ফানাহ্ পর্ব-১০

0
1409

#ফানাহ্ 🖤
#হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১০

ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে এক কোণায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহর। চোখ মুখের অভিব্যক্তি নিতান্তই স্বাভাবিক। তবে আশপাশের পরিবেশ মোটেও শমিতচিত্তে নেই।
আজহার ও আরহাম মুর্তজা দুজনেই কপালে তিন ধাপে বলিরেখার ভাঁজ ফেলে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানাতে মেহরাজের শিথানের দুইপাশে শাহারা বেগম আর মিসেস আম্বি মুর্তজা বসে। শাহারা বেগম ক্ষীণ চেহারায় গম্ভীর হয়ে থাকলেও আম্বি মুর্তজা চুপ নেই। এতক্ষণ বেশ জোরে জোরে কাঁদছিল এখন চুপ হয়ে গেলেও চোখের পানি থেমে নেই। মেহরাজের পাশে বসে খানিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তো আবার কপালে চুমু দিচ্ছেন। আবার জোরে কেঁদে উঠছেন। এই মহিলাকে মোহর যতবার দেখেছে সবসময় গম্ভীর মুখেই পেয়েছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় মেহরাজের এমন রহস্যময়ভাবে গাম্ভীর্যের কারণ হয়তো তার মা। কিন্তু যখনই প্রসঙ্গ আসে মেহরাজের, আম্বি একেবারে মোমের মতো গলে যায়। এরূপ নির্মল, নির্ভেজাল মমতা দেখে মোহরের বুকটা চিড়ে হাহাকার বেড়িয়ে আসে, হয়তো তার মা থাকলেও আজ তার গায়ে একটা ফুলের টোকাতেও কেঁদে উঠতো, কিন্তু তার তো ত্রিভুবনে কেও নেই আর।

-তুমি এভাবে আর কেঁদো না আর, ও তো এখন ভালো আছে

আজহার মুর্তজা এগিয়ে গিয়ে তার বেগমের কাঁধে হাত রেখে বললেন। তবুও থামার বদলে আরও উপচে পড়লো আম্বির কান্না, ধরা গলায় বলল

-আমার ছেলেটা এমন আঘাত পাওয়া শরীরে আমার সামনে শুয়ে আছে আর তুমি আমাকে থামতে বলছো। আমার মানিকের গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত আমি সইতে পারিনা

-মেহরাজ তোমার এ অবস্থা কি করে হলো,আর তুমি আমাদের রাতেই কেন জানাওনি

নড়েচড়ে চোখ খুললো মেহরাজ, বুকের ক্ষত টা খুব বেশি ছিল নাহ। ট্রিটমেন্ট আর ব্যথার ওষুধ টার কারণে এখন খানিকটা ধাতস্থিত। আধখোলা চোখের ক্ষীণ স্বরে বলল

-ছিন’তাইকারি। রাতে ফিরতে দেরি হচ্ছিল বলে শর্টকাটে পেছনের গলি দিয়ে আসছিলাম। রাস্তায় কাওকে পড়ে থাকতে দেখেই গাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম। আর তখনই অ্যা’টাক করেছে

আরহাম মুর্তজা চিন্তিত গলায় আবারও জিজ্ঞাসা করলো

-তোমার আর কোনো ক্ষতি হয়নি তো? ওরা কিছু নিয়ে গেছে?

-নাহ, কিছু নিতে পারেনি বলেই ছু’ড়ি বসিয়ে দিয়েছে লাস্টে, একসাথে পাঁচজন ছিল। নাইট গার্ড রাউন্ডে আসা দেখেই পালিয়েছে।

আজহার সাহেব, বেশ ক্ষুদ্ধ হলো যেন এহেন কথা শুনে। অসন্তোষ জনক স্বরে বললেন

-তুমি এতো রাতে কেন ফিরছিলে মেহরাজ। ইদানীং তুমি নিজেকে নিয়ে একটু বেশিই খামখেয়ালিপনা করো। এর চেয়েও বড়ো কোনো বিপদ হতে পারতো

-আমি ঠিক আছি, একটু খানিই লেগেছে..

-মেহরাজ! কি হয়েছে? এসব কি করে হলো

মেহরাজ নিজের সম্পূর্ণ কথাটা শেষ করার আগেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো তিয়াসা। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল

-তোমার এ অবস্থা কি করে হলো। আন্টির ফোন পেয়ে আমি এক মুহূর্ত দেরি করিনি, ঠিক আছো তুমি?

তিয়াসা উৎকণ্ঠিত হয়ে হড়বড় করে প্রশ্ন করে গেল। সকাল বেলা মোহর নাজমাকে দিয়ে খবর দিয়েছিল শাহারা বেগমকে। আস্তে আস্তে বেলা হতে থাকলে সবার কানে খবরটা যেতেই এ ঘরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেহরাজকে নিয়ে। এসবের ফাঁকে কাকলি সুযোগ বুঝে তিয়াসাকে ফোন করে জানিয়েছে মেহরাজের ব্যপারটা।

-ইটস ওকে, আ’ম বেটার নাও।

-তুই চুপ কর বাবু। বুকের কাছে কতখানি ঘা হয়ে আছে দেখেছিস,আবার বলছিস ঠিক আছিস। কি হলো আমার বাড়িতে কে জানে, কোন ব’দ নজর পড়েছে আমার ছেলের উপর।

-এভাবে কাঁদলে কি সব ঠিক হয়ে যায় আম্বি? ছোটদের মতো আচরণ করো নাহ। শুকরিয়া করো যে দাদুভাই এখন সুস্থ আছে। যা শুনছি তাতে আরও বড়ো কিছু হতে পারতো

শাহারা বেগম এক হাতে তসবিহ গুনতে গুনতে বলল। আম্বি বেগম চুপ হয়ে গেলেও মুখ খানা কালো করে রইলো। তিয়াসা আশপাশে চোখ বুলিয়ে বলল

-বাট রাজ, তুমি এই ঘরে? এই ঘরে কিভাবে আসলে তুমি?

-সেই তো? আমিও এটাই ভাবছি। তুমি এতটা আ’ঘাত পাওয়ার পরেও হসপিটাল যাওনি কেন? আর এই ঘরে..

-মোহর, অল থ্যাংকস টু হার। সী ইজ মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, ওই আমার ট্রিটমেন্ট করেছে রাতে। না হলে হয়তো এখন সুস্থভাবে বসে থাকতে পারতাম নাহ

নিমিষেই তিয়াসার মুখ কালো হয়ে গেল। কাকলিও হয়তো এরকম কিছু প্রত্যাশা করেনি। শাহারা বেগম এবার বললেন

-থাক, অনেক হয়েছে। দাদুভাইয়ের বিশ্রাম দরকার। তোমরা ওকে একা থাকতে দাও। আর আম্বি তুমি গিয়ে হালকা কিছু তৈরি করে আনো, ওর তো একটু কিছু পেটে পরা দরকার

তাইতো,এটা তো মাথায় ই আসেনি তার।আম্বি তড়িঘড়ি করে উঠে গেল মেহরাজের খাবার আনতে। আরহাম মুর্তজার কল আসলে সেও বেড়িয়ে গেল। তিয়াসা বেশ কিছুক্ষণ হাসফাস করে কেমন রুক্ষ গলায় বলল

-মেহরাজ তোমাকে তো নিজের ঘরেও যেতে হবে, এভাবে তো এই ঘরে পরে থাকা যায়না

কথা বলতে বলতে আড়চোখের কটাক্ষমূলক দৃষ্টিতে মোহরের দিকে তাকালো। শাহারা বেগম এহেন কথায় গর্জে উঠলেন খানিক। অসন্তোষ গলায় বললেন

-তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না ওর অবস্থা? উঠে বসতেও তো পারছেনা ঘরে যাবে কি করে!

-আসলে আমি

-আসলে ও অতটা বুঝতে পারেনি, বাচ্চা মানুষ তো। তিয়াসা তুমি আমার সাথে এসো তো, চলো তোমার বড়ো আন্টিকে হেল্প করবে

কাকলি ইতস্তত হয়ে ব্যাপার টা সামাল দিয়ে তিয়াসার হাত ধরে বেড়িয়ে গেল। তিয়াসার একেবারেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা মেহরাজকে রেখে তবুও এক প্রকার জোরপূর্বকই নিয়ে গেল কাকলি।
আজহার মুর্তজা এক পলক চাইলো শান্ত স্থবিরতা পূর্ণ মোহরের চেহারায়। আস্তেধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন ওর কাছে।মোহর তার দিকে তাকালে ওর সমস্ত ভাবনাকে অবাক করে দিয়ে মোহরের মাথায় হাত রাখলেন আজহার মুর্তজা, ধীমি নরম গলায় বললেন

-তোমাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে সেটাও হয়তো স্বার্থবাদীতা দেখাবে। এতদিন তুমি এ বাড়িতে রয়েছো অথচ একটা বার খোঁজ খবর ও নিতে আসিনি। আসলে বিয়েটাই এভাবে হয়েছে যে কেও মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু মেনে নেওয়া হোক বা না হোক,এটা তো সত্য যে তুমি আর মেহরাজ হাসবেন্ড ওয়াইফ। আমার ছেলের এতবড়ো উপকার করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। আর আম্বি বা অন্যদের কথায় মন ছোট করিও না, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে, কেমন?

স্মিতভাবে ঘাড় নাড়ালো মোহর। আজহার মুর্তজার নিকট এহেন অনুষঙ্গপূর্ণ আচারণ নেহাৎ অপ্রত্যাশিত ছিল। তবুও, নিজের বিস্ময় ছাপিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিমা বজায় রাখলো। অতঃপর আজহার মুর্তজাও বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে। শাহারা বেগম তসবিহ বিড় বিড়বিড়াতে খাট থেকে নামলো। মোহরকে চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা করে সেও বেড়িয়ে গেল। রইলো ঘরে মোহর আর মেহরাজ।

বিছানার দিকে তাকিয়ে হুট করেই বুকটা ধুক করে উঠলো মোহরের। পুরো বিছানা জুড়ে শুয়ে আছে দীর্ঘাকার সৌষ্ঠব গড়নের পুরুষটি। চোখ বুঁজে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এক দুই পা এগিয়ে গেল মোহর, নাজুক দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাজের দিকে,তার সামনেই বিছানাতে শুয়ে থাকা এই লোকটা তার স্বামী। তিনবার কবুল বলে যার কাছে নিজেকে সপে দিয়েছে মোহর, গ্রাম ভর্তি লোকজনকে সাক্ষী রেখে যাকে না চাইতেও জীবনের আধিপত্য বিস্তারের অধিকার টা দিয়েছে।
তার এই অসুস্থতায় মোহরের কি উচিত স্ত্রী ধর্ম পালন করা? মোহরের কি উচিত মেহরাজের কি দরকার কি না সহ সমস্ত সেবা শুশ্রূষা করার! নাহ তা কেন করবে, এই বিয়ে তো কেও মানে নাহ! স্বামী-স্ত্রীর মতো কোনো প্রকার বন্ধন তাদের মাঝে নেই। তবে কি চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে স্রেফ সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে নিজেকে দূরে রাখাই উচিত তার?

-মোহর

অতিশয় গভীর প্রগাঢ়কণ্ঠে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মোহরের, এতক্ষণের সমস্ত চিন্তাভাবনা যুক্ত দোটানা জিজ্ঞাংসা ঠুনকো স্বরূপ হারিয়ে গেল। দুবার ঠোঁট ভিজিয়েও উত্তর করতে পারলো নাহ, কণ্ঠনালী যেন কোনো রজ্জুতে আটকে গেছে। ক্ষীণ পা ফেলে আরেক কদম এগোলে মেহরাজ ওর প্রহত গলায় আবারও বললো

-একটু আমার কাছে আসবেন মোহর?

মুহুর্তেই সব জড়তা দ্বৈধীভাব উবে গেল, সংবেশিতের ন্যায় মৃদুমন্দ পায়ে এগিয়ে মেহরাজের পাশে দাঁড়ালো নিঃশব্দে। মেহরাজ ওর সমুদ্রের ন্যায় শীতল চোখ মেলে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে, অন্তরস্পর্শী প্রগাঢ় গলায় বলল

-শুয়ে থেকে আমার পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছে। একা আমি উঠতেও পারছি না, একটু সাহায্য করবেন মোহ?

ক্লান্ত কণ্ঠে নামটুকু শেষ সম্পূর্ণ করতে পারলো না নাকি ইচ্ছে করেই অসম্পূর্ণ রাখলো মেহরাজ? খানিক বিব্রত হলো মোহর, কিন্তু ওকে নাকচ করার মতো কাঠিন্য আনতে পারলো নাহ। পরক্ষণে নিজেই ভাবলো সে তো মেডিক্যাল স্টুডেন্ট তাই রোগীকে সাহায্য করাই তার ধর্ম। এক্ষেত্রে সামনে কে আছে সেটা মূখ্য নয়।
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে পিঠের নিচে একটা হাত দিল,মেহরাজ নিজের হাত মোহরের আরেক হাতে ধরে উঠার চেষ্টা করলে অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো দুজন
মেহরাজের মুখটা একদম মোহরের বুক ছুঁইছুঁই দূরত্বে,ওর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে মোহরের গলা এবং বুকের কাছে। একরাশ জড়তা, অস্থিরতা ঘিরে ধরলো মোহরকে। হাত দুটো অবশ হয়ে আসতে লাগলো, তবুও সর্বশক্তি দিয়ে মেহরাজকে ধরে উঠিয়ে বসালো।

-ধন্যবাদ।

মোহর তৎক্ষনাৎ সরে এলো। ধাতস্থ হয়ে কতগুলো ওষুধ এনে মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো

-এগুলো খেয়ে নিন

মেহরাজ প্রত্যুত্তর করলো নাহ। চুপচাপ ওষুধ গুলো হাতে নিলো। মোহর গ্লাসভর্তি পানি এগিয়ে দিলে চুপচাপ খেয়েও নিল।

-আ আমি একটু আসছি

বলেই এক লহমা দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মোহর। মেহরাজের সামনে থাকাও দায় হয়ে গেছিল ওর। ক্রমশ জড়ত্ব ঝাপটে ধরছে ওকে।
মোহরের বেরিয়ে যাওয়া দেখে গাল বাকিয়ে হাসলো মেহরাজ, মেয়েটার অস্বস্তি, জড়তা বা অস্থিরতা কোনোটাই চক্ষুগোচর হয়নি। বরং বেশ সূক্ষ্মভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছে।

রুমের বাইরে পায়তারা করছে মোহর। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। এতক্ষন শাহারা বেগমের ঘরেই ছিল। আজ মেডিক্যালেও যাওয়া হয়নি। আবারও একটা ক্লাস মিস। কিন্তু এ অবস্থায় বাড়ির বাইরে যাওয়ার কথাটা বলতেও পারেনি। এমনিতেই এ বাড়ির অধিকাংশ মানুষই পায়ে পায়ে দোষ খুঁজে মোহরের।
এতক্ষণ শাহারা বেগমের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলেও এখন তো গোসলেরও সময় হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত একটা জড়তা মোহরকে জেঁকে ধরেছে। মেহরাজের সামনে যেতেও আড়ষ্টতা হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে পায়চারি করে ঘরে ঢুকলো। মেহরাজ ঘুমাচ্ছে। যাক একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ আগেই আম্বি বেড়িয়েছে ঘর থেকে। মেহরাজের শরীরের কথা চিন্তা করে এ ঘরে থাকতে এক চুল আপত্তিও করেনি সে।
মোহর আস্তেধীরে ঘরে ঢুকে কাবার্ড খুলে একটা সুতি জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যে গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলে পেছন থেকে আসা কণ্ঠস্বরে থেমে গেল

-আমার এ ঘরে থাকায় আপনার খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই না?

এরূপ কথা মোহর একেবারেই আশা করেনি। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মেহরাজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। মোহর আমতা-আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই মেহরাজ বলল

-আমি আহত হয়েছি, কিন্তু শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো এখনো একেবারে অচল হয়ে যায়নি। কারো অস্বস্তির কারণ হতে আমি চাইনা। চলে যাচ্ছি আমি

বলেই কনুইয়ে ভর করে উঠতে গেলে মোহর ছুটে এসে মেহরাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল

-এই উঠবেন না, ঘা এখনো তাজা। একটু টান লাগলে ব্লীডিং হতে পারে।

বলে মেহরাজের কৌতুহলী মুখের দিকে তাকিয়ে বলল

-এই ঘর বাড়ি সবই আপনার, আমি আশ্রিতা মাত্র। তাই এখানে কে কোথায় থাকবে তা আমি বলার কেও নই। আর যদি আমার একান্ত সুবিধা অসুবিধার কথা বলেন তাহলে ভুল ভাবছেন আপনি। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাহ। তবুও দয়া করে উঠবেন নাহ

বিছানায় ঠেস দিয়ে গা এলিয়ে দিল মেহরাজ। শানিত গলায় বলল

-তাহলে আমি আছি বলে ঘরে আসতে এতটা দ্বিধা কেন লাগে আপনার?

-আসলে আপনার আমার এক ঘরে থাকাটা বাড়ির লোক সন্তষ জনক চোখে দেখছে না তাই, এড়িয়ে চলাটাই শ্রেয় মনে হয় আমার

-বাড়ির লোকেরা আমাদের বিয়েটাতেও সন্তুষ্ট নয়, বিয়েটাও কি এড়িয়ে যেতে চান?

চোখ তুলে তাকালো মোহর,পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই বলল

-মানিয়ে নেওয়ার মতোও তো নয়

-আমাকে এতটা খারাপ মনে হয়?

-আমি আপনাকে এক বারও খারাপ বলিনি। বরং আমি তো আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ যেই মুহূর্তে আমার নিজের লোকেরাই আমাকে ছুড়ে ফেলেছিল তখন আপনিই দয়া করেছিলেন

-বিয়েটাকে কি শুধুই দয়া মনে হয় মোহ?

ফট করে মেহরাজের দিকে তাকালো মোহর। ওর দৃষ্টির অর্থ বুঝে মেহরাজ নিজেই বলল

-আপনার নামটা বলতে বেশ অন্যরকম লাগে তাই ছোট করে মোহ বললে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?

মোহর না বোধক ঘাড় নাড়ালো। সদ্য গোসল করে আসায় ভেজা চুলগুলো টপকে পানি পরছে। হালকা আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজে একদম নরম প্রস্ফুটিত জারবেরার মতো স্নিগ্ধ দেখালো মোহরকে। ঘন দীর্ঘ আঁখিপল্লবের অনিমেষ নিচে ঝুঁকে থাকা চেহারাটা কোনো শ্রেষ্ঠ কারিগরের হাতের নিপুণতা মনে হলো মেহরাজের নিকট। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো।
মোহর চোখ তুলে তাকালে চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। তড়িৎ চোখ সরিয়ে নিল, নিজেও অস্বস্তিতে জড়িয়ে সরে গেল সামনে থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে থাকলেও মেহরাজের নিষ্পলক দৃষ্টি যে তার দিকেই স্থির হয়ে আছে তা স্পষ্ট দেখতে পেল, সামান্য গলা খাকারি দিয়ে বলল

-আমার দিকে এভাবে তাকাবেন নাহ

-কিভাবে?

একচুল নড়চড় হলো না চাহনির। বিছানাতে আধশোয়া হয়ে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে থেকেই জবাব দিল মেহরাজ। মোহরের ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছে এরকম কারো চাহনির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতে, তবুও ইতস্তত গলায় বলল

-আমার দিকে এভাবে তাকাবেন নাহ। আমার অস্বস্তি হয়

-কেন তাকাবো না

মেহরাজের কথা যেন ভীষণ খামখেয়ালি শোনালো মোহরের কাছে। হুট করেই এহেন আচরণ বোধগম্য হলো নাহ। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল

-কেন তাকাবেন?

-ঘরে আপাতত আপনি ছাড়া কেও নেই যে তার দিকে তাকাবো । আর চোখের সামনে সুন্দর জিনিস থাকলে না তাকানো মানে সেই সৌন্দর্যকে অপমান করা,আমি কাওকে অকারণ অপমান করিনা

মেহরাজের শেষের কথাটুকুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মোহর প্রথম লাইনটাই মাথায় ধরে বলল

-তার মানে যে থাকবে তার দিকেই তাকাবেন তাই তো?

মেহরাজ উত্তর দিলো নাহ। মোহর কাল বিলম্ব না করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলল

-আমি বলব আপনার উচিত তিয়াসার দিকে তাকিয়ে থাকা, সে আপনার বাগদত্তা

-আর আমি যদি বলি আমার উচিত আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা, আপনি আমার বউ!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে