প্রেয়সীর শব্দপ্রেম পর্ব-০৪

0
539

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৪]

-” ইতরের মৃ’ত্যু ভিতরে-ভিতরে। জানো তো?

ভয়ে চোখ বন্ধ ছিল নীরার তখনি পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল হিরণ কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঢোক গিলে মনে-মনে আউরালো, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। দেখে ফেলেনি তো আবার? নীরা’কে ভয় পেতে দেখে ঝুঁকে পড়ল হিরণ। জিজ্ঞাসা করল, ছেড়ে দিবো?
-” এই না-না ।

সরে দাঁড়ালো নীরা। সন্দিহান নজরে চারদিক দৃষ্টিপাত করল হিরণ। পূর্বের ঘটনা সে দেখেনি। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী করছিলে পোশাকের সামনে? চুরি?

গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নীরা। হিরণ কিছু দেখেনি বলে মনে+মনে লুঙ্গি ড্যান্স দিতে ভুল করল না। ভাবুক নীরাকে চুপ থাকতে দেখে হিরণ নিজেদের পোশাকের ধারে দাঁড়াল। নীরা এইবার চোখ কান বন্ধ করে এক-দুই-তিন বলেই দৌঁড় লাগালো। বুঝে উঠার পূর্বেই নীরার দৌঁড় দেখে বিষম খেল হিরণ। সন্দেহজনক হওয়ায় নিজেদের পোশাকে হাত রাখল। কুচিকুচি করা গোপন পোশাকগুলো হাতে পড়ল। তীব্র রাগে চোয়াল শক্ত হলো। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে বলল, অসভ্য মেয়ে আমি তোমায় দেখে নিবো।

মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ঝুমঝুমি। প্রাইভেট এক কোম্পানিতে জবের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। বর্তমানে গ্রাজুয়েট কমপ্লিট ছাড়া চাকরি পাওয়া দুষ্কর। কত ছেলে মেয়ে আছে পড়াশোনা শেষ কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। প্রাইভেট কোম্পানিতে যদি চাকরিটা পেয়ে তাহলে মা-বোনকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে ঝুমঝুমি। সমস্ত মনোযোগ বইয়ের পাতায়। হঠাৎ বেজে উঠল হাতের কাছে থাকা মুঠোফোনটি। বিরক্তি নিয়ে ফোন উঠাল ঝুমঝুমি। জ্বলজ্বল করছে মেঘের নাম। সযত্নে ফোনটা রেখে দিল। বার তিনেক ফোন আসলো, ঝুমঝুমি দেখেও না দেখার ভান ধরল। তখনই ম্যাসেজ আসলো, এই মুহূর্তে ফোন রিসিভ না করলে দু’গালে গুনে-গুনে আটটা থা’প্প’ড় লাগাবো। তোর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি বাধ্য করিস না বাসার ভিতরে ঢুকতে। রাগ বাড়ালে আমার চেয়ে খারাপ মানুষ এ পৃথিবীতে তুই খোঁজে পাবি না।

ম্যাসেজ পড়ল ঝুমঝুমি। মেঘের সম্পর্কে অবগত সে। তাই বাধ্য হয়েই বের হলো। রাত তখন আটটা দশ মিনিট। আকাশে ঘনকাটা মেঘের দেখা মিলেশে। রাতের মধ্যেই বৃষ্টি আসবে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সারি-সারি অযত্নে বেড়ে উঠা বড়বড় গাছ। রেন্টি গাছ বাতাসের বেগে হেলেদুলছে। ওড়না পিনআফ করার পরেও ঠিক জায়গায় থাকছে না। তীব্র রাগ নিয়ে মেঘের সামনে দাঁড়ালো। কণ্ঠে ফুটলো রাজ্যর বিরক্তি,
-” সমস্যা কী আপনার? রাত করে বাসার নিচে আসতে বললেন কেন?

মেঘ তখন গভীর চোখে দেখছে ঝুমঝুমিকে। মেঘের চোখ দুটো ভয়ানক রকমের লাল বর্ণ ধারণ করেছে, চুলের করুন অবস্থা। শার্টের বোতাম তিনটে খোলা। সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে স্পর্শ করে ঝুমঝুমিকে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, আমায় একটু ভালোবাসা যায়না ঝুমি? তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি শুধু নিজের জীবন দেওয়া ছাড়া। তোকে পাওয়ার জন্য আমায় বাঁচতে হবে। ভালোবাসার কাঙাল আমি। ঝুমঝুমি নামক পাষাণ প্রেয়সীর শব্দপ্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। আমায় একবার ভালোবেসে দেখ না। অযত্নে রাখব না, রাণীর মত রাখব। মেঘের ঝুমরাণী।

মাতাল মেঘকে দেখে ঝুমঝুমি চারদিকে চোখ বুলালো। এই প্রথম অজান্তে উচ্চারণ করল জঘন্য গালি। ঝুমঝুমির কন্ঠস্বর হতে ভালোবাসার শব্দের বিনিময়ে গালাগাল শুনে জোরে-জোরে হাসতে লাগলো মেঘ। মুহূর্তেই ক্ষোভের বসে ঝুমঝুমির গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল, তুই আমার না মানে আর কারো না। যা বাসায় যা।

আঙ্গুলের ছাপ বসে পড়ল ঝুমঝুমির গালে। নিজের করুণ অবস্থা দেখে কান্না পাচ্ছে ভীষন কিন্তু সহজে কান্না করার মেয়ে ও নয়। দম নিয়ে ধাতস্থ করে মেঘের উদ্দেশ্য বলল, আপনি বাসায় যান মেঘ ভাই। দয়া করে এখানে আসবে না। মাতাল হয়ে তো নই। অনুরোধ করছি।

কোমল দৃষ্টিতে তাকালো মেঘ। শান্ত গলায় বলল, চেষ্টা করব। বাসায় যা বৃষ্টি নামবে।

ঝুমঝুমি দ্রুত হেঁটে বাসার ভিতরে চলে গেল রেখে গেল একজন পাগল প্রেমিকের হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার। পার ভাঙ্গা জোয়ারে আশ্রয়ের সন্ধানে আসা মেঘকে ঠেলে দিল মাঝ সমুদ্রে। দুহাত মাথায় চেপে ধরল মেঘ। চিৎকার করে বলল, আমায় কেন ভালবাসিস না ঝুমি? আমি ম’রে যাচ্ছি, তোর বিরহে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। একটু ভালোবাসা দিয়ে আমায় বাঁচা প্লিজ।

মেঘের এসব কথা ঝুমঝুমির কানে পৌঁছালো না। তবে আজকের এই ঘটনায় অনেক বড় আঘাত আনবে একজনের হৃদয়ে। সবই হবে লোকচক্ষুর আড়ালে। ভুলের মাঝে সৃষ্টি নিবে মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি।

___________

নাজিমের বুকে মাথা দিয়ে মিরাজের পায়ের উপর পা তুলে শুয়েছে হিরণ। চুখেমুখে খেলছে দুষ্টুমি। আষাঢ় ওদের মাঝেই বসে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হিরণ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠে বলল, বোতল এনেছিস?

নাজিম অ্যালকোহল গ্লাসে ঢেলে সকলের সামনে ধরল। আষাঢ় বাদে সকলেই পান করল। শুরু হলো ড্যান্স। হিন্দি গানের সাথে তাল মিলিয়ে চলল ব্যাচেলর পার্টি।

______________

জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে নিরব ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে ঝুমঝুমি। কান্না পাচ্ছে খুব ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও বৃথা হচ্ছে বারংবার। নীরা ও তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চল বৃষ্টিতে ভিজি।

দুজন চমকে উঠল ভীষণভাবে। কানে টান দিয়ে অবাক হয়ে বলল, ঠিক শুনছি তো নীরা? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো।
-” না রে তৃষ্ণা আমরা বোধহয় স্বপ্ন দেখছি।

দুজনের কথা শুনে ম্লান হাসলো ঝুমঝুমি। এক প্রকার তাড়া দিয়ে চলল ছাদে। অতীতের পুরনো ঘা হৃদয়ে হানা দিয়েছে। শান্তি পাওয়া দরজার, ভীষণভাবে দরকার। রাত বেড়াতে বৃষ্টিতে ভিজার অভ্যাস নেই নীরা-তৃষ্ণার তবুও ঝুমঝুমির কথা রাখার জন্য ভিজতে লাগল। রাতের আঁধারে মৃদু আলোর রশ্মিতে ভিজতে মন্দ লাগছে না। ওরা দুজন নিজেরা গান গেয়ে সুরে-সুরে তাল মিলাচ্ছে ঝুমঝুমি তখন ওদের থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ফেলতে ব্যাস্ত। চোখের সামনে ভেসে আসছে পুরনো স্মৃতি। ভয়ঙ্কর অতীতের কথা স্মরণ হতেই শরীরের লোমশ দাঁড়িয়ে পড়ল। টনটনে-কনকনে শীতের রাতটায় ছটফট করেছিল ছোট্ট ঝুমঝুমি তখন ওর বয়স কত হবে পনেরোর এদিক-সেদিক।

ঝুমঝুমির বাবারা তিনভাই-একবোন। সকলের থেকে অবস্থা ভালো ছিল ঝুমঝুমিদের। কিন্তু সমস্যা ছিল একটা ঝুমঝুমির কোনো ভাই ছিল না এনিয়ে ঝুমঝুমির মা’কে ওর ফুপি-চাচীরা নানান কথা বলতো। তখন ওর বাবা এসবে কান দিত না উল্টো ধমক দিয়ে উঠত ভাইয়ের বউদের ও বোনকে। পারিবারিক অবস্থা ভালো থাকায় তখন পরিবারের চোখের মনি ছিল ঝুমঝুমি ও ঝর্ণা। হঠাৎ একদিন ঝুমঝুমির বাবার ব্যাবসায় বড় অংকের টাকার লোকসান ঘটে। লোকসানের ঘটনা মনে-মনে গেঁথে বসে ঝুমঝুমির বাবার, সেই থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জমানো অর্থ দিয়ে শরীর মোটামুটি ভালো হলেও পরিবারের লোকজনের ব্যাবহার হয়ে উঠে ধারালো চা’কু’র মত। ঝুমঝুমির মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই ওর বাবার অসুস্থ্যতা বেড়ে যায়। ঠান্ডা,জ্বর লেগেই থাকত। সেই সাথে বুকে এক অসহ্য ব্যাথা। ঝুমঝুমির ফাইন্যাল পরীক্ষার তৃতীয়দিন দুনিয়ার মায়া ছেড়ে বিদায় নেয় ঝুমঝুমির বাবা। কোনোমতে পরীক্ষা শেষ করে বাবাকে শেষবারের মত দেখে জ্ঞান হারায় সে। বাবার মৃত্যুতে পরিবারের সকলের চোখের বালি হয় ঝুমঝুমি ও- ওর পরিবার। এভাবে তিনমাস কেটে যায় অবহেলায়,লাঞ্ছনায়,অনাদরে। ভাই না থাকায় সকল জায়গা-জমি আত্মসাত করে ওর দুই চাচা। জেসমিন বেগম ভীতু প্রকৃতির মানুষ। মামলা-মোকদ্দমা সম্পর্কে অবগত নয়। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে স্বামীর ভিটেয়। বাবার বাড়ি থেকে সাহায্যর হাত কেউ বাড়ায়নি তখন।

শীত তখন প্রচন্ড। জেসমিন বেগম ঝর্ণাকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি। ছোট্ট মেয়েটির ডায়েরিয়া হয়েছিল। ঝুমঝুমিকে বাড়িতে থাকে সেদিন। সেদিনও ছিল বৃষ্টিময় রাত। কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বোনের চিন্তায় কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে ঝুমঝুমি। শক্ত,পুরুষালি হাত ঝুমঝুমির আবেদনময়ী জায়গায় নোংরা ছোঁয়া ফলাতে ব্যাস্ত। ঝুমঝুমি টের পেয়ে সরে যেতে চাইলেও শক্ত হাত চেপে ধরে কর্কশ গলায় বলে, দূরে যাবে না। আমার কাজ আমায় করতে দাও। সহজে দিয়ে দাও কষ্ট দিবো না। ঝামেলা করলে ব্যাথা বেশি পাবে।

ঝুমঝুমি সেদিন পরিচিত কণ্ঠের নোংরা কথা শুনে চিল্লিয়ে উঠে। বৃষ্টিময় রাতে ঘটে যায় বিষময় ঘটনা। সেদিন ঝুমঝুমির চিৎকার কারো কানে পৌঁছাল না। বাবার আদরের বড় হওয়া ফুলকে সেদিন দুমরে-মুচড়ে শেষ করে দেয় আপন লোকজন। কালো রাতের কালো ছোঁয়ায় ধারালো তীরের ফলা বিঁ’ধে পুরো অ’ঙ্গে।

##চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে