ফানাহ্ পর্ব-০৯

0
1359

#ফানাহ্ 🖤
#হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_০৯

-মেহরাজ আব্রাহাম! মানে এআর গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিস এর ওনার! মেহরাজ আব্রাহাম?

কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো মোহর। মেয়েটি আবারও প্রচণ্ড উৎকণ্ঠিত গলায় বলল

-এসব কিভাবে হলো মেহু, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে নাহ। মানে আন্টি কবে,কিভাবে। আর তোর বিয়েই বা!

-সবই তো শুনলি। এই-ই হয়েছে।

মৃদুমন্দ পা ফেলতে ফেলতে বলল মোহর। ওর হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড় করালো শ্রীতমা, ওকে রাস্তার এক পাশের বেঞ্চিতে বসিয়ে হাতে হাত রেখে বলল

-ভগবান জানে এই কদিনে তোকে কতো না খুঁজেছি আমি। পরপর তিনদিন যখন তুই ক্লাসে এলিনা তখন তোর বাড়িতেও গিয়েছিলাম। সেখানে তুই বা আন্টি কেও ছিল নাহ। অথচ আমি যখন তোদের কথা জানতে চাইলাম তখন তোর চাচী বলল তুই নাকি কোন বড়োলোক ছেলেকে ফা’সিয়ে বিয়ে করে চলে গেছিস। আমার বিশ্বাস হয়নি উনার কথা, আমি মিথিলা আপুর বাড়িতেও গেছিলাম কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য আপুরা কেও বাড়িতে ছিলনা। এই কতগুলো দিনে আমি যে কতবার ঠাকুরের কাছে তোর নামে পূজা দিয়েছি তা বেহিসেবী। তোকে ছাড়া আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছিলো নাহ

বলতে বলতে চোখ ভিজে গেল শ্রীতমার। মেয়েটার এই এক স্বভাব। একটু কিছুতেই কেঁদে ফেলে। ভীষণ নরম মনের, যাকে এ যুগের মানুষ বোকা বলেও সম্বোধন করে থাকে। এতদিন পর মোহরকে দেখে ও কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না, কোনো রকমে ক্লাস গুলো করে বেরিয়েছে

-যে যাই বলুক মেহু, আমি জানি তুই কেমন। পুরো দুনিয়া তোর বিরুদ্ধে প্রমাণ এনে দেখালেও আমি জানি তুই কি। আর মেহরাজ নামের লোকটা সেই না যাকে তুই মাঝ রাস্তায় পরে থাকতে দেখেছিলি?

~

-এই যে এলেন মহারাণী। দুদিন হলো না বাড়িতে এসেছে অথচ মেহরাজের মাথায় হাড়ি ভে’ঙে খাচ্ছে

বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই কাকলির কটুক্তি কানের পর্দা ছেদ করলো। তবে সেসব গায়ে মাখলো না মোহর, এই কদিনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে এ ধরনের কথাবার্তায়। নিরুত্তর পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।

-দাঁড়াও

কাকলির ডাকে পা থামিয়ে দাঁড়ালো মোহর। এই মানুষ টাকে আজ অব্দি ভালো ভাবে কথা বলতে দেখেনি,,সবসময়ই মোহরের সাথে এধরণের আচরণই করে। তবে সেসব আর গায়ে লাগে না ওর

-তোমার সাহস দেখে আশ্চর্য হচ্ছি আমি। যেখানে ছয় মাসের মধ্যে তোমাদের ডিভোর্স ফাইল করার কথা হচ্ছে সেখানে তুমি কি না ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাইরে বাইরে বেড়িয়ে লোকজন জাহির করতে চাও যে তুমি এবাড়ির ছেলেকে বিয়ে করেছ?

-আমি কোনো কিছু জাহির করতে চাচ্ছি না চাচী। আর আমাকে মেহরাজ নিজেই পড়াশোনা আবারও কনটিনিউ করার কথা বলেছে। কলেজে যাওয়ার সাথে লোকজন জাহির করার কিসের সম্পর্ক?

মোহরের ক্লিয়ার কাট স্বীকারোক্তি, অর্থাৎ জবাবে কাকলির মুখ কালো হয়ে এলো। দুদিনের মেয়েটার মুখের উপর জবাব যেন কিছুতেই সহ্য হলো না ওর। ক্ষেপাটে গলায় বলল

-এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হলো আমার সাথে তর্ক করার। কার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি

-তর্ক নয়, আপনি যেকথা বলেছেন তারই উত্তর দিয়েছি। উত্তর আর তর্ক কখনোই এক হতে পারে না

-দেখেছো ভাবী, দেখলে কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি ফুটেছে। প্রথম কদিন তো ভালই ভেজা বেড়ালের মতো মুখ করে থাকতো। এখন কেমন খই ঝরছে মুখ দিয়ে

ঠিক পেছনেই সোফাতে বসে আছে মেহরাজের মা আম্বি। মহিলা মোহরকে একেবারেই পছন্দ করেন না, তবে অহেতুক কথাও বলেন নাহ। যদিও যা বলে তা পুরোটাই ওর বিরুদ্ধেই। কাকলির এহেন অহেতুক ঝগড়াতে বেশ বিরক্ত হলো। চোখ কুচকে কিছু বলবে তার আগেই বাচ্চার চিৎকার শোনা গেল। তন্মধ্যে মালা একটা বাচ্চা কোলে এনে উপস্থিত হয়েছে।

-ম্যাডাম কান্না তো কিছুতেই থামছে না। আর তাথই আপাকে দিতে গেলে বিছানায় ছিটকে রেখে দিচ্ছেন। ওকে ধরছেও নাহ

বলতে বলতে এগিয়ে এলে কাকলি এদিকে ভুলে দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটা কোলে নিল। সেদিনের বাচ্চাটা, যেটা মোহর কোলে নিয়েছিল। নাজমার থেকে শুনেছে এটা তাথই নামের মেয়েটার বাচ্চা। তাথই কাকলি বেগমের বড় মেয়ে। মেয়েটা কেমন হুটহাট আসে আবার চলে যায়। আর প্রত্যেকবারই বাচ্চার সাথে এরূপ রূঢ়তাই লক্ষ্য করা যায়

-দেখি কি হয়েছে, কেন কাঁদছে সোনা বাচ্চা দেখি কান্না থামাও তো

বাচ্চাটাকে নানান কিছু বলে থামানোর চেষ্টা করতে থাকলো কাকলি, কিন্তু কিছুতেই থামার নাম নেই। মিসেস আম্বি এগিয়ে এলো, মালাকে উদ্দেশ্য করে বলল

-ওকে খাইয়েছো কিছু, দেখি দুধ আনো তো?

মালা মেয়েটা এক ছুটে দুধের ফিডার এনে তার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল

-অনেকবার চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। খাচ্ছেও না কিছু।

কাকলি বাচ্চাটাকে শুইয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো খাওয়ানোর। কিছুতে মুখেও তুলছে না। মোহর না চাইতেও এগিয়ে গেলো, অনবরত কান্নার হিড়কে ছোট্ট মুখটা লালাভ বর্ণ হয়ে গেছে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গলাটাও বসে গেছে। ভীষণ মায়া হলো মোহরের। তাই ওদের পরোয়া না করেই কাকলির সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল

-ওকে আমার কাছে দিন

কাকলি অবাক হলো বেশ। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে বলল

-ওকে নিয়ে কি করবা তুমি। দেখছো না কাঁদছে। এসব আদিক্ষেতা দেখাতে আসবে না একদম

মোহরের রাগ হলো এ পর্যায়ে। এইরকম একটা অবস্থাতেও এই মহিলার কটাক্ষ-বানের স্বভাব গেল নাহ। তাই আর শব্দ খরচ না করে কোনো কথা ছাড়াই হুট করে কাকলির হাত থেকে বাচ্চাটা নিয়ে নিল।

-এই কি করছো টা কি তুমি?

কাকলির কথার কোনো পরোয়া না করেই, বাচ্চাটাকে নিয়ে মেঝেতে বসলো। সোফার উপর থেকে একটা কুশান নিয়ে পায়ের উপর রেখে তার উপর বাচ্চাটার মাথা রেখে চিত করে শুয়ালো। ঘাড়ের দিক টা লাল হয়ে আচ্ছে বাচ্চাটার। হাত দিয়ে একটু ধরতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা

-বাচ্চাটা কাঁদছে তুমি দেখতে পাচ্ছো নাহ? ওকে দাও আমার কাছে

আম্বি খাতুনের কোনো কথার উত্তর না করে মালার দিকে তাকিয়ে আদেশ সূচক গলায় মোহর বলল

-একটা বাটিতে করে সরিষার তেল গরম করে আনো

মেয়েটা এহেন কথায় বিব্রত হয়ে তাকালো আম্বি আর কাকলির পানে। মোহর এবার বেশ জোরালো গলায় ধমকে বলল

-তোমাকে কি বলেছি শুনতে পাওনি? যাও!

এ পর্যায়ে মেয়েটা না চাইতেও রান্নাঘর থেকে তেল গরম করে এনে দিল। কাকলি আর আম্বি বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে মোহরের কাণ্ড দেখছে। মোহর গরম তেল হাতের সাথে লাগিয়ে বাচ্চাটার গলার দিকে ধরতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, কাকলি বার কয়েক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও মোহর নিজের কাজ থামাইনি। হালকা গরম তেল আঙ্গুলের ডগায় লাগিয়ে মালিশ করতে থাকলো গলা ঘাড়ের দিকটাতে। এক পর্যায়ে বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল। ওকে তুলে কাঁধের উপরে রাখতেই ঘুমে তলিয়ে গেল। মোহর উঠে বাচ্চাকে কাকলির কোলে দিতে দিতে বলল

-বাচ্চাদের ছয় মাস বা বছর না হওয়া পর্যন্ত ওদের হাড় খুব নমনীয় আর অদৃঢ় হয়, সবচেয়ে বেশি ঘাড়ের কাছের হাড়গুলো। তাই অসাবধানতা বশত যদি টান লাগে বা নাড়াচাড়া কোনো ব্যাঘাত হয় তাহলে ঘাড়ের কাছের হাড়টার স্থানের নড়চড় হয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়। যার কারণে বাচ্চা খাওয়া বা ঘুম কোনোটাই করতে পারেনা। পরেরবার থেকে ওকে দেখে শুনে কোলে নিবেন

বলে মেঝেতে পরে থাকা ব্যাগটা ঘাড়ে তুলতে তুলতে বলল

-হয়তো আমি আপনাদের মতো বড়োলোক, রায়িজ নই। টাকার অভাব থাকলেও আমার শিক্ষার কোনো অভাব নেই। কারো ক্ষতি করা বা সুযোগ নেওয়া আমার উসুল নয়। নেহাৎ পরিস্থিতির স্বীকার আমি। আর কথা যদি ডিভোর্সের হয় তবে তারিখ টা সিউর হয়ে বলে দিয়েন, সময়মত গিয়ে সই করে আসব।

বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। কাকলি আরা আম্বি বেশ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। অন্য সময় হলে হয়তো কাকলি নিজে গিয়ে ঝগড়া করে আসতো, কিন্তু এবার আর কোনো উত্তর পেলোনা দেওয়ার মতো।
ঘরে এসে ব্যাগ টা রেখে ধপ করে বিছানায় বসলো মোহর। সুস্থ হয়েছে আজ দিন দুয়েক। ও জানেনা কিভাবে কিন্তু গতকাল মেহরাজ মোহরের প্রয়োজনীয় সব বইপত্র আনিয়েছে। নিজে এসে মোহরের ঘরে জিনিসগুলো রেখে বলেছিল

‘ ভাববেন না বিয়েটা প্রতিকূল পরিবেশে হয়েছে বলে আপনার আশেপাশে সবকিছুই প্রতিকূলতায় ভরে দেব।আপনি যেভাবে চলছিলেন,যে লক্ষ্য নিয়ে আগাচ্ছিলেন তাই করুন। আর আমার আপনার মাঝে যেটা চলছে সেটা সময়ের উপর ছেড়ে দিন, বিধাতা যেখানে এনে থামাবে সেখান থেকেই নাহয় আমরা শুরু করবো ‘

তারপর আর দেখা হয়নি সেই মানুষ টার সাথে। সকালে মোহরের ঘর থেকে বের হওয়ার আগে সে বেরিয়ে যায়। আর রাতে কখন আসে তার ঠিক নেই। আজ ড্রাইভার রেখে এসেছিল মোহরকে, আর আসার সময় ও সেই এনেছে। মোহরকে একটা ব্যাপার খুব ভাবায় যে মেহরাজ নামক লোকটার সাথে যার যতটা দূরত্ব, মোহরের সব ব্যাপারে তার ততটাই যত্ন। মাঝে মধ্যে মনে হয় লোকটা আদও কি চাই? বিয়ে নামক বন্ধন টা কি সময়ের উপরে ছেড়ে দেওয়ার মতো? যদি তাই করে তবে সময় কোথায় এনে দাঁড় করাবে সব!

_________________

-ম্ মোহর

আহত গলার উপহত কণ্ঠের কাঁপা কাঁপা শব্দ কানে আসতেই দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মোহর। রক্তাক্ত ভয়াবহ শরীর টার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে আঁৎকে উঠলো। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তবৎ শরীরের অবয়ব টা স্পষ্টত কোনো পুরুষের, মোহরের বুঝতে এক চুল ও অসুবিধে হলো না দেহাবয়বের অধিকারীকে।
ছুটে গিয়ে সুইচবোর্ড চেপে ঘরের লাইট জ্বেলে দিল। জানালা থেকে আসা আউটহাউসের আলোতে দৃশ্যমান রক্তাক্ত চেহারাটায় আলো পড়তেই যেন আরো ভয়াবহ হয়ে উঠলো। চিৎকার দিতে গেলেই বিদ্যুতের গতিতে ছুটে এসে মুখ চেপে দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ধরলো মোহরকে। আহত কণ্ঠের জীর্ণশীর্ণ স্বরে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো

-হুসস্,, ডন্ট শাউট। হে্ হেল্প মি

প্রচণ্ড কষ্টে দুটো বাক্য উচ্চারিত করে ঢলে পড়লো মোহরের উপর। মেহরাজের শরীরের ভারে দেওয়ালের সাথে মিশে গেল মোহর। মেহরাজের শরীরের রক্তে ওর নিজের শরীর ও ভিজে যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ নিদারুন ভীতিকর পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে কারেন্ট টাও চলে গেল। বাইরে শোঁ শোঁ হাওয়া বইছে, দাপটের সাথে জানান দিচ্ছে আষাঢ়ে আবহাওয়ার বিচরণের। এই সময়ে প্রায়ই লোডশেডিং হচ্ছে, কিন্তু আজ বাড়ির আইপিএস টাও জ্বলে উঠলো নাহ। বড়লোক বাড়িতে এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কারণ টা বোধগম্য হলো না মোহরের।
মেহরাজের দূর্বল শরীরটা যেন পুরো ভার ছেড়ে দিলো, মোহরের উপরে শরীর ছেড়ে ঝুঁকে পড়লো, ঢলে পড়ার সাথে মোহরের ঘাড়ের মধ্যে চিবুক ছুঁয়ে গেল মেহরাজের। এহেন টানটান পীড়িত দশায় ও মোহরের শরীর জুড়ে দক্ষিণা শৈথিল্যের অনিল চড়ে উঠলো। বুকের বা-পাশের ছোট্ট জায়গা টাতে খরস্রোতা নদীর মতো উত্থাল প্রবাহ উদ্যমচিত্তে হামাল তুললো।
মেহরাজের অস্ফুটে গোঙ্গানি কানে আসতেই সচকিত হলো মোহর, কোনো রকম হাত বাড়িয়ে টেবিলের পাশে থাকা লাইট টা জ্বালালো। মেহরাজের ভারি শরীর টা খুব কষ্টে সোজা করতেই প্রচণ্ডরকম আতঙ্কে রোঁমচিত হয়ে উঠলো। আঁতকে ওঠা গলায় বলল

-আপ্ আপনাকে তো ছুড়ি মা’রা হয়েছে, এক্ষুনি হসপিটাল যেতে হবে, নাহলে অনেক বড়..

-হসপিটাল নাহ, বাড়ির কাওকে জানানো যাবে নাহ। তুমি কিছু করো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মোহ…

নামটাও পুরোটা উচ্চারণের পূর্বেই সর্বচিত্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জ্ঞান হারালো। মোহর ধরতে গেলেও মেহরাজের শরীরের ভর সামলাতে পারলো নাহ। ফ্লোরে লুটিয়ে পরতেই মোহরের ভয় উচ্চহারে বেড়ে গেল। একে তো বৃষ্টিমুখর নিশুতি রাত, তার উপর কারেন্ট নেই। ল্যাম্পের মৃদু আলোতে মেহরাজের ফর্সা ঘর্মাক্ত চেহারাটা ভীষণ মায়াভরা লাগলো। ফ্যাকাসে ঠোঁট রুক্ষ শুষ্ক হয়ে চামড়া টনটনে দেখাচ্ছে যেন একটু টোকা লাগলেই রক্ত বেরিয়ে যাবে।
মোহর বার কয়েক মেহরাজের গাল চাপ’ড়ালো। ভয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলো, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনো মতে মেহরাজের শরীর টা টেনে বেড পর্যন্ত নিয়ে খাটে তুললো। মেহরাজের আধো আধো জ্ঞান হয়তো ছিল যার দরুন খাটে তুলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তার পর হাজার চেষ্টা করেও কোনো সাড়া শব্দ পেল নাহ। হাত পায়ের তালু ঠান্ডা হয়ে এলো মোহরের। মেহরাজের অবস্থা ভালো না, সারা শরীরে রক্তে ভিজে জবজবে। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করলো মোহর। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাজের দিকে, ওকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এখন মোহর নিজে!

মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হিসেবে এধরণের অভিজ্ঞতা ওর কাছে নতুন নয়, কিন্তু এবারে একেবারেই একা। তার উপর সামনের মানুষ টার অবস্থা কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না ওকে। তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো, খুব সাবধানে ল্যাম্প টা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ালো। মেহরাজের ঘরে থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার ওর আলমারি খোলার সময় ভেতরে সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস এর বক্স দেখেছে, তাই কোনো কিছু না ভেবে ছুটে গেল মেহরাজের ঘরে। আলমারি খুলে কয়েক মুহূর্ত খোঁজার পর পেয়েও গেল কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা।
আবারও ছুটতে ছুটতে এলো নিজের ঘরে। রাত তখন প্রায় একটা ছুঁইছুঁই। আব্রাহাম ম্যানসন জুড়ে নিস্তব্ধতার প্রখর দাপট। এর মাঝে নিজের এক একটা পদধ্বনিও যেন প্রবল শব্দের সৃষ্টি করছে।
সব সরঞ্জাম গুলো এনে বসলো মেহরাজের পাশে, গলা মুখ ক্রমশ শুকিয়ে আসছে মোহরের, তবুও চরম উৎকণ্ঠা, ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা দমিয়ে বার বার উচ্চারণ করলো

-তোকে পারতেই হবে মোহর, পারতেই হবে

কাঁপা কাঁপা হাতে ইতিপূর্বে আধছেঁড়া শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। মেহরাজ কোনো নড়চড় ছাড়াই পরে আছে বিছানায়। তুলা বের করে সারা বুকে লেগে থাকা র’ক্ত পরিষ্কার করলো। স্যাভলনে ভিজিয়ে ক্ষ’ত স্থানে চেপে ধরলো, ক্ষ’ত টা খুব বেশি না কিন্তু মেহরাজের পোশাকে র’ক্তের পরিমাণ টা তুলনামূলক বেশি!
মোহরের অন্যরকম ঠেকলো ব্যাপারটা, শরীরে ক্ষ’ত অনুযায়ী অতখানি ব্লিডিং হওয়ার কথা না!
তবুও সেসব ভাবনা বাদ দিয়ে আবারও নিজের কাজ শুরু করলো। অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিল পেটের ডান পাশটায়। হাতের কবজিতে হাত রাখলো মোহর, খুব ক্ষীণ গতিতে চলছে পালসরেট। এ অবস্থায় হসপিটাল ছাড়া এতো বড়ো পদক্ষেপ মানেই ঝুঁকির প্রবলতা। তবুও হার মানলো না মোহর। দীর্ঘসময় ধরে ব্যান্ডেজ করে অপেক্ষা করলো পালসরেট স্বাভাবিক হওয়ার।

ক্লান্ত শরীরে খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিলো মোহর। ঘড়ির কাটার দিকে তাকালে ছোট-বড়ো কাটা খুব সূক্ষ্মতার সাথেই ইঙ্গিত দিল সময়টা তিনটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ঝুম শব্দটা মৃদু শোনাচ্ছে। আশেপাশে কোথাও হয়তো টিনের ঘর আছে যার উপরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ায় এহেন শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু এই প্রাসাদতুল্য বাড়িটাতে টিনের চাল কোথায় থাকবে! হাজারো ভাবনার ছেদ ঘটলো দূর হতে আসা মধুর ধ্বনিতে। নতুন দিনকে স্বাগতম করতে সদ্য প্রস্ফুটিত কুড়ির মতন রজনী চিড়ে ভোরের আগমনের জানান দিলো আজানের সুমিষ্ট ধ্বনি। মোহর নির্ঘুম রাতের শেষে ক্লান্ত চোখে তাকালো মেহরাজের দিকে। নিস্তেজ শরীরে ঘুমিয়ে আছে, মোহর-ই ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল, কেননা এই ব্যথাটার জন্যে ঘুম অত্যাবশকীয়।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, ওয়াশরুম থেকে ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পরে নিল, অতিরিক্ত সুন্নত ও আদায় করলো। কেন তা পড়লো মোহর নিজেও যানে না, সুধু বিনীত গলায় করুন আর্জি রেখে দুহাত তুলে বলল

-হে আমার রব, আসমান জমিনের একচ্ছত্র মালিক, মহা-পরাক্রমশালী! আপনি দয়ালু,রহমানুর রাহিম। দুনায়াবি সমস্ত সমস্যার সমাধান শুধুই এবং একমাত্র আপনি। আমার জীবন কোনদিকে, কিভাবে বয়ে যাচ্ছে আমি জানি নাহ। শুধু এতটুকুই জানি আমার রব আমাকে কখনোই নিরাশ করবে নাহ। সেই ভরসায় পরিবার, পরিজন হীনা জীবনে বেনামি একটা সম্পর্কের ভার নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। কারণ আমি মানি আমার রব উত্তম পরিকল্পনাকারি। তিনি যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।
তবুও আপনার নিকট একান্ত অনুরোধ আপনি তার রোগ-বালাই বেদনা যন্ত্রণা দূরীভূত করে সুস্থ করে দিন। কেন জানি নাহ ওই মানুষটার ব্যথা যন্ত্রণা আমার সহ্য হচ্ছে নাহ, আপনি তাকে খুব শীঘ্রই আরোগ্য দান করুন।

আরও কিছু দোয়া করে উঠে দাঁড়ালো মোহর। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকালো। এখনো দারোয়ান টাও আসেনি। মেহরাজের কালো রঙের মার্সিডিজ টা দাঁড়িয়ে আছে গ্যারাজের বাইরে।
মেহরাজের অবস্থা আপাতত সুস্থ হলেও মোহরের মনের ভেতর হাজারো প্রশ্নের সমাহার। কি হয়েছিল রাতে? মেহরাজ এভাবে আহত হলো কিভাবে? আর কেনোই বা হসপিটালে যেতে চাননি? এমনকি বাড়ির কাওকেও জানাতে চাইনি!
নিঃশব্দে গিয়ে বসলো মেহরাজের পাশে। ঘুমন্ত অবস্থায় মেহরাজের চেহারা টা আরও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে। খাড়া নাক, ধারালো চোয়াল, ঘন ভ্রু যুগল, কালচে খয়েরী ঠোঁট। থুতনিতে একটা তিল ও আছে। মেহরাজের সাথে ওর চেহারা টাও কেন যে রহস্যময় লাগে মোহরের।
পরমুহূর্তেই নিজেকে বুঝ দেয়, এক এক জন মানুষের এক এক রকম চেহারা, হয়তো মেহরাজের বংশের কেও এমন ছিল। ভীষণ ভর্সা,লম্বা, সুদর্শন।
ভাবতে ভাবতে হেডবোর্ডে হেলান দিয়েই চোখ বুজলো মোহর, মিনিট খানেকের মধ্যেই চোখ জুড়ে ভর করলো কড়া ঘুম।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে