#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৮
লেখায়: তানিয়া তানু
শানুদের গাড়ি থামলো নদীর পাড়ে। বেশ নির্জন জায়গা। শহর থেকে বহু দূরে। এখানে মানুষ তো দূরের কথা কোনো প্রানীই আছে কী না তাতে সন্দেহ। শুনশান পরিবেশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যায়। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে দেখলাম ওরা কিছু একটা বের করে নদীর পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা এমন নির্জন স্থানে কী ফেলছে? আমরাও তাদের সাথে নদীর পাড়ে যাচ্ছি। ওরা যখনই নদীতে জিনিসটা ফেলবে তখনই উনি টর্চের আলো ওদের মুখ ফেলেন। শানু আর শাহিন টর্চের আলোর সহ্য করতে না পেরে মুখ হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই শুনশান জায়গায় আমাদের দেখে তার থেকে বেশি উনাকে দেখে আঁতকে যায়। দৌড় দিয়ে পালাতে চাইলে দুজন কনস্টেবল ওদের ধাওয়া করে। ওরা চলে যাবার পর টর্চের আলো সেই জিনিসটার দিকে দিলেন। এটা একটা বস্তা ছিলো।
ওদের দুজনকে ধরে আনা হলে উনি জিজ্ঞেস করেন এতে কী আছে?ওরা ভয়ার্ত চেহারায় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এমন ঠান্ডাময় পরিবেশে ওরা দুজন ঘামে ভিজে গেছে। কিন্তু তাও কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”ওতে ময়লা আছে। আমাদের ওখানে ময়লা পেলবার জায়গা নেই দেখেই এই জায়গায় নিয়ে এসেছি।” শানুর সাথে তাল মিলিয়ে শাহিন বললো, “দেখুন না ময়লার থেকে কী গন্ধ বের হচ্ছে।”
আমি এতক্ষণ দূরে ছিলাম। কিন্তু ওদের কথা শুনে আগ্রহ নিয়ে একটু কাছে গেলে তেমন গন্ধ পেলাম না। তবে আরো কাছে গেলে কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পেলাম। এই গন্ধে গা ঘুলিয়ে এলো।
“ময়লা! তা কী এমন ময়লা আছে? তা তো আমাদের দেখা দরকার।”
উনি এই কথা বলে একজনকে ইশারা করলেন বস্তার বাঁধন খুলার জন্য। কিন্তু কনস্টেবল ময়লা বলে বাঁধন খুলতে রাজি হলো না। কিন্তু পরক্ষণে উনার অগ্নিচোখ দেখে হাতে গ্লাভস পড়ে বাঁধন খুলা ইয়াক থু বলে দূরে সরে গেল।
বাঁধন খুলার পর উনি টর্চ সেখানে মারলে একটা মৃতদেহের মাথার চুল দেখা যায়।তবে এইটুকু চুলে মেয়ে কীনা ছেলে তা বুঝা যাচ্ছে না। ভালো করে দেখার আগেই তিনি আলোটা সরিয়ে নিলেন। তবে এইটুকু দেখেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। তাই কিছুটা দূরে সরে আসলাম। না জানি কার লাশ এইটা!
উনি শাহিনের দিকে এগিয়ে একটা নাক বরাবর জোরে ঘুষি দিয়ে রাগি কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কার লাশ?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শাহিন বললো, “বেবলির।”
ওর এই কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো। অঝোরে ঝরছে চোখের পানি। কিছু বলতেও পারছি না। ঠায় হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার বোন! সে কীনা এখন লাশ হয়ে গেল! সে আর কোনোদিন আমাকে আপা বলে ডাকবে না। এসব ভাবতেই চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখতে পেলাম। পৃথিবী ঘুরছে না আমি ঘুরছি কিছুই বুঝতে পারছি না। এক সময় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে যাবার আগে কারোর মুখে আমার নাম উচ্চারণের শব্দ শুনলাম।
চোখের আলো পড়ায় ঠিক মতো চোখ খুলতে পারছি না। তিরতির করে কাঁপা চোখ এক সময় খুললে দেখতে পেলাম আমি আমার ঘরে আছি। কিন্তু আমি তো নদীর পাড়ে ছিলাম। এখানে এলাম কীভাবে? আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলো মনে হতে লাগলো। আচ্ছা এগুলো সপ্ন নয়তো। আমার বোনের সত্যি কিছু হয়নি। আমি গত রাত্রে এগুলো স্বপ্ন দেখছিলাম।
আচ্ছা উনি বেবলির খোঁজ পেয়েছেন কী? উনাকে একটা ফোন করতে হবে। ফোন করার জন্য সারা ঘরে খোঁজেও পেলাম না। অবশেষে আপার ফোন আনার জন্য বাইরে বেরুলেই শুনতে পেলাম মানুষের হাহাকারের শব্দ। কান্না করছে অনেকে। কিন্তু কেন?
বারান্দায় গেলে দেখতে পেলাম এক ঝাঁক মানুষ গোল হয়ে আছে কিছু একটার প্রতি ঘিরে। মা কান্না এখনো নীরবে করছেন। আপা আঁচলে বার বার চোখ মুছছে। দুলাভাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। দুই পিচ্চি বোন অনবরত কেঁদে চলেছে। তাই এক প্রকার দৌড়ে ভীড় ঠেলে গেলাম।
মেঝেতে শুয়ে আছে আমার বোন বেবলি। আমাদের অবুঝ বোন। শরীর ডাকা একটা কাপড় দিয়ে। ঠোঁটের কোণে রক্ত লেগে আছে। ঠোঁটের দুই পাপড়ি ভীষণ ফুলা। চোখের কোণে এখনো জলের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সারামুখে নখের খাবলা। এগুলো দেখে জোরে কেঁদে দিলাম। সারামুখে আদর করতে লাগলাম। এই বোনকে আর আদর করতে পারবো না। বাবার আনা জিনিসগুলো নিয়ে আর টানাটানি করতে পারবো না। ঝগড়া করতে পারবো না। এসব মনে হতেই জোরে জোরে বিলাপ করে কান্না শুরু করে দিলাম।
হঠাৎ কতগুলো লোক ও রে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু আমি আমার বোন দিবো না। এই বলে জোরে চিৎকার দিলাম। কিন্তু ওরা না নিয়ে যাবে না বলছে। আর আমিও না দেওয়াতে টানা হেচড়া শুরু হলে আচমকা উনি এসে আমার হাত ধরে অন্যত্র নিয়ে গেলেন।
আমি তৎক্ষণাৎ উনার পায়ে ধরে বলি, প্লিজ,”স্মৃতিকে ময়নাতদন্ত করবেন না।আমি চাই না আমার বোনকে কাটা ছেড়া করা হোক।”
কেঁদে কেঁদে বলায় হয়তো মায়া জন্মালো। তাই তো উনাদের না বললেন। এক সময় কিছু মহিলা ওরে গোসল করাতে নিয়ে গেল। বাবার গোসল সাড়ার সেই জায়গায়।
“তোমার বোনকে শাহিন ধর্ষণ করেছে। আর তাতে হেল্প করেছে শানু।”
আচমকা এই কথা শুনে হতবাক হলাম। এক মেয়েকে ধর্ষণ করতে অন্য মেয়ে সাহায্য করেছে। হায়রে অবাক পৃথিবী!
“ও হেল্প করলো কেন?আর এতো মেয়ে থাকতে ঐ পিচ্চির প্রতি নজর দিলো কেন? এতই যখন মেয়েদের দিকে ওর নজর তাহলে ও বিয়ে করলেই পারে।” কেঁদে কেঁদে এই প্রশ্নগুলো করলাম।
“দীপ্তি,তোমার মাথা গেছে। এটুকু বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয় ছেলেদের নয়। ছেলেদের আরো অনেক অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু অনেক ছেলে খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে যৌন বিষয়ে জেনে আগ্রহ বেড়ে যায়। যার ফলে এই ছোট বয়সেই এমন কাজ করতে তেমন ভয় পায় না। যেমনটা শাহিনের ক্ষেত্রে হয়েছে। তোমার বোনের প্রতি নজর পড়ার কারণ হলো ওর অবুঝ মন। আর বয়ফ্রেন্ড চাওয়ার ইচ্ছে। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই নাকি শানুকে বলে বয়ফ্রেন্ড খোঁজে দেওয়ার কথা। ওর এই কথা শাহিন শুনে যায়। যার ফলে প্রতিদিন বয়ফ্রেন্ড সাজে। একদিন ওর বাবা মা নানা বাড়িতে আর শানু মার্কেটে চলে যাওয়ায় সে সাহস পায় স্মৃতির দিকে নজর দেওয়া। সেই সময় ও নিজের কার্যাসিদ্ধি করে। ঝাপিয়ে পড়ে তোমার বোনের প্রতি। স্মৃতির বাঁধা দেওয়ায় ও কে মারা শুরু করে। বলতে গেলে একেবারে নিষ্টুর হয়ে গিয়েছিলো শাহিন। শানুর হাতে ডুপ্লিকেট চাবি থাকায় মার্কেট থেকে ফিরে বেবলির এমন অবস্থা দেখলে ভয় পেয়ে যায়। শাহিনকে মারতে শুরু করে। সবাইকে বলে দিবে বলেছিলো।কিন্তু একমাত্র ভাইয়ের অনুরোধে সে বেবলিকে বস্তায় ভরতে ও নদীর পাড়ে লাশ পালানোর জন্য সাহায্য করে। হূমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা কথা মনে আছে তো?পুরুষরা হচ্ছে সোনার চামচ, সোনার চামচ বাঁকা হলেও ভালো। তাই একমাত্র ভাইয়ের জন্যই এই বড় অপরাধ করতে সাহায্য করা হলো।”
এতক্ষণ নির্বাক শ্রোতা হিসেবে মনোযোগ দিয়ে উনার সব কথা শুনছিলাম। আমার বোনের প্রতি এত নির্যাতন হয়েছে ভেবে কান্না করতে লাগলাম তবে উনাকে বেবলি যে বয়ফ্রেন্ড চায় সে কথা বললে উনি বলেন, স্মৃতি যেদিন বয়ফ্রেন্ড খুঁজেছিলো শানুর দেখায় সেদিন তোমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো। বুঝা উচিত ছিলো এই বাসায় গিয়ে তোমার বোনের ধারণা নষ্ট হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে আমি তোমাদেরও দোষারোপ করব। শুধু তোমার বোন নয় এভাবে কোনো মেয়েরই ক্ষেত্রে কিছু অসঙ্গতি দেখে দিলে সেখান থেকে দূরে থাকা উচিত বা দূরে রাখা উচিত। যেটা তোমরা করোনি।”
উনার এই কথা শুনে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হলো। তাই এক ধ্যানে চোখের পানি ছেড়ে চেয়ে রইলাম সেই পর্দার দিকে।
“আচ্ছা আপনি কী করে বুঝলেন শানুদের বাসায় কোনো গন্ডগোল আছে?”
“শানু যে কথাগুলো আর ওর মা বাবা বাসায় নেই। এতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু ওদের বাসায় যাবার পর সারা ঘরে সেন্টের ঘ্রাণ আসছিলো। তারপর এই এত সেন্ট কেন দিয়েছিলো তা জিজ্ঞেস করলে বলে পচা মাছের গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু সারা রান্না ঘর খোঁজেও মাছের কোনো চিহ্ন না পাওয়ার সন্দেহ হলো। আর শাহিনের কথাবার্তায় বুঝলাম ও খুব টেনশনে আছে। আবার যাবার সময় ওরা দরজা লাগানোর পর আমি আবারও কান পেতে শুনলাম ওরা কাল রাত্রে কিছু একটা ফেলবার কথা বলছিলো। সেই থেকেই বুঝলাম স্মৃতির কিছু একটা হয়েছে।
ওনার মুখে এমন কথা শুনে কান্নারত অবস্থায় বললাম, “আমি ওদের কঠিন শাস্তি চাই।”
আমার কথা শুনে মৃদু হেসে বলেন, তেমন শাস্তি হবে না। বড়জোড় চার-পাঁচ বছর কারাদন্ডে থাকতে হবে। কারণ ওদের বয়স ১৮ পেরোয়নি।
ওদের শাস্তি ভয়াবহ হবে না শুনে কেঁদে দিলাম।
আচমকা একটা শব্দে সিঁড়ি দিয়ে আসলে সেদিকে সবাই তাকালাম। দেখলাম বড় আপা তার ব্যাগ নিয়ে দুলাভাইসহ নিচে নামছে। নিচে নেমেই মায়ের উদ্দেশ্য বললো, মা, শ্বশুরবাড়ির সব প্রয়োজনে আমাকে ডাকা হয়। এমনকি ওদের সাংসারিক কাজেও আমাকে প্রয়োজন। কিন্তু এখানে তো আমার প্রয়োজন নেই। এখানে শুধু কান্নাকাটি করাই দরকার। এগুলো আমার কাছে অযথা। তাই আমি আজই চলে যাচ্ছি।পাঁচদিনে শিন্নিতেও আসবো না।
এই বলেই আপা আঁচলে চোখ মুছে দুলাভাইকে নিয়ে চলে গেল। মা আর বাকি সবাই অবাক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আপা এইটা কী করলো? ওর মতে বোন হারানোর শোক অযথা। এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমারও তো এগুলো প্রয়োজন নেই। তবে বাবা আর বেবলিকে আবারও আমাদের মাঝে ফিরে পাওয়ার খুব প্রয়োজনবোধ করছি।
চলবে,,,,,,,,