ফানাহ্ পর্ব-১৩+১৪

0
1317

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৩

-ওখানে ভূত আছে মেহরাজ আমি যাবো মা ও ঘরে। আমি ভ ভয় প পেয়ে

ঘুমের ঘোরেই দুই লাইন বলে আবারও তলিয়ে গেল বুদ হয়ে। মেহরাজ আলতো করে মোহরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অনেক বেশিই হয়তো ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। তবে এতে মেহরাজ যে খুব বেশি কারসাজি করেছে তাও কিন্তু নাহ। মোহরের ঘরের পাশে যে ফিসফিসানির শব্দ সে শুনতে পেয়েছিল সেটা রেকর্ডেড ভয়েস,আর সাদা ধোয়ার মতো দেখা অবয়ব টা লেজার রশ্মির খেলা, এটুকুই।
বাকিটা মোহর আতঙ্কগ্রস্থ হয়েই ভয় বেড়ে গেছে। মানুষের মস্তিষ্ক যেকোনো দৃশ্য তৈরি করতে কম্পিউটারের চেয়েও সচল। মানব মস্তিষ্ক যখন কোনো বিষয়বস্তু মন থেকে বিশ্বাস করে মস্তিষ্কতে মহীয়ান করে তখন মস্তিষ্ক ঠিক সেটাই দেখায় যেটা মানুষ কল্পনা করে। মানব শরীরের স্নায়ুবিক সিস্টেমের কেন্দ্র বা মধ্যমণি হলো মস্তিষ্ক। কল্পনা হলো মস্তিষ্কে মনের ভেতর সৃজনশীল প্রতিচ্ছবি তৈরি করার ক্ষমতা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বাইরে মন থেকে কিছু অনুভব ও চিত্রায়ন করা হলো কল্পনা। ভয় পেয়ে মোহরের মস্তিষ্ক ধরেই নিয়েছিল ওকে কোনো অশরীরী অপ্রকৃতস্থ কোনো শক্তি তাড়া করছে, তাই ওর আশেপাশের পরিবেশেও ঠিক তেমনটাই আবহ আসছিল।

মেহরাজের প্রশস্ত কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ ফেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহরের ঘুমন্ত চেহারায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সমস্ত চেহারা।
উজ্জ্বল তামাটে বর্ণের গায়ের রঙ খুব ফর্সা নয়, তবে শ্যামলাও নয়। ঘনপল্লবে বেষ্টিত আঁখিযুগল সবচেয়ে বেশি নজরকাড়া। চিকন পাতলা ঠোঁট, ছোট নাক, হালকা পাতলা গড়নের লম্বাটে লতানো শরীর। অদ্ভুত মাদকতায় পরিপূর্ণ সমস্ত চেহারা।
একবার দেখলে আঠাকাঠির মতো চোখ লেগে থাকে, সরাতে ইচ্ছে করে না। কী গভীর মায়া, নিশ্চুপ নির্জীবতায়ও কতটা প্রাণপূর্ণ! মোহরের তামাটে বর্ণের অতি সাধারণ চেহারাও কোনো দুধে আলতার মতো গড়নের কোনো মেয়েকে মাত দিকে নিঃসন্দেহে সক্ষম। অদ্ভুত মায়া জড়ানো মুখ যা যেকোনো পুরুষকে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য করবে।

মেহরাজ থেকে থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবারও এসে বসছে মোহরের একদম কাছটায়। বিছানাতে নয়। মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে বিছানায় ঠেস দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। কতবার চেষ্টা করছে তবুও কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছে তা তার মোহমায়ার মায়াবী মুখ খানা। ভোর চারটা বেজে ছয় মিনিট। সারাটা রাত এক লহমার জন্যেও চোখের দু পাতা এক করেনি। অনিমেষ তাকিয়ে ছিল। মোহরের নিঃশ্বাসের শব্দ গুনেছে, তীব্র প্রদীপ্তিয়ময় অন্তঃস্থলের ঢিপঢিপ শব্দ গুনেছে। প্রাণহারীনিকে কাছ থেকে দেখবার জন্যেই তো এতো প্রচেষ্টা!

প্রদোষকালের বুক চিরে ধরণীতে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে কমলাকার ভাস্কর। নরম রোদের আলোতে ঝিলমিল করছে শরতের প্রস্ফুটিত কুড়ির মতন সকাল। আব্রাহাম ম্যানসনের বৃহতাকার দেওয়ালের মধ্যিখানে অবস্থিত বসার ঘরটাতে গুঁটি কয়েক মানুষের অবস্থান। সকাল বেলা করে আম্বি আর নাজমা নাস্তা সাজাচ্ছেন টেবিলে। কাকলি তাথই এর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে এদিক ওদিক। হাঁটছে কম, ঢুলছে বেশি। চোখ মুখের অবস্থা অবিন্যস্ত। সারাটা রাত বাচ্চাটা না নিজে ঘুমিয়েছে না তাকে ঘুমাতে দিয়েছে।

-গুড মর্ণিং আন্টি!

চিকচিকে মেয়েলী কথায় প্লেট সাজাতে সাজাতে দরজার দিকে দৃষ্টি অগ্রসর হলো আম্বি খাতুনের। উপস্থিত মানুষটাকে দেখে হাসলো মৃদু, বললেন

-গুড মর্ণিং। এসো এসো নাস্তা করবে আমাদের সাথে।

তিয়াসা বেশ আহ্লাদী গলায় বলল

-করবো আন্টি, রাজের সাথে আগে দেখা করবো। ও কি ঘুম থেকে উঠেছে?

-এখনো তো নামেনি। উঠেছে বোধ হয়,দাঁড়াও আমি ডেকে দেই

বকে ব্যস্ত হয়ে সিড়ির দিকে এগোতে নিলে তিয়াসা নড়েচড়ে এগিয়ে এলো,আম্বির হাত ধরে বললো

-আরে আপনি কাজটা শেষ করুন না আন্টি। আমি নিজেই গিয়ে দেখা করে নিচ্ছি

আম্বিও দ্বিরুক্তি করলো নাহ। তিয়াসা সিড়ি বেয়ে উঠে একদম কোণার ঘরের দিকে আসলো। আস্তে করে দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস, আর উৎফুল্লকর চিত্তে ঘরে ঢুকলেও মুহুর্তেই তা মিলিয়ে গেল, এক ফালি অমানিশা এসে ভর করলো ফর্সা মুখ খানাতে। ভ্রু যুগল কুচকে এসে ক্ষুদ্ধতরে কপালে গাঢ় ভাঁজ পরলো। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠে বলল

-তুমি এখানে কি করছো?

অকস্মাৎ চিৎকারে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো মোহর। অস্বাভাবিক চিত্তে এদিক ওদিক তাকালো। আপতিকভাবে ঘুম ভাঙায় পরিস্থিতি বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগলো। কিন্তু ততক্ষণে তিয়াসার মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, দাঁত খিঁচিয়ে বলল

-তুমি এই ঘরে কেন এসেছো, কখন এসেছো তুমি? রাতে এখানেই ছিলে? কি হলো উত্তর দাও রাতে এই ঘরেই ছিলে তুমি?

মোহর ধাতস্থ হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তিয়াসাকে আর নিজেকে এই ঘরটাতে দেখে অত্যাধিক ভড়কে গেল। রাতে কি হয়েছিল, হুট করেই মনে করতে পারছে না। মোহরের নিরুত্তর থাকাটা তিয়াসার রাগ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে তুললো। ক্ষিপ্ত ভাবে মোহরের হাত চেপে টেনে খাট থেকে নামাতে নিলে নিজের হাতের উপরে বরফের ন্যায় শীতল স্পর্শের প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে মেহরাজের জলদগম্ভীর ধারালো চোখ টাকে একদম কাছাকাছি অবস্থায় দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

-হাতটা ছাড়ো

মেহরাজের এরূপ শান্ত গলায় নড়েচড়ে উঠলো তিয়াসা। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে মোমের পুতুলের মতো।

-কি বলেছি শুনতে পাওনি? ওর হাতটা ছাড়ো!

দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে এক ঝটকায় তিয়াসার হাত সরিয়ে দিল। প্রচণ্ড ঝটকায় তাল সামলাতে না পেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল তিয়াসা। মোহর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বিমূর্ত ভাবে তাকিয়ে আছে।
তিয়াসা মেহরাজের আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে মোহরের দিকে তাকালো। সদ্য গোসল করে বেড়িয়েছে মেহরাজ পরনে শুরু কালো রঙের একটা ট্রাউজার , অত্যাধিক ফর্সা লোমহীন বুকের উপরের দিক টাতে মৃদু একটা আচরের দাগ। যা লালচে আকারে সগৌরবে গলার নিচের দিকে অবস্থান করে আছে। আর বিছানাতে মোহর এলোমেলো অবস্থায় চোখ মুখ ও কেমন ফোলা ফোলা।
অবাঞ্ছিত খেয়াল মাথায় বড়সড় কারেন্টের শকের মতো ঝটকা দিল। অস্থির গলায় বলল

-তোমরা এক ঘরে ছিলে? ও আর তুমি এক ঘরে ছিলে রাজ!!

মেহরাজ ততক্ষণে শার্ট গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাচ্ছে, তিয়াসার প্রশ্নকে দাম্ভিকতার সাথে অগ্রাহ্য করে বিরক্ত গলায় বলল

-কারো ঘরে ঢুকতে যে পারমিশন নিতে হয় এই জ্ঞান টুকু নেই?

তিয়াসার মাথা দপদপ করে উঠলো। ছুটে গিয়ে মেহরাজের কলার চেপে ধরলো, উন্মাদের ন্যায় চেঁচিয়ে বলল

-ওকে নিজের বউ মেনে নিয়েছো তাই না? বাড়ির লোককে ফাঁকি দিয়ে রাতের আধারে দুজন একঘরে কি করছিলে হ্যাঁ? কি মনে করেছো উপরে লোক দেখানো সেপারেশন দেখিয়ে রাত হলে দুজন ন’ষ্টামি করবে আর কেও বুঝবে নাহ হ্যাঁ? উত্তর দাও?

মেহরাজ দুহাতে নিজের কলার ছাড়িয়ে সরিয়ে দিল তিয়াসাকে। অত্যন্ত তেজস্বী গলায় রক্তচক্ষে হাড হীম করা গলায় গর্জে উঠে বলল

-একমাত্র মেয়ে বলে আজ তুমি বেঁচে গেলে। নাহ তো মেহরাজের কলারে হাত দেওয়ার শাস্তি কিরূপ হতে পারে তা তোমার ধারণার বাহিরে, আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাওয়ার আগে বেরিয়ে যাও এই ঘর থেকে, না তো আমি ভুলে যাব তুমি এ বাড়ির কেও হও

তিয়াসা কেঁপে উঠলো মেহরাজের রূঢ় ধমকে। মুখ ফুটে আর কিছু বলবে তার আগেই মেহরাজ হাতের তর্জনী তুলে বলল

-আই রিপিট, এক্ষুনি এই মুহুর্তেই যদি তুমি এই ঘর থেকে বের না হও তাহলে কি হবে তুমি ভাবতেও পারবে না!

তিয়াসা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো নাহ। ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মোহর এতক্ষণ পাথরমূর্তির মতো বসে ছিল, মেহরাজের ধমকানিতে ওর শিরা উপশিরা কেঁপে উঠেছে, এমন ভয়ংকর রাগ! আজ অব্দি কারো দেখেনি মোহর। সমুদ্রের ন্যায় শান্ত চরিত্রের এই রূপটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সারা মুখ রক্তাভ বর্ণে উপনিত হয়েছে, গলার রগ গুলো ফুলে উঠেছে। প্রচণ্ড অপ্রতিভতায় থ মেরে বসে রইলো মোহর।

-দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসুন

মুহুর্তেই বদলে আবারও স্বাভাবিক গলায় বলল মেহরাজ। এতে যেন মোহর আরও কিয়দংশ ভড়কে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে মেহরাজের দিকে তাকালে ও গম্ভীর গলায় বলল

-দশ মিনিটের চেয়ে বেশি নাহ। আমি অপেক্ষা করছি।

-এতো কান্নাকাটির কি আছে, এই মেয়ের ন্যাকা এই জন্যেই আমার সহ্য হয়না। বেহায়া,বেশরম

ফিসফিস করে ভর্ৎসনা করছিল এতক্ষণ নাজমা। শাহারা আড়চোখে তাকাতেই চুপসে গেল। শাহারা নিজেও প্রচণ্ড বিরক্ত, আর তার চেয়েও বেশি লজ্জিত। তার এখন মনে হচ্ছে না তিনি এই সময় নিচে নামতেন আর নাইবা এইরকম একটা পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী হতে হতো।
তার চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছে তিয়াসা নামের মেয়েটার উপর। এতদিন ভাবতো মেয়েটার শুধু পোশাক আশাকেই হয়তো বেহায়াপনা, কিন্তু মেয়েটা নিজেও যে এতটা নির্লজ্জ তা ভাবতে পারেনি। তা না হলে এতগুলো মানুষের ভেতরে এসব কেও বলে? স্বামী স্ত্রী এক ঘরে কখন থাকবে কি করবে এসব কেও গুরুজনদের সামনে এভাবে বলে? ছি ছি ছি, লজ্জায় নলা নত হচ্ছে উনার।

-তিয়াসা, তুমি আগেই এতটা কেন ভাবছো বলো তো। এমন ও তো হতে পারে তুমি যা ভাবছো ভুল ভাবছো। সবসময় মানুষের চোখের দেখাও তো ঠিক হয়না?

-আমি ঠিকই দেখেছি ছোট আন্টি, এখন আমার আপনাদের ও বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনারাও জানতেন তাই না যে মেহরাজ ওই মেয়েটাকেই বউ করে ঘরে রাখে। শুধু শুধু ডিভোর্সের নামে মিথ্যা আশা দিয়েছেন আমাকে। ড্যাড ঠিকই বলেছিল আপনারা সবাই ঠক

কাকলি তিয়াসার কথায় চুপসে গেল। সকাল বেলা করে এসব শুনতে হবে ভাবতেও পারেনি। মেহরাজের ঘর থেকে এসেই কেঁদে যাচ্ছে তিয়াসা। আর সবার সামনেই বলেছে মেহরাজ রাতের অন্ধকারে চুরি করে মোহর কে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।

-তুমি আগেই বেশি বলছো তিয়াসা। মেহরাজ আসুক সবটা ওর থেকেই শোনা যাবে

আরহাম মুর্তজার কথা শেষ না হতেই মালা ক্ষীণ গলায় বলে উঠলো

-ওই তো আসছে ছোট সাহেব

বলেই আবারও চুপ করে গেল। এ বাড়ির লোকের ঠিক নেই। সবার মুখ থমথমে না জানি কার রাগ কার উপর ঢেলে দেবে। তার চেয়ে বরং এখন চুপ থেকে তামাশা দেখায় ভালো।

ততক্ষণে মেহরাজ সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসছে। পরনে নিত্যদিনের মতো অফিসের ফরমাল ড্রেসাপ নয়, ইনফরমাল ভাবেই কফি কালার একটা টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার পরনে। চোখ মুখের ভঙ্গিমা নিতান্তই স্বাভাবিক। এক হাত পকেটে গুঁজে আরেক হাতে মোহরের কবজি মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।
ড্রয়িং রুমে বসা সকলের উৎসুক দৃষ্টি তখন মেহরাজের হাতে চেপে রাখা মোহরের দিকে। যে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কিয়ৎকাল পিনপতন নীরবতা ছেয়ে রইলো৷ নিস্তব্ধতার ভাঙন হলো আজহার মুর্তজার গলায়,

-মেহরাজ, তুমি আর মোহর একসাথে থাকছো এটা কি সত্য?

মেহরাজ উত্তর করলো নাহ। তার আগেই শাহারা বেগম নাক কুচকে বললেন

-আজহার! তোমার ছেলে এখন তার বউকে তার ঘরে রেখেছে কি না এই নিয়েও জবাবদিহি করাবে তুমি?

আজহার মুর্তজা বেশ অপ্রস্তুত হলো। তৎক্ষনাৎ আরহাম বলে উঠলো

-জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হয়েছি বলেই করছি মা। ওদের যখন সেপারেশন চলছে এই মুহূর্তে ওদের একসঙ্গে থাকার ব্যাপার টা ডিভোর্সে অনেক ইফেক্ট করবে

-সেপারেশন? ডিভোর্স? কিসের কথা বলছেন আপনারা?

আরহামের কথার পৃষ্ঠে অবিলম্বেই ফিচেল গলায় প্রত্যুত্তর করলো মেহরাজ। এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও আম্বি এবার বেশ তেজী হয়ে বলল

-তোর আর মোহরের ডিভোর্স। এই বিয়ে আমরা কেও মানি না এটা তুই ভালো করেই জানিস বাবু। তোর বিয়ে তিয়াসার সাথেই ঠিক হয়ে আছে গত চার বছর ধরে, আর হবেও ওর সাথে

-তিয়াসার সাথে আমার বিয়ে তোমরা ঠিক করেছো। নিজেরাই গিয়ে আংটি পড়িয়েছো। আমি কি কখনো বলেছি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই? আর নাইবা আমি নিজে ওকে আংটি পড়িয়ে নিজের বাগদত্তার স্বীকৃতি দিয়েছি?

আম্বির কথার উত্তরে মেহরাজের বলা কথাগুলো শ্লথ স্রোত বয়ে দিলো উপস্থিত পরিবেশ জুড়ে, তিয়াসা কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে বলল

-দেখলেন, দুদিনের এই মেয়েকে পেয়ে ও কি করে সম্পর্ক টাকে অস্বীকার করছে? এমন কেন করছো তুমি রাজ? আমি তোমাকে ভালোবাসি, ওই মেয়েকে কেও মানবে না

-সী ইজ মাই ওয়াইফ। আমি স্বেচ্ছায় ওকে বিয়ে করেছি। আর আমি নিজে মানি। কেও মানুক না মানুক আই ডন্ট কেয়ার

উপস্থিত সকলে বিস্মিত হলো, তার চেয়েও দ্বিগুণ হলো মোহর। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মেহরাজের দিকে। এখানে তার ভূমিকা টা কোথায় বুঝছে নাহ? কি থেকে কি হচ্ছে? সে কি বলবে, তার কি কোনো মতামত দেওয়ার নেই? নাহ নেই। অদ্ভুত একটা জোর মোহরের বুকে বাসা বেঁধেছে, মেহরাজের হাতের মধ্যিখানে চাপের পিষ্ঠনে আবদ্ধিত হাতটা যেন ওকে বারবার বলছে এইখানটাই তোর ভরসা, তোর আশ্রয়। ছাড়িস নাহ। কিন্তু কোনো ভাবেই কোনো ভাবনায় স্থির হতে পারছে নাহ।
মোহরের ধ্যান ভাংলো কাকলির কর্কশ গলায়, তাচ্ছিল্য করে সে বলল

-ও কি করে এ বাড়ির বউ হবে মেহরাজ। না আছে জাত, না আছে বংশপরিচয়, না আছে পরিবার, না আছে ঘর।

কাকলির কথাটুকু শেষ না হতে মেহরাজের হাতের মুষ্টি আরও দৃঢ় হলো, তার চেয়েও অধিকতর দৃঢ় হলো তার ভরাট গলা। জড়তাহীনা বলে গেল

-আমিই ওর জাত,ওর বংশপরিচয়, ওর পরিবার ওর ঘর। আমিই ওর স্বামী। আর কোনো কিছুর দরকার আছে বলে মনে করিনা
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©হুমু

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৪

-একটা কথা আমি প্রথম এবং শেষ বারের মতো বলে দিচ্ছি, মোহর ইজ মাই ওয়াইফ। মিসেস মেহরাজ আব্রাহাম। নাহ ও এ বাড়ি থেকে কোথাও যাবে আর নাইবা সেপারেশনের নাম ও উঠবে। ও আমার বাড়িতে আমার ঘরে আমার সাথেই থাকবে এ্যন্ড দ্যাটস ইট!

বজ্রকণ্ঠের উচ্চরবযুক্ত হুংকারসুলভ বাক্যে এক মুহুর্তে থমকে গেল আবহ। নীরব স্রোত বয়ে গেল উপস্থিত মানুষের ভীড়ে। মেহরাজ সদা সর্বদা অভ্রভেদী স্বভাবের। দৃঢ় কাঠিন্য তার ব্যক্তিত্বে। অন্যদের তুলনায় অনেক বেশিই স্বল্পভাষী। তার গাম্ভীর্যের কারণে বাড়ির ছোট বড় অনেকেই সমীহ করে, সমীহ বলতে ওর কথার বিপরীতে কোনো অর্থও টানে না। হার হামেশা নিজের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকায় ওর সাথে বিতর্কের মতো কখনো কোনো অবকাশ ও আসেনি। তাই গম্ভীরচোরা মেহরাজের কাঠিন্য সম্পর্কে সবাই তথ্যাভিজ্ঞ থাকলেও এহেন ক্রোধপূর্ণ আচরণ আগে দেখেছে বলে মনে হয়না।

আজহার ও আরহাম বিস্ফোরিত চোখে তাকালো, মেহরাজকে রাগিয়ে দেওয়া কখনোই ওদের ইচ্ছে নয়। কোনো অজানা কারণেই হোক, বাপ চাচা হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেরা মেহরাজের প্রতিটি আচরণ, এবং অভিব্যক্তি মান্যজ্ঞান করে। আজহার সাহেব থতমত খেলো, রোমন্থন গলায় অস্বস্তির ভাঁজ এঁটে বলল

-তাহলে কি এটাই তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেহরাজ? তুমি মোহরকেই নিজেই বউ হিসেবে চাও?

-বিয়ে যখন করেছি তখন ওই আমার বউ। এ বিষয়ে আর কোনো কথা আমি চাইনা।

আরহাম মুর্তজা কিছু বলতে গেলেও বড় ভাই তার থামিয়ে দিল। উপস্থিত সকলের মুখে আধার নামলেও শাহারা বেগম মুখ লুকিয়ে হাসছেন। আর মনে মনে ভাবছেন ‘ এই না হলে আমার দাদুভাইয়, যে পুরুষ নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার আর সম্মান দিয়ে ভালোবাসে সেই তো তার ব্যক্তিত্বে পুরুষত্ব ধারণ করে। না তো অসম্মান করে হেউ করে ওঠা তো পশুরও স্বভাব । ‘

-ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস, রিলেটিভস অনেকেই জানে তোমার আর তিয়াসার এঙ্গেজমেন্টের ব্যাপার টা। তাদের কাছে কতটা ইম্ব্যারাসড হতে হবে। কানাঘুঁষা করবে সবাই

কাকলি মুখ কালো করে টেনে টেনে কথাগুলো বলল, মেহরাজ জড়তাহীনায় সকপটে বলল

-কে কি বলল আই ডন্ট কেয়ার। ওকে কারো পছন্দ হোক বা না হোক ওর প্রাপ্য সম্মান টা ওকে দিতে হবে। দ্যাটস এনাফ,নো মোর ওয়ার্ডস।

বলে গটগট করে উপরে উঠে গেল। আম্বি খাতুন ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকলো ছেলের যাওয়ার পানে। কতো শখ ছিল একমাত্র ছেলের বিয়ে, বউ নিয়ে। কতসব ভেবেছিল তার কিছুই হলো নাহ। শেষে কি কাকলির কথায় সত্য হবে? এই মেয়েটা কি তার বুকের মানিককেও কেড়ে নিবে? অশ্রুসিক্ত ধারালো চোখে তাকালো মোহরের দিকে। মেয়েটার প্রতি ক্ষোভ, ক্রোধ যেন তড়তড় করে বেড়ে গেল আরও কয়েক ধাপ।

কোনো দিক না তাকিয়ে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। তিয়াসা আগেই চলে গেছে মেহরাজের প্রথম কথা গুলো শুনে। আজহার আরহাম ও দাড়ালো না। নিজেদের কাজে গেল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভই নেই।
মোহর দ্বিধাগ্রস্থের মতো দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে শাহারা বেগমের কাছে দাঁড়ালো।

-মোহর আমাকে ধরে একটু ঘরে নিয়ে চল তো

তথাস্তু মেনে মোহর শাহারা কে নিয়ে তার ঘরে গেল। বিছানাতে দুই পা মেলে বসে শাহারা চোখের ইশারায় মোহরকে নিজের পাশে বসতে বললেন, মোহর বাধ্য মেয়ের বসলে শাহারা মুখাবয়বে ভীষণ গুরুতর ভাব এনে বলল

-তোকে কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোন। আজকে যা হলো তাতে এইটুকু নিশ্চয় বুঝেছিস দাদুভাইয়ে তোকে ডিভোর্স দেবে না, আর তোকে আজ থেকে ওর সাথেই থাকতে হবে

মোহর প্রত্যুত্তরে শুধু ঘাড় ঝুকিয়ে নিলো। শাহারা মোহরের অপ্রস্তুততা বুঝে সবিনয়ে বলল

-তোদের বিয়েটা যে পরিস্থিতি হয়েছে তাতে খাপ খাইয়ে সমন্বয় করে নেওয়াটা দুজনের জন্যেই একটু দুরহ। কিন্তু অসম্ভব তো নয়! আর প্রথম পদক্ষেপ তো দাদুভাই নিজেই নিয়েছে তোকে সকলের সামনে নিজের বলে স্বীকৃতি দিয়ে।
শোন মেয়ে ‘ জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে ‘ এটাই আমরা মেনে আসছি আদিকাল থেকেই, তোর কিসমতে বহু আগেই স্বামীর স্থানে মেহরাজের নামটা লিখা হয়ে গেছিল তাই তো এতো রেখে ওর সাথেই বিয়েটা হলো তোর । আল্লাহ চেয়েছিলেন বলেই কস্মিনকালেও যাকে দেখিনি জানিনি সেই এ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারীনি হয়ে এসেছে।

খানিক দম নিয়ে বৃদ্ধা আবারও বলতে শুরু করলো

– আল্লাহ তোর বাবা মাকে কেড়ে নিয়ে একমাত্র সম্বল হিসেবে দিয়েছেন তোর স্বামীকে। আমার দাদুভাই বাক্যসংযত ,গম্ভীর স্বভাবের কিন্তু দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন না। ওকে যেমন শক্ত খোলসে আবৃত দেখায় পূর্ণাঙ্গ রূপে ঠিক তেমনও নয়। এ বাড়ির মানুষের সাথে ওর সম্পর্ক নিয়মমাফিক হলেও ওকে আমি চিনি। শৈশবের অধিকাংশ সময়ে আমার আঁচলের তলেই কেটেছে ওর। তুই একবার ওকে ভরসা করে দেখ তোকে কখনও কষ্ট পেতে দেবে নাহ। মেহরাজ ওর পছন্দের জিনিস গুলোকে নিজের ভালোমাসায় মুড়িয়ে রাখে, ক্ষতি তো দূর একটা আঁচড় ও লাগতে দেয়না। তুইতো ওর স্ত্রী। জোর করবো না তবে গুরুজন হিসেবে তোকে এইটুকু উপদেশ আমি দেব সম্পর্কটাকে যখন খোদাতায়ালা নিজ হাতে এক করেছন তখন তোরা দূরে থাকিস না। সময় দে, গুরুত্ব দে, প্রচেষ্টা দে । শুধু সম্পর্ককেই নয় একে অপরকেও।

পুরোটা কথা শেষ করে ভারি প্রশ্বাস ছাড়লো পৌঢ়া , মোহর ছলছল আঁখি দুটে তুলে তাকালো। ওর রিনিঝিনি কণ্ঠে অগাধ বিষাদময়তা ঢেলে বলল

-ছোট থেকে পরিবার বলতে আব্বা, আম্মা আর বুবু। এ বাদে কেও ছিল না আত্মীয় সজনরা যাও ছিল তারাও খুব একটা স্নেহমহী ছিলেন নাহ। তার একমাত্র কারণ আমার আব্বার অস্বচ্ছলতা। নিজে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সারাটা জীবন ঘু’ষ, দূর্নী’তি নামক বেড়াজালের থেকে নিজেকে দশ হাত দূরে রেখেছে বলেই সে নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবার বহন করেছে। তবে টাকার অভাব থাকলেও আমাদের সুখের কোনো অভাব ছিল না। বছর তিনেক আগে বুবুর বিয়ে হলো, তার পছন্দের মানুষের সাথেই। সেই মানুষটাও সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করেছে বলে নিতান্তই স্বল্প বেতনের চাকরি। তবুও আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো কাটছিল দিনগুলো। কপালের অখণ্ড ভোগ তো সেদিন ঝড় হয়ে হুমড়ে এলো যেদিন আব্বা থানা থেকে বাড়িই ফিরলেন না আর। শুরুতে ভেবেছিলাম হয়তো কাজে আটকে গেছে। বারংবার ফোন যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে পুরো দুটো দিন অর্ধেক বেলা পার করার পর আব্বা ফিরলো। কিন্তু সেই আব্বা আর আগের মতো নেই, পালটে গেছে। বাড়িতে ফিরে একটা বারও মা বলে ডাকেনি বুকে জড়িয়ে ধরেনি এতটা সময় পর ফিরলো অথচ আমার জন্যে একটা চকলেট ও আনেনি। গূঢ়, নিষ্ঠুরের মতো পরে রইলো। একটা বার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলোও না তার মেয়ে দুটো অসহায়ের মতো তার মুখ পানে চেয়ে আছে একটাবার মা ডাক শোনার জন্যে।

শাহারা বেগমের চোখ ভিজে উঠেছে, মোহরের চোখে অদ্ভুত বিতৃষ্ণা, উৎকর্ষতা। চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে। বার কয়েক ঢোক গিলে আবারও উদ্ভ্রান্তের মতো বলতে শুরু করলো

-যানো দিদা ওরা কেও আমায় আব্বাকে কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে দিচ্ছিলো নাহ। আমার আব্বাকে ওরা স্ট্রেচারে করে এনেছিল। আমি কত বার করে বললাম আমার আব্বা তো হাঁটতে পারে তোমরা কেন স্ট্রেচারে করে এনেছো। ওরা শুনলো না। আমার আব্বাকে ঘরেও নিতে দিল না উঠানের মধ্যিখানে রাখলো। আব্বার অর্ধেক পচন ধরা ফুলে ওঠা শরীর দেখে কেও ভয় পেল কেও নাক চেপে ধরলো। আমরা তো ধরিনি গো আমি আর বুবু ছুটে গিয়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। কত করে ডাকলাম আব্বা গো তুমি একটা বার কথা বলো, আমরা একটুও রাগ করবো না, একবারও বলবো না তুমি কেন দুদিন আসোনি। তাও আব্বা শুনলো নাহ। একটা বার চোখ খুলে বলল না আমার মা জননী রা কই। মাকে কতো করে বললাম আব্বাকে একবার বলো না কথা বলতে, কিন্তু নিষ্ঠুরতমভাবে মা একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। চুপচাপ পাথরমূর্তির মতো আব্বাকে খাটিয়া করে তুলে নিয়ে যাওয়া দেখলো। তারপর থেকে সব বদলে গেল সব। আমাদের ঘরে আর কেও হাসলো না, মা তো কথাও বলা বন্ধ করে বিছানায় পরে গেল। আত্মীয় সজন দুয়েক দিন মুখ দেখানো খোঁজ নিয়ে হারিয়ে গেল। চাচা-চাচীও কেমন রঙ বদলে নিলো।
কিন্তু সেসবে তো আমার কিছু না, আমার কিছু না। আমি তো আব্বাকে দেখতে চেয়েছি শুধু । আব্বাতো সেদিনের পর আর আসলো না, আর মাথায় হাত বুলিয়েও দিলো নাহ। সকাল বিকাল করে কেও হাঁক ডাক ছেড়ে বলেও না আমার ডাক্তার সাহেবা কই। আমার আব্বা তারপরে আর আসলো না দিদা, আব্বার মায়াভরা মুখটা আর এ দুচোখে দেখতে পারলাম নাহ। আর আম্মা সে থেকেও নাই। নির্জীব লা’শের মতো পরে রইলো কয়টা মাস তার পর সেও ছেড়ে গেলো। সাথে দিয়ে গেল নিজের সমস্ত মৃত্যুর দায়ভার। আমাকে বুবুও দোষ দিয়ে তাড়িয়ে দিল। কেও রইলো না কেও নাহ

পরপর কয়েকবার ফিসফিস করে বলল ‘কেও রইলো না, কেও না’ বলতে বলতে নিজের অজান্তেই সারা কপোল, গলা বুক ভিজে গেছে অশ্রুতে। যন্ত্রমানবির মতো স্থির অপলক তাকিয়ে রইলো মোহর। তার পর হুট করেই শাহারা বেগমের হাত ধরে বলল

-কেও থাকেনি দিদা কেও না। আব্বা তো বলেছিল আমি যেদিন সম্পূর্ণ ভাবে ডাক্তার হবো সেদিন এপ্রোন টা আব্বা নিজ হাতে পরিয়ে দেবে আমায়। আম্মা বলেছিল আমার বাচ্চা হলে নাতির ঘরের নাতিকেও কোলে নিয়ে খেলবেন। বুবুও তো বলেছিল সবসময় আমার ছায়া হয়ে থাকবে। কেও থাকেনি গো কেও থাকেনি। সবাই আমায় ছেড়ে গেছে সবাই। কেও আমার বিশ্বাস রাখেনি। আব্বা, আম্মা, বুবু কেও নাহ। সবাই ঠ’কিয়েছে আমাকে। আমি আর কাকে বিশ্বাস করবো দিদা, কিভাবে বিশ্বাস করবো। আমার বিশ্বাস তো কেও রাখেনি। আমি আর এখন কিছু বলতে পারিনা, ভাবতে পারিনা। আমি কিছুই বুঝি না। আমার তো কেও নেই। আজ যদি আব্বা আম্মা বুবু আমায় ছেড়ে না দিত তাহলে তো আমি কারো চক্ষুশূল হতাম না,কারো পথের কাঁটা ও হতাম নাহ। আমিতো চাইনি আমার জন্য এতো কিছু হোক। আমি সত্যিই চাইনি। তাও কেন এমন হলো বলতে পারো দিদা, বলোনা কেন এমন হলো

কথাটুকু শেষ করে দম ছাড়লো, হাঁফিয়ে উঠলো। কান্নার হিড়কে মুখ রক্তাভ বর্ণ ধারণ করে উঠলো। শাহারা বেগম হাত বাড়িয়ে মোহরকে ঝাপটে ধরলেন বুকের ভেতর, অশান্ত বাচ্চার মতো ছটফট করতে থাকা মোহর নিমিষেই শান্ত বনে গেল। শাহারা বেগম অশ্রুভেজা গালে সহজ গলায় বললেন

-কে বলেছে কেও নাই। আমি আছি তো। তোর দিদা আছে সবসময় তোর পাশে। কেও তোকে ঠ’কাইনিরে বুবু তোর নিয়তিতে যা ছিল তাই হয়েছে, এতে যে কারো হাত নেই। স্বয়ং আল্লাহ্ যা চেয়েছে তাতে কার হাত আছে বল। তুই তো ধৈর্যশালী, শক্তিশালী বাচ্চা। তুই কেন কাঁদছিস। আল্লাহ্ সবসময় তোর সাথে আছে, তোর জন্যে আছে। কাঁদতে নেই

বলে বুক থেকে তুলে মোহরের মুখ মুছিয়ে দিল। মোহর বহুকষ্টে সংযত করলো নিজের ভেতর থেকে উগড়ে আসা কান্নার কুন্ডলী। ফুঁপাতে ফুঁপাতে গলা ধরে এলো। শাহারা ওর মুখে হাত দিয়ে বলল

-তুই একদিন খুব সুখী হবি দেখিস, যেই প্রকৃতি তোকে শূন্য করেছে সেই তোকে ভরিয়ে দেবে। ভালোবাসায় কানায় কানায় ভরে যাবে তোর জীবন। আর কক্ষনও কাঁদবি না,কেমন?

মোহর ঘনঘন মাথা ঝাকালো। কান্নার দাপটে চোখ মুখ লালাভ হয়েছে, তখনি হুট করে সামনে একটা পানির গ্লাস ধরে মেয়েলি গলায় কেও বলল

-এই পানিটা খাও

সামনে পানির গ্লাস ধরে রাখা হাতটা উদ্দেশ্য করে ঘুরে তাকালো শাহারা বেগম, মোহর দুজনেই। তাথই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কড়া গলায় বলল

-কি যেন মণি না মোহর, নাও এই পানিটা খাও। চোখ মুখ তো ফুলিয়ে আলু বানিয়েছ।

শাহারা বেগম হাতে ধরে গ্লাসটা মোহর কে দিলে ও এক নিঃশ্বাসে গ্লাস ফাঁকা করে দিল। এখন যেন একটু স্বস্তি লাগছে। তাথই আর শাহারার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় বলল

-আসলে আমার এমন প্রতিক্রিয়া করাটা ঠিক হয়নি, হুট করেই কেমন ভেঙে পড়েছি,দুঃখিত।

-দেখতে তো বাচ্চা, এমন বড়দের মতো আচরণ করতে কে বলেছে তোমাকে। দুঃখিত বলছেন

বলে একটা ধমকি দিয়ে বেরিয়ে গেল তাথই। ঘর থেকে বেরিয়ে চোখ বয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণ খুব কষ্টে সংযত করে রেখেছিল। সত্যিই,আমরা তো অল্পতেই ভেঙে পড়ি, অথচ কত মানুষ আছে যাদের জীবনী শুনলে নিজের সমস্যা গুলোকে অতিব তুচ্ছ বলেই মনে হয়।
তাথই অস্থির মনে ভাবলো এইটুকু একটা মেয়ে, কতই বা হবে বয়স। এতকিছু সহ্য করেছে?
তবে তার ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ। আবারও গম্ভীরচিত্তে নিজের ঘরে ঢুকলো।

সুদীর্ঘ দিন ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে নিকষ রজনীর আগমনে কৃষ্ণাভ রাঙা হলো ধরনী। পুরোটা বেলা মোহর শুয়ে বসেই কাটিয়েছে। শাহারা বেগম সারাটা দিনই ছিল ওর সাথে। বাড়ির কারো সাথে আর তেমন দেখাই হয়নি।
কাকলি সারাদিন তাথইয়ের বাচ্চাটাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আর আম্বি বেগম আজ ঘর থেকেই বেরোইনি।
তবে বিড়ম্বনায় তো এখন পড়লো মোহর, মেহরাজ সার্ভেন্ট কে দিয়ে ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিজের ঘরে নিয়েছে। জেদের বশে রাগ করে নাকি সত্যিই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে মেহরাজের এহেন পদক্ষেপ তা এখনো মোহরের বোধগম্যতার বাহিরে। এখনও আগের ঘরটাতেই বসে আছে মোহর, ও ঘরে কি করে যাবে কিভাবে থাকবে ভাবতেই চিত্তজুড়ে অস্বাভাবিক অস্বস্তি ঘিরে ধরছে।

-এহেম এহেম

পুরুষালী গলার কাশির শব্দে ঘুরে তাকালো মোহর। দরজায় ঠেস দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক মুখাবয়বে দাঁড়িয়ে আছে সুঠাম শরীরের মানুষটা। চকচকে নীল রঙের টি-শার্ট টা পেশিবহুল হাতে আঁট হয়ে লেগে আছে। গাঢ় ধূসর বর্ণা চোখের হার হামেশার তীক্ষ্ণভেদী দৃষ্টিতে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল মোহর।

-কাল কিছু একটা বলছিলেন, এ ঘরে ভূত আছে বা এমন কিছু?

স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় কথা গুলো বলে সকৌতুকে চেয়ে রইলো মোহরের উত্তরের অপেক্ষায়। ভূত কথাটা শুনতেই মোহরের কল্পনাতে বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো মনে পরে গেল কাল রাতের ঘটনা। আচমকা উঠে দাঁড়ালো। কাল রাতের কথা মনে হতেই অদ্ভুত শব্দ গুলো কানে বেজে উঠলো। থতমত খেয়ে জড়তা ভরা গলায় বলল

-এই, এই ঘরের জানালার বাইরে কেও কথা বলছিল। আমি জানালা খুলতেই সাদা থানের মতো কিছু সরে যেতে দেখেছি, দরজাটাও খুলছিল নাহ।

অবিন্যস্ত গলায় এলোথেলো ভাবে বলল মোহর। মেহরাজ ভাবুক মুখ করে বুকে গুঁজে রাখা হাত টান করলো। বা হাতের তর্জনী তুলে প্রশস্থ কপালে ঘষতে ঘষতে বলল

-আপনিও এই কথা বলছেন? এর আগেও এই ঘরে যে ছিল সেই এরকম বলেছে। কেও এই ঘরে বেশিদিন থাকতে পারেনা। রিয়াজ কে চেনেন? এই বাড়ির দারোয়ান, ও তো মাঝে মধ্যেই বলে এই ঘরের জানালা দিয়ে সাদা কাপড় পরা কাওকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছে। তবে আমার মনে হয় এটা তাদের মনের ভুল। স্বপ্ন দেখেছে হয়তো।

মোহরের ভয় আরও দুই গুণ বেড়ে গেল। তার মানে সে একাই নয় আরও অনেকেই ওটা দেখেছে। আর এই লোকটাও কেমন, এতগুলো মানুষ কি স্বপ্নই দেখেছে আজব।

-যাই হোক। রাত অনেক হয়েছে। আসলে আমি বাড়িতে সবার সামনে বলেছি আপনি আমার সাথেই থাকবেন তবুও আমি আপনাকে কোনো ব্যাপারে প্রেসারাইজ করতে চাইনা। আপনার যদি এই ঘরে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, তাহলে এখানেই থাকুন, গুড নাইট

বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়ালো নাহ। বড় বড় পায়ের লম্বা লম্বা পদক্ষেপ ফেলে নিজের ঘরে আসলো। পেছনে ঘুরে দরজা লাগাতে গেলেই মোহর হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো, মেহরাজের সকৌতুক দৃষ্টি দেখে বলল

-না মানে, বলেছেন যখন তাই এখানেই থাকা উচিত হয়তো।

এলোমেলো ভাবে বলেই চোখ ঘুরিয়ে নিলো। মোহরের ভয়ার্ত, অস্থির চেহারাটা দেখতে ভারি লাগছে। মেহরাজ ওর দৃষ্টির অগোচরে ঠোঁট টিপে বাঁকা হেসে দরজা লাগিয়ে দিলো।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে