ফানাহ্ পর্ব-০৮

0
1393

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_০৮

-আরে বাবা তুমি কাঁদছো কেন, মেহরাজ শুধু তোমাকেই ভালোবাসবে, ওই মেয়ে অসুস্থ বলেই ওর দেখভাল করছে, তাছাড়া কিছুই নাহ

-নো আন্টি, আমি নিজে কানে শুনেছি। রাজ ডক্টরকে নিজে মুখে বলেছে মোহর ওর ওয়াইফ। আপনারা তো বলেছিলেন এই বিয়ের কথা বাড়ির বাইরে যাবে নাহ, আর যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স করিয়ে দেবেন। তাহলে এখন কেন পাবলিক হচ্ছে, ডক্টর যখন জেনেছে বাকিদের জানতে দেরি কই

কথাটুকু প্রায় অসম্পূর্ণ রেখেই আবারও কাঁদতে আরম্ভ করলো তিয়াসা, আব্রাহাম ম্যানসনেই বসে, বিশালাকার ড্রয়িং রুমটার মধ্যবর্তী ডিভানে বসে আছে। দুপাশে কাকলি আর আম্বি বসে। কাকলি তিয়াসাকে শান্তনা দিলেও আম্বি গম্ভিরমুখো হয়েই বসে আছে। মেহরাজের অন্য মেয়ের প্রতি এতটা উৎকন্ঠা বারবার তার মনে নিছক ভাবনার উৎপত্তি ঘটাচ্ছে, বারংবার মনে হচ্ছে সত্যিই কাকলির কথাটাই ফলে যাবে না তো? এই মেয়ে তার ছেলেকে, তার প্রাণাধিক প্রিয় মানিককে ছিনিয়ে নেবে না তো! ভাবতেই আঁৎকে উঠছে অন্তস্থল।

-আন্টি আপনি কেন কিছু বলছেন না, রাজ ওই মেয়েকেই নিজের বউ হিসেবে মেনে নেবে না তো? তাইলে আমার কি হবে, আই লাভ হিম সো মাচ!

তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে মিসেস আম্বির দিকে ফিরে বলল, ভাবনাচ্যুত হলো ভদ্রমহিলার। নির্লিপ্ততার গুমোট চিন্তাভাবনা ছেড়ে মুখাবয়ব কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক করলেন। সামান্য হাসার প্রচেষ্টা করে বললেন

-তুমি একদম চিন্তা করো না বেটা, এরকম কিছুই হবে নাহ। আর ডক্টরের সাথে আমি কথা বলে নেব। উনি আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, বাড়ির খুটিনাটি অনেক কিছু সম্পর্কেই তিনি অবগত। আমি নিষেধ করে দিলে কথাটা উনি নিজের মাঝেই রাখবেন

-দেখলে তো, ভাবীও বলছে। এবার তুমি শান্ত হও তো মা।

কাকলি তিয়াসাকে শান্ত করে, উঠে দাঁড়ালো হাঁক ছেড়ে মালা কে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে ট্রে হাতে বেড়িয়ে এলো অল্পবয়স্ক চিকন চাকন শরীরের মেয়েটি।

-এই যে ম্যাডাম আপনাদের কফি।

কাকলি একটা কাপ তুলে তিয়াসার হাতে দিয়ে বলল

-কফি খাও, রিলিফ লাগবে। আর এসব ব্যাপারে এতো প্যানিকড হয়ে যাবে না তো। কোথায় তুমি আর কোথায় ওই দুদিনের মেয়ে। মেহরাজকে চেনো না? যিনিস যত দামিই হোক, ওর প্রয়োজন, ইন্টারেস্ট ফুরিয়ে গেলে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে, এ তো দু টাকার মেয়ে। কয়েকটা দিন যেতে দাও,নিজেই দেখতে পাবে।

..…………………

নীরন্ধ্র পরিবেশ, আশেপাশে কোনো কলরব নেই,নেই কোনো আনন্দ,হাসি খুশি নাইবা আমেজ। এইতো কয়েকটা মাস আগেই তো,,বাড়ি ভরা পুলকিত আমেজ ছিল। ছোট্ট একটা বাড়িতে বাবা মা, ছোট বোনটা মিলে কতই না আদুরে সংসার ছিল। সবসময় সাথে না থাকতে পারলেও মাঝে মধ্যেই বাবা মায়ের কাছে গিয়ে আদরের ভাগ বসাতো। কোথায় গেল সেসব? কোথায় হারালো সুখের দিনগুলো। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! ছোট্ট সুখে ভরা নীড়ে কার বদ নজর লাগলো?
এখনো স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে দীর্ঘ দুইদিন পর নদীর পানি থেকে তুলে আনা ফুলে ফেঁপে ওঠা অর্ধপচন ধরা বাবার লা’শটার মুখশ্রী। ভাবতেই চোখ মুখ মুদে এলো মিথিলার, প্রাণপ্রিয় ভালোবাসার মানুষের ওই ভয়ানক মুখশ্রীতে দৃষ্টি রাখতে পারেনি কেও। দুই বোন কোনো ভাবে সামলে নিলেও মা পারেনি, বাবার বিভৎস লা’শের চেহারা দেখে সেদিনই স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যায়। নিঃস্ব দুনিয়ায় একমাত্র সম্বল ছিল জীর্ণ শীর্ণকায় শরীরের মায়ের ওই অংশটুকুই। সেটুকুও মাটির তলে মিশে গেল।

উন্মত্ত ক্লান্তি,কষ্টে,বেদনায় দম বন্ধ হয়ে আসলো মিথিলার। তবে চোখ বেয়ে এক ফোঁটাও পানি পড়লো না।এই কয়দিনে কাঁদতে কাঁদতে যেন চোখের পানিও ফুরিয়ে গেছে

-মিথি?

ফ্যাকাসে মুখ খানা স্থবির হয়েই রইলো, ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসলো ইফাজ। স্থিতিশীল,দৃঢ় হাতের স্পর্শ রাখলো কাঁধে, নরম গলায় বলল

-আর কতদিন এভাবে থাকবে মিথি, তোমাকে এভাবে দেখে আমার কতটা আঘাত লাগে বোঝো না? আমার কথা নাহয় নাই ভাবলে ঝুমুর কথা টা একবার ভাবো, মা কে না পেয়ে ওর অবস্থা টা কিরূপ হচ্ছে।

তবুও ঘাড় নামিয়ে রইলো মিথিলা, ইফাজের ওই মোহাভরা চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই। ওর দিকে তাকালে আবারও ভেঙে পরবে সব ভুলে বেহায়া অশ্রু আবারও বাঁধ ভাঙবে।
ইফাজ মিথিলার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরালো। থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঁচিয়ে বলল

-যা হয়েছে তার উপর কারো হাত নেই, বিধাতার এই নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত না চাইলেও মেনে নিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু তা বলে তো জীবন থেমে থাকছে না মিথি, তুমি কেন থেমে আছো? সেদিনের পর কতগুলো দিন পার হয়ে গেছে তুমি না কথা বলো, না ঠিকমতো খাও, নাইবা নিজের সন্তানের দিকে তাকাও। তুমি বেঁচে থাকতেই ওকে মায়ের অভাব টা কেন বোঝাচ্ছো? তুমি কি জানো না তোমার হাসিমুখ না দেখলে আমি শান্তি পাইনা? এই চার দেওয়ালের ঘরে তুমি ছাড়া আর কেইবা আছে আমার!

গা কাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো মিথিলা, ঝাপিয়ে পড়লো ইফাজের বুকের মাঝে, বক্ষস্থলের মধ্যিখানে মুখ ডুবিয়ে কেঁদে উঠলো সশব্দে, আহাজারি করতে করতে বলল

-আমি কি করবো ইফাজ, কোথায় যাব। আমারতো কেও রইলো না গো, বাবা পরে মাও চলে গেলো। বোনটা কোথায় গেছে জানি নাহ। আমি কি করে হাসবো বলো। আল্লাহ্ এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলো। আমার সব কেড়ে নিলো ইফাজ, সব কেড়ে নিলো।

কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধ হয়ে আসার জো মিথিলার, ইফাজ শক্ত হাতের বাহুবন্ধনীতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রাখলো সহধর্মিণীকে। মাথায় চুমু দিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল

-আমি আছি তো, আমি তুমি আর আমাদের সন্তান। আমরা সবাই আছি। কেন একা ভাবছো নিজেকে? দুনিয়ার নিয়মই তো এমন। যে এসেছে তাকে তো যেতে হবেই, আটকানোর সাধ্য কার আছে বলো, হয় আগে নয় পরে যেতে তো হতই।

ইফাজের বুক থেকে মাথা তুললো মিথিলা, কান্নার দাপটে সারা মুখ লাল হয়ে গেছে, দম বন্ধ হয়ে আসা ফূঁপানিতেও ভাঙা ভাঙা গলায় বলল

-এই দুই হাত দিয়ে আমি ওকে মে’রেছি, ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি ইফাজ যেই হাতেই আমি ওকে খাইয়ে দিয়েছি, কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুম পারিয়েছি। যেই বোনকে ধমকে দিলেও আমার চোখে পানি এসে যেত সেই বোনকেই আমি নিজ হাতে মে’রে বের করে দিয়েছি। ও কোথায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানি নাহ। আমার ছোট্ট বোনটাকে না খাইয়ে আমি কখনো খাইনি, ওকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে খাবার কিভাবে নামবে বলো। এতো যন্ত্রণার ভার আমি কিভাবে বইবো বলো না ইফাজ। এমন কেনো হলো, আমি কিভাবে একটু শান্তি পাবো বলো আল্লাহ্ আমাকেও নিয়ে গেলো না কেন বলো না

ইফাজ আবারও জড়িয়ে ধরলো মিথিলাকে, শক্তভাবে, প্রচন্ড দৃঢ়ভাবে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো মিথিলাকে। পরপর কয়েকবার ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চুম্বন এঁকে দিল। মুখ ঘুরিয়ে নিল দূর জানালার দিকে।
হয়তো নিজের চোখের পানি দেখাবে না বলে। মিথিলার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ওর কাছে নেই, দুনিয়ায় কোন প্রান্তে এই জবাব গুলো আছে ও জানে নাহ। শুধু এতটুকুই জানে এ অবস্থা আর সহ্য হচ্ছে না ওর, প্রিয়সিনীর এরূপ নির্জীব হাহাকার আর সহ্য হয়না ওর। কোথায় গেল ওর হাসিখুশি বউটা, যার মুখদর্শন করলে সারাটা দিন ধন্য হতো, কোথায় গেল ওর ছোট্ট মেয়ে আর বউকে নিয়ে সুখের সংসার। শান্তি কবে ফিরবে ওর নীড়ে, কবে আবারও স্বাভাবিক হবে সব?

………………………..

সন্ধ্যা নেমেছে অনেক্ষণ, পুরো ঘর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। উত্তরের জানালা দিয়েও হিম আনিল তড়বড় করে ঢুকছে। মেহরাজ উঠে গিয়ে বিরাট কাচেঁর স্লাইড জানালা টা বন্ধ করে দিল। আবারও এসে বসলো খাটের একদম সম্মুখ বরাবর ডিভানে। অনড় দৃষ্টি নিবন্ধিত মোহরের দিকে, বিছানায় অসাড় ঘুমে বুদ। চিকন লতানো শরীরটা দৌর্বল্যের দাপটে বিছানার সাথে যেন মিশে আছে। সকাল থেকে একভাবে ঘুমুচ্ছে মোহর, কড়ামাত্রায় ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ার ফলে সুদীর্ঘ সাত ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরেও ঘুম ভাঙেনি মোহরের।

আরো বেশ কিছুক্ষণ যাপিত হলে চোখ টিপটিপ করে ওঠে মোহরের, মাথার প্রচন্ড ভারি মনে হচ্ছে, ক্ষিধেতে পেটের ভেতরে প্রবল ভাবে মুচড়ে উঠছে। আস্তে আস্তে ঝাপসা দৃষ্টি মেলে তাকালো,বায়ুশূন্য লাগছে , মুখ জুড়ে তিতকুটে হয়ে আছে, শুষ্ক কাঠকাঠ হয়ে আসা কণ্ঠনালী থেকে শব্দ নিঃসৃত হলো না চেষ্টা করেও।
আস্তেধীরে ঘাড় ফেরালে আবারও সেই বৃহৎ কাঁচের আয়নাটার দিকে চোখ গেলেও ধক করে উঠলো বক্ষস্থল। ঝাপসা জিরো বাল্বের লালচে আলোতে স্পষ্ট একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে আয়নাতে। স্থির, স্থবির, অনড় অবস্থায় বসে আছে একটা দেহাবয়ব।
দূর্বল শরীরেও হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মোহর, অবিলম্বে সফেদ আলোতে ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। বিছানার সামনাসামনি ডিভানে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অবিচলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে, গায়ে কালো রঙ জড়ানো থাকায় ঝাপসা আলোতে ঠাওর করে উঠতে পারেনি, ভড়তে যাওয়া গলায় কোনো শব্দ উচ্চারণের আগেই মেহরাজের পরিমিত সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে আওয়াজ আসলো,

-রিল্যাক্স, আমি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন কেমন লাগছে?

মোহর প্রত্যুত্তর করলো নাহ। মেহরাজ ডিভান থেকে উঠে দাঁড়ালো, এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো মোহরের দিকে, মোহর নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইলেও শরীরের দূর্বলতার কাছে হার মেনে বসে রইলো অবিন্যস্ত মনবস্থায়। মেহরাজ এগিয়ে এসে মোহরের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ওকে কিছু ভাববার সুযোগ না দিয়েই কপালে হাত রাখলো। কেঁপে উঠলো মোহর শীতল স্পর্শে।

-এখন কেমন লাগছে?

মেহরাজের সুস্থির কন্ঠটাও মোহরের অদ্ভুত ঠেকলো। নিরুত্তর রইলো।

-একা নামতে পারবে? ফ্রেশ হওয়া দরকার

মোহর আস্তেধীরে নড়েচড়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। সারাদিন পেটে কিছু না পড়ায় ক্ষুধায় সারা শরীরের শক্তি ফুরিয়ে গেছে। তবুও বহু কষ্টে সংযতচিত্তে পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। দীর্ঘ বিশ মিনিট ব্যয় করে ফ্রেশ হয়ে বেরোলেও মেহরাজকে দেখতে পেলো নাহ। নাজমা দাঁড়িয়ে আছে গালভর্তি হাসি আর সামনে খাবারের ট্রে সাজিয়ে, মোহর এগিয়ে আসতেই ট্রে টা রেখে তোয়ালে এগিয়ে দিল, মুখ মুছে বসলো মোহর

-আপনাকে এই সব খাবার গুলো খেতে বলেছেন ছোট সাহেব। অনেকগুলো ওষুধ ও খেতে হবে

পেটের মধ্যে ক্ষিধের জ্বালায় ব্যথা শুরু হয়েছিল তাই কোনোরূপ অবাধ্যতা না করে গপাগপ সব খাবার গুলো খেয়ে নিল মোহর, নাজমা বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মোহরের খাওয়ার দিকে। সব খাবার শেষে নাজমার দিকে তাকালে চোখাচোখি হওয়ার বেশ অপ্রস্তুত গলায় নাজমা বলল

-আপনার মনে হয় খুব ক্ষিধে পেয়েছিল তাই না?

মোহর ভ্রু কুচকে তাকালে,পরক্ষণেই নিজের বোকামি বুঝতে পেরে জিহ্বে কামড় দিয়ে কতগুলো ওষুধ মোহরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

-এইগুলো এক্ষুনি খেয়ে নিন। আমি প্লেট গুলো নিয়ে যায়

মোহর ওষুধ গুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ততক্ষণে পেছনে একটা শব্দ হতেই ঘুরে দাঁড়ালো। মেহরাজ বৃহদাকার স্লাইডিং ডোর টা খুলে ভেতরে ঢুকলো। তার মানে এতক্ষণ এখানেই ছিল সে!
ভাবনার মাঝেই মেহরাজ এসে দাঁড়ালো ওর সামনে, মোহরের হাত থেকে ওষুধের প্যাকেট গুলো নিয়ে ওষুধ বের করে ওর হাতে দিলো। অনিমেষ তাকিয়ে রইলো মোহর, ওষুধ গুলো খেয়েও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

-বসুন এখানে

খাটের দিকে ইশারা করে বলল মেহরাজ। মোহর কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো। সকালে জ্ঞান ফিরলে ঘোরে বশে উম্মাদের ন্যায় আচরণ করলেও স্পষ্ট মনে আছে তখন মেহরাজ ওকে তুমি করেই বলেছিল, এখন আবার আপনি করে বলছে

-বেটার লাগছে?

ভাবনাচ্যত হলে বার দুয়েক ঘাড় নাড়ালো মোহর, মেহরাজ আবারও ডিভান টাতে বসেছে, রাত হয়েছে প্রায়। মেহরাজের সামনে এভাবে বসে থাকার মতো প্রবল বিড়ম্বনা হয়তো আর দুটো হবে নাহ। জড়াতা সুলভ গলায় জড়ানো কণ্ঠে মোহর বলল

-আ আমি ঘরে যেতে চাই

-এটা কি ঘর না?

এক হাত মুখের কাছে রাখা, ভয়ানক তীক্ষ্ণ ধূসর চোখের ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডিভানে হেলান দেওয়া অবস্থায় বলল মেহরাজ। মোহর আমতাআমতা করে বলল

-এটা আপনার ঘর, এখানে থাকাটা অবশ্যই উচিত হবে নাহ

-ঘরটা যেহেতু আমার তাই এখানে কার থাকা উচিত আর কার অনুচিত সেটাও আমাকেই ভাবতে দিন

-আমি থাকলে আপনার অবশ্যই অসুবিধা হবে, যাকে তাকে তো আর নিজের ঘরে রাখবেন নাহ মি.মেহরাজ

-যাকে তাকে রাখিনি মিসেস মোহর।

মোহর আড়চোখে তাকালো কিন্তু কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই মেহরাজ জিজ্ঞাসা করলো

-কে ছুঁয়েছিল আপনাকে? কার কথা বলছিলেন আপনি?

মুহুর্তেই চোখ দু’টো জ্বলে উঠলো মোহরের, বিভৎস দৃশ্য মনে আসলো। তার চেয়ে বেশি আতংকিত হলো মেহরাজের হাতের দিকে তাকিয়ে, প্রথমে না চাইতেও সন্দেহের তীর টা মেহরাজের দিকে এসেছিল। কিন্তু মোহরের স্পষ্ট মনে আছে সেই অজানা আগন্তুক যখন ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিলো তখন মোহর সর্বশক্তি দিয়ে খামচে দিয়েছিল সেই মানুষ টার মুখ গলা হাত সব। কিন্তু মেহরাজের মুখ গলা বা হাতে এরূপ কোনো চিহ্নই নেই, এক বেলার মধ্যে নিশ্চয় দাগ মুছে যাবে না!
তবে সে কে, এ বাড়িতে এমন কে আছে! নোমান কাল দুপুরেই চলে গেছে, আর বয়স্ক মানুষ গুলোর সাথে মোহরের দেখা হয়না বললেই চলে। থরথর করে কেঁপে উঠলো মোহরের অন্তঃস্থল, ভয়ে আতংকে অপ্রতিভ হয়ে উঠলো।

-আমি ঘরে যেতে চাই, এখানে থাকবো না

-আপনাকে এ ঘরেই থাকতে হবে। এ্যাট লিস্ট যতদিন না সুস্থ হন

-আমি সুস্থ আছি, আমাকে জোর করতে পারেন না আপনি। কেন থাকবো আমি আপনার সাথে, কে হন আপনি।এখানে কেও ভালো নাহ কেও না। যত দ্রুত সম্ভব আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। না এই বাড়ি না এখানকার মানুষজন কেও ভালো নাহ, দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। যেই বিয়ের কোনো মানেই হয়না সেটা ধরে বসে থাকার কোনো মানেই হয়না

একদম বলে হাফিয়ে উঠলো মোহর, বড় বড় পা ফেলে দরজার দিকে যেতে গেলেই একদম সামনে এসে দাঁড়ালো মেহরাজ। ওর তীক্ষ্ণ নজরকে আরেক ধাপ শানিত করে বলল

-আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন নাহ মোহর, কোনো প্রকার দ্বিরুক্তি করলে আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাবে, আর এটা অবশ্যই শুভকর হবে না আপনার জন্য।

মাথা তুলে তাকালো মোহর দীর্ঘাদেহি পুরুষের পানে, স্থির নির্লিপ্ত মুখাবয়বেও ভয়ংকর রাগ দেখতে পেলো মোহর, তড়িৎ চোখ সরালো। মেহরাজের অতি মাত্রায় অদ্ভুত চোখে নিজের সর্বনাশ যেন স্পষ্ট দৃশে দেখতে পেল মোহর। অবিন্যস্ত চাহনিত্র ভীত ঢোক গিললো। মৃদুমন্দ পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে খাটের উপরর বসলো, বুক ফেটে কান্না আসছে ওর, কিচ্ছু ভালো ঠেকছে না, এখানে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে মোহরের।

-এদিকে ফিরুন

মেহরাজের কণ্ঠস্বর খুব কাছ থেকে শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মোহর, মেহরাজ ওর পাশেই বসে, হাতের জিনিসটা থেকে আঙুলের মাথায় মলম লাগিয়ে ছুঁয়ে দিলো মোহরের গলা, আকস্মিক ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মোহর, কেঁপে উঠলো সমস্ত শরীর। মেহরাজের এহেন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ সারা শরীরে হীম শৈথিল্যের হাওয়া জুড়ে দিল। চোখ বুজে নিলো মুহুর্তেই। মেহরাজ মোহরের গলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মলম লাগিয়ে দিল। চোখ বুজেই ঠকঠক করে কাঁপছে মোহর।

তড়াৎ সরে গেল মেহরাজ, চোখ খুলে তাকালো মোহর, তখন গুরুগম্ভীর দাম্ভিকতার আওয়াজে মেহরাজ বলল

– ভরা সমাজকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি আপনাকে, সেক্ষেত্রে আপনি আমার আমানত, আর আমানতের খেয়ানত করার মতো জালিম ও নই। আপনার সমস্ত কিছুর দ্বায়িত্ব আর আমার কর্তব্যের ব্যাপারে ওয়াকিফ আছি আমি। আপাতত অন্য ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন নাহ, অসুস্থ আপনি রেস্ট করুন।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে