#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৯
লেখায়: তানিয়া তানু
ধর্ষণের পর হাজারটা শাহিন হাজারটা খুন করলেও তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না।যদি তারা নাবালক হয়। শাহিনের বয়সও আঠারো বছর পেরোয়নি। তাই ওরও সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না। বোনের এত কষ্টের মৃত্যু হলো। অথচ ওর অপরাধী তিন চার বছর পর ঠিকই বুক ফুলিয়ে রাস্তায় হাঁটা চলা করবে। ভাবতেই কান্নার দলা যেন পাকিয়ে আসছে।
“আপা, শুনো।”
সহসা বিথীর ডাক শুনে পিছনে তাকালে ও আমাকে অন্য জায়গায় আসতে বলে। এমনভাবে বলছে যেন কোনো গোপন কথা আমাকে বলতে যাবে। তাই যাতে কেউ না শুনে নিরিবিলি জায়গায় যাওয়া জন্য বললো। আমিও গেলাম। ওর দু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনেক কথাই বড় আপার সমন্ধে বললো। যা শুনে অবাক হলাম। আপা আর দুলাভাইয়ের কথোপকথন ও আড়াল থেকে শুনেছে। সেখান থেকেই বললো, আপার কাছে মা নাকি কাপনের কাপড় আর আরো টুকটাক জিনিসের জন্য টাকা খুঁজছিলো। এই টাকা দেওয়াতে নাকি ওদের দুজনের সমস্যা হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ায় এখন সব প্রয়োজন নাকি এদের মিটাতে হবে। বাকি তিন বোনের বিয়ে, পড়ালেখার খরচ এদের ওপর নাকি দায়িত্ব বর্তাবে। তাই ওরা দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এখান থেকে কেটে গেছে। তবে আপা নাকি বলেছিলো, বেবলিকে শেষবারের মতো দেখে যেতে। কিন্তু দুলাভাই এতে নারাজ।
এতক্ষণ আমি আর বিথী আমার ঘরেই কথা বলছিলাম। মায়ের কান্না শুনে দৌড়ে গেলাম সেখানে। বেবলিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু মা দিতে চাচ্ছেন না। এবারও বলছেন,” আমি আমার কোল খালি করবো না। আমার সন্তান আমার কাছে থাকবে। কেউই মাকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। এক প্রকার জোরাজুরি অবস্থা চলছে সেখানে।মায়ের এই অবস্থা দেখে আমি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
কাঁদতে কাঁদতে আমি মায়ের কাছে যাবার পূর্বে উনি মায়ের সামনে হাটু ভেঙে বসে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন, জানেন, আপনার মতো আমিও এমন মৃত্যু দেখেছি। আপনি বুঝদার মানুষ। কিন্তু আমি যখন এমন মৃত্যু দেখেছি তখন আমার বয়স তেরো ছিলো। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছয় বছর ছিলো। তখন একটা এক্সিডেন্টে আমার ছোট বোন যে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলো। যার জন্যই বাবা-মা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার সময় একটা বাস তাদের ধাক্কা দেয়। পুরো গাড়ি ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। ওদের সাথে না শেষ সময়ও কথা বলতে পারিনি। কারণ ওরা এক্সিডেন্টের সময়ই মারা যায়। জানেন, ওদের চেহারায় পুরো রক্তাক্ত ছিলো। মুখ।বিভৎস হয়ে গিয়েছিলো। সে সময় না আমি লুকিয়ে কেঁদেছি। কখনো সেই ভাইটার সামনেও কাঁদেনি। কাউকে বুঝতেই দেয়নি আমি আমার মা-বাবা আর সেই ছোট্ট বোনটাকে হারিয়েছি। নিজেকে বুঝ দিয়েছি। বলেছি, আমাকে সবল হতে হবে। ভাইকে সামলাতে হবে। আপনিও দেখুন না এইভাবে কাঁদার পর তারা নিজেদের কান্না আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের দুর্বল করে দিয়েছে। ঐ পিচ্চি দুটোকে দেখুন আপনার এমন কান্না দেখে কেমন করে কাঁদছে। স্মৃতিকে যেতে দিন। ওর এখন আপন জায়গায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
এতটুকু বলেই উনি থেকে গেলেন। এক দৃষ্টিতে মায়ের ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। মা তো সেই বোন দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের কাছে ডেকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। শেষে চোখ মুছে ওদের ঘরে যেতে বলায় ওরাও চলে গেল। মা এবার উনার দিকে তাকালেন। উনি এবার জোরে দম নিয়ে বললেন, জানেন, আমি আর আমার ভাই সেই কবে থেকে আমা ডাকি না! মায়ের মমতা পাইনি। ফুপির পেলেও তিনি এক বছর পরই বিয়ে করে বিদেশ চলে যান। আমাদের দায়িত্ব দিয়ে যান আমাদের বাড়ির এক আত্নার আত্মীয়কে। আমাদের কাজের লোক মকবুল চাচাকে। উনি বাবার দায়িত্ব কিছুটা পালন করতে পারলেও মায়েরটা পারেননি। মা ছাড়াই আমরা বড় হয়েছি। সেই মায়ের প্রয়োজন এখনো আমাদের আছে। আপনি কী আমাদের মা হবেন?”
উনার এই কথা শুনে মা অবাক হলেন। তার সাথে উনার কথার মর্মও বুঝতে পারলেন না। উনি একটু থেকে আবাও মাকে বললেন,
“আমি দীপ্তিকে বিয়ে করতে চাই। আপনাকে মা ডাকতে চাই। দুটো পিচ্চি বোনকে পেয়ে আমার মৃত বোনের প্রয়োজন মিটাতে চাই।”
উনার কথায় মায়ের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটলো। মা আনন্দে কেঁদে দিলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। আমিও মায়ের মতো অনেক খুশি।
মা উনার গাল দুটোতে হাত রেখে বললো, “তুই আমার ছেলে হবি। আমাকে মা মা বলে ডাকবি। জানিস, বড় মেয়ের জামাই না আমাকে বেশি মা ডাকেই না। আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। আমি না চাই। কোনো ছেলে সারাক্ষণ আমাকে মা মা বলে ডাকুক। আমার ছেলের প্রয়োজন মিটাক। তুই মিটাবি। আমার ছেলে হবি।”
উনিও কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়ালেন। উনার মায়ের প্রয়োজন আর মায়ের ছেলের প্রয়োজন মিটলো আজ।
ওদের দিকে চেয়ে অন্যদিকে মনেই রইলো না বেবলিকে অনেক আগেই নিয়ে গেছে। আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ভাইয়া। উনি মায়ের কাছে এগিয়ে মাকে কী বলবে তা ভেবে পেলো না। ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালা আমি জানাজায় যাচ্ছি।”
উনি আকাশ ভাইয়াকে দেখে বলল, দোস্ত,দাঁড়া আমিও যাবো।”
মা বললো, “তুই এতক্ষণে এলি।”
“খালা তুমি তো আমাকে বলোনি। আর খবরের কাগজে পড়েই আমি হতবাক হয়ে এখানে এসেছি। আর অয়ন তুই একটু পর আয়। আমার একটা কাজ আছে। ওটা খুব প্রয়োজন করার।
এই বলেই দৌড়ে চলে গেলেন।
উনি মায়ের দিকে এবার তাকিয়ে বললেন, “পাঁচ দিনের শিন্নির পরপরই আমি ফুপিকে পাঠিয়ে দেবো। এখানে আমি সব সময় আসবো। শুধু থাকবো না।”
এটুকু বলে চলে গেলেন।
রাত্রে আমার রুমে আমি, মা,বিথী, ও দ্যুতি জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়েছি। বেবলির সাথে আর ঘুমানো হবে না বলে অনেক কেঁদেছি। সাথেও মায়ের কান্নাও পুরো রাত জুড়ে শুনলাম।
বিষাদময় কেটে গেল ছয় দিন
এই ছয় দিনে অনেক কিছু ঘটেছে। বাবার পাওনাদাররা এসে বারবার বিরক্ত করেছে। এই জ্বলায় বাবার কথামতো গাড়ি বিক্রি করতে চাইলে উনি কিনে নেন। মা উনার কাছে বিক্রি করতে চাইলেন না। বললেন, এটা তোমাদের বিয়ের যৌতুক। উনি না করলে মা বলেন, লাগবে না কেন, বাবা?বড় মেয়ের বিয়েতেও দিয়েছি। তার জন্যই তো এত পাওনাদার।”
উত্তরে উনি সেদিন বলেছিলেন, মা, আমি তোমার ছেলে হই। আর যৌতুক আমি ঘৃণা করি। ওগুলোতে আমার সংসার পূর্ণ হবে না। তাই নেবোও না।
“ছেলেই যখন তাহলে বাবার গাড়িটা কিনতে চাইছিস কেন?”
“বাবার গাড়িটা কিনতে চাই নিজের জন্য। আর ঐ টাকা দিয়ে তোমরা পাওনাদারদের দিয়ে দিবে।”
“তুই তো বাবা পুলিশ। গাড়ি দিয়ে কী করবি?”
“মা, এটা দিয়ে সপ্তাহে একদিন তোমাদের সকলকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।”
উনার এই কথায় মা অনেক খুশি হলেন। নিয়নও সেদিন মাকে মা বলে ডেকেছিলো। মা তো দু দুটো ছেলে পেলেন। তাই খুশিতে তিনি আত্মহারা।
বাড়ি রঙ করা হয়েছে। উনার ফুপি আর দিবিয়া শিন্নির দিন এসেছিলো। পুরো শিন্নীর আয়োজনে তিনি থাকলেও আকাশ ভাইয়া আর কোনোদিন আসেনি। নিলাও না। এতে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কেন ওরা আসেনি।
দিবিয়া আর ফুপির এমন সুন্দর ব্যবহারে মা এক্কেবারে অবাক। তিনি ভাবতেই পারেননি ওনাদের ব্যবহার এত সুন্দর হবে। এত শ্রদ্ধা করবে। মা তো আমাকএ রাজ কপালী হিসেবে উপাধি দিয়ে দিয়েছেন। উনারা বিয়েটা ঘটা করে আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাতে রাজি নই। কারণ চাই না বড় করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হোক। নাচ-গান হোক। এতে যে বেবলির ইচ্ছা গুলো খুব কাঁদায়। আচ্ছা কেন এমন হলো? কী দোষ বেবলির ছিলো?
ঠিক হলো সাতদিন পরই আমাদের বিয়ে। আর এই বিয়েতে কয়েকজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউই থাকবে না। শ্বশুরবাড়িতে শুধু আমি নয় আমআর পুরো পরিবার যাবে। কারণ এই বাড়িতে থাকলে অতীত বার বার হৃদয়ে হানা দেব।
চলবে„„„„„