#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৩]
ঝুমঝুমি পিছনে তাকিয়ে দেখল আলনার জামা কাপড় এলোমেলো। মেঝেতে কয়েকটা জামা পরে আছে। বইগুলো ছড়ানো-ছিটানো। পানির গ্লাসটা মেঝেতে রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো ঝুমঝুমি, এসব কীভাবে হলো?
তৃষ্ণা ও নীরা একত্রে বলল, ছেলেগুলো এসে আমাদের ওড়না সব নিয়ে গেছে।
ঝুমঝুমি চলে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর তিনজন ছেলে কলিং বেল বাজায়। ডোর-হোলে ভাড়াটিয়া তিন ছেলেকে দেখে প্রথমে দরজা খুললো না ওরা। কিন্তু পাজি ছেলেগুলো শপথ নিয়েছে যতক্ষণ না পর্যন্ত দরজা খোলা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কলিং বেল বাজিয়েই যাবে। ধৈর্য হারিয়ে নীরা দরজা খুলে।
-” দরজা খুলতে দেরি হলো কেন?
বলতে-বলতে রুমের ভিতরে ঢুকে পড়ে ছেলেগুলো। তৃষ্ণা ভীতু না হয়ে কঠিন গলায় বলে, আপনারা রুমে ঢুকছেন কেন?
কবিতা বলা ছেলেটি বলে, ঐ মেয়েটি কই, তার জন্য আমার মন করে শুধু টই-টই।
নীরা বিরক্তি নিয়ে বলল, কী চাই? সকালের ঝ’গড়া সকালে শেষ এখন কেন এসেছেন?
-” আমাদের অপমান করে পার পেয়ে যাবে ভেবেছিলে? তা’তো হবে না। হিরণকে অপমান করার শাস্তি তোমাদের পেতে হবে। মিরাজ,নাজিম ওদের আলনা থেকে জামাকাপড় সব নিয়ে চল। পাপোশ বানানো কাকে বলে,কত প্রকার,উদাহরণস্বরূপ বুঝিয়ে দিবো।
বলা শেষ না হতেই তিনজন আলনা থেকে ওড়না সব গলায় ঝুলিয়ে, জামা কাপড় এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, পড়ার টেবিল এলেমেলো করে চলে গেল। নীরা ও তৃষ্ণা বাঁধা দিয়েও লাভ হলো না।
সবকিছু শুনে অদম্য রাগ চেপে বসলো ঝুমঝুমির। সিদ্ধান্ত নিলো এদের কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে। মেয়ে বলে সবসময় অপদস্ত করবে কেন? মেয়েদের শক্তি নেই? মান-সম্মান নেই? মাথা ঠাণ্ডা রেখে গমগম সুরে বলল, এখন খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড় সকালে যাব তিন তলায়।
ফজরের নামাজ আদায় করে রান্না করতে চলে গেল ঝুমঝুমি। এরই মাঝে মায়ের ফোন আসলো। স্পিকার বাড়িয়ে কথা বলল, হ্যাঁ বলো?
-” মেঘ’কে বিয়ে করে ফেল মা। প্রতিদিন এদের অসহ্য কথা ভালো লাগছে না আর।
মলিন হাসলো ঝুমঝুমি। কড়াইতে আলুর টুকরো ছেড়ে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বলল, তোমার কী মনে হয় আমি মেঘ ভাইকে বিয়ে করলে সুখী থাকবো?
অপরপাশ থেকে শব্দ আসলো না তাই ঝুমঝুমি আবারও বলল, জানোই তাহলে কেন বলো বিয়ে করতে?
-” ঝর্ণার জন্য ভয় হয় মা। মেয়েটা সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। ভাবী হু’ম’কি দিচ্ছে বারবার যদি তুই বিয়েতে রাজি না থাকিস তাহলে ঝর্ণা এবং আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। তুই এখনও স্টুডেন্ট, টিউশনি করে কয় টাকা পাস বল? আমাদের তিনজনের খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত করিস না ঠিকমত। মেঘ’কে বিয়ে করলে অনন্ত তোর আর টিউশনি করতে হবে না। মেঘ’কে আমি যতটুকু জানি ও আমাদের দায়িত্ব নিবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো ঝুমঝুমি। মায়ের ব্রেন-ওয়াশ খুব ভালো মতোই করেছে তাসলিমা খাতুন।
-” কয়েকদিন কষ্ট করো শুনে যাও ওদের কথা। গায়ে হা’ত তুলছে না এটাই অনেক। খুব শীগ্রই তোমাদের আমার কাছে নিয়ে আসবো। ওদের কথা গায়ে মাখিও না। দাঁত চেপে সহ্য করে যাও। কয়েকদিনের জন্য না হয় বেহায়া হলাম। গন্ডারের চামড়া মনে করে সহ্য কর।
ফোন কেটে দিলো ঝুমঝুমি। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু সে পারছে না। এত অপমান করার পরেও মা-বোনকে বলছে ঐখানে পরে থাকতে। কেমন মেয়ে সে? নিজের উপর বারবার ধিক্কার জানিয়ে রান্না শেষ করল। তৃষ্ণা ও নীরা সকালে উঠতে পারে না। ঝুমঝুমি বহু কষ্টে ফজরের সময় উঠায় ওদের। ওরা নামাজ পড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। রান্না-বান্না শেষ করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো ঝুমঝুমি। গোসল করে পোশাক পরার সময় মনে হলো ওদের ওড়না নিয়ে গেছে তিন তলার ভাড়াটিয়া তিনজন ছেলে। গামছা জড়িয়ে বের হয়ে তৃষ্ণা ও নীরাকে ডাক দিল। এক্ষুনি যেতে হবে তিন তলায়। বেয়াদব ছেলেদের কড়া ভাষায় কয়েকটি কথা বলবে আজ।
কলিং বেল বাজার পাঁচ মিনিট পর দরজা খুললো নাজিম। দেখেই মনে হচ্ছে সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। দরজা খোলার পর সামনে তিন-তিনটি রমণীকে দেখে ঘুম রাজ্য থেকে উবে গেল। মুচকি হেসে বলল, দরজা খুলে দেখব জারে করব তারে বিয়া, আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন-তিনটে টিয়া।
নীরা নাক ছিটকে বলল, বাজে কবিতা। আপনার কবিতা শুনে কবিতারা প্রতিনিয়ত হার্ট-অ্যাটাক করছে। দয়া করে বেচারাদের উপরে আর অত্যাচার করবেন না।
নীরার কথাকে পাত্তা না দিয়ে নাজিম ঝুমঝুমিকে মনযোগ দিয়ে দেখে বলল, রাজার রাজ্যয় তোমারই বাস, ওগো কে তুমি রাজার প্রিয় স’র্ব’না’শ। সুন্দর না?
-” আমাদের ওড়না কোথায়?
ঝুমঝুমির কঠিন গলা। নাজিম কিছু বলার আগেই পিছন থেকে ভেসে আসলো, কে এসেছে নাজিম?
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল হিরণ। অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল, আমাদের রুমটা আজ আপনাদের পায়ের ধুলোয় পরিপূর্ণতা লাভ করল। আসুন আসুন ভিতরে আসুন। মিরাজ ম্যাডামদের জন্য চা-কফির ব্যাবস্থা কর।
ঝুমঝুমি এসেছিল এদের শায়েস্তা করতে কিন্তু এদের চালচলন,কথাবার্তা শুনে নিজেই উল্টো বোকা বনে গেল। একেকটা অসভ্য,নচ্ছার। এদের সাথে কথা বলা মানে নিজের সময় নষ্ট করা। মনেমনে যা ভেবেছিল এখন সেসব কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। ভদ্রতার খাতিরে বলল, আমাদের ওসব দরকার নেই। ওড়নাগুলো দিয়ে দিন আমরা চলে যাচ্ছি।
মিরাজ সোফার উপরে পা ঝুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কিন্তু আমরা তো ওড়না দিয়ে পাপোশ বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের লুঙ্গি আছে ওড়নার মত পড়া যাবে। নিবে?
তৃষ্ণা হাতের কাছে কিছু খোঁজতে ব্যাস্ত। পেয়ে গেলেই ছুঁড়ে মা’র’বে এদের গায়ে। ঝুমঝুমি ইশারায় শান্ত হতে বলল তৃষ্ণাকে। অযথা প্যাচাল ,কথাবার্তা বলে লাভ নেই। ছেলেগুলোর কথাবার্তা শুনেই বুঝা যাচ্ছে একেকটা বজ্জাতের হাড্ডি।
-” শুনুন, এখানে ঝ’গড়া করতে আসিনি। পাশের রুমের কেউ দেখার আগেই আমাদের জিনিস আমাদের দিয়ে দিন। তা’নাহলে বাড়িয়ালি আন্টির কাছে নালিশ দিবো।
ফোন টিপতে-টিপতে এদিকে আসছিল আষাঢ়। হঠাৎ ঝুমঝুমির কণ্ঠ শুনে সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। সদ্য গোসল সেরে এখানে এসেছে বুঝাই যাচ্ছে। ভিজা চুল থেকে টুপটুপ পানি ঝরছে, ওড়নার বদলে গামছা জড়ানো। মুহূর্তেই নেশা ধরে গেল চোখে। আষাঢ়কে এদিকে আসতে দেখে হিরণ বিড়বিড় করে বলল, কন্ট্রোল দোস্ত কন্ট্রোল। প্ল্যান কিন্তু জলে ভেসে যাবে।
আষাঢ় গরম চোখে তাকাল বলল, ওদের ওড়না দিয়ে দে। দুষ্টুমি করবি ভালো কথা কিন্তু লিমিট ক্রস করে নয়। প্রথমত অন্যায় করেছিস ওদের রুমে গিয়ে, দ্বিতীয়ত ওদের পার্সোনাল জিনিসে হাত দিয়ে। বন্ধু হয়েছিস বলে তোদের অন্যায় আবদার সহ্য করব এমনটা নয় । ওদের জিনিস ওদের ফিরিয়ে দে।
মিরাজ হতাশ হয়ে রুম থেকে ওড়নাগুলো ওদের হাতে দিয়ে তৃষ্ণার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, বেগুনি ওড়না তোমার নিশ্চয়? ঘ্রাণ কিন্তু মারাত্মক। সারারাত জড়িয়ে ধরে সুঘ্রাণ নিয়েছি।
-” আপনাকে আমি দেখে নিবো।
ওড়না পেয়ে চলে আসার সময় ঝুমঝুমি ত্রিশ টাকা আষাঢ়ের সামনে ধরে বলল, আপনার টাকা।
-” লাগবে না।
-” কেন লাগবে না? আমি অপরিচিত কারো দয়া নেই না।
সোফার উপরে টাকা রেখে চলে গেল ঝুমঝুমি। ওরা চলে যাবার পর আষাঢ় সে টাকা তুলে টাকার উপরে চুমু খেয়ে বলল, আর কতরুপ দেখাবে তুমি, প্রতিটি রূপেই মুগ্ধ হই আমি।
________________
জানালায় পা ঝুলিয়ে বালিশে মাথা রেখে ফোনে স্ক্রল করছে নীরা। মাথার কাছে বসেছে তৃষ্ণা। হাতে মুড়ি মাখা। নিজে খাচ্ছে এবং নীরাকেও খাইয়ে দিচ্ছে। তবে দুজনের দৃষ্টি ফোনের দিকে। “এলিয়েন গার্লফ্রেন্ড” ড্রামা সিরিজ দেখতে ব্যাস্ত দুজনে। রোমান্টিক সীন চলছে ঠিক ওইসময় ঝুমঝুমি এসে বসলো ওদের পাশে। রোমান্টিক সীনটা দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল, ভালো হতে পয়সা লাগে না।
নীরা বলল, তুই তো নিরামিষ প্রজাতির মেয়ে বুঝবি কীভাবে ভালোবাসা কী?
-” আমার ওসব ভালোবাসা-টালোবাসার দরকার নেই। এখন চল ছাদে হাঁটতে যাই। গাছগুলোতে পানি দেওয়া হচ্ছে না।
তৃষ্ণা ফোন রেখে উঠে দাঁড়াল। নীরার কানে ফিসফিস করে কিছু বলল। নীরা দুষ্টু হেসে বলল, তোরা যা আমি আসছি।
বান্ধবীদের দুষ্টু হাসি দেখে সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল ঝুমঝুমি, মতলব কী তোদের? অঘটন ঘটলে খবর আছে।
ঝুমঝুমির কথায় পাত্তা না দিয়ে তৃষ্ণা জোর করে নিয়ে গেল । পাঁচ মিনিট পর নীরা আসলো ছাদে। ছাদের এক কোনায় তৃতীয় তলার চার ছেলের জামা-কাপড় ঝুলানো। তৃষ্ণা ঝুমঝুমিকে আড়ালে নিয়ে অন্য কথায় ব্যাস্ত। নীরা এই ফাঁকে হাতে গ্লাভস পরে ছেলেদের গোপন পোশাক হাতে নিয়ে কুচিকুচি করে কে’টে লুঙ্গির ভিতরে রেখে দিল। লুঙ্গিতে দুটো করে ফোঁটা করে দৌঁড়ে নিচে নামতে যাবে তখনই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়তে যাবে তাৎক্ষণিক পুরুষালি শক্ত হাত খপ করে ধরে ফেলল ওকে।
-” ইতরের মৃ’ত্যু ভিতরে ভিতরে। জানো তো?
##চলবে,