#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৫
কুসুম রাঙা আলোয় খুব ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধরিত্রী। অসীমে নীলের মাঝে মাতাল মেঘেরা তুলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষের ভেতরের চাপা কষ্ট গ্লাণিকে হরদমে উপেক্ষা করে প্রকৃতি প্রাণোচ্ছল ভাবে হরিদ্বর্ণ দিগন্তে মন বনান্তপ্রাণ খুলে অধর ছড়িয়েছে।
ফোনের বিপ বিপ ভাইব্রেশনের বিভৎস শব্দে চোখ কুচকে এলো মোহরের। বার কয়েক বিরতিহীন গুমগুমে শব্দে চোখ খুললো মোহর৷
আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝে আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। ঘুমে ঢুলুঢুলু আধবোজা চোখে সামনে তাকালে চোখ দু’টো স্থির হয়ে যায়। চুম্বকীয় টানের ন্যায় অভিভূত হয়ে স্থবিরত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের চেয়ে কয়েক ফিট্ সামনে।
কুচকুচে মেরুন রঙের ডিভানটা পুরোপুরি দখল করে শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী সৌষ্ঠব ব্যক্তিটা। বারান্দায় যাওয়ার স্লাইডিং ডোরে কিঞ্চিৎ ফাঁক পেয়ে অবাধ্য রোশনাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তারই একাংশ মেহরাজের গায়ে উপচে পরেছে। সমুদ্রের ন্যায় গভীর নীল রঙের টি-শার্ট এর রঙকে তুচ্ছ করে মেহরাজের ফর্সা বাহু দুটোতে চোখ বিঁধে গেল মোহরের।
ঘুমুরে চোখের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখলো সম্পূর্ণ মেহরাজকে। এই লোকটা এমন কেন? মানুষটাকে দেখলে মোহরের ছোট্ট মনটা জুড়ে খরস্রোতা নদীর আকস্মিক প্লাবনের ন্যায় ওঠাপড়া অদ্ভুত অনুভূতি গুলো উপচে পড়ে।
ভীষণ মন্থর গতিতে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো, দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মনে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের একদম সামনে। ঘুমন্ত অবস্থায় ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে শুভ্র নির্মল চেহারাটা। ঘন চওড়া ভ্রুযুগলের নিচের বন্ধ চোখ দু’টো কত শান্ত, চিত্তগ্রাহীই না লাগছে, ইচ্ছে করছে প্রাণ ভরে শুধু এই চোখ দুটোই অবলোকন করতে।
কেমন মোহাচ্ছন্নের মতো লাগলো মোহরের। নিজের অজান্তেই মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে কিঞ্চিৎ ঝুকে আসলো, দুই হাত হাঁটুতে ভর করে মেহরাজের উপর উবু হয়ে তাকালো, দৃষ্টি ভরা কেমন সকৌতুকতা। এক পর্যায়ে ভ্রু কুচকে এলো মোহরের।
কিছু একটা নিয়ে ভাবনাগ্রস্ত হয়ে ঘাড় কাত করে তাকালে মোহরকে চূড়ান্ত বিড়ম্বনায় ফেলে বেহায়া ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো, তৎক্ষনাৎ মেহরাজ চোখ খুললেই মুখের উপর এমন মোহরকে উবু হয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো। মোহর প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সরে আসতে নিলে ডিভানের সামনে রাখা ছোট একটা টি-টেবিলের মতো কিছু একটায় হাঁটুতে সজোরে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পরলো একেবারে মেহরাজের বুকের উপর।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহর আকস্মিক ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। বুকের ভেতর প্রচণ্ডরকম দ্রিমদ্রিম শব্দে টাইফুন তুলেছে। ঘুমের প্রকপে ফোলা ফোলা চোখ দুটিতে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
মেহরাজ ভ্রুকুটি করে কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে। সকাল বেলাই ঘুম ভেঙে এহেন কাণ্ড ওর ধারণার বাইরে ছিল। মোহর নড়েচড়ে সরে আসার চেষ্টা করলে পিছলে গেলেই মেহরাজ ওর সুডৌল কোমর আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় কম্পে উঠলো মোহরের সমস্ত চিত্ত। চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিল। সরে আসতে গেলেও প্রচণ্ড শক্ত থাবার ন্যায় হাত দুটো সরাতে পারলো নাহ। বরং ওর অস্বস্থিকে থার্মোমিটারের পারদের মতো তরতর করে বাড়িয়ে দিল মেহরাজের ভারী গালার ঘুমঘুম স্বর
-এতো কষ্ট করে চুরি করে দেখবার কি দরকার ছিল। আপনার যদি আমাকে এতই দেখতে ইচ্ছে করে তাহলে আমাকেই বলতেন, আমিই নাহয় বসে থাকতাম আপনার সামনে, আপনার মন না ভরলে সারাদিনই বসে থাকতাম মোহমায়া।
উত্তাপধারী কণ্ঠের এমন মাদকতা মিশ্রিত শব্দে মোহরের শিরা উপশিরায় শীতল রক্ত স্রোত বয়ে গেল। মস্তিষ্কের নিউরনের প্রচণ্ড উদ্দীপনার দাপটে দূর্বল হয়ে এলো মেরুদণ্ড। প্রকাণ্ড ভার এসে ভর করলো কণ্ঠনালীতে। জিহ্ব ঠেলে কোনো রকমে জড়তা ভরা গলায় বলল
-দে্ দেখুন
-এতো ছটফট করলে কিভাবে দেখব আপনাকে
মোহর গরম ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস করে মেহরাজের বুকের উপর হাত রেখে উঠে আসার চেষ্টা করলো। হাতের করপুট নিমিষেই ঢিলে করে দিল মেহরাজ। ছাড়া পেয়ে এক ঝটকায় সরে এসে দাঁড়ালো, বিব্রতচিত্তে অবিন্যস্ত ভাবে বলল
-আ আপনার ফোন বাজছিল অনেক্ষণ ধরে, তাই ডাকতে এসেছিলাম, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন না
মেহরাজ শোয়া থেকে উঠে বসলো। স্বচ্ছ টলটলে দীঘির ন্যায় আঁখিদুটির স্থবির দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে।
-আমি তো কিছুই ভাবছি নাহ
মেহরাজের সে চাহনি মোহরকে তড়বড় করে অস্বস্তিকে বাড়িয়ে দিল। অপ্রকৃতস্থ হয়ে বলল
-আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিল। মোহরের পালিয়ে যাওয়া দেখে মেহরাজ ঠোঁট কামড়া হাসলো, একেবারেই ক্ষীণ হাসি দিয়ে নিজের হাতটা তুলে রাখলো বুকের ঠিক সেইখানে মোহর হাত রেখেছিল যেখানে।
•
গেট পেরিয়ে ঢুকে নিজ ক্লাসরুমের দিকে এগোতে লাগলো মোহর। খানিক এগোতেই সিড়ির দিকে শ্রীতমা কে দেখলো। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে হয়তো। মোহর এগিয়ে যেতে যেতে ফোনে কথা শেষ হলে মোহরকে দেখেই অধর ছড়িয়ে হাসলো।
-মোহ, আই আই তোর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি
মোহর এগিয়ে গিয়ে, ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-তুই কি করে জানলি আমি এখনই আসবো। আজ তো তাড়াতাড়ি এসেছি অনেক
-ওমা আমি জানবো না তো আর কে জানবে।
বলে ফিক করে হেসে দিল। মোহরও ক্ষীণ হেসে এগোতে লাগলো সিড়ি বেয়ে। কিন্তু মোহরের স্বাভাবিক চেহারাকে তব্দা মেরে দিয়ে তমা বলল
-মোহ আমি না প্রেমে পরেছি
চোখ ছোট করে মোহর তাকালো তমার দিকে।
ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, কারণ এর আগেও তমা এহেন মজা করেছে মিথ্যা বলে। ও তনুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল
-আবারও মজা করছিস।
-আরে নাহ। শোন না আমি সত্যিই বলছি। আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি উনাকে।
মোহর ওর কথায় তবুও গা করলো নাহ। তাই ওর বলা শব্দসমষ্টিকে নিরবে মিথ্যে আখ্যা দিয়ে চুপ করে রইলো। তনু ওর বিশ্বাসকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে ফোন বের করে ধরলো মোহরের সামনে।
স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ফরমাল স্যুট পরিহিত হাস্যজ্বল একটা শ্যামবর্ণ চেহারা। বেশ সুদর্শন পুরুষ। তমা মুচকি হেসে বলল
-অরুনাভ মুখার্জী। বিজনেসম্যান, উনাকেই ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
মোহর চোখ বড় বড় করে তাকালো শ্রীতমার দিকে। ওর মুখে লাজুক হাসি। এই প্রথমবার ওকে কোনো ছেলে নিয়ে কথা বলতে দেখলো। লজ্জায় মাথা নামিয়ে রেখেছে। চিরচেনা প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এমন অচেনা চেহারাটা মুহুর্তেই মোহরকে অভিভূত করলো। হৃদয়ের কোনো এক কোণে অনাদরে পরে থাকা ভালোবাসা শব্দটার সুপ্ত মৃদু মুগ্ধতা গুলো উঠকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো যেন,চোখের সামনে অজান্তেই একটা সুদর্শন চেহারা ভেসে উঠলো। পরমুহূর্তেই ওর জীবনের বাস্তবতা গুলো স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় প্রতিফলন হয়ে উঠলো। মৃদু হাসি দিয়ে মাথা থেকে অযাচিত চিন্তা গুলো গা ঝারা দিয়ে তমার হাত ধরে বলল
-আসলে কি কি হয়েছে বল তো?
•
পুরু কাঁচের দেয়ালে আবদ্ধ বৃহৎ কেবিনটা। দক্ষিণ পাশটা দিয়ে পুরো শহরের একত্রিত চিত্র দেখা যায়। সাদা নীলের মিশ্রণে দারুণ রঙ আকাশের বুকে। যেন রম্য ক্যানভাস স্বচ্ছ রহস্যময়ী নির্মল রূপ, মেঘের উপরে মেঘ উড়ছে জগলুর চিত্ত বিহ্বলের ন্যায়।
ধোয়া ওঠা কফির মগটা পাশের টেবিলে রাখলো।
দু’হাত পকেটে গুঁজে গাঢ় মণির অপলক দৃষ্টিতে তাকালো নীলে সবুজের অপরূপ আকাশ আর মাটির রেখায়।
-স্যার আসবো?
নিজ স্থানের নড়চড় করলো নাহ। ক্ষীণ গতিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ভেতরে ঢুকে আবারও দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ালো অভিমন্যু। নিজ স্যারের নিরব সম্মতিকে তার খুব ভালো ভাবেই চেনা আছে। ওর চাঞ্চল্য ভরা গলায় শ্রদ্ধা বিনয় মিশিয়ে বলল
-স্যার এই লোকেশন গুলো রিকমেন্ড করেছে সবাই। এখন শুধু আপনার ভ্যারিফাই করে সিলেক্ট করার অপেক্ষা। তার পরেই কাজ শুরু হবে
বলে ফাইল টা এগিয়ে দিল। মেহরাজ স্থির নিমিত্তে তাকিয়ে আছে সুদূর দিগন্তে। আকাশের বুকেও যেন ভীত-সন্ত্রস্ত সেই কৃষ্ণাভ আঁখিদুটি ভেসে উঠছে। বুকের উপরে রাখা সেই হাতের স্পর্শ এখনো তাজা হয়ে আছে।
-স্যার?
অভিমন্যুর ডাকে ধ্যান ভাংলো মেহরাজের। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ঘুরে দাঁড়ালো। অভিমন্যুর জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি পরখ করে এগিয়ে গিয়ে নিজের চেয়ার টাতে বসলো। অভিমন্যু এগিয়ে এসে কিছুক্ষণ আগে বলা কথা গুলো আবারও সম্পূর্ণ আগ্রহের সাথে পুনরায় বলল
-সাইট গুলো সব চেক-আউট করা হয়েছে?
কালো রঙের চকচকে ফাইলটার কাগজ ওলটাতে ওলটাতে বলল মেহরাজ। অভিমন্যু ঘাড় নাড়িয়ে বলল
-ম্যানেজার সব দেখে এসেছে স্যার
-ফরগেট দ্যাট। তুমি নিজে।গিয়ে দেখে আসো একবার।
-জ্বি স্যার, আমি আজ রাতেই যাচ্ছি। টিকিট বুক করাও হয়ে গেছে।
মেহরাজ অভিমন্যুর এরূপ বুদ্ধিমত্তায় নতুন খুশি হলো নাহ। কারণ ও এমনই, স্যার আর তার সব কাজের ঠিক রাখায় অভিমন্যুর স্বভাব। মেহরাজের মতো খুতখুতে স্বভাবের মানুষের সব কাজ একমাত্র অভিমন্যুই পারফেকশনের সাথে কমপ্লিট করতে পারে।
মেহরাজ ফাইলটা ওর হাত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল
-এদিকের সব ডান?
-ইয়েস স্যার, এখন আপনি বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। আর একটা প্রজেক্ট ভ্যারিফাই করা বাদ আছে আমি ওটা সামলে নিতে পারবো।
বলে দরজার দিকে যেতে নিলে মেহরাজ পেছন থেকে ডেকে বলল
-অভি, শীপ ম্যানেজমেন্টের ফাইলটা ইবনাত দেখে নিবে। তুমি বাড়ি যাও
-ইটস ওকে স্যার, আমি সামলে নিতে পারবো
-তোমাকে যা বলেছি তাই করো। এসব কাজ ওরাই সামলে নিবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও, ওভারটাইম তোমার কাজ নয়
অভিমন্যু নীরবে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেলে মেহরাজ ফোনটা হাতে নিলো। ওখানে স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে ডিম লাইটের মৃদু আলোতে মোহরের ঘুমন্ত চেহারাটা
……………………..
-ছোট ম্যাডাম সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমি না গেলে তো তাথই আপা এখনি বাচ্চাডারে মাইরা ফেলতো।
মালা চিৎকার করতে করতে এলো বসার ঘরে, কাকলি বসে ফোনে কথা বলছিলেন। আর আম্বি টিভি দেখছিলেন। মালার কথায় সব কাজ রেখে উঠে দাঁড়ালে মালা এগিয়ে এসে বলল
-বাচ্চাটা কখন থেকে কাঁদতেছিল খিদায়। আমি দুধ গরম করতে আইছিলাম নিয়ে যেতেই দেখি তাথই আপা ফ্ল্যাক্স থেকে গরম পানি বের করে বাচ্চারে খাওয়াইতে লাগছে। ওমা ম্যাডাম আমি সময় মতো না গেলে তো বাচ্চাডারে আজ মাইরা ফালাইতো গো
কাকলি আতঙ্কিত হয়ে গিয়ে মালার হাত থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বলল
-ওকে খাওয়াইনি তো গরম পানি?
-না ম্যাডাম তার আগেই আমি পৌঁছাই গেছিলাম
মোহর সবেমাত্র ফিরেছে, বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এসব শুনেই ভ্রু কুচকে এলো। কাকলি বেগম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ক্ষিপ্ত ভাবে বলল
-অনেক দেখেছি ওর এসব উদ্ভট কাজ, আজ ওকে এর জবাব দিতেই হবে
বলেই ছুটে গেল তাথই এর ঘরের দিকে। আম্বি বেগম আর মালাও ছুটলো পেছনে। ঘরে ঢুকেই কাকলি ছুটে তাথই এর গালের উপর সপাটে ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দিল। অকস্মাৎ চ’ড়ে তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পরে গেল তাথই। কাকলি বেগম চিৎকার করে বলল
-কি পেয়েছিস টা কি তুই। যা নয় তাই করবি? তুই কি মে’রে ফেলতে চাস মেয়েটাকে? এটাকে তুই আদও পেটে ধরেছিস
তাথই উঠে দাঁড়ালো। কথার পৃষ্ঠে সজোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল
-না ধরিনি আমি, ওকে আমি পেটে ধরিনি। ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।না তো সত্যিই ওকে মে’রে ফেলবো আমি।
কাকলি বেগম আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। আবারও হাত উঠালেন আ’ঘাত করার জন্যে। কিন্তু এবার চ’ড় দিতে গেলে কেও খপ করে পেছন থেকে হাত চেপে ধরলো। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মোহরকে দেখে বলল
-মার’বেন না উনাকে
-আমার হাত ধরেছ কোন সাহসে তুমি? আমার মেয়েকে আমি মা’রবো তোমাকে হাত ধরতে কে বলেছে
মোহর সকপটে বলল
-উনাকে মার’লেই তো এসবের সমাধান হবে নাহ। সবটা বুঝুন তারপরে শাসন করবেন
কাকলি বেগম উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই মোহর তাথইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি দিদার ঘরে যান
কেমন আদেশের স্বরে বলল। আর অদ্ভুত ভাবে তাথই প্রত্যুত্তর করা দূর আজ্ঞামত চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আম্বি বেগম বলে উঠলেন
-তুমি ওকে চলে যেতে কেন বললে। ওর সাথে কথা বলাটা কত দরকার যানো তুমি। দিনদিন ওর পাগলামি বেড়েই চলেছে
-আসলে আপনারা সবাই খুব বেশি খামখেয়ালি, সবসময় নিজেদের মতামত টাকেই শ্রেয় মনে করেন।
আম্বি বেগম ভ্রু জড়ো করে বললেন
-কি বলতে চাইছো টা কি তুমি?
-এই যে একটা বাচ্চা এসেছে ঘরে, আপনারা সবসময় ওকে নিয়েই ব্যস্ত একবার আপার কথাটা ভেবেছেন? উনার প্রতিও কি যত্নশীল হওয়ার দরকার ছিল না?
-কিসব বলছো তুমি?
মোহর ঘুরে দাঁড়ালো ওদের দিকে। জড়তা হীনায় বলল
-আমি যতটুকু শুনেছি তাথই আপার প্রেগন্যান্সিতে ডিফিকাল্টি ছিল। ডেলিভারির সময়েও অবস্থা ক্রিটিকাল ছিল। আর ডেলিভারির পরে মায়েদের শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে মায়েদের আচরনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। যেমন অকারণে মেজাজ খিটখিটে, কান্না করা, বাচ্চার প্রতি অনীহা ছাড়াও সুই’সাইডাল টেনডেন্সি ক্রিয়েট করে। অনেক সময় ডিপ্রেশন এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যার ফলে বাচ্চাকে মে’রে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। মেডিকেলের ভাষায় আমরা এই সমস্যাটাকে বলি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন! আপুর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। নতুন সদস্য পেয়ে সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরেছে যে আপুর দিকে ততটাও খেয়াল করেনি। যার কারণে বাচ্চাটার উপরেও সকল ক্ষোভ এসে পরেছে। আর মেন্টালি, ফিসিক্যালি প্রবলেম মিলিয়ে ফ্রাসট্রেশন থেকে এমন আচরণ করে৷ এক্ষেত্রে উনার সাথে এমন রূঢ় আচরণ করলে শাসন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে নাইবা কমবে।
একদমে কথাগুলো বলে দম নিল মোহর। কাকলি বেগম আর আম্বি বেগম কোনো উত্তর করলো নাহ। মোহর আবারও বলল
-বাচ্চাটাকে সবাই সামলাতে পারবে। আপনি নাহয় তাথই আপুর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। মেয়েরা দুঃসময়ে আপন মানুষগুলোর কাছেই ঠাঁই পেতে চাই,তাছাড়া কিছু না।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে এলো। ঘরে এসে ব্যাগটা রেখেই ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
আধ ঘন্টা সময় নিয়ে একবারে গোসল করেই বেরোলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালে পেছনে হুট করে লম্বাকৃতির প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ঘুরে তাকালো
-রিল্যাক্স, আমি
মেহরাজ অভয় দিয়ে বলল মোহরকে। মোহর বিব্রতকর চেহারায় তাকালো তার দিকে। এই লোকটা কখন এলো? ঘরে ঢুকে তো দেখেনি? আর আসলেও এতক্ষণ কোথায় ছিল?
-আমি আপনার আসার কিছুক্ষণ আগেই এসেছি, ব্যালকনিতে ছিলাম তাই খেয়াল করেনি
মোহর ঠোঁট গোল করে ও বলল শুধু। পরক্ষণেই ভাবলো সে তো মুখে প্রশ্ন করেনি তাইলে বুঝলো কি করে মেহরাজ? এমন অদ্ভুত কেন লোকটা?
-আপনি খুব অল্পতেই ভয় পেয়ে যান মোহমায়া।
-আমি মোটেও ভয় পাইনি?
মোহর সকপটে উত্তর করলো। পুনরায় নিজেই বলল
-আমি চমকে গিয়েছিলাম হুম করে পেছনে আপনাকে দেখে।
-চমকে যাওয়া আর ভয় পাওয়া আলাদা,বলছেন?
-অবশ্যই, ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা বা মানুষ যখন কোনো কিছু নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে নিজের ক্ষতির আশঙ্কা করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। আর চমকে যাওয়ার অর্থ অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু দেখে হুট করেই ভড়কে যাওয়া বা ইতস্তত বোধ করা।
মেহরাজ মোহরের শিক্ষকের ভঙ্গিমায় বলা কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অবশেষে বলল
-তাহলে আমার ঘরেই আমার থাকাটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে আপনার,তাই তো?
আবার তব্দা মে’রে গেল মোহর। এই লোকটা কি করে প্রত্যেকটা কথার উল্টো জবাব বলে ফেলে? ইতস্তত হয়ে বলল
-মানে?
-কফি খাবেন?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️
#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৬
– কি এতো গভীর চিন্তা করছেন?
রাশভারি গলার স্বভাব বিপরীত নরম কণ্ঠে ধ্যান ভাংলো মোহরের। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষাবয়ব টার দিকে। মোহরের সাথে চোখাচোখি হতেই খানিক ঠোঁট এলালো, মোহর যেন স্তম্ভিত চিত্তেও মুখোভিব্যক্তি স্বাভাবিক রাখলো। এই মানুষ টাকে কখনো হাসতে দেখেছে বলে মনে হয়না, চেহারায় কর্কশতার ছাপ বিন্দুমাত্রও নেই, তবে হাসির উপস্তিতিও একেবারে নেই বললেই চলে। আজ প্রথম শুভ্র চেহারার ওই কড়া রঙের ঠোঁটের সামান্য বাঁকা হাসিটা রোমঞ্চিত করলো মোহরের নির্জীব চিত্তকে।
– কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?
মোহর না বোধক ঘাড় নাড়ালো। মেহরাজ কফির কাপ হাতে নিয়ে বসলো মোহরের চেয়ে এক হাতেক দূরত্বে অবস্থিত শৌখিন ধাঁচের বেতের চেয়ার গুলোতে। হাতের কাপ দুটো রাখলো সামনের ছোট গোলাকৃতির বেতের মোড়ার মতো টেবিলে, যার উপরাংশে গোলাকৃতিরই ডাইন গ্লাসের পারদ।
– আমার সাথে বসতে অসুবিধা হবে?
– এক ঘরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না তাহলে পাশাপাশি বসলে কিসের অসুবিধা?
মেহরাজ ঘাড় নাড়ালো বার দুয়েক, ভাবোভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। লম্বাটে শরীর টা খানিক ঝুঁকিয়ে হাঁটুর উপর দু’হাতের কনুইয়ের ভাঁজ রাখলো। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাৎ করে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল
– একই ঘরে বসবাস করলেও আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব যে ক্রোশাধিক, এটা কি সত্য নয়?
– সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আমাদের বিয়েটা অনিশ্চিত। এর আদেও কোনো ভবিষ্যত আছে কি না তারও কোনো ভরসা নেই। সত্য এটাই যে আমি আশ্রিতা হয়ে আছি, আপনি সাহায্য করছেন। অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এতটা বিলাসিতা ভোগ করছি।
– এটাকে সাহায্য মনে হয় আপনার? আমার দ্বায়িত্ব নয়?
মোহর দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। এটা ব্যালকনি হলেও ছোট খাটো একটা ছাদই বলা চলে। রেলিঙের গা ঘেঁষে ছোটো লাইন মতো করা। সেখানে সারি সারি ফুলের গাছ। পরন্তু বিকেলের হলদেটে আলোতে ফুলগুলোতে মেদুর ঝিলিক স্পষ্ট চোখে বিঁধছে। মোহর সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল
– যদি সত্যি জানতে চান তবে এ বাড়িতে থাকাটা আমার কাছে আশ্রয় ব্যাতিত অন্যকিছুই মনে হয় নাহ। আমাদের বিয়েটাকে আমি প্রতিকূল পরিবেশে ঘটে যাওয়া একটা দূর্ঘটনা বলেই মনে করি?
– বিয়েটা যদি দূর্ঘটনা হয় তবে আমি কি সেই দূর্ঘটনায় সৃষ্ট ক্ষত মোহ?
সচকিত হয়ে ঘাড় তুলে তাকালো মোহর। মেহরাজের সকৌতুক চেহারাতে চোখ ফেললেও মেহরাজ দৃষ্টি ফেরালো নাহ। মোহর ওর চোখে চোখ রেখেই বলল
– হ্যাঁ তাই। তবে আপনি আমার ক্ষত নন,আমিই আপনার ক্ষত। না আমার সাথে আপনার বিয়ে হতো আর নাইবা আপনাকে এতো ঝামেলা র্ঝঞ্ঝাটে পরতে হতো। আপনার পরিবার, বাগদত্তা ব্যক্তিজীবন সবকিছুতেই আমার জন্য বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। দ্বায়িত্বের ভারে আমাকে আপনার ঘরে থাকতে দেওয়ার মতো কাজটাও করতে হচ্ছে।
কথা গুলো বলে, তড়িৎ নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিজের অজান্তেই মোহরের মনে হলো মেহরাজের ওই চাহনিতে চোখ রাখা টা তার পক্ষে আর সম্ভবপর হবে নাহ। নিজেকে কঠিন রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা টার ভিত্তিও কেমন নাড়া দেয় মেহরাজের চাহনিতে।
– আজ একটা কথা আমি ক্লিয়ার করতে চাই। বিয়েটা যে পরিস্থিতিতেই হোক বিয়েটা হয়েছে। তিয়াসাকে আমি কখনোই নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে দেখিনি। ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ যদি আপনি নিজের ঘাড়ে নেন সেটা সম্পূর্ণই ভুল হবে। আর পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটা বরাবরই শান্ত,এক্ষেত্রেও আপনার নিজেকে দায়ী করার লজিক টা ননসেন্স। আর যদি কথা বলেন আমার ব্যক্তিজীবনের তবে আমাকে কিন্তু কেও বাধ্য করেনি আপনাকে নিজের বাড়ি বা নিজের ঘরে রাখতে। ব্যাপারটা সাহায্যের হলে সেক্ষেত্রে আপনাকে একটা ব্ল্যাংক চেক ধরিয়ে দেওয়াই কাফি ছিল মিসেস মোহর।
মোহর না চাইতেও চোখ ফিরিয়ে তাকালো বাম পাশে, চুম্বকের ন্যায় আটকে গেল জমাট বাঁধা রক্তের মতো স্থির চিত্তের চেহারার দিকে। মুহুর্তেই যেন কাঠিন্যের ছাপ দাপিয়ে উঠেছে মুখটাতে, লহমা খানেক বিরতির পর মেহরাজ আবারও বলল
– আমি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করিনা মোহর শিকদার। আপনাকে আমার বাড়ি আমার ঘরে থাকতে দেওয়া টা একান্তই আমার ইচ্ছে না এখানে সাহায্য আছে নাইবা দ্বায়িত্ব। আমার যা উচিত মনে হয় তাই করি। আর এখানে আমার এটাই উচিত মনে হয়েছে। আপনার যদি বিয়েটা মানতে খুব অসুবিধা হয় তবে আমি আপনাকে কোনো প্রকার পরামর্শ দেব না। যদি ডিভোর্স চান তার জন্যেও ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
এই ছয়টা মাস কি সম্পর্কটাকে সুযোগ দেওয়া যায়না? বিয়েটা আপনার কাছেও যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত আমারও কিন্তু পূর্বপরিকল্পিত নয়। সম্পর্কের অর্থ তো শুধু দাম্পত্য জীবন নয়। আপনাকে এক ঘরে রেখে সম্পর্ককে সুযোগ দেওয়ার কথা বলতে চেয়েছি মানেই যে স্বামীর অধিকার চেয়েছি এমন কিছুই নয়। স্বামী স্ত্রী বাদেও একটা সম্পর্ক আছে, নাহয় সেটাতেই আমল করলেন।আমাকে স্বামী হিসেবে মানতে হবে নাহ। কারো শুভাকাঙ্ক্ষী বা বন্ধু হতে বয়সের এ্যাডযাস্টমেন্টটা কখনও মূখ্য হতে পারেনা।
বলেই হুট করেই দাড়ি বসিয়ে দিল নিজের বক্তব্যে। মোহর পুরোটা মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনলেও উত্তর করার শব্দ খুঁজে পেল না। মেহরাজ ভুল কিছু বলেনি কিন্তু তবুও মোহরের মনের ভেতর ভয়, অপ্রসন্নতা, অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে যা ওকে সর্বদা বেচ্যাইন করে রাখছে। সম্পর্কটার কোনো ভবিষ্যৎ ভাবতে পারছে না।
কিন্তু আজ মেহরাজের বলা কথা গুলো যেন দেই দূর্ভেদ্য দেওয়ালের ভিত নাড়িয়ে দিল, সত্যিই তো! এই মানুষটাই তো তাকে বিভৎস অবস্থা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছে। তার ভরসায় তার দাপটে এই অজানা প্রাসাদে এতগুলো রাত পার করলো। অথচ তাকেই অবিশ্বাস করছে। এক্ষেত্রে ‘ নদীতে ভেসে ভেলাকেই ডুবন্ত পদার্থ ‘ বলে মনে করার মতোই যেন হয়ে গেছে অনেকটা
– কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মোহমায়া।
একটু আগে বলা মেহরাজের কথা আর এখনকার বলা কথায় আকাশ পাতাল তফাৎ ঠেকলো মোহরের নিকট। দাম্ভিকতার ধ্বনি তোলা কণ্ঠস্বর নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে গেল। মোহর দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারায় তাকালে মেহরাজ মুখখানির আরও সহজ ভঙ্গিমায় বলল
– এতো ভাববেন নাহ, আপনার যেমনটা সুবিধা হয় তাই করবেন। আপাতত কফি খান। এটার জন্যেই কিন্তু এইখানটায় আসা
বলে মোজাইক পাথরের ন্যায় নকশার চিনামাটির কাপটা তুলে দিল মোহরের হাতে। পরিস্থিতি টাকে সামাল দিতে মেহরাজ অন্য মোড় ধরলো এটা সেও বুঝতে পেরেছে, তাতেই নীরব সম্মতি দিয়ে আর বাড়ালো না অস্বস্তি তোলা কথা গুলো।
এতক্ষনের সুমিষ্ট গন্ধটা আরও কাছ থেকে লাগলো মোহরের নাকে। কাপটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলো ঘ্রাণ টা কফির।
– কফিটা কিন্তু মন্দ বানাই না, ট্রাই ইট?
মোহর মৃদু হেসে কাপটা হাতে নিয়ে তা ঠোঁটে লাগিয়ে চুমুক দিল। আসলেও তাই, কফিটা খেতে অন্যরকম। দুর্দান্ত স্বাদের কফি। এমন টেস্ট অন্য কোনো কফিতেই পাইনি মোহর।
– সত্যিই দারুণ কফি বানাতে পারেন আপনি। এমন টেস্ট আগে কখনো পাইনি।
মেহরাজ নিজের কফির কাপ হাত্র নিতে নিতে বলল
– এই কফিটা বিশ্ববিখ্যাত, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি এটা। আমার এক ফ্রেন্ড কানাডা থেকে পাঠিয়েছে।
মোহর বিনিময়ে কিঞ্চিৎ গাল এলিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকালো। হলদেটে আকাশ ভরা পুঞ্জীভূত সাদা মেঘ। লম্বা গাছগুলো শীষমুখ উঁচিয়ে উদ্ভাসে দাঁড়িয়ে। অনুষ্ণ বাতাসে অবাধ্য চুলগুলো অবিন্যস্ত চোখে মুখে আঁছড়ে পরলেও বিরক্ত হলো না মোহর, যেন মনে হলো অনেক দিন পর কোনো মনকে প্রশান্ত করার মতো একটা অবস্থান পেল।
মূলত মেহরাজ কফি খাওয়ার কথা বলে মোহরকে ব্যালকনিতে এনেছিল। বিশাল জায়গা জুড়ে ব্যালকনিটার রেলিং ভরা ঘাস আর নানান ফুলে। এবং তা খুব যত্নসহকারে পরিচর্যা করা হয় তা ফুলগুলো সুবিন্যস্ত সাজ আর প্রাণবন্ত পরিস্ফুটনেই স্পষ্ট।
– আমাকে ভরসা হয় না মোহমায়া?
হুট করেই মেহরাজের বলা কথাটা বিব্রতবোধে ডুবিয়ে তুললো মোহরকে। মেহরাজের চোখে একরাশ আগ্রহ উত্তরের, সেটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারলো না মোহর, খুব স্বাভাবিক গলায় বলল
– আপনাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য, এ ছাড়া আর কিই বা আছে আমার।
– বিশ্বাস আর ভরসা দুটো আলাদা নয় কি?
মেহরাজের সকৌতুক গলাতে মোহর জড়তাগ্রস্ত হয়ে উঠলো। কেমন বিব্রতে ভরা দৃষ্টিতে তাকালে মেহরাজ হাসলো খানিক, রম্য ভাবে বলল
– সবকিছুতে এতো সিরিয়াস কেন হয়ে যান আপনি। বয়স কতটুকু হবে? এইটুকু বয়সে এতটা গাম্ভীর্য মানায় নাহ। জীবনে চলার পথে অনেক কিছু হারাবেন,অনেক কিছু পাবেন। তা বলে নিজ ব্যক্তিত্বেকে দমিয়ে রাখা টা কোনো সমাধান নয়। আপনার চাঞ্চল্যে বা গাম্ভীর্যে জীবন তার গতির পরিবর্তন করবে না। সো এভোইড নেগেটিভিটিস, বি ইউরসেল্ফ,যাস্ট দ্যা ওয়ে ইউ আর।
•
– আসতে পারি?
মেয়েলী রিনিঝিনি কণ্ঠে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো। দরজায় মোহরকে দাঁড়িয়ে দেখে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে এলো, মোহর এবার নিজ থেকেই ঘরের ভেতর ঢুকলো। হাতের খাবারের ট্রে টা বেড সাইড টেবিলে রেখে দাঁড়ালে তাথই তীর্যক গলায় বলল
– তোমাকে খাবার দিয়ে কে পাঠিয়েছে?
– আমাকে কোনো কাজের দ্বায়িত্ব দেবে এমন সম্পর্ক এ বাড়িতে দিদা ছাড়া অন্য কারো সাথেই নেই। তবে খাবার আনতে দিদা বলেনি আমায়
– তাহলে কে আনতে বলেছে?
– আমিই এনেছি আপা।
মোহরের আপা বলাটা যেন তাথইয়ের ভেতরটাই লাগলো। নিজের অজান্তেই সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার প্রতি নরম হতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে ইচ্ছাতে ধামা চাপা দিয়ে, বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বলল
– আমার খাওয়ার চিন্তা তোমাকে করতে হবে নাহ, নিয়ে যাও এসব
বিছানার এক কোণায় বসেছিল মোহর। তাথইয়ের কথায় মোহর প্লেটে ভাত বারা থামিয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
– এ বাড়িতে আমার সাথে যে কারো ভালো সম্পর্ক নেই এটা তো বললামই। দিদাও ঘুমিয়েছে। একা একা খেতে আমার একদম ভালো লাগে না আপা, তাই ভাবলাম দুই বোন একসাথে বসে খাই। তবে আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে চলে যাচ্ছি
বলে উঠে দাঁড়াতে নিলে তাথই হাতের বইটা ধপ করে বিছানাতে রেখে বলল
– দাঁড়াও বাড়া ভাত রেখে কোথাও যাবে না। বোসো
বলেই উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। ততক্ষণে মোহর দুই প্লেটে খাবার বেরেছে। তাথই এলে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে প্লেট এগিয়ে দিল। মেয়েটার মুখে যেন রাশিভরা মায়া জড়ানো। তাথই চেয়েও কঠোর হতে পারেনা। মোহরের মুখ থেকে আপা ডাক শুনে হুট করেই তাথইয়ের ভীষণ ইচ্ছে হলো ওর কথা গুলো রাখার। তাই আর কোনো অমত না করে ওউ খাটে উঠে দুই পা ভাঁজ করে বসলো। মোহর খেতে খেতে বলল
– ইলিশ মাছ ভাঁজা নাকি আপনার খুব পছন্দ?
– আমার চেয়ে তোমার স্বামীর বেশি পছন্দ
খেতে খেতে ব্যস্ত গলায় শুষ্ক ভাবে বলল তাথই। ”তোমার স্বামী” এটুকু শব্দ যেন মোহরের বুকে ফালের মতো বিঁধে গেল। হুট করেই খাওয়া থেমে গেল ওর। তবে তাথই থেমে গেল না, ফিচেল গলায় বলল
– কি হলো? স্বামীর নাম শুনেই গলায় খাবার আটকে গেছে? পটরপটর বন্ধ হয়ে গেল?
মোহর কেমন অপরাধীর মতো মুখ করে তাকালো তাথইয়ের দিকে। ঢক গিলে আবারও খাওয়া শুরু করলে, খানিক বাদে বলল
– তেমন কিছুই না আপা
– এই মেয়ে, খবরদার আমার সাথে সেয়ানা গিরি দেখাবে না। মেহরাজের নাম শুনলেই তো আমাবস্যার চাঁদ হয়ে যাও কি সমস্যা তোমার?
মোহর খাওয়া থামিয়ে চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকালো, সে তো এসেছিল তাথইয়ের সাথে সময় কাটাতে যাতে ওর সাথে স্বাভাবিক হতে পারে,কিন্তু এখন ওকেই গেড়াকলে ফেলছে
– আমার ভাইকে কি তোমার হেলাফেলা মনে হয়? যেখানে ও নিজে পুরো বাড়ির সামনে নিজের বউ বলে জোর দেখায় আর তুমি পালিয়ে বেড়াও কেন। সারাদিন তো দিদার চামচার মতো লেগে থাকো ৷ কখনো তো বউ হওয়ার কোনো চেষ্টা তোমার মাঝে দেখলাম না
– ক্ কি চেষ্টা করবো আমি?
খানিক হতাশা মিশিয়ে নতমস্তকে বলল মোহর। তাথইয়ের থেকে এরূপ কথা এ কোনো কালেই আশা করেনি। তাথই না কখনো নিচে আসে না কখনো কোনো ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে তবে আজ!
– শোনো মেয়ে আগে কি ছিলে কি করেছো জানি না। তোমাকে আমার ভাই বিয়ে করেছে, যে পরিস্থিতিতে হোক যেভাবে হোক বিয়ে বিয়েই হয় কোনো ছেলেখেলা নয় যে তুমি কোনো গুরুত্ব দিবে না, নাকি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে আছে? আছে নাকি?
– হ্যাঁহ? না,,,না নেই
মোহর কেমন মন্তবুদ্ধির মতো করে বলল।তাথই যেন আজ ওকে যাতাবার জন্য আটঘাট বেঁধেই বসেছে
– তাহলে না চাইতেই যেটা পেয়েছো সেটার গুরুত্ব দিতে শেখো। এমন হাজারো আছে যারা পাগলের মতো ছুটেও পাইনি। মেহরাজকে চেনো।ওর সাথে এক ঘরে থেকেও যদি তুমি বুঝতে না শেখো তাহলে তোমার মতো বোকা আর কেও নয়। সময় থাকতে সম্পর্কের মূল্য দাও নয়তো এক সময় পস্তায়েও কিচ্ছু হবে নাহ
তাথইয়ের এতগুলো কথা বলার কারণ মোহর বুঝলো নাহ। তবে এটুকু স্পষ্ট যে মেহরাজ এমনি গম্ভীর যতই হোক বোনের সাথে সম্পর্কে তার কোনো হেরফের নেই। প্রায়ই তাথই এর ঘরে আসে, দীর্ঘ সময় ধরে বোনের সাথে গল্প করতে দেখেছে মোহর।
বাকিটা সময় আর কোনো কথা বলল না কেও-ই। খাওয়া শেষে মোহর উঠে দাঁড়ালে তাথই আবারও বইটা খুলে বসলো, হুমায়ুন আহমেদের বই ‘অপেক্ষা’। মোহর হুট করেই বলে বসলো
– সুরাইয়া আজীবনই অপেক্ষা করে যায় হাসানুজ্জামান তো ফেরেই না।
তাথই ধপ করে তাকালো মোহরের দিকে। নিজের বোকামি টা বুঝতে পেরে জিহ্ব কামড়ালো মোহর । ইশ এবার নিশ্চয় রেগে যাবে। এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছিল আর ও কি না ধপ করে বলে দিল শেষটা। তবে মোহরের ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিপরীত করে দিয়ে তাথই নিরেট দৃষ্টিতে আবারও বইয়ের পাতায় তাকিয়ে বলল
– সব অপেক্ষা ফিরে পাওয়ার হয়না৷ কিছু অপেক্ষাতে শুধু একবুক বেঁচে থাকার আশা আর ভালোবাসা থাকে, যা শেষ নেই যেনেও আমৃত্যু একটা মানুষকে অপেক্ষারত রাখতে বাধ্য করে
মোহরের কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল কথাটার মর্মার্থ বুঝতে। খানিক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে বলল
– আপনি বইটা পড়েছেন?
বিনিময়ে শুরু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব এলো অপরপক্ষ থেকে। মোহর আর কোনো শব্দ
ব্যয় করলো নাহ। চুপচাপ খাবারের প্লেট গুলো নিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। আর মনে মনে বারংবার ভাবতে থাকলো
‘মানুষ তার বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে র’ক্তাক্ত অবস্থায় প্রতিনিয়ত ম’রছে আর আমরা কত সহজেই না মানুষের বাহ্যিক রূপটা দেখে বিচার করে ফেলি ‘
•
সকাল বেলা করে ব্যস্ততা ডাইনিং রুমটা জুড়ে। আজহার, আরহাম দুজনে অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে একবারে, তাদের খাবার তুলে দিচ্ছে আম্বি। শাহারা বেগম তাথইয়ের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেহরাজ এখনো নিচে নামেনি মোহর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সিড়ি থেকে নামছিল তখনই কানে এলো
– সাঞ্জে আসবে আজ, ওকে কখন আনতে যাবে?
– অফিস থেকে বেরিয়েই যাবো।
কাকলি বেগমের কথায় আরহাম বলল। আম্বি রুটি তুলে দিচ্ছিলো প্লেটে, ব্যস্ত গলায় খানিক মমতা ঢেলে বললেন
– প্রায় দুমাস হলো মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, একটুখানি মেয়ে এতদিন বাড়ির বাইরে আছে মনে পড়লেই কেমন দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে।
ততক্ষণে মোহর নিচে নেমে এসেছে। মোহরকে দেখে আজহার মুর্তজা বললেন
– মোহর? এসো খেতে বসো
আম্বি বেগম ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। মোহর খানিক ইতস্তত গলায় বলল
– আমার লেইট হয়ে গেছে, আজ খাবো না আংকেল
– এটা আবার কেমন কথা। সকাল বেলা করে না খেয়ে কেন বেরোবি। একটু কিছু হলেও মুখে দিতে হবে।
শাহারক বেগমের জোরাজুরিতে অগত্যা বাধ্য হয়ে বসতে হলো টেবিলে। আরহাম মুর্তজা খাচ্ছিলেন মোহরের সাথে চোখাচোখি হলে তিনি সহবত সুলভ হাসলেন সামান্য। মোহর বসেছে একদম তাদের সামনা-সামনি। এভাবে ওদের সামনে বসতেও অস্বস্তি হচ্ছে, তবে মোহরের অস্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ। মোহরের জড়তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে মেহরাজ এসে বসলো একদম ওর পাশের চেয়ারটাতে, আম্বি বেগম এসে মেহরাজকে ওর ফ্রুট সালাদ আর অ্যাভোকাডো জুস দিলের। সাথে আরও একটা প্লেট এনে রাখলেন মোহরের সামনে। মোহর প্রচন্ড বিহ্বলিত হলেও প্রকাশ করলো না, আম্বি বেগম মোহরকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন সেখানে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেওয়া টা সত্যিই ভাবনাতীত।
খাবার শেষ করে মেহরাজের সাথেই উঠে দাঁড়ালো মোহর। শাহারা বেগম কে বলে বেরিয়ে এলো। মেহরাজ হাঁটছে আর তার পেছন পেছনে মোহর। আচানক ভীষণ অপ্রত্যাশিত এক ভাবনা ঘিরে ধরলো মোহরকে, ও বেশ তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পারলো যে ইদানীং ওর সব জড়তা অস্বস্তি মেহরাজ এলেই কেমন উবে যায়, সকল নস্তিবাচক অবস্থাতেও অদ্ভুত এক নিশ্চিন্ততা ওর মনের ভেতর গেঁথে দেয় মেহরাজের উপস্থিতি।
অথচ এই মানুষ টাকে ঘিরেই আপাতত ওর যত অস্থিরতা, জড়তা, ব্যকুলতা।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️