#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_০৬
অন্ধকার ঘর, উত্তরের বিরাট জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঝকঝকে টাইলসের মেঝেতে। রূপালি আলো প্রতিফলিত হয়ে মুক্তার মতো চিকচিক করছে।
বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে কাদা মোহর। দুহাতেই পাতলা শুভ্র কাপড়ের ব্যান্ডেজ। নিস্তব্ধ রাতে অদূর থেকে ডাহুক পাখির ডাকে কেমন কেঁপে উঠলো বাতাবরণ।
দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো অতিরজিত সৌষ্ঠব ব্যক্তি। অতি সাবধানী পায়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো বিছানার পাশে। পকেটে গুঁজে দুহাত। প্রখর শানিত দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকালো মোহরের দিকে যার নজর ভরা নির্লিপ্ততার প্রলেপে।
জানালার স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে থালার মতো বৃত্তাকার চন্দ্রটার ঝিলিক স্পষ্ট চোখে বিঁধছে। নভোমণ্ডল আজ ঝিকিমিকি তারায় সুসজ্জিত, পূর্ণ চাঁদটার পরম দয়ায় উথলে পড়ছে নরম আলো, যা ঘরজুড়ে মেলা বইয়েছে।
তন্মধ্যে পাশ ফিরল মোহর,বা পায়ে জড়ানো সুতার মতো অ্যান্টিকের পায়েলটা মৃদু শব্দ করে ঝনঝনিয়ে উঠলো। প্রশস্ত বুক ফুলিয়ে প্রদোষকালের প্রসুপ্ত বাতাস টেনে নিল মেহরাজ। ভীষণ ধীরে, ধীমি গতিতে ছাড়লো। বুকের ভেতর কোথাও প্রচন্ড জ্বালা হচ্ছে, থরথর করে কেঁপে উঠছে সমস্ত চিত্ত। আস্তেধীরে নড়েচড়ে মোহরের ঠিক পাশে হাটু মুড়ে বসলো মেঝেতে ।
একফালি চন্দ্রসুধা এসে পড়েছে ওর মুখ খানায়। অসাড় পরে থাকা হাতের চিকন আঙুলের আলতো করে আঙুল ছোঁয়ালো মেহরাজ, অম্ভোধির মতো অমত্ত গলায় বলল
-ওই যে চাঁদটা দেখছো না? ঠিক ওর মতই আমি,সারাজীবন উপগ্রহের মতো নির্দিষ্ট একটা গতিপথকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ন্যায় নিজের সময়নিষ্ঠ জীবনকেই ঘুরে যাচ্ছিলাম। যার না ছিল কোনো সংযোজন নাইবা বিয়োজন, নাইবা দূরত্ব বাড়িয়েছি নাইবা কমিয়েছি। ধ্রুব হয়ে একই রূপে বহমান থেকেছি। তারপরে হুট করেই আমার অন্তর সত্ত্বায় অনিবারনীয় ঝড় উঠলো। কিসের নেশায় মত্ত হলাম জানি নাহ! আমার আত্মার যে অংশটুকু আজীবন নিরুদ্দিষ্ট বলে ভেবেছিলাম সেই অংশে কোন এক চাহিদা প্রবলরূপে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। যেই ক্ষতর কোনো অস্তিত্ব সম্পর্কেই আমি অবগত ছিলাম নাহ, সেই ক্ষত গুলো দাওয়া পাওয়ার জন্যে চরম ভাবে জ্ব-লন ধরিয়ে দিলো। একদম নতুন, অনভিজ্ঞ কোনো এক অনুভূতি জেঁকে ধরলো,কিসের উন্মাদনায় ছুটতে শুরু করলাম জানি নাহ, দিগন্তের ন্যায় পথের শেষ নেই জেনেও ছুটতে শুরু করেছি, উপসংহার অস্তিত্বহীন জেনেও সূচনা করেছি, এর ফল কি হবে আমি জানি নাহ জানতে চাই ও নাহ। কিন্তু এ অবিরাম অবিচ্ছেদ ভাংতে দেব না আমি, হোক এর পরিনতি ভয়ংকর কিংবা অনিশ্চিত। মুক্তি তুমি পাবে না অদ্বিতীয়া,পাবে নাহ!
বলেই উঠে দাঁড়ালো। নিকষিত পরিবেশেও চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বের হয়ে গেল। ঘরে এসে ধড়াম শব্দে দরজা লাগিয়ে দিল। অশান্তি, তুফান শুরু হয়েছে মস্তিষ্কে যা ক্রমাগত অস্থিরতায় ডুবিয়ে দিচ্ছে মেহরাজকে। মাথার মধ্যে ঝেকে বসেছে এলোথেলো চিন্তাভাবনা, বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেড়িয়ে এলো।
বেশ খানিক সময় নিয়ে শান্ত করলো নিজেকে। স্বভাব বিপরীত কোনো কাজই সে করতে পারবে নাহ। বিছানাতে বসে ল্যাপটপ টা হাতে নিয়ে খটাখট শব্দ করে কিছু একটা টাইপ করলো, সদাসর্বদা ভাইব্রেশনে রাখা ফোনটা বিপবিপ শব্দে কারো কড়া নাড়ার জানান দিল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ স্থির রেখেই কানে ধরলো আধখাওয়া আপেলের লোগো বসানো ফোনটা। ওপাশ থেকে অত্যাধিক বিনয়ী গলায় শোনা গেল
-সালাম স্যার, ভালো আছেন?
-কাজের কথায় আসো
মাত্রাতিরিক্ত সহবত সুলভ আচরণের শুরুতেই দাড়ি বসিয়ে থামিয়ে দেওয়াই বেশ স্তম্ভিত হলো অপরপক্ষ। মনে মনে ক্রুদ্ধ হলেও উপরে তার বিপরীত আচরণ করে সবিনয়ে বলল
-স্যার বলছি আপনি ঠিক যেমনটা বলেছিলেন তাই ই করেছি৷ এবার যদি আমার পারিশ্রমিক দিয়ে খুশি করে দিতেন!
-কিসের পাওনার কথা বলছো। তোমাকে শুধু নিজের ভোতা মুখটাকেই ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল, হু ডেয়ারড ইউ টু টাচ হার। ওর গায়ে হাত তুলেছ তুমি কোন সাহসে!
চাপা স্বরে গর্জে উঠলো মেহরাজ। অপরপক্ষ বেশ থতমত খেল, জড়তা-সংকোচমিশ্রিত গলায় বলল
-স্যার আমিতো চাচ্ছিলাম যাতে পরিস্থিতি আরও গরম হয়ে ওঠে, ওকে সবাই ভুল বোঝে আর আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয় তাই..
-তার জন্য তুমি আ’ঘাত করেছো ওকে রাস’কেল! তোমার তকদির ভালো যে আমি সংযত ছিলাম। না তো এমন দুঃসাহস দেখানোর অপরাধে তোমার ওই হাত আমি মাটিতে পুঁ-তে দিতাম।
-স্যার আপনি যা চেয়েছেন তাই তো হয়েছে, তাও কেন রেগে যাচ্ছেন
-ভেস্তেই তো দিচ্ছিলে সবকিছু, যাই হোক তোমার টাকা কাল সকালের মধ্যেই পেয়ে যাবে, মেহরাজ আব্রাহামের কথার কোনো নড়চড় হয়না। আর ফারদার আমাকে ফোন করা তো দূর আমার সামনেও যেন আসতে না দেখি, তোমার অপরাধ কিন্তু আমি ভুলিনি
বলেই খট করে লাইনচ্যুত করলো কলটা। ফ্যাকাসে মুখে লোকটা টুটটুট শব্দ শুনতেই স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখলো ‘কল এন্ডেড’ শব্দ দুটো ভাসছে। তীব্র আক্রোশে মুখ থেকে একদলা থুতু ফেলে বিশ্রি একটা গা’লি দিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকে গেল লোকটা ।
………………….
শহর জুড়ে তুমুল বর্ষণ। তোলপাড় তুলেছে পরিবেশ তার ঝড়ো হাওয়ার দাপটে। দীর্ঘাকার জানালার কাঁচ ভেদ করে সে হাওয়া ভেতরে পৌঁছাতে না পারলেও স্বচ্ছ কাঁচের এপাশ থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান ওপাশের তান্ডবলীলা।
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে অবলোকন করছে মোহর।
চোখেমুখে কেমন অসাড়তা ভরা চাহনি। সবকিছু নিস্তেজ লাগে, বাবা মা বোনের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত নিরবকাশ মনে পড়ে বারংবার। কুড়ে কুড়ে খাই ভেতরটা। দগ্ধ হয় অসহ যন্ত্রণায়। একাকিত্ব, অসহায়ত্ব,তুচ্ছতা ছাড়িয়ে অমর্ষ পীড়নে জেঁকে ধরে সারা শরীর।
প্রায় ছয়দিন হলো এবাড়িতে এসেছে, এই ঘর, সিড়ি আর রান্নাঘর ছাড়া সবকিছুই অপরিচিত ওর কাছে প্রাসাদতুল্য বাড়িটার। শহরের বুকে এতো বড় বাড়ি সচরাচর চোখে পড়ে নাহ, ওই হাতে গোণা কয়েকটা আরকি। বাড়টার চারপাশে ঘেরা বিশাল প্রাচীর, দুটো আউটহাউসের দুপাশে সামনা-সামনি অবস্থানের মধ্যিখানে দাম্ভিক্যের সহিত দাঁড়িয়ে আছে আলিসান বাড়িটি।
বাড়িটা দুতালা হলেও অন্য বাড়ির চেয়েও তুলনামূলক উঁচু। আউটহাউসের চারিপাশ জুড়ে বেশ অনেক গুলো গাছ, বাগান বললেও ভুল হবেনা। দিনের আলোয় যতটা অপূর্ব চাকচিক্যময় লাগে বিলাসবহুল এই মহল, রাত হলে ঠিক ততটাই সুনসান আর ভয়ংকর লাগে।
বাড়ির মানুষ গুলোও কেমন অদ্ভুত, সবচেয়ে অদ্ভুত তো লেগেছে মেহরাজকে।
একটা বিষয় মোহরকে না চাইতেও বেশ ভাবায় তা হলো মেহরাজের এই ব্যতিক্রমী চেহারা আর স্বভাব তার সহিত ওর নাম। এ বাড়ির সকল সদস্যের নামের পদবি মুর্তজা। মেহরাজের বাবা ও চাচার নাম আজহার মুর্তজা এবং আরহাম মুর্তজা। কিন্তু একমাত্র তার নাম-ই মেহরাজ আব্রাহাম। ওর ‘রুদ্ধ’ নামটাও কেমন অদ্ভুত। শাহারা বেগম বলেছিল ওই নামটাই ওকে কেও ডাকে না, মেহরাজের নিষেধ আছে। অথচ সে নিজেই মোহরকে এই নামেই সম্বোধন করতে বলেছিল।
লোকটার সাথে দেখা সাক্ষাৎ ও খুব কম ই হয়েছে এই কয়দিনে। সকাল বেলা অফিসের জন্যে বেড়িয়ে যায়,রাত করে ফেরে। তবে বাড়ির লোকের চক্ষুশূল হওয়া সত্ত্বেও মোহরের প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসের অভাব হয়না। ঘরের ভেতরের বিশাল আলমারি ভর্তি নানা জামা কাপড়। শাড়ি,লেহেঙ্গা থেকে শুরু করে টপস কুর্তি কোনো টাই বাদ নেই। ওর খাবার নাজমা নিজ দ্বায়িত্বে ঘরে দিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে শাহারা বেগম এসে গল্পগুজব করে যায়।
-এহেম এহেম
ভাবনায় ছেদ ঘটলো মোহরের, পেছনে ফিরে দেখলো কয়েকদিনের চেনা পরিচিত চেহারাটার হাস্যজ্বল অবয়ব। সহাস্য মুখে বলল
-আসতে পারি?
-জ্বি আসুন।
সৌজন্য বজায় রেখে মোহর কিঞ্চিৎ হাসলো। নোমান এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মোহরের সামনে। দু’হাতে দুটো কাপ, মোহরের সামনে একটা ধরে বলল
-ক্যান ইউ প্লিজ হোল্ড?
মোহর কাপটা হাতে নিলে নোমান একটা চেয়ার টেনে বসলো নিজের হাতে একটা কাপ নিয়ে, কোনো রকম জড়তা ছাড়াই বলল
-বৃষ্টি হচ্ছে খুব, বাইরেও যেতে পারছিনা, ঘরে বসেও বোর হচ্ছি তাই ভাবলাম এককাপ কফি খাওয়া যাক। এ বাড়িতে আড্ডা দেওয়ার মতো আপনাকে ছাড়া কাওকেই মনে আসলো নাহ,মাইন্ড করেননি তো ভাবি?
মোহর ঘাড় নাড়িয়ে না বলল। নোমান এর আগেও দুদিন মোহরের সাথে গল্প করে গেছে, ছেলেটা ভীষণ মিশুক। এ বাড়িতে এই একটা মানুষকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে মোহরের, তবে বেশ চঞ্চল। হুটহাট চলে আসে গল্প করতে আবার হুট করেই উধাও হয়ে যায়।
-বসছেন না যে ভাবি?
মোহর হাতের কাপটা নিয়েই নোমানের সম্মুখ বরাবর খাটের এক কোণায় বসলো। নোমান কফি খেতে খেতে বলল
-সবসময় ঘরে বসে থাকতে বিরক্ত লাগেনা ভাবি? এত বড় বাড়ি ঘুরে দেখলেও তো টাইম পাস হয়।
-এত বড় বাড়িটা ঘুরে দেখার মতো অনুমতি বা ইচ্ছে কোনো টাই নেই। আর যার কেও নেই তার আবার কিসের বিরক্তি। এখানে খাচ্ছি পরছি,থাকছি এটাই তো অনেক।
কিঞ্চিৎ হেসেই বলল মোহর। নোমানের মুখটা আচমকা শুকিয়ে গেল। শুষ্ক গলায় বলল
-পরিবারের জন্য মন খারাপ হয়না ভাবি?
গাল প্রসারিত করে হাসলো মোহর। শুকনো ঠোঁট, চোয়াল এলিয়ে গেল। নির্জীব গলায় বলল
-যা নেই তা নিয়ে কি করে মন খারাপ করবো। মা বাবা দুজনই তো ছেড়ে গেছে, যে একজন বেঁচে আছে সে থেকেও নেই।
নোমানের মুখ শুকিয়ে এলো। মোহরের একাকিত্ব খানিক সহজ করতেই ও এসেছিল গল্প করতে, সবসময় এমন শুকনো চেহারায় ওকে দেখলে কেমন ভারি ভারি লাগে। কফির কাপটা পাশে রেখে বলল
-যদি কিছু মনে না করেন, মেহরাজ ভাইয়ের সাথে আপনার এ অকস্মাৎ বিয়ের ঘটনা টা কি জানতে পারি? মানে কি হয়েছিল সেদিন?
মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে। ঝুমঝুম বৃষ্টির তালের সহিত স্পষ্ট মনে পরে গেল আজ থেকে সাতদিন আগের রাতের ঘটনা।
_রাত তখন প্রায় নয়টা। বিরতিহীন শহুরে জীবনের তালে রাস্তা ভর্তি যানযট। যার ফলে মেডিকেল থেকে বেড়িয়ে স্টুডেন্টের বাড়ি পৌঁছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশিই দেরি হয়ে গেছে। গার্জিয়ানের কালো করে রাখা মুখ দেখে না চাইতেও দেরি হয়ে যাওয়া সময়টা ধরে পড়াতে গিয়েই দেরি হয়ে গেছে।
মাসের মাঝ সময়,বেতন পেতে এখনও দিন দশেকের বেশিই দেরি। হাতে যা টাকা ছিল তা দিয়ে আজ ব্যাগভর্তি ওষুধ কিনেছে । মায়ের বিছানাগত জীর্ণ শরীরটা দুদিন হলো বেশি খারাপ করেছে। হাত ফাঁকা থাকায় অটোরিকশাতে উঠার সৌভাগ্য হয়নি। পা চালিয়ে দ্রুতগতিতে হাঁটছে চিকন গলিটার মধ্য দিয়ে। এই পথ ধরে গেলে পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছাতে পারবে।
হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই পা থমকে গেল মোহরের, পেছনে না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারলো ঠিক তার থেকে সামান্য দূরেই কতগুলো মানুষের পায়ের শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নাহ, বরং হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। তবে ওর সাথে তাল মিলিয়ে পেছনের পদক্ষেপ গুলোর গতিও বাড়লো। কাঁধের ব্যাগটা একহাতে চেপে ধরলো মোহর। হাঁটার মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চারজন মাতা’লের মতন ছেলেকে ওরই পেছনে আসতে দেখা গেল, মোহরের সাথে চোখাচোখি হতেই দাঁত বের করে বিশ্রি হাসি দিল। গা গুলিয়ে উঠলো মোহরের, ভয়ে পায়ের তালু ঠান্ডা হয়ে এলো।
-আরে আর কত ছোটাবে জানেমান, এবারতো দাঁড়াও
উত্য’ক্তমূলক বাক্যগুলো শুনে মোহর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই দৌড় শুরু করলো, কোনো দিকে না তাকিয়ে কাঁধের ব্যাগটা চেপে ধরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলো
-শা’লী পালাচ্ছে ধর ওকে
বলে পেছনের ছেলেগুলো ও একই সাথে দৌড়াতে শুরু করলো। মোহর দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে লাগলো প্রচন্ড বেগে। পায়ের জোর যতক্ষণ থাকবে তার সম্মানও ঠিক ততক্ষণই অক্ষত থাকবে, রাতের অন্ধকারে সুনসান এই গলিতে মোহরকে মানুষ রূপি পশুরা ছি’ড়ে খেলেও বাঁচানোর মতো কেও নেই।
মনে মনে সাত কালেমা জপ করতে করতে প্রাণাধিক চেষ্টায় ছুটতেই থাকলো। অন্ধকারের চোরা গলি পেরিয়ে কোনদিকে এসে পড়েছে ও নিজেও ঠাওর করতে পারছে না কিন্তু তবুও এক লহমা থামার নাম নেই। পেছনে চারটা নরখা’দক এখনো ছুটছে, বাগে পেলে নিস্তার নেই এই অ’মানুষের হাত থেকে।
দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় হাফিয়ে উঠলো মোহর, ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। বেশ চওড়া রাস্তা, দুইপাশে সারি সারি গাছ। কোথায় আসলো সে! রাতের অন্ধকারে হয়তো চেনা জানা জায়গাও ভয়ংকর ঠেকছে। আবারও জোর দিল অবশ হয়ে আসা পায়ে তবে সে জোর বেশিক্ষণ টিকলো নাহ। পেছন থেকে একটা হাত ওড়টা টে’নে ধরলো মোহরের, গলার সাথে পেচিয়ে উলটে পড়ে গেল মোহর, প্রচন্ড ধাক্কায় মাথার সাথে রাস্তায় বা’রি খেল। বিশ্রি হাসিতে মেতে উঠলো চারজন মোহরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল
-এবার কোথায় পালাবে সুন্দরী। এইখানে জম ছাড়া আর কেও আসবে না তোমাকে নিতে
বলেই মোহরের গলায় পেচিয়ে যাওয়া ওড়নাটাতে হাত লাগাতে নিলেই মোহর এক পা তুলে ছেলেটির নাজুক জায়গা বরাবর সজোরে লা’ত্থি বসিয়ে দিল। গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো ছেলেটা। ওর এই অবস্থা দেখে বাকি তিনজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো, মোহরের চুল টে’নে ধরে তুলে দাঁড় করালো গলা চেপে ধরে বলল
-খুব তেজ তাইনা? তোর সব তেজ আজ কমাবো, ধর ওকে
বাকি দুজন এগিয়ে আসতে গেলে মোহর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছেলেটার নাক বরাবর ঘু’ষি বসিয়ে দিতেই গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসলো, হাত আলগা হতেই ধা’ক্কা দিয়ে আবারও দৌড়াতে শুরু করলো।
হঠাৎই চোখের সামনে তীব্র লাইটের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে এলো মোহরের, মোহরের প্রাণপণ দোয়া আকুতিতে দয়া রহম করে দৈবাৎ সাহায্যের মতো একটা গাড়ির আগমন ঘটলো, ততক্ষণে মোহরের গতি থেমে যাওয়ায় পেছন থেকে একটা ছেলে রাস্তা থেকে পাথর তুলে মাথায় বা’রি বসিয়ে দিল, প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে শরীর দুলে উঠলো, চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসতে থাকলো। নিভে যাওয়া চোখে শুধু একটা চেহারা ছুটে আসতে দেখলো তার দিকে কেমন চেনা চেনা লাগলো কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো নাহ_
-তারপর কি হয়েছিল ভাবি?
নোমান মন্ত্রমুগ্ধের গলায় প্রশ্ন করলো। বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নোমানের দিকে তাকালো মোহর। ততক্ষণে হাতের ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ জলে পরিনত হয়েছে। মোহর সামান্য গলা খাকারি দিয়ে আবারও বলতে শুরু করলো
-আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি কোথায়,কার সাথে, সময় তখন ঠিক কতো কিছুই মনে ছিল নাহ। চোখ খুলতে হালকা ঝাপসা একটা চেহারা দেখলাম। আস্তে আস্তে চেহারাটা আরও স্পষ্ট হলো । ধাতস্ত হয়ে উঠে বসে সবটা উপলব্ধি করলে বুঝতে পারি আমি হসপিটালের বেডে, আমার পাশেই বসে সেই লোকটা যাকে দিন তিনেক আগে আমি নিজে হসপিটালে ভর্তি করেছিলাম।
মাথায় আ’ঘাত টা বেশ ভালই লাগায় ডক্টর সকালের আগে ছাড়েনি আমায়। এর মাঝে আমি বেশ কয়েকবার আমায় সাহায্যকারিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যেতে বলেছি, বিনিময়ে তার থেকে একটা উত্তরই এসেছিল
‘সেদিন আমি রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় যে হসপিটালাইসড করে এত বড় উপকার করেছে, তাকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়ার মতো বেহিসাবি আমি নই, সেদিন আপনি আমায় সাহায্য করেছিলেন আজ আমি করছি। হিসাব বরাবর না করতে পারলে আমার ভাল্লাগে নাহ’
আমি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিলাম লোকটার দিকে। একটা মানুষ যে এইরকম পরিস্থিতিতে হিসাব চুকানোর কথা বলতে পারে তা আমি আগে শুনিনি। সকালে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে বেরিয়ে মেহরাজ আমাকে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বাজারের উপর ড্রপ করে দিয়েছিল। ভয়ংকর রাত পেরিয়ে মনে মনে খোদার দরবারে শুকরিয়া করে যখন ফিরছিলাম।তখনও বুঝিনি আমার আজীবনের জন্য ভয়ংকর কোনো সত্য অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমার মা…
আর বাকিটা বলতে পারলো না মোহর। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। না চাইতেও ভেতরের গুমোট বায়ুশূন্য অনুভব গুলো বাষ্পীভূত হয়ে জলে পরিনত হয়ে চোখ বয়ে গড়িয়ে পরলো। নোমান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মোহরে পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল
-নিয়তির ওপর কারো হাত নেই। বিধাতা কপালে যা লিখেছিল তাই হয়েছে, এভাবে ভেঙে পড়লে হবে নাহ। জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়ের অর্ধেকাংশ পার করে ফেলেছো। এবার শুধু বুদ্ধিমত্তা আর ধৈর্য ধরতে হবে। আমি মেহরাজ ভাইয়ের ছোট হলেও বয়স তোমার চেয়ে বেশি। তাই তুমি করেই বললাম। আমাকে বড় ভাইয়ের মতো মনে করবা, আমি সবসময় ছায়ার মতো তোমার পাশে থাকবো। কখনো একা ভেবনা নিজেকে। ভাববে আজ থেকে তোমার এই ভাই সবসময় তোমার সাথে আছে
বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নোমান। হয়তো মোহরের কান্নার জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। না ও জিজ্ঞাসা করতো না মোহর সেই তিক্ত কথাগুলো মনে করতো।
কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে মোহরের, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাড়িয়ে ওর এহেন কান্না কেমন অপার্থিব শোনালো। ঝিম দিয়ে উঠলো যেন আব্রাহাম ম্যানসনের দেওয়াল গুলোও। এমন হাহাকার ভরা কান্নায় হয়তো শূন্যতা আর যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই নেই যা জড় বস্তুগুলোকেও শিউরে তুলছে!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#Humu_❤️