ফাগুণের নবধারা
পর্ব-১১
– শাহাজাদী হুমাশা
কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার পর হতেই রুকু আর কখনো নিঝুমের সাথে যোগাযোগ করেনি।
সময় সময়ের মতই পার হচ্ছিলো।কিন্তু সব ভালোর মাঝেও খারাপ থাকে।সব খারাপকে মেনে নিয়েই জীবন যুদ্ধে এগোতে হয়। বিপদের আঁচ পেলেও মানুষ বিশ্বাস রাখে সৃষ্টিকর্তা সব ঠিক করে দিবেন।কিন্তু কিছু বিপদ আর কিছু দুঃসময় যে কখনই ফুরাবার নয়।
ইদানীং রুকু অনেক দুঃস্বপ্ন দেখছে ঘুমে।এটা প্রেগনেন্সির একটা ফেইজ। মাত্র তো ৪ মাস। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছেনা সে।গতবারও মেঘের বেলায় এমন হয়েছিলো রুকুর।কিন্তু তখন আবিদের সাথে দুর্ঘটনাটা ঘটে।আবিদ আর ফিরে আসেনি।তাহলে এবারো কি?? না না। কক্ষনো না এবার এমন কিছু রুকু সহ্য করতে পারবেনা।পাগল হয়ে যাবে ও।আবিদ ওর পাশে নেই।রেস্টলেস ফিল করছে।আবিদের সাথে কথা বলতে মন চাইছে।কিন্তু আবিদ হয়তো এখন ফ্লাইটে।কি করবে ও?? কিছুক্ষণ উঠে পায়চারি করে। অযু করে তাহাজ্জুদের নামাজে বসে রুকু। মন তার অস্থির হয়ে আছে আবিদের জন্য।এই মানুষটাকে রুকু পাগলের মত ভালোবাসে।জীবনের প্রতিটি সুসময় কিংবা দুঃসময়ে সে আবিদ কে তার পাশে চায়।এই মানুষটার পাগলামিতে পাগল হতে চায়,তার ভালোবাসায় সিক্ত হতে চায়, তার আহ্লাদে,আদরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে থাকতে চায়।সে শুধু আবিদ এবং নিজের সন্তানদের নিয়ে একটা সুখী জীবন চায়।আল্লাহ জেনো তার বেঁচে থাকার অবলম্বন গুলো কেড়ে না নেন সেই দোয়াই করছে রুকু।
ভোর সারে পাঁচটা নাগাদ আবিদের কল আসে।কল রিসিভ করতেই মিষ্টি কন্ঠে আবিদ বলে ওঠে আমার বিড়ালীটা কেমন আছে?? আর আমার বিড়াল ছানারা কেমন আছে?? রুকু চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা।কান্নার দমকে হেচকি উঠে যায় রুকুর পাশে শোয়া মেঘ আর রুকুর নিধি জেগে যায়।নিধি আবিদ না ফেরা পর্যন্ত রুকুর বাসাতেই থাকবে আবিদের আদেশ সেটা।সুমুর রিকোয়েস্টে নিধি থেকে যায় ওদের বাসায়।পাশের ঘর থেকে আবির ছুটে আসে রুকুর কান্না শুনে।
– ভাবি তুমি ঠিক আছো??
– রুকু আপা তুমি শান্ত হও দীর্ঘশ্বাস নাও।এভাবে কেঁদো না।আমরা সবাই আছি।
রকুর এহেন অবস্থা দেখে আবিদ ভয় পেয়ে যায়।সে দ্রুত ফিরে আসবে বলে রুকুকে আসস্ত করে।রুকুও আবিদ কে একনজর দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছে।
ইলমা আর ফাহিম সিলেটেই আছে। ফাহিমের বদলী না হওয়ায় ঢাকায় ফিরতে পারছেনা।ইলমা ঢাকায় একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ জব পেয়েছে।ফাহিম বদলীর চেষ্টা করছিলো এ কয় মাস যাবত অবশেষে তার চেষ্টা সফল হলো।কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে আগামী ১বছর পর তাকে নিউইয়র্ক শিফট করতে হবে। ইলমা রাজি।সে শুধু রুকু আর সুমুকে চোখে চোখে রাখার জন্যই ঢাকায় আসতে চেয়েছে।মানুষ দুটোকে যে সে বড্ড ভালোবাসে।আজ তার ভালোবাসার মানুষকে পাশে পাওয়ার পিছনে এদের সবচেয়ে বড় হাত রয়েছে।তাদের এতটুকু ক্ষতিও সে মেনে নিতে পারবেনা। প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে সে।
কে জানতো আল্লাহ তার মনের কথাটা শুনে নিবেন আর তার জীবনটাই তার থেকে চেয়ে নিবেন??
রাত ২টা বেজে ১৩ মিনিট।বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে মুসুল ধারে।
কিছুতেই ঘুম আসছেনা সুমুর।সময় জেনো কাটছেই না।ব্যথাটা সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে।
এক পর্যায়ে তা তীব্র আকার ধারণ করে। সুমুর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় নাভিদের।ধড়মড় করে উঠে বসে সে।
– কষ্ট হচ্ছে সুমু??
– আম্মাকে ডাকো নাভিদ আমার লেবার পেইন হচ্ছে ওয়াটার ব্যাংক ব্রোক করেছে।
– স্টে দেয়ার,কিপ পেসেন্স। আমি মাকে ডাকছি
নাভিদ মাকে ডাকতে গেলো। সুমু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
নাভিদ আর তার মা ঘরে ঢুকেই দেখেন সুমুর অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে।তিনি নাভিদকে বললেন গাড়ী বের করতে সুমুকে ইমিডিয়েট হসপিটালাইজ করতে হবে। নাভিদ পকেটে মানিব্যাগ আর গাড়ীর চাবি নিয়ে নিচে নামলো।সুমুকে তার শাশুড়ি আর শশুড় মিলে নিচে নিয়ে এলো। নাভিদ নিধিকে কল দিয়ে সব জানালো।এবং দ্রুত সুমুকে নিয়ে হাসপাতালের জন্য রওনা হলো।যদিও সুমুর নরমাল ডিলেভারি হবার কথা ছিলো।কিন্তু বাচ্চা পেটে বমি করে দেয়ায় ডাক্তাররা অপারেট করতে চাচ্ছেন।নাভিদ ঘাবড়ে গিয়েছে।মাথা ঠান্ডা রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে।ইতো মধ্যে নিধি ওর মা বাবাকে নিয়ে চলে এসেছে।অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় সুমুকে ব্লাড দিতে হবে তাই ডোনার হিসেবে নিধিকে রেখেছে।কিন্তু নিধি বেশি হলে একব্যাগ রক্ত দিতে পারবে আর হাসপাতালে আর রক্ত নেই ও।তাই নাভিদের বাবা বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করছেন।ফাহিম এর ব্লাড সুমুর সাথে ম্যাচ করে তাই নাভিদ ফাহিমকে কল দিয়ে রেডি হতে বললো।নাভিদ গাড়ি নিয়ে বের হলো ফাহিমকে আনতে।ইলমা ঠিক করলো সে রুকুদের বাসায় যাবে রুকু একা আছে।
প্রচন্ড ঝড়ো বৃষ্টির মাঝেই ফাহিম আর ইলমাকে নিয়ে বের হলো নাভিদ।ইলমাকে ড্রাইভারের সাথে ইলমাদের গাড়িতে পাঠিয়ে দিলো নাভিদ।আর ফাহিমকে নিয়ে দুটো ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিতে গেলো।এর মধ্যে নাভিদের বাবা ফোন দিলো।ফোনটা তুলতেই –
– নাভিদ ব্লাড যোগাড় হয়ে গিয়েছে তুই শীঘ্রই চলে আয়। ডাক্তাররা সুমুকে ওটিতে নিয়ে গিয়েছে।
– বাবা আমরা আসছি।
– বন্ডে সই করে দিয়েছি আমি। তুই তাড়াতাড়ি আয় বাপ।
– আমরা আসছি বাবা বের হয়েছি ড্রাইভ……….
– হ্যালো নাভিদ? হ্যালো?? নাভিদ??
কলটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। তিন ঘন্টা পার হতে চললো নাভিদ এবং ফাহিমের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ওদিকে সুমু ওটি তে। চিন্তায় সবার মাথা খারাপ হবার যোগার।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে নতুন ভোরের আলোয় নতুন রঙ ছড়াবে এ নবধারায়।ঝড়ের পরের শান্ত সেই মুহূর্ত শুরু হয়ে গিয়েছে।
ডাক্তার বের হতেই সবাই ডাক্তারকে ঘিরে ধরেছে।
– কংগ্রাচুলেশনস মিসেস নাভিদের পুত্র সন্তান হয়েছে।মিসেস নাভিদ এবং বেবি দুজনেই সুস্থ।
– সবাই এক সাথে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
-বেবিকে আজ ইনকিউবেটরে রাখা হবে।কাল বিকেলে সবার সাথে দেখা করতে পারবেন।পেসেন্টকে কাল ক্যাবিনে শিফট করা হবে।
চলবে……