#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৩
লেখায়ঃ তানিয়া তানু
রাত বারোটায় শুরু হলো গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান। চারদিকে আলোর ঝলমলে পরিবেশে এক অনন্য জগত তৈরি করেছে। দেখতেও বেশ ভালো লাগছে। এই মাত্র সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হলাম। সবাই শাড়িতে আর আমিই এক মাত্র ব্যক্তিই যে কীনা জামা পরিধান করেছে। তাই নিজেকে যে নিজের কাছে অদ্ভুদ গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। সে যাইহোক বেবলিকে খুঁজতে হবে বলে দরজা থেকে বের হয়ে নিচে গেলাম। সেখানে নিচ তলায় বিউটিশিউয়ানরা যেখানে সাজিয়েছে সেই রুমে গেলাম। রুমের মধ্যে বিউটিশিউয়ানরা আড্ডায় মত্ত। আবার কয়েকজন আশি বছরের বুড়িদের সাজাতেও ব্যস্ত। তাদের এমন সাজানো হয়েছে যে এখন বুড়ি আর লাগে না। এই তো নীলার দাদুকে দেখে আমি নিলার খালাকে ভেবেছিলাম। উনি আমায় দেখে বললেন,
“ও নাতি। তুই জামা পড়লি ক্যান?”
অভাব কাউকে দেখালে সে তোমার সামনে সসমবেদনা জানাবে। কিন্তু আড়ালে আবডালে তোমায় নিয়ে হাজারবার উপহাস করবে। তাই দাদিকে বললাম,
“বু, একটু অন্যরকম সাজার চেষ্টা করলাম বৈ কি।
“ও ভালা। কিন্তু তুই সাজিস নাই ক্যান। ক্যামন জানি খালি খালি লাগতাছে। আ তো দেহি। আমার কাছে আয়।”
দাদির এই সাজানোর পাল্লায় আমি পড়তে অনিচ্ছুক। মূলত এখন এই স্থান ত্যাগ করাটা হবে আমার প্রধান কাজ। তাই দাদিকে বললাম,
“বু, শুনছো, শুনো, বেবলি আমায় ডাকছে। ও বোধয় ভয়-টয় পেয়েছে।আসি গো।
দাদি কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু আমি না শুনেই দৌড়াতে শুরু করলাম। রুম থেকে বের হয়েই মনে হলো এক আইফেল টাওয়ারের সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলাম। ধাক্কার চোটে মাথা সিঁড়িতে লাগতে গেলেই কেউ হাত দিয়ে আমার মাথার পিছনে ও কোমরে ধরে কাছে টানিয়ে গেল। পুরো শরীরটাই যেন ঘুরে গেল। তবে বাঁচা গেল। কোথাও কোনো ব্যথা পাইনি। তবে কোন আইফেল টাওয়ারের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো। আর কেই বা বাঁচালো তা দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই দেখলাম নিয়নের ভাই আমার দিকে ঐ গভীর দুচোখ নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।চশমাটার কারণে চোখ দুটো স্পষ্টভাবে দেখে যাচ্ছে না। তাই আমি চশমাটা খুলে নিলাম। অদ্ভুদ ব্যাপার হলো উনার নাড়াচাড়ার কোন ভাব দেখা গেল না। উনি এখনো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কিন্তু কী দেখছেন! সেটা আল্লাই মালুম! আমি এমন আহামরি কিছু সাজিনি। যে এতক্ষণ ধরে আমায় দেখতে হবে। তবে আমিও উনাকে দেখছি। উনার সেই মায়াময় চোখ দুটিকে। চারপাশে যেন আগুনোর শিখা। মধ্যে গোল সমুদ্র। চোখের পাপড়ি ঘন। একেবারে মাথার চুলের মতো। পাপড়িগুলোও কী লম্বা! পাপড়ি যদি হাতে তালুতে রেখে চাওয়া পড়ে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে সেটা নাকি নবিজীর কাছে গিয়ে পৌছায়। নবীজি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেন সেই চাওয়াগুলো পূরণ হওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আমার পাপড়ি কখনো হাতে পাইনি। ছিড়তেও কষ্ট লাগে। আবার চাওয়াও অনেক। তাই উনার এত পাপড়ি দেখে লোভ সামলাতে পারছি না। হাত উপরে তুলে উনার পাপড়িতে আস্তে আস্তে নিচ্ছি। উনিও মনে হয় বুঝতে পারছেন না। আমি ঠিক কী করতে চাইছি। শুধু চেয়ে চেয়ে এতক্ষণ ধরে দেখছেনই। কিন্তু উনি যত দেখবেন। তত আমার লাভ। কোনোরূপ বাধাঁ ছাড়াই আমি পাপড়ি আনতে পারবো।
“আহহহ”
উনার চিৎকারে আমার হুঁশ এলো।হাতে থাকা কয়েকটা পাপড়ির দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বললাম, আহা! এতগুলো ছিড়লি। বেচারা তো অনেক কষ্ট পেলো। তাই না?
“আপনি এটা কী করলেন? আমার পাপড়ি ছিড়লেন কেন?”
উনি চোখে হাত রেখে এই প্রশ্নগুলো করলেন। মনে হচ্ছে অনেক ব্যথা পেয়েছেন। অন্যদিকে উনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তাই এখান থেকে পালানোটাই উপযুক্ত মনে করলাম। তাই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ছুটলাম ছাদের দিকে। শুনলাম পিছন থেকে উনি চিল্লিয়ে বলছেন, আমি আপনাকে ছাড়বো না। দেখে নেবো।
দেখে নিলে নিবে। সে পড়ে দেখা যাবে। মন তো আনন্দে আর মানছে না। এত এত পাপড়ি হাতের মাঝে। এখন অনেক চাইবো। সেগুলো উড়িয়ে নবীজির কাছে পাঠাবো। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। মন যেন আনন্দে মেতে উঠছে।
ছাদে উঠেই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। আজ এতদিন পর এত জোরে দৌড় মনে হয় প্রথম দিলাম। সেই যে ছোটবেলায় কোনো এক দৌড় প্রতিযোগিতায় দিয়েছিলাম। তারপর এই আজ। উফ! দৌড়ে পুরো হাপিয়ে গেলাম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি তবুও যেন ক্লান্ত মন শান্ত হচ্ছে না।
“কীরে এভাবে হাপাচ্ছিস কেন?”
আচমকা কারোর কথায় পিছন ফিরে দেখলাম আকাশ ভাইয়া। তার হাতে ক্যামেরা। পিক তুলছিলেন মনে হয়। সে যাইহোক, আমি সাধারণভাবেই বললাম,
“বেবলিরে খুঁজার জন্য সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠেছিলাম। তাই হাপাচ্ছি।”
“বেবাট! ও তো উপরেই থাকবে।যেহেতু উপরে মূল অনুষ্টান। ঐ দেখ, ও নাচ দেখে হাসিতে মত্ত হয়েছে।”
ভাইয়ার আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় অনুসরণ করে দেখলাম বেবলি, নাচ দেখে মিটিমিটি হাসছে। কিন্তু নাচ তো চমৎকার! তবুও ও হাসছে কেন? জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে গেলাম ওর কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বেবলি, তুই এইভাবে হাসছিস কেন?”
হঠাৎ আমাকে দেখে ও চমকিত হলো। পরক্ষণে হাসতে হাসতে বললো,
“আপা, একটু আগে আসতে পারতি। তখন দেখে জানতে পারতি। আমি কেন হাসছি?”
“একটু আগে তো আসিনি। এখন এসেছি। তাই দেখতেও পাইনি। তুই অন্তন্ত বল,আমি শুনি।”
” আপা একটু আগে একটা ছেলে নাচার মধ্যে ইচ্ছা করেই একটা মেয়েকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটা সবার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। মেয়েটার অবস্থা কী বিচ্ছিরি লাগছিলো! তাই তো এখনো মনে পড়লে হাসি পায়।”
আমার এই কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। একটা মেয়ে তো আর ইচ্ছাকৃত ভাবে পড়িনি। তাকে ল্যাং মেরেছে। তো এখানে হাসার কী আছে। তাই রাগে বেবলিকে বললাম, বেবলি এই নিয়ে তোকে যেন আমি আর হাসতে না দেখি।ওকে।”
“ওকে”
প্রত্যেকের নাচ দেখে আমি মুগ্ধ। তার সাথে সবার হাসি। সবার হাসি দেখে মনে হচ্ছে ওদের মতো সুখী আর কেউ নেই। কিন্তু প্রত্যেক হাসির আড়ালে থাকে এক সাগর পরিমাণ দুঃখ। ভিন্ন ধরণের দুঃখ
যা নিজের সত্তা ছাড়া কারোর কাছেই ভাগ করা যায় না। এগুলো ভাবতে ভাবতে সিঁড়ির দিকে নজর পড়লো। নিয়নের ভাই দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন। উনার এইভাবে আসা দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করবে এই ছেলেটা! সবার সামনে তুলে আছাড় দিবে না তো! যদি দেয় আমি কী করবো! নাহ, আমাকে লুকাতে হবে।
স্টেজের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম উনার পথচলার প্রতিটি পদক্ষেপ। এদিক সেদিক চেয়ে বার বার খুঁজছেন। খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন বেবলির কাছে। তারপর আর খোঁজার চেষ্টা করলেন না। বেবলির সাথে খোশগল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। উফ, এই যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেলাম। কালই চলে যাবো। বিয়ে-টিয়ে কিচ্ছু খাবো না। তারপর টিউশনিতে গেলে কী হবে? নাহ, আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। মাথাটা যেন ঝিম ধরে আছে। কাজ করছে না। আচ্ছা উনি এখনও কী গল্পে মেতে আছেন। দেখার জন্য স্টেজের পিছন থেকে উঁকি দিলে দেখতে পেলাম। বেবলি বিভোর হয়ে নাচ দেখছে। কাপল নাচ। আমিও সেখান থেকে কাপল নাচ দেখতে লাগলাম। বলা তো যায় না সেখানে গেলেই যদি ঐ খাটাশটা চলে আসে।
” কে তুমি? স্টেজের পিছনে কী করছো?”
আচমকা প্রশ্ন ও পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠ শুনে আত্মা কেঁপে উঠলো। পরিচিত কণ্ঠ লাগলো। কিন্তু তাও কে সেই লোক তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরালে দেখতে পেলাম,,,,,,,
চলবে,,,,,,,,,