আজকে আমার ছাত্রের জেএসসি রেজাল্ট দিবে।ছাত্র আমার এলাকারই।সকালবেলা ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে তার সাথে মসজিদে দেখা।রেজাল্টের আগে নামাজের দিকে সবাই মনোনিবেশ করে।সেটি নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।দেখলাম ছাত্রের চোখজোড়া লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।রাতে যে একটুও ঘুমায়নি তা স্পষ্ট।যদিও তার আজ ফল প্রকাশ করবে,তাই বলে নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে সে নামাজ পড়তে আসবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।এখানে অবশ্যই অন্য কোনো।কারণ আছে।তাই নামাজ শেষ করে তার সাথে কথা বলতে গেলাম।
-কী খবর নীরব?সারারাত ফেইসবুকিং করেও ঠিকসময়ে মসজিদে উপস্থিত হলে,কাহিনী কি?
-সারারাত একটাবারের জন্যও মোবাইলটা ধরিনি।
-তাহলে চোখ লাল কেনো?
-টেনশনে ঘুম হয়নি।
-কেনো?কিসের টেনশন?তুমি তো ভালোই পরীক্ষা দিয়েছো তাহলে টেনশন করো কেনো?
-স্যার আসেন ওই সিঁড়ির উপরে বসি।তারপরে কথা নলি।
-ওকে চলো।
-এবার বলো কী হয়েছে?
-আসলে স্যার পরীক্ষার পরে যে দেড় মাসের মতো বন্ধ পেয়েছি সেই সময়টা যাতে নির্বিঘ্নে এনজয় করতে পারি তাই আমি ভাব দেখিয়েছি যে অনেক ভালো পরীক্ষা দিয়েছি।কিন্তু আসলে আমি ততটা ভালো পরীক্ষা দেই নি যতটা ভাব দেখিয়েছি।
-কী একটা অবস্থা!তাহলে তো বিপদ!তো কোন সাবজেক্টে A+ মিস হতে পারে?
-স্যার A+ তো দূরের কথা,আমি এখন পাশ নিয়ে ভাবছি।
-এটা তো মানা যায় না নীরব।যে ছেলের সবগুলো সাবজেক্টে A+ পাওয়ার কথা তার এই অবস্থা হবে কেনো?কোন সাবজেক্ট খারাপ দিয়েছো?
-বিজ্ঞান।
-শুধুই বিজ্ঞান।বাকীগুলো কেমন দিয়েছো?
-বাকী সবগুলোতেই A+ পাবো বলে আশা রাখি।
-সবগুলোতে A+।একটাতে ফেইল।ব্যাপারটা ক্লিয়ার না।ক্লিয়ার করে বলো।
-তার আগে আপনি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর কি কারো কোনো হাত আছে?
-না।স্রষ্টা ছাড়া তো এটা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা।
-কেউ যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সেটি কি তার দোষ?তাকে কি দোষারোপ করা যৌক্তিক?
-না।একদমই না।তাকে কোনোমতেই দোষারোপ করা যাবেনা।
-উত্তর শুনে ভালো লাগলো।এবার তাহলে আসল ঘটনা বলি।
এরপর ছাত্র বলতে শুরু করলো,
স্যার আমাদের এক্সাম ২ তারিখে শুরু হয়ে ১১ তারিখে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে ১১ তারিখের বিজ্ঞান পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করে ১৩ তারিখে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু ১৩ তারিখ হচ্ছে আমার গার্লফ্রেন্ড নাবিলার বার্থডে।পরীক্ষা থাকার কারণে আমার এই ব্যাপারটা খেয়াল ছিলো না।যখন পরীক্ষার হলে গিয়ে খাতায় তারিখ লিখতে যাবো তখন মনে পড়লো।স্যার আপনিই বলেন এরপরেও কি পুরো তিনঘণ্টা পরীক্ষার হলে বসে থাকা যায়?ততক্ষণে নাবিলা হয়তো অভিমান করে না খেয়ে বসে আছে। চিন্তা করলাম মোটামুটি সম্মানজনক নাম্বার যাতে পাই এজন্য মোটামুটি অ্যান্সার করে যাই।প্রশ্নও কমন পড়েছে।তাই খুব দ্রুত কিছু উত্তর করে দিতে পারবো।কিন্তু এখানো ঘটলো আরেক বিপত্তি।আমি যখন খাতায় লিখছি তখন আমার পিছনের ছেলেটি আমারটা দেখে দেখে লিখছিলো।যা আমি বুঝতেই পারিনি।তাই গার্ড এসে আমার খাতা নিয়ে যায়।পুরো ত্রিশ মিনিট বসিয়ে রাখে।আমার এত তাড়ার মধ্যেও যদি ত্রিশ মিনিট বসিয়ে রাখে তাহলে কি আর লেখার কোনো মুড থাকে?পরে খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে যাই।এখন আপনিই বলেন ঘূর্ণিঝড়ের কারণেই তো আমার ফল বিপর্যয় ঘটবে।যদি ঘূর্ণিঝড় না হতো তাহলে কি সুন্দর পরীক্ষা এগারো তারিখে শেষ হয়ে যেতো।আর আমার পরীক্ষাও খারাপ দেওয়া লাগতো না।
ততক্ষণে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেছি।তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
-তোমার প্রেমিকা কে?বাসা কোথায়?কিসে পড়ে?
-আমার বাসার পাশের নাবিলা।এবার সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে।
এ কথা শুনে তো আমার যায় যায় অবস্থা!
-তোমার প্রেমিকার কি খবর?
-ও তো অনেক ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।আমার ভরাডুবিকে ও কিভাবে নেয় কে জানে?আরেকটা কি সমস্যা হয়েছে জানেন স্যার?
-কী?
-পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারণে আমার আম্মুর সাথে ওর আম্মুর নিয়মিত কথা হয়।গত কয়েকদিন যাবৎ তারা শুধু এই রেজাল্ট নিয়েই কথা বলছেন।নাবিলার আম্মু পুরো এলাকায় রেজাল্টের দিনই মিষ্টি বিতরণের জন্য মিষ্টি অর্ডার করায় আমার আম্মুও গতরাতে আমার হাতে পাঁচ কেজি মিষ্টি আনিয়েছেন।আমি একবার আম্মুকে সত্যটা বলে দিতে চাইলেও তেমন সিচুয়েশন তৈরি না হওয়ায় কিছু বলতে পারলাম না।আর স্যার আরেকটা অনুরোধ এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবেন না প্লিজ।আপনিই শুধু এই কাহিনী জানেন।আর কেউ না।
এমন পরিস্থিতিতে কি করতে হয়,কি বলতে হয় তা জানা নেই আমার।এরপর ওকে বিদায় দিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে আন্টির ফোন।
-বাবা বাসায় এসে মিষ্টি খেয়ে যাও।
-আন্টি রেজাল্টটা পাবলিশ হোক,তারপর আসি।
-আরে রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয়?তুমি ওকে এত কষ্ট করে ওকে পড়িয়েছো।তোমাকে কি সবার কাতারে ফেলা যায়।রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পরে তো অন্যান্য মানুষদেরকে খাওয়াবো।তোমার ব্যাপারটা তো ভিন্ন।
আন্টির সাথে কথায় না পেরে এক পর্যায়ে যেতে বাধ্য হলাম।আমার সামনে অনেক মুখরোচক খাবার থাকলেও আমার তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই ছিলোনা।আমি শুধু খাবারগুলো গিলেছি।কোনটার স্বাদ কেমন,কোনটা খাবো কোনোপ্রকার ফিল ছাড়াই খেয়েছি।এরমাঝে আন্টি এসে বলে গেলেন রাতে যেনো এসে ডিনার করে যাই।মনে মনে বললাম,আগে নিজেরা লাঞ্চ করতে পারেন কিনা সেই চিন্তা করেন।এরপর সেখান থেকে চলে আসলাম।
দুপুর দেড়টায় নীরব আমাকে কল দিলো,
-স্যার কেমন আছেন?
-আগে তোমার খবর বলো।রেজাল্ট তো আমি দেখেছি তোমার।একটাতে ফেইল,একটায় এ গ্রেড আর বাকীগুলো A+।
-জ্বী স্যার।আম্মু খুবই রাগ আমার উপর।আপনার আর ডিনার করতে আসতে হবেনা।আমরা লাঞ্চ ঠিক করে করতে পারবো কিনা জানিনা।আম্মু এখন খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছেন।কারণ আপনাকে ইনভাইট করেছে।
-আচ্ছা আমি আসবো না।তোমার প্রেমিকার কি খবর?
-ও তো A+ পেয়েছে।আমাদের বাসায় মিষ্টি দিয়ে গেছে।আম্মুর আসলে সেটা নিয়েই বেশি মন খারাপ।একইদিনে আসলে দুইটা রেজাল্ট দেয়া ঠিক হয়নি।কারণ আমার মধ্যে এখন সুখ-দুঃখের মিশ্র অনুভূতি বিরাজ করছে।
-তোমার রেজাল্ট নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী?
-ও বলেছে নেক্সটাইম ভালো হবে।এ নিয়ে আমি যাতে একদম মন খারাপ না করি।
-হুম সেটাই।মন খারাপ করার দরকার নেই।
-না আমি একদমই মন খারাপ করছি না।মিষ্টি খাচ্ছি।গতকাল যে পাঁচ কেজি মিষ্টি এনেছিলাম সেগুলো একা শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
-গুড।আর শোনো তুমি চাইলে তোমার নিজের সুবিধার্থে পরবর্তী দুইবছর ইচ্ছে করে ফেইল করতে পারো।
-কেনো স্যার?
-কারণ টানা তিনবার ফেইল করার পর তোমার প্রেমিকা আর তুমি ক্লাসমেট হয়ে যাবে।তখন প্রেম বিনিময় করতে সুবিধা হবে।
-এই বিষয়টি ভেবে দেখবো স্যার।
-আচ্ছা বাই।
-জ্বী স্যার আসসালামুআলাইকুম।
-ওয়ালাইকুমুসসালাম।
আমার কান গরম হয়ে গেছে।মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।আজ গোসল না করলে রাতে ঘুম হবেনা।গোসলটা করেই প্রেশার মাপাতে ফার্মেসিতে যেতে হবে
আব্দুল আজিজ ফায়েদ