#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১১
সকালের নম্র, কুসুমের মতো হলুদ সুবহ মুখের উপর উপচে পড়তেই ঘুম হাল্কা হয়ে এলো মোহরের। ঘুমের ঘোরেই মনে হলো কেও মুখের উপরে থেকে খুব সযত্নে,আলগোছে চুল গুলো আঙ্গুলের ডগার সাহায্যে সরিয়ে দিচ্ছে।
ঘুমের রেশ হালকা হয়ে চোখ খুলতেই নিজেকে বিছানায় দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল মোহর। টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকিয়ে আশপাশে ঘাড় ঘুরালে হতভম্বতা আরও তড়তড় করে বেড়ে গেল মেহরাজের অবস্থান দেখে।
একদম ওর মুখ বরাবর কাউচে বসে দুইহাতের কনুই হাটুতে ভর দিয়ে মুখের কাছে ধরে রেখেছে। ধারালো চাহনিযুক্ত চোখ দু’টো নির্লিপ্ত নেত্রে আটকে আছে মোহরের দিকে। স্পষ্ট মনে আছে মোহরের গতরাতে আম্বি অনেক রাত অব্দি এ ঘরেই ছিল, উনি বেরিয়ে গেলে মোহর কাউচেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাহলে এখানে এলো কি করে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বলল
‘ আমি এখানে এলাম কি করে? ‘
‘ আমি এনেছি ‘
স্ট্রেইট কাট স্বীকারোক্তি উনার। কি নিঃসংকোচে বলে দিল। অথচ এই বাক্যটিই যথেষ্ট ছিল মোহরের ভেতরের দামামা তুলে দিতে। অতিবিস্তারিত দূরহ দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাজের দিকে, সে এখনো দায়সারা ভঙ্গিমায় বসে। মোহর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। এখন তার কি বলা উচিত! কিছুই তো মাথায় আসছে নাহ। মোহর কখনোই আড়ষ্ট, জড়তাগ্রস্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল নাহ। কিন্তু ইদানীং দুনিয়ার যত অসাড়তা এসে ভর করে ওর উপর। প্রয়োজনেও কোনো উত্তর দিতে ওষ্ঠাধর কেঁপে ওঠে অস্থিরচিত্তে। আর তা শুধু এবং কেবলমাত্র এই মানুষ টার সামনেই
‘ আ আপনি? আপনি আমাকে কিভাবে এখানে আনলেন ‘
‘ অবশ্যই কোলে তুলে ‘
কেমন রম্য শোনাচ্ছে মেহরাজের কণ্ঠস্বর। যেন নিতান্তই কোনো স্বাভাবিক কাজ করেছে। ভ্রু কুচকে এলো মোহরের, কপালে বলিরেখার ভাঁজ ফেলেই তাকালো ওর দিকে। অদ্ভুত রোঁমাচিত হলো অন্তঃস্থল। ফর্সা শরীরে শুভ্র কাপড়ে শার্টটাতে অত্যাধিক স্নিগ্ধ লাগছে মেহরাজকে। মেহরাজকে এতো দীর্ঘ সময় ধরে নিজের কাছাকাছি দেখার অভিজ্ঞতা আগে ছিল নাহ। তাই তো মোহর একেবারেই অজ্ঞাত ছিল এরকম অনুভূতির প্রতি। যা ওর মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র নিস্ক্রিয় করে ফেলে। খাড়া নাক, পুরু কালচে খয়েরী ঠোঁট, আর ধূসর বর্ণা চোখে সীমাহীন নেশা। যা মোহরকে বারবার মতিচ্ছন্ন করে তোলে।
‘ আপনি আমাকে কেন এনেছেন বিছানাতে, আর কিভাবেই বা আনলেন। আপনি ইঞ্জুরিড ‘
‘ সামান্য আঘাত, হাত পা বা কোনো অংশই অচল হয়ে যায়নি ‘
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো। গ্যাবাডিন প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বলল
‘ আর আপনার ঘরে এসে আপনাকেই সোফাতে শুইয়ে রাখাটা মোটেও ভালো দেখায় নাহ। সুস্থ আছি আমি, আমার দেখাশোনা করার জন্য ধন্যবাদ ‘
বলেই কোনো রকম প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে দরজার দিকে হাঁটা ধরলো। মোহর তটস্থ হয়ে বলল
‘ শ্ শুনুন ‘
মেহরাজ পা থামিয়ে দাঁড়ালো, কিন্তু ঘুরে তাকালো নাহ। মোহর বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে এসে বলল
‘ কোথায় যাচ্ছেন, আপনি তো এখনো প্রোপারলি সুস্থ নাহ ‘
‘ নিজের ঘর অব্দি হেঁটে যাওয়ার মতো সুস্থ মনে হয় হয়েছি,হয়নি ডক্টর? ‘
খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল মেহরাজ। মোহর আড়ষ্ঠ ভঙ্গিমাতে বলল
‘ আমি এখনো ডক্টর হইনি ‘
‘ হতে আর দেরি কোথায় ‘
মোহর অস্বস্তি কাটাতে মেহরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল
‘ এখনি যাবেন না, আরেকবার ড্রেসিং করা দরকার ‘
মেহরাজ খানিক ভেবে এগিয়ে গিয়ে আবারও বসলো কাউচে, ব্যস্ত গলায় বলল
‘ আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, অপেক্ষা করছি ‘
মোহর আর কোনো শব্দ খরচ না করে ওয়াশরুমের দিকে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে মেহরাজকে আগের অবস্থাতেই বসে আছে। এইড বক্স টা হাতে নিয়ে বসলো মেহরাজের পাশে। ঘা টা একদম বুকের উপর হওয়াতে শার্ট না খুললে ড্রেসিং করা সম্ভব নাহ। কিন্তু মেহরাজকে কথাটা বলতেও কেমন লাগছে।
মোহরের হাসফাস করা দেখে মেহরাজ ভ্রু কুচকে বলল
‘ কিছু বলবেন? ‘
‘ হ্যাঁ, আম মানে। খুলুন ‘
‘ কি খুলবো? ‘
অস্বস্তিতে কান লাল হয়ে এলো মোহরের, মেদুর গালে লালিমা পড়লো অসংখ্য। ধীমি গলায় প্রচণ্ড কষ্টে বলল
‘ শার্ট খুলুন ‘
মেহরাজ অধর কিঞ্চিৎ বাকিয়ে হাসলো। যেন ইচ্ছে করে মোহরকে অস্বস্তিতে ফেলছে। এক হাতে শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে পুরো শার্টটাই খুলে ফেলল। মোহর লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে নাহ। এ ধরনের কাজ এর আগেও করেছে কিন্তু কখনো এতটা জড়তা লাগেনি, চোখ মুখ মুদে এলো ত্রপায়।
কম্পিত হাতে তুলো স্যাভলনে ভিজিয়ে ছুঁয়ে দিল মেহরাজের বুকে। কাটা ঘা-য়ে কেমিক্যালের ঠান্ডা স্পর্শে জ্বলে উঠলে কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলো মেহরাজ। মোহর এক পলক তাকালো মেহরাজের মুখের দিকে, জড়তা ভেদ করে মুখ এগিয়ে এনে ওষ্টাধর ফাঁক করে মৃদু ফুঁ দিল আহত স্থানে। এক মুহুর্তের মধ্যে থমকে গেল মেহরাজ, নিজ থেকে মোহরের এহেন কাজ ওর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।
হৃদযন্ত্র অবস্থানকৃত ছোট্ট যায়গা টা অস্বাভাবিক ভাবে কম্পিত হলো। অযাচিত দুর্বার অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে উঠলো পাঁজরের মাঝের যন্ত্রটা। ওষ্টের ফাঁক দিয়ে ঝড়ের বেগে নিঃশ্বাস টেনে নিল। সংযমচিত্তে তাকালো মোহরের দিকে।
নিজের কাজ শেষ করেই বিদ্যুতের গতিতে সরে গেল মোহর, মেহরাজের এতটা নৈকট্যে ওর দম বন্ধ হবার যোগাড়।
মেহরাজের শরীর থেকে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ আসে, যতবার মোহর কাছাকাছি যায় ততবারই। তীব্রভাবে নাসারন্ধ্র ভেদ করে যায় কড়া একটা পুরুষালী ঘ্রাণ। কেমন গোলাপ-চন্দন মিশ্রিত একটা সুবাস, আবার মাঝে মধ্যে মনে হয় বিদেশি কোনো দামি পারফিউম হয়তো। কিন্তু এমন মোহনীয় ঘ্রাণ আগে কখনো কোত্থাও পাইনি মোহর, যেন সারা চিত্তে এক মুহূর্তে ভ্রম ধরিয়ে দেয় এই সুরভী।
‘ ঠিকাছে, আর জ্বলবে না ‘
অপ্রিতিকর পরিস্থিতিকে সামাল দিতে মোহর স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলে।
‘ যেই জ্বলন ধরিয়ে দিলেন, সেটার ওষুধ কোথায় পাবো ডাক্তার ম্যাডাম! ‘
‘ মানে? ‘
অস্বস্তিপূর্ণ চাহনিতে বলল মোহর। মেহরাজের কথার মর্মার্থ যেন দূর্ভেদ্য মনে হলো ওর নিকট।
‘ নাথিং, তৈরি হয়ে নিচে আসুন। আপনার ক্লাসের টাইম হয়েছে ‘
বলেই গটগট করে বেড়িয়ে গেল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে। মোহর মিনিট দুয়েক থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। পরমুহূর্তে ওতসব চিন্তা বাদ দিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে তৈরি হয়ে নিল।
ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে কানে এলো আজহার মুর্তজার কণ্ঠস্বর, তিনি প্রচণ্ড অসন্তোষ জনক গলায় বলছেন
‘ তুমি এখনো সুস্থ হওনি ঠিকভাবে মেহরাজ। তবুও আজই কি অফিস যাওয়ার খুব দরকার? ‘
‘ আজ নিউইয়র্ক থেকে ক্লায়েন্ট আসবে, এমডি শুধুমাত্র আমার সাথেই ডিল করবে বলে আসবেন, আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটেই ব্যাক করবে, আমার বাড়িতে থাকা মানে প্রজেক্টের অনেক বড় লস ‘
‘ কোনো প্রজেক্টের দামই তোর সুস্থতার চেয়ে বেশি নাহ বাবু, এমন শরীর নিয়ে গিয়ে যদি কিছু হয়ে যায় ‘
‘ ছোট একটা আ’ঘাত, একটু কে’টে গেছে মাত্র, এতটা হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আর আমি সুস্থ আছি ‘
বলতে বলতেই সিড়ির দিকে একবার তাকালো মেহরাজ। মোহর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে কণ্ঠের খাদ স্বাভাবিক রেখেই বলল
‘ এদিকে আসুন মোহর ‘
মেহরাজের কথা অনুসরণ করে কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হলো মোহর। মৃদুমন্দ পায়ে এগিয়ে এলে সোফাতে বসে থাকা অবস্থায় শাহারা বেগম বললেন
‘ নাজমা দাদুভাইয়ের সাথে ওর বউকেও খেতে দাও। মনে হয় দুজন একসাথেই বেরোবে ‘
শাহারা বেগমের এহেন কথায় কাকলি আর আম্বি দুজনের মুখেই আধার নামলো। যেন কোনো ভাবেই ওরা মেহরাজের আশেপাশে মোহরকে সহ্য করতে পারেনা। আজহার সাহেব নিউসপেপার পরতে পরতে বলল
‘ একা একা যাতায়াত করার দরকার নেই৷ তুমি বরং আজ থেকে মেহরাজের সাথে আসা যাওয়া করবে ‘
মোহর উত্তর করলো নাহ। শাহারা বেগম সোফাতে বসেই ইশারা করলো মোহরকে, এগিয়ে গিয়ে দ্বিধাবোধ নিয়েই চেয়ারে বসলে নাজমা এসে খাবার বেড়ে দিল।
নাস্তা সেরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মোহর। মেহরাজ গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করতে গেছে, সূর্যের তীর্যক রোশনাই কড়া হতে শুরু করেছে আলোতে ঠিক করে চোখ মেলে তাকানোও দায় মনে হচ্ছে
‘ তুমি এখানে কি করছো? ‘
চেনাজানা কণ্ঠের কথাটা শুনে চোখ কুচকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মোহর। ঠিক ওর সামনেই গোলাপি রঙের টপস আর একটা জিন্স পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াসা। মনে হয় এ বাড়িতেই এসেছিল, মোহর নিরুত্তর থাকা অবস্থায়ই এগিয়ে এলো ও
‘ কি হলো বলো কোথায় যাচ্ছো? আর কার পারমিশন নিয়ে বেড়িয়েছো তুমি ‘
মোহরের জবাব দেওয়ার আগেই পেছন থেকে আসা গাড়ির শব্দে দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মেহরাজ গাড়িটা গেইটের উপরে দাঁড় করিয়ে বলল
‘ তাড়াতাড়ি উঠে বসুন, দেরি হচ্ছে ‘
‘ রাজ তুমি ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? ‘
এহেন মুহূর্ত যেন ভাবতেও পারেনি তিয়াসা, তোখে মুখে তীক্ষ্ণ কৌতুহলের ছাপ, মেহরাজের দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়
‘ যেখানে যাওয়ার কথা সেখানেই যাচ্ছি ‘
মেহরাজের খাপছাড়া উত্তরে হতাশ হয়নি তিয়াসা, ওর ক্ষুব্ধ নজর তো মোহরের দিকে, মোহর এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠতে গেলে আবারও বলল
‘ ও তোমার সাথে কেন যাচ্ছে রাজ ‘
বিরক্তি সুলভ নজরে তাকালো মেহরাজ। তিয়াসা আরও কিছু বলতে চাইলেও মেহরাজের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস করলো নাহ। কিন্তু মোহরকে মেহরাজের সাথে এক গাড়িতে ও কিছুতেই সহ্য করতে পারবে নাহ, হুড়মুড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফ্রন্ট সীটে বসে বলল
‘ আমিও অফিসের ওই রাস্তায়ই যাবো, হোপ, ড্রপ করে দিতে কোনো অসুবিধা হবে নাহ ‘
মোহর ওর কাজ দেখেও কোনো রকম অভিব্যক্তি দেখালো নাহ। চুপচাপ ব্যাকসীটে উঠে বসলেই হাই স্পীডে গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো। মেহরাজের কর্কশ চেহারা দেখে তিয়াসা আর কিছু বলার সাহস না করলেও একটু পরপরই ঘাড় ঘুরিয়ে মোহরের দিকে তাকাচ্ছে ক্ষুব্ধ নজরে।
প্রায় সাত আট মিনিট বাদেই গাড়িটা এসে থামলো মেডিক্যাল কলেজের সামনে। মোহর কোনো কথা ছাড়াই দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। পেছন ঘুরে তাকালে দেখলো তিয়াসা ওর দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে যেন মেহরাজের পাশে বসে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো মোহর। নিজের কাঙ্ক্ষিত বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠতে গেলে বেখেয়ালি বশত হুট করেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে যায়
‘ সরি সরি আসলে আমি খেয়াল করিনি ‘
‘ মোহর? ‘
আগন্তুকের দিকে না তাকিয়েই হন্তদন্ত হয়ে সরি বলতে লেগেছিল। সুপরিচিত গলা শুনেই চোখ তুলে তাকালো
‘ স্যার! আ’ম সরি। আসলে আপনি আসছিলেন আমি বুঝতে পারিনি ‘
‘ ইটস ওকে, হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকেও খুঁজছিলাম মোহর ‘
‘ আমাকে? ‘
‘ এতদিন কোথায় ছিলে তুমি মোহর? কতগুলো ক্লাস মিস করেছো? তোমার কোনো ফ্রেন্ডস এর কাছেও কোনো খোঁজ পাইনি তোমার। ইস এভরিথিং অলরাইট? ‘
‘ আমার মা মারা গেছে স্যার। তাই আসতে পারিনি ‘
বিয়ের ব্যাপার টা সূক্ষ্ম ভাবে গোপন রেখেই অর্ধেক সত্যটা বলল মোহর। মোহরের কাছে এরূপ উত্তর একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল ডক্টর, ফায়াজের নিকট। নিজের অজান্তেই অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বললেন
‘ ওহ ভেরি সরি। আসলে আমি তোমায় নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। এই ঘটনা ব্যাপারে আমি কোনো ভাবে অবগত ছিলাম না, সত্যিই দুঃখিত ‘
‘ ইটস ওকে স্যার ‘
‘ যা হয়েছে তাতে কারো হাত নেই। বাট ইউ আর এ ব্রাইট স্টুডেন্ট। ভেঙে না পরে তোমার উচিত নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। ঠিক যেমনটা তোমার বাবা চেয়েছিলেন ‘
ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো মোহর। ফায়াজ মোহরের সাথেই পাশে এগোতে এগোতে বলতে থাকলো
‘ এই কদিন তোমার উপর কতটা ট্রমা গিয়েছে আমি বুঝতে পারছি। তবে তোমার যেকোনো প্রয়োজনে আমি পাশে আছি। আমাকে মনে করতে ভুলবে না ‘
মোহর এবার ও নিরুত্তর রইলো। তবে ফায়াজ উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলল
‘ তোমার ফোনের কি হয়েছে? অনেকবার ট্রাই করেছি আনরিচেবল দেখাচ্ছিল বারবার ‘
‘ স্যার ওটা হাত থেকে পরে ভেঙে গেছে ‘
মোহরের ফোনটা সেদিন রাতে ধাওয়াকারির থেকে পালানোর সময়ই রাস্তায় পড়ে গেছিল। তারপর না ফোনের খোঁজ করার সুযোগ হয়েছে, না দরকার।
টুকটাক কথা বলতে বলতে ক্লাসের দিকে গেল মোহর। সাথে ডক্টর ফায়াজ ও গেল। কারণ এখন তারই লেকচার।
……………….
‘ ওকে আমার সামনে থেকে সরাও মা, সহ্য হচ্ছে না আমার একদম ওকে ‘
‘ তাথই, তোর আচার আচরণ দেখে আমি বলার ভাষা হারাচ্ছি। বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে এই তোর আচরণ। এমন একটা নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে এমন কিভাবে করিস তুই? ‘
‘ ওকে নিয়ে কোনো কথা আমার সামনে বলবে না মা। একদম সহ্য হয়না ওকে। আমি ওকে আমার কাছে রাখতে পারবো নাহ। আমাকে বেশি জালালে হয় আমি মরে যাবো নয় ওকেই মেরে ফেলব ‘
কাকলি অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। নিজের মেয়েকেই চিনতে অসুবিধা হচ্ছে নিজের। ছোট একটা বাচ্চা, কেবল মাস কয়েক হয়েছে। তার সাথে এমন নিষ্ঠুর আচরণ তো কোনো শত্রুও করবে নাহ। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকেই ওর আচার আচরণ এমন রুষ্ঠ হয়ে গেছে। কারো সাথে ঠিক করে কথা বলে না মেশে না বাচ্চাটাকেও সহ্য করতে পারে নাহ।
ওর স্বামী প্রায়ই ফোন করে বলে রাতে যদি বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে নীল ও হয়ে যায় তবুও ফিরেও তাকায় নাহ। হুটহাট করে বাড়ি চলে আসে, বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে বাচ্চাটা তো মরেই যাবে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। বাচ্চাটাত দিকে তাকালেও মায়া লাগে, কি সুন্দর ডাগর ডাগর চোখ, চিকন নাক। পাতলা ঠোঁট। মুখের অবয়ব একদম ধরা বাঁধা মায়ের মতই পেয়েছে। কিন্তু কপালে মায়ের মমতা আদর কোনো টাই পাইনি।
ততক্ষণে তাথই আবারও ওর আগের ঘরটাতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। আগে তো হুটহাট এসে আবার চলে যেত। এবার ব্যাগপত্র নিয়ে এসেছে, এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেও বলে
‘ আমার যদি এ বাড়িতে আসায় তোমার অসুবিধা হয় তো বলে দাও, অন্য কোথাও চলে যাব। এতো প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না ‘
………………….
‘ তুই কি এখনি ফিরে যাবি মেহু? ‘
‘ হ্যাঁ, কেন দরকার? ‘
‘ না তেমন কিছু না ‘
মোহর হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালো। শ্রীতমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল
‘ কি হয়েছে বল তো? তোর ভাবসাব অন্যরকম ঠেকছে, কি লুকাচ্ছিস? ‘
‘ আমি তো তোর কাছ থেকে কিছুই লুকায় না মেহু। এবারও লুকাবো নাহ। সঠিক সময়মত বলে দেব। এখনো বলার মতো হয়নি ‘
‘ কি যা তা বলছিস, কিছুই বুঝছি না। খুলে বল তো ‘
‘ উহু, বললাম তো পরে বলব। তুই আমার কথার উত্তর দে। কি ভাবলি বল তো ‘
‘ কোন ব্যাপারে? ‘
‘ বিয়েটার ব্যাপারে। এই সম্পর্ক নিয়ে কি তুই এগোতে চাস আদও? ‘
ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মোহর। বুক ভারি হয়ে আসলো। এর উত্তরে ঠিক কি বলা উচিত ওর জানা নেই। অবিন্যস্ত গলায় বলল
‘ আমার চাওয়া না চাওয়াতে কার আসে যায় বল তো। যদি তাই হতো তাহলে তো নিয়তি আজ এখানে এসে দাঁড় করাতো না ‘
তমা মোহরের কাঁধে হাত রাখলো। ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল
‘ বিধাতা কার ভাগ্যে কি রেখেছে আমরা কেও জানি নাহ। মাঝে মাঝে জীবন আমাদের এমন একটা মোড়ে এনে দাঁড় করায় যেন সবটা কুয়াশার মতো ধোয়াশা আর ঝাপসা লাগে। এগিয়ে যাবো নাকি পিছিয়ে পরবো কোনো টাই আমরা বুঝে উঠতে পারিনা। নষ্ট ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো থমকে যায় আমাদের জীবন, কিন্তু তা বলে সময় কিন্তু থেমে থাকে না, সেটা আপন গতিতেই এগিয়ে চলে। তুই এখন জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে আছিস যেখানে ধৈর্য ধরা, প্রার্থনা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখানে পিছিয়ে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তা বা সুযোগ খোলা নেই। আর এগিয়ে যেতে চাইলে একটা রাস্তায় আছে, মেহরাজ আব্রাহাম।
খানিক থামলো শ্রীতমা। মোহর এখনো নির্বাক শ্রোতার মতই চুপ করে আছে। সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলো তমা
‘ মেহরাজ আব্রাহাম নামটা এখন তোর জীবনে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত এক পশলা বৃষ্টির মতই। হয় ও তোর রুক্ষ শুষ্ক, খরা ধরা জীবনটাকে বহুকাঙ্ক্ষিত জলের ফোঁটা হয়ে প্রাণপূর্ণ করে তুলবে হয়তো বা ভয়ংকর প্রলয়ঙ্কারী বন্যার মতো সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জীবনে যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুও। কোনো টাই স্থির করে বলা দায় ‘
শ্রীতমার শেষোক্ত কথাটা বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজতে থাকলো মোহরের কানে। আসলেই তো তাই। ওই মানুষটা আদও কি? তাকে কি ভরসা করতে পারবে মোহর? বিশ্বাস করে তার হাতে নিজের অবশিষ্টাংশের বুনিয়াদি সপে দিবে? সেই ভরসার কি প্রতিদান দেবে অপরিজ্ঞাত মানুষটা? সত্যিই কি প্রাণ এনে দেবে নাকি সব ভাসিয়ে দেবে!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️
#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১২
– খেয়াল কোথায় থাকে আপনার!
আচানক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ধ্যান ভেঙে সচকিত হয়ে পাশে তাকালো। মেহরাজ চুলার নব টা ঘুরিয়ে স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে।
– আরেকটু দেরি হলেই তো দুধ উপচে পড়তো, যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন শরীরে ছিটকে পড়তে দেরি হতো নাহ
মোহর হুকচকিয়ে গেল। নিজের এমন বেখেয়ালি আচরণে নিজেরই অপ্রস্তুত লাগছে। কোনো রকম
অপ্রতিভ ভাবে বলল
– আমি খেয়াল করিনি দুঃখিত
– আপনি রান্নাঘরে কেন এসেছেন?
মোহর অপ্রতিভতা সামলে আবারও চুলার নব মুচড়ে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল
– দিদা চা খেতে চেয়েছিলেন তাই
– ভালো মানুষকে চা করতে পাঠিয়েছে, এ তো রান্নাঘরই উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় আছে
অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল মেহরাজ। মোহর ভ্রুকুটি করে বলল
– কিছু বললেন?
– না কিছু না
বলেই ফ্রিজের দিকে গেল। ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল বের করে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে নিলে পেছন থেকে মোহর বলল
– আমি মোটেও রান্নাঘর উড়িয়ে দেওয়ার মতো নই, আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে কিচেন সম্পর্কে
– হ্যাঁ তার নমুনা কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছি
মোহরের যেন আত্মসম্মানে লাগলো। শেষে কি না রান্নাঘর নিয়েও খোটা শুনতে হবে? একটু বেখেয়ালি বশত অন্যকিছুর ভাবনাতে বুদ হয়ে গেছিল বলেই টের পাইনি, তার জন্য নিশ্চয় সে রান্নাঘর উড়িয়ে দেওয়ার মতো মেয়ে নয়।
– সে তো একটু অসাবধান হয়ে গেছিলাম তাই। আপনি না আসলেও আমি ঠিকই সামলে নিতে পারতাম
মেহরাজ কিয়ৎকাল নিরেট চোখে তাকিয়ে রইলো। দুই পা এগিয়ে এসে ফিচেল গলায় বলল
– আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাচ্ছেন মোহমায়া?
মোহর মুহুর্তেই দমে গেল। মূর্ছে গেল হুট করে জ্বলে ওঠা চঞ্চলতা। নাজুক দৃষ্টি নামিয়ে নিলেও পরক্ষণেই মেহরাজের বলা কথাটা উপলব্ধি করে বিব্রত মুখাবয়বে বলল
– মোহমায়া? মানে?
– শুধু মোহ কেমন খালি খালি লাগে। তাই মোহমায়া। নট ব্যাড, সাউন্ডস গুড রাইট?
– আমার নাম মোহর শিকদার। আমাকে আমার নামে ডাকলেই খুশি হবো
-, শুনেছি আগের যুগে অনেকেরই শ্বশুড়বাড়িতে এলে নাম পরিবর্তন হয়ে যেত। নিজের আগের নাম যা ছিল সেটা বাদ দিয়ে স্বামী, শ্বশুরালের নাম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো। বাট দ্যাটস নান অফ মাই বিজনেস। আপনার যাদি আপত্তি থাকে তবে আমি আপনাকে আপনার নিজের নামেই ডাকবো মোহর শিকদার
বলেই পুরু অধর ছড়িয়ে বাকা হেসে স্থানত্যাগ করলো মেহরাজ। মোহর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো খানিক। এই লোকটাকে কি সে আদও বুঝতে পারবে?
সাত পাঁচ ভেবে কাপে চা ঢেলে নিয়ে হাঁটা ধরলো নিচতলার একদম কোনার ঘরের দিকে। কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে শাহারা বেগম ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কতক্ষণ গল্প গুজব করে মোহরকে চা বানানোর কথা শাহারাই বলেছিল। কিন্তু রান্নাঘরে একা দাঁড়িয়ে থেকে শ্রীতমার কথা গুলো বারবার মনে পড়ছিল। আসলেই কি সম্পর্ক টাকে সুযোগ দেওয়া উচিত? কিন্তু এ বাড়ির লোক তো তাকে মানে না, আর মেহরাজের পূর্ব থেকেই একজন বাগদত্তা আছে। সেই বা কি চাই এসবের কিছুই জানে না মোহর। কার ভরসায় ভরসা আনবে ও?
ভাবতে ভাবতেই ঘরটার সামনে এসে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল
– আসবো?
– হ্যাঁ হ্যাঁ আসো। আবার অনুমতির কি দরকার
মোহর ভেতরে ঢুকে শাহারা বেগমের খাটের পাশের টুলটাতে বসলো। কেটলি থেকে চা ঢেলে শাহারা বেগমের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল
– কারো ঘরে ঢুকতে গেলে তো অনুমতি নেওয়া উচিত, তা নয় কি?
– হ্যাঁ তা উচিত। তবে আমার ঘরে ঢুকতে গেলে আর পারমিশন নিতে হবে না, তোকে আজীবনের প্রবেশাধিকার দিয়ে দিলাম। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু ওতো তুমি টুমি করতে পারবো না বাপু
মোহর স্মিত হাসলো। ক্ষীণ শব্দ হলো তাতে। শাহারা বেগম চায়ের কাপটা রেখে নাজুক দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের মায়াভরা ডাগর ডাগর আঁখি জোড়ার দিকে। একটু হাসিতেই চিকচিক করে উঠেছে। মেয়েটা হয়তো নিজেই জানে না সে কতটা মায়াবতী। বৃদ্ধা কুচকানো চামড়ার এক হাত এগিয়ে দিয়ে মোহরের নরম গালে হাত রাখলেন। পৌঢ়া গলার স্বরে খানিকটা শীলতা মিশিয়ে বললেন
– হাসলে কতটা মনোহরী লাগে রে তোকে। সবসময় এভাবে হাসিস না কেন বলতো
মোহর ক্ষীণ শব্দে হাসলো। তাতে বিদ্যমান তাচ্ছিল্য বোধগম্যতার বাইরে ছিলনা বৃদ্ধার। তবুও কৌতুহলী চেয়ে রইলেন। নির্জীব গলায় মেয়েটা বলল
– আমাকে হাসার কোনো কারণ তো উপরওয়ালা দেননি দিদা। একসময় দিয়েছিলেন, অনেক বেশিই দিয়েছিলেন। তখন এতটা হেসেছি তাই হয়তো ফুরিয়ে গেছে আমার হাসির মেয়াদ
মুহুর্তেই মূর্ষে গেল বৃদ্ধার চেহারার খুশিয়াল ঔচ্ছ্বাস। চোখ মুখে জড়ো হলো একরাশ বিষন্নতা। এই বদ্ধ ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে বলা এই যুবতীর কথাটা তার অন্তর আত্মা ছেদ করলো বিভৎসভাবে। আফসোস, এ কথার মর্মার্থ যদি এ বাড়ির লোকেরা বুঝতো। তাহলে হয়তো মেয়েটার প্রতি এহেন নিষ্ঠুরতা আসতো নাহ
– দিদা, তোমার ঘরের টেবিলফ্যানটা কি আছে?
রুক্ষ একটা চিকন নারী কণ্ঠ কানে আসতেই মোহরসহ শাহারা বেগম ও ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। বাইশ তেইশ বছরের একটা মেয়ে। ছিমছাম গড়ন। খোপা করা চুল অবিন্যস্ত অবহেলায় ঘাড়ের কাছে পরে আছে। পরনের বাসন্তী রঙের জামাটা গায়ের রঙের সাথে মিশে গেছে মনে হচ্ছে।
– তাথই এদিকে আই বনু। বস আমার কাছে
– বসতে আসিনি দিদা। তোমার টেবিলফ্যানটা থাকলে দাও
কয়েক কদম এগোতে এগোতে বলল তাথই। কথার মাঝে এক পলক শুধু তাকালো মোহরের দিকে। অভিব্যক্তিতে কিছুই ঠাওর করা গেল না মোহরের প্রতি ওর আচরণ টুকু।
– তোর ঘরের ফ্যানটার কি হয়েছে? চলছে না?
– চলছে। কিন্তু কেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ করছে। একদম ভাল্লাগছে না আমার কোনো শব্দ। তুমি দিবা কি না বলো
– দেবোনা কেন। অবশ্যই দেব। মোহর আমার আলমারিটার পাশের টেবিলের উপরে কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে ফ্যানটা। ওকে দে তো
মোহর কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে, উঠতে গেলে তাথই কর্কশ গলায় বলল
– ও কেন যাবে। আমি নিজেই নিতে পারবো
বলেই এগোতে নিলে মোহর এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি বসুন না আপু। আমি এনে দিলে কি খুব সমস্যা হবে?
তাথই রূঢ় দৃষ্টিতে তাকালেও সেটা স্থায়ি হলো নাহ। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে থপ করে বসলো এতক্ষণ মোহরের বসে থাকা টুলটার উপরে। শাহারা বেগম কেটলি থেকে কাপে চা ঢেলে তাথইয়ের দিকে ধরে বলল
– একটু চা খা বনু। মাথাটা ধরেছে বোধহয় তোর। আরাম লাগবে
– আমার আরামের চিন্তা তোমাদের করতে হবে নাহ। এভাবে আদর আপ্যায়ন করে কি বারবার বুঝিয়ে দিতে চাও আমি এ বাড়ির মেহমান, যাতে আমি এ বাড়িতে না থাকি
– তা কেন হবে বনু। তুই এ বাড়ির বড়ো মেয়ে। তোরই তো বাড়ি।
– থাক আমাকে এসব ভুজুংভাজুং দেওয়ার দরকার নেই। আমাকে ফ্যানটা দিয়েছো ওই যথেষ্ট
মোহর ফ্যানটা এগিয়ে এনে পাশে রাখলে তাথই উঠে দাঁড়ালে মোহর নরম গলায় বলল
– আপু এখানে বসুন না। অসুবিধা হলে আমিই চলে যাচ্ছি। আপনি বিরক্ত হবেন না
– নাম কি তোমার?
হুট করেই কথার মাঝে প্রশ্ন করলো তাথই। মোহর এক নজর তার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
– মোহর
– শোনো মণি নাকি মোহর। আমাকে তেল দিতে এসো না। এটা আমার বাড়ি। আমি কোথায় থাকবো কোথায় সুবিধা সেটা আমিই ভালো বুঝি।
বলেই ফ্যানটা হাত থেকে খপ করে নিয়ে শাহারা বেগমের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল
– আসছি
বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ওর যাওয়ার পানে চেয়ে ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহারা। ভরা গলায় বলল
– কি যে হলো মেয়েটার। আগে এমন ছিল না। কি সুন্দর হাসি হাসি কথা বলতো। আমার ঘর থেকে নড়তই না। বিয়ের পর যাও বা পাল্টেছিল বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে একেবারেই খিটখিটে হয়ে গেছে।
মোহর তাথই এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বসলো আগের স্থানে। শাহারা বেগমের কথা শুনে মৃদু হেসে বলল
– আপুর সমস্যা টা আমি বুঝতে পেরেছি। চিন্তিত হবেন না। শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।
…………………………
পুরো সন্ধ্যা টা পার করে প্রায় রাত আটটার দিকে ঘরে এলো মোহর। শাহারা বেগমের সাথে গল্প করতে করতে এতটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ঘরে আসলেই তো আবারও শূন্যতা হাহাকার ঘিরে ধরে। কংক্রিটের চার দেওয়ালের মাঝে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে যেন। মোহরের ঘরের সাথে একটা বারান্দা আছে, বারান্দা বলা ভুল হবে, ওটা অন্য একটা বারান্দার অংশ। স্লাইডিং উইন্ডো টা খুললে খাছেই ওটা। ঘরের জানালা টা একদম মেঝে পর্যন্ত। প্রথমে দেখলে যে কেও দরজাই ভাববে।
ঘরে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে নিলো। তোয়ালে টা হাত থেকে রেখে জানালার কাঁচটা খানিক সরিয়ে দাঁড়ালো। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। বর্ষাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে শরতের আগমন বার্তায় পুরোদমে
তোড়জোড় শুরু করেছে। থেকে থেকে বৈরী হাওয়ায় রেশমের ন্যায় ফুলের গন্ধ এসে ধাক্কা দিচ্ছে নাকে। এই বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা ঝিল মতো আছে। শহরের বুকে এমন দৃশ্য বেশ দুষ্কর।
বেশ খানিকক্ষণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে, সরে এলো। টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে ঘন্টা চারেক পার হয়ে গেল। রাত প্রায় একটা। ঘরের লাইট বন্ধ করে শুতে এলো মোহর।
বিছানায় শুয়ে খানিক এপাশ ওপাশ করে যেইনা চোখ দু’টো লেগে এসেছে তখনি ধপ করে কিছু পড়ার শব্দে ঘুম ছুটে গেল। মনে হলো শব্দটা জানালার দিক থেকেই আসছে। কিন্তু জানালার নিচে তো ফাঁকা। আর পড়ে যাওয়ার মতো কিছু নেই ও? মনের ভুল ভেবে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করতে নিলে কারো পায়ের শব্দ কানে এলো। মনে হলো কেও গুনগুন করে গান গাইছে।
হুট করেই কেমন ঠান্ডা হয়ে আসলো মোহরের হাত পা। জানালার বাইরে ফিসফিসানির শব্দ ও আসলো কানে। মোহর বিছানা থেকে নেমে গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোনো মেয়েলি কান্না। আর অনেকগুলো মানুষের একসাথে ফিসফিসানির শব্দ। জানালার বাইরে দাঁড়ানোর মতো স্পেস বা রেলিং নেই। তাহলে এখানে কেও কি করে আসতে পারে? ভূতে ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে সে না। তবে এরূপ অভিজ্ঞতাও নেই। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হলো। ধপাস করে স্লাইডিং উইন্ডো টা সরিয়ে দিতেই হুট করে একটা সাদা ছায়া মতো বাতাসে মিশে গেল।
ভয়ে আতংকে হাড় হীম হয়ে এলো মোহরের। ছুটে এলো দরজার দিকে। ছিটকিনি খুলে ফেললেও মোহরের আকস্মিক ভয়কে আরও দ্বিগুণ করে দিল দরজাটা। ঘাবড়ে গেল মোহর এটা কি হচ্ছে ওর সাথে! কয়েকবার চেষ্টা করেও দরজাটা খুলতে পারলো নাহ। সে তো ছিটকিনি ছাড়া কোনো লক করেনি ও। কয়েকবার নব মুচড়েও খুলতে পারলো নাহ। এবার মনে হলো সত্যিই কোনো অশরীরী অপ্রকৃতস্থ কোনো উপস্থিতি টের পেলো নিজের আশেপাশে। প্রচন্ড উদ্বিগ্নতা ঠেলে মনে মনে সাত কালেমা জপ করে ছুটে গিয়ে আবারও নব মুচড়ে দিতেই ফট করে খুলে গেল দরজাটা।
বাইরে যাওয়ার পথ পেয়েই কোনো দিক না ভেবে এক ছুটে বেরিয়ে গেল। দিকবিদিকশুন্য হয়ে এক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের ঘরের সামনে। ঘনঘন দুই তিনবার দরজা ধাক্কালো। তবুও খুলছে না। মোহরের ক্রমশই মনে হচ্ছে বায়বীয় কোনো সূক্ষ্ম উত্তাপ ধেয়ে আসছে ওর দিকে। ভয়বিহ্বলে তটস্থ হয়ে সজোরে ধাক্কা দিতেই দরজা টা খট করে খুলে গেলো। মোহর এক ছুটে গিয়ে ঝাপটে পরলো মেহরাজের প্রশস্ততর বুকটার মাঝে। অবস্থান,পরিস্থিতি ঠাওর করে উঠতে পারার আগেই মোহর আতঙ্কগ্রস্থের মতো বলল
– ও ওহ ওখানে আছে, ওখানে কেও আছে। আমা আমাকে ধরবে। আমাকে ধাওয়া করতে আসছে
– মোহ? কি হয়েছে? কি আছে। দেখি এদিকে তাকান?
ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। হাত পা অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে আসছে। লাল হয়ে আসা মুখটায় জ্বলজ্বল করা চোখ তুলে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলল
– ওই ঘরে কিছু আছে। ভ্ ভূত ভূত আছে। আমি যাবো না যাবো…
বলতে বলতেই প্রচন্ড ভীতিকর পরিস্থিতিতে সমস্ত চিত্ত চেতনা হারিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরলো মেহরাজের বুকের উপর।
মেহরাজ উদ্বিগ্ন হলো না মোটেও। সদা সর্বদা শান্ত মুখাবয়ব বজায় রেখে আলতো ভাবে চাপ’ড়ালো মোহরের গালে। ওর চেতনাহীন অবস্থা টা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত করে মুচকি হাসলো।
অবিলম্বেই কোলে তুলে নিলো মোহরের নিস্তেজ দেহটা। খুব যত্নে আগলে রাখলো খাটের উপরে। বালিশের উপর মাথাটা রেখে চিত করে শুইয়ে দিল। ঘামে ভিজে চুলগুলো মুখের সাথে লেপ্টে আছে। আস্তে আস্তে আঙ্গুলের তর্জনী উঠিয়ে সরিয়ে দিল এক এক করে। নিজের শার্টের হাতাটার কোণা দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সারা মুখের ঘাম মুছে দিল।
হলদেটে লাইটের মৃদু আলোয় মাখামাখি সারা ঘর, সেই আলোতে জ্বলজ্বল করা দুটো ধারালো চোখের দৃষ্টিতে স্থবিব মুখটার দিকে অনড় তাকিয়ে থেকেই জলদগম্ভীর গলায় একরাশ মাদকতা মিশিয়ে বলল
– জানেন মোহমায়া নভমন্ডলের বুকের মধ্যিখানে অবস্থিত ওই চাঁদটার সাথে আপনার ভীষণ মিল। দুটোই মোহনীয়, অদ্ভুত উষসী। দুজনকেই দূর থেকে দেখতে হয়, ধরা ছোঁয়া যায়না। চাঁদকে নাহয় দূরেই থাকতে দিলাম,কিন্তু আপনি তো আমার স্পাইনাল কর্ডের চেয়েও নিকটে। আপনাকে কি করে দূরে রাখি বলুন ।
কিন্তু এভাবেই ভয় পেয়ে যাবেন বুঝতে পারিনি। তবে এমন ভয়ের জন্য যদি আপনাকে আমার দুচোখের সামনে পায় তাহলে তাতে খুব ক্ষতি নেই, তাইনা?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️