের রঙটা যেন বেশিই উজ্জ্বল। এতটা ফর্সা কেন লোকটা!
ফর্সা হাতের লোমগুলো ও বেশি চোখে বিঁধছে । মাথার ঢেউ খেলানো কালো বাদামি মিশ্রিত চুল, খাড়া নাক। ঠোঁট দুটোও কেমন, দেখলে মনে হয় না কখনো নিকোটিনের স্পর্শ পেয়েছে । সবকিছুই যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। একটা মানুষকে এতটা সুদর্শন হতে হয়? ছেলে মানুষ এতটা নিখুঁত কেন হবে! ছেলে মানুষ তো একটু শ্যাম গড়নের, চোখ দু’টো দাবা, ঠোঁট দুটো কালচে হবে।

মোহরের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই গাড়িটা ব্রেক করলো। সচকিত হয়ে আশপাশ দেখে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে গেলেই মেহরাজ গুরুগম্ভীর গলায় বলল

– ক্লাস শেষে দাঁড়াবেন, আমি এসে নিয়ে যাবো

– আমি একাই ফিরতে পারবো

মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কালো চশমাতে ঢাকা চোখের অভিব্যক্তি ঠাওর করতে পারলো না মোহর, তবে রাশভারি গলার স্বরটা স্পষ্ট কানে বাজলো

– আমার সাথে ফিরলে সমস্যা? ফায়াজ স্যার রাগ করবেন?

এখানে ফায়াজ স্যার কেন আসলো? মেহরাজের নিকট এহেন অপ্রত্যাশিত কথায় ললাটে ভাঁজ ফেলে বলল

– আপনি আমাকে খোটা দিচ্ছেন?

– মনে করিয়ে দিচ্ছি, ক্লাস শেষে দাঁড়াবেন আমি নিয়ে যাবো

বলেই গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে এস্কেলেটরে চাপ বৃদ্ধি করলো, শুধু অপেক্ষা টা স্টিয়ারিংটা ঘুরানোর। মেহরাজের গাড়ি স্টার্ট করাটা যে মোহরকে বেরিয়ে যেতে বলার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এটা বুঝতে এক লহমাও দেরি হয়নি মোহরের। এতে অপমানিত হলো কি না জানা নেই,তবে ভীষণ বিভ্রান্ত সহ ক্ষুব্ধও হলো, মানুষটার এক এক সময় এক এক রকম আচরণটা একেবারেই পছন্দ হয়না মোহরের।

গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। শ্রীতমা এখনো আসেনি। কারণ ক্লাস শুরু হতে এখনো মিনিট বিশেক দেরি। মোহর আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। মূলত মেহরাজের নৈকট্য এড়াতে যথাসময়ের পূর্বেই বেরিয়েছিল। বেরোলেও তা এড়াতে আর পারলো কই।

– স্টপ, মোহর

বেশ চেনা মনে হলো কণ্ঠস্বরটা। তবে আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলো নাহ। মনের ভুল ভেবে আবারও পা বাড়াতে নিলে হুট করেই কেও ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– তোমাকে দাঁড়াতে বলেছি না? কথা কি কানে যাই না?

জিন্সের প্যান্ট এর সাথে হাটু সমান লাল রঙের টপস পরা মেয়েটিকে দেখে বেশ বিব্রত হলো মোহর। ও এইখানে হঠাৎ?

– আপনি এখানে?

– কেন মেডিক্যাল কি তোমার একার? আমি আসতে পারিনা?

তিয়াসার হাতে একটা এ্যাপ্রোন ঝুলানো। তিয়াসাও কি ডক্টর? কই আগে তো দেখেনি, হয়তো খেয়াল হয়নি, যাই হোক ওর কর্কশ গলার মর্মার্থ বোধগম্য হলো নাহ মোহরের। শান্ত রূপেই জবাব করলো

– আমাকে ডাকছিলেন?

– এখানে তুমি ছাড়া আর কারো নাম মোহর বলে তো জানি না, এ্যানিওয়েস আমার সাথে এসো কথা আছে

– আমার ক্লাস আছে, এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব না

মোহরের নাকচ করা শব্দে তিয়াসার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। চড়া গলায় বলল

– তোমাকে আমি ডেকেছি আর তুমি আমার মুখের উপর না করছো। কি মনে করো নিজেকে মেহরাজকে বিয়ে করে খুব ডানা গজিয়েছে তাইনা?

– আপনি অহেতুক ঝগড়া করছেন, এটা আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিন ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ

– আমি সিন ক্রিয়েট করছি? আমার মুখে মুখে তর্ক করার সাহস হয় কি করে, হাউ ডেয়ার ইউ চিপ, ক্লাসলেস। কি মনে করো দেহ দিয়ে ভুলিয়ে রেখে মেহরাজের সব হাতিয়ে রাজত্ব করবে। তোমাদের মতো মেয়েকে সবাই খুব ভালো করেই চেনে বড়লোক দেখে ছেলে পটিয়ে বিছানায় মাতিয়ে নিজেদের সার্থসিদ্ধ করাই তোমাদের কাজ

সামান্য একটা কথার বিপরীতে এহেন উত্তর মোহর কখনও আশা করেনি। প্রচন্ড অপমানবোধ ঘৃণায় গা জ্বলে উঠলো। আশেপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, তিয়াসাদ উচ্চ্যবাক্যে বলা কথা গুলো অনেকেরই কানে গেছে, মোহর ক্ষুব্ধ গলায় গর্জে বলল

– চিপ ক্লাসলেস শুধু টাকার হিসেবে না বাহ্যিক আচরণ আর উগ্র ব্যবহারেও বোঝা যায়। যেটা আপনার মাঝেই স্পষ্ট। এভাবে লোকসম্মুখে যে এরূপ বিশ্রি ভাষার ব্যবহার করতে পারে তাকে শুধু কুশ্রী স্বভাবেরই না মানসিক ভারসাম্যহীন ও বলা যায়

মোহরের তীক্ষ্ণ গলায় বলা অপমানসূচক কথায় মাথাটা যেন দপদপ করে জ্বলে উঠলো তিয়াসার। জেদ রাগ মাথায় চড়ে বসলে ও জলন্ত চোখে তাকিয়ে মোহরকে থা’প্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই পেছন থেকে একটা হাত খপ করে ওর কবজি চেপে ধরলো। মেডিক্যালের সামনে যদিও বেশি লোকজনের ভীড় নেই, তবুও গুটিকয়েক লোক জড়ো হয়েছে। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে দেখছে অপ্রীতিকর দৃশ্য।

নিজের কবজিতে অস্বাভাবিক শক্ত চাপ পড়তেই যন্ত্রণায় মুখ কুচকে এলো। তবুও ক্ষুব্ধ হয়ে পেছনে ঘুরে তাকালেই মোমবাতির ন্যায় ধপ করে নিভে গেল এক জোড়া হিংস্রাত্মক লালাভ চোখ দেখে। তিয়াসা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করার আগেই হাড় হীম করা ভারি কণ্ঠটা বলে উঠলো

– ওর গায়ে একটা টোকা দিলেও ভবিষ্যতে এই হাত আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় থাকবে নাহ, এ্যন্ড আই উইল মেইক সিউর দ্যাট
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে