প্রেয়সীর শব্দপ্রেম পর্ব-০১ (দ্বিতীয় খন্ড)

0
606

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[১]

কোম্পানির বসের রূপে প্রিয় প্রাক্তনকে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু-পা পিছিয়ে নেয় ঝুমি। চোখের পাতায় ভেসে উঠে পুরনো স্মৃতি,মধুর সম্পর্ক,বিষাদের সুর। অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে গাল টপকে নিচে পড়ে। হাতের বাহুতে চোখের পানি মুছে সামনে থাকা মানুষটিকে প্রশ্ন করে, আপনি এখানে?

এত বছর পর প্রিয় মানুষকে চোখের সামনে দেখে অবাক হয় আষাঢ়। চোয়াল শক্ত হয়ে আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষে। রাগ শরীরের শিরা-উপশিরায় টগবগ করে ফুটছে। প্রিয় মানুষের অপ্রিয় ব্যাবহারে বুকের ভিতরটা তেতো হলো। অচেনার মত চেয়ে থেকে উত্তর দিল, আমায় বলছেন?

চরম পর্যায়ে অবাক হলো ঝুমি। আষাঢ় ওকে চিনতে পারছে না কিন্তু কেন? নাকি চিনেও না চিনার ভান ধরেছে? ঝুমঝুবি অবশ্য কথা বাড়ালো না। আগ বাড়িয়ে পরিচয় দেওয়াটা বোকামি। আষাঢ় চিনেও যদি না চিনার ভান ধরে তখন অপমানিত বোধ করবে সে। প্রশ্ন ঘুরালো। কাগজপত্রের ফাইল আষাঢ়ের সামনে ধরল। ফাইল হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আষাঢ়। ঘাটাঘাটি করে বলল, ফাইন। আপনি নতুন জয়েন করেছেন আজ?

ঝুমঝুমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। বিস্ময়ের নগর থেকে এখনও মন সরেনি। আষাঢ়ের প্রতিটি বক্তব্য অচেনা ঠেকছে ওর। যথা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে অবচেতন মনে প্রশ্ন করল, স্যার! আপনার নাম কী?

আষাঢ় মনে-মনে বিস্তার হাসলো। কিন্তু চেহারার গম্ভীর ভাব ধরে রইল। ভাঁজ পড়ল কপালে। হাত ঘড়িটা ঠিক করে গমগম কণ্ঠে শুধাল, জব নেওয়ার আগে বসের নাম শুনেননি?

কথা আটকাল কণ্ঠে। উত্তর খোঁজে না পেয়ে আমতা-আমতা করে ফাইল হাতে নিয়ে দ্রুত পা বাড়াল। এক মুহুর্ত সময় এখানে থাকা যাবে না। প্রিয় মানুষটির অপ্রিয় সত্তা মানা যায় না। হৃদয়ে ব্যাথার দাবানল জ্বলে। এক সমুদ্র কষ্টের তাড়নায় গুটিয়ে রাখা নিজেকে প্রকাশ করা বেমামান। সূর্যের দাপটে চলা ঝুমঝুমি কখনোই নিজের সত্যকে প্রকাশ করবে না।

ঝুমঝুমি চলে যাবার পর পরেই আষাঢ় টেবিলে শক্ত থাবা দিল। চোখের সামনে ঝুমঝুমির অস্তিত্ব আবারও গভীর সমুদ্রে ঠেলে দিল। ম্যানেজারকে ফোন দিল। আদেশ করল ঝুমঝুমির ডিটেলস ইমেইলে পাঠাতে। মিনিট পনেরোর মধ্য ইমেইলে ডিটেলস আসলো। মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে রিলেশন স্ট্যাটাসে ‘ম্যারিড’ দেখতে পেয়ে মুখশ্রী শক্ত হলো। কান গরম হলো। চোখে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠল। হাতের কাছে থাকা গ্লাসটি ফ্লোরে ছুঁড়ে বিড়বিড় করল,
-” আমাকে পুড়িয়ে নতুন করে জ্বালাতে আসলে কেন তেজপাতা? তোমাকে ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরনো ঘা’য়ে নতুন করে আঘাত কেন করলে? সুখেই তো আছো। আমার মন,ভালোবাসা সব হ’ত্যা করে নিজে তো বড্ড সুখে। তোমার সুখ যে আমার সহ্য হচ্ছে না। কী করণীয় এখন আমার?

নিজে-নিজে বিড়বিড় করে বের হয়ে পড়ল আষাঢ়। যাওয়ার পথে একবার ঝুমঝুমির ডেস্কে চোখ বুলিয়ে হাঁটা ধরল। ঝুমঝুমি দেখল আষাঢ়ের চোখের ভঙ্গি। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো।
পুরনো স্মৃতি আকড়ে ধরতে নেই। কাঁটা যুক্ত জালে আটকে আবারও নিজের ক্ষতি করবে না। অনেক কিছু হারিয়েছে জীবন থেকে। ছোট্ট জীবনে সব হারিয়ে পথের ভিখারিনী এখন। হারানোর মত জীবনে একজন রয়েছে। তাকে সে হারাতে পারবে না। কোনো কিছুর বিনিময়ে না।
______________________________

রুমের ভিতরে চলছে মিউজিক। সারি-সারি হুইস্কির বোতল। লাগাতার একের পর এক গ্লাস গলায় ঢেলে হিরণকে বলল,
-” ও কেন আবার এসেছে?

হিরণ নিশ্চুপ রইল। ঝুমঝুমির চলে যাওয়ার কথা শোনার পর আষাঢ়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দুই বছর কোমায় ছিল। বিদেশে ভালো চিকিৎসার মাধ্যমে দুই বছর পর সুস্থ হয় ঠিকই কিন্তু পুরনো আষাঢ়কে ফিরিয়ে পাওয়া যায় না। হাসি খুশি, নরম মনের আষাঢ়ের ভিন্ন রূপ খুব কষ্টে মেনে নেয় বন্ধুমহল। আষাঢ়ের জীবন গুছানোর জন্য সর্বক্ষণ সাপোর্ট দিয়েও আশারুপ ফল পাইনি তারা।
-” ওর সত্যিই বিয়ে হয়েছে?
-” ডিটেলস তো তাই বলে।
-” ওর হাজব্যান্ডের নাম?
-” জানি না। শুধু ম্যারিড লিখা ছিল।
-” ঠিকানা?
-” ছায়াতল ১০৮ গলির ৫ নম্বর বাসা।

আষাঢ়ের ডিটেলস শোনে মিরাজ বলল, মেয়েটাকে এমন শাস্তি দিবো না জীবনেও প্রতারণা করার কথা ভাববে না।

আষাঢ় ধমকে উঠল, ঝুমঝুমি আমায় কখনোই বলেনি ও আমায় ভালোবাসে কিংবা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। ওকে দোষ দেওয়া বন্ধ কর রাস্কেল।

মিরাজ ফোঁস করে দম ছাড়ল। এতকিছু হওয়ার পরেও মেয়েটার জন্য ভালোবাসা উতলে পড়ছে দেখে রেগে গেল। মুখ খুলতে যাবে হিরণ ইশারায় থামতে বলল। মিরাজ চুপ থাকলো। নাজিম তখন চোখে-মুখে প্রশান্তির ঢেউ খেলিয়ে বলল, চল ঝুমঝুমির স্বামীকে গু’ম করে আষাঢ়ের সাথে নতুন করে বিয়ে দিয়ে দি।

তিনজন বিরক্ত হলো নাজিমের বাজে কথায়। চোখ-মুখ শক্ত করে আষাঢ় বলল, ঝুমঝুমির স্বামীকে আমি সচক্ষে দেখতে চাই। আমাকে অবহেলা করার কারণ জানতে চাই। যতক্ষণ আমি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে না পারবো ততদিন জ্বালাবো। আমার অনুভূতির সাথে খেলা করা ঠিক হয়নি তোমার তেজপাতা।

_______________________

সূর্য ডুবেছে অনেক আগে। আকাশ জুড়ে কালো টিপ লাগানো। ছোট-ছোট ব্রণের দাগ হওয়া নক্ষত্রের মাঝে বিরাজ করছে এক ফালি লম্বা চাঁদ। চেয়ারে হেলান দিয়ে ভেজা চুল ছেড়ে বসেছে ঝুমঝুমি। অফিস থেকে ফিরেই লম্বা গোসল দিয়েছে। শাড়ির আঁচল ফ্লোরে লুটোপুটি খাচ্ছে। ফ্যান ছাড়ার ফলে আঁচল ও চুল অবাধ্য হয়ে নড়ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ঝুমঝুমির। মনোচিন্ত অফিসের প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ব্যাস্ত। বার কয়েক ডেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে চার বছরের এক মেয়ে ঝুমঝুমির সামনে কোমরে হাত রেখে রাগী মুডে দাঁড়ানো।
-” আমার তকলেট কোথা মাম্মা?

জিভে কামড় দিল ঝুমঝুমি। অতীতের মায়াজালে পরে চকলেট আনতে ভুলে গেছে। ক্লান্তিকর দেহটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” আমার ঝিনকু মা রাগ করেছে? মাম্মা তো চকলেট আনতে ভুলে গেছে। মাম্মা প্রমিজ করছে আগামীকাল গুনে-গুনে দুটো আনবে।
-” তত্তি?
-” হুম সত্যি।

ঝুমঝুমির বুকে মাথা রাখলো ঝিনুক। খিলখিল করে হেসে দিল। শাড়ির আঁচল নিজের মাথায় দিয়ে লাজুক-লাজুক হাসলো। ঝুমঝুমির লম্বা চুল আঙ্গুলে পেছালো। গালে চুমু দিল। ঝিনুকের আদর খেতে-খেতে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করল, দুষ্টুমি কি করেছো? হালিমা খালা কোথায়? খালা ও খালা তুমি কোথায়?

হাঁক ছেড়ে ডাকলো ঝুমঝুমি। ব্যাস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে ঝিনুকের দিকে কড়া চোখে তাকালো হালিমা। বলল, তোমার মাইয়াটা খুব শয়তান। দেখো গিয়া ঘরের কি অবস্থা করছে। ডাইলের প্যাকেট ছিইড়া পুরো ঘরে ছড়াইয়া রাখছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে একটুও নিস্তার নাই। তোমার মাইয়ার পিছনে দৌড়াতে-দৌড়াতে দেখো আমার পাঁচ কেজি ওজন কইমা গেছে।

ঝুমঝুমি হাসি আটকাল। ঝিনুকের দিকে কঠিন নজরে তাকিয়ে বলল, নানুকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছি না? লক্ষী মেয়ের মতো থাকবে নয়তো চকলেট পাবে না।

ভদ্র বাচ্চার মত মাথা ঝাঁকাল ঝিনুক। হালিমা এক পলক দেখে বলল, দেখো এমন ভাব দেখাইতেছে হের মত ভদ্র-শান্ত মাইয়া দুনিয়াতে আর দুইডা নাই। আমি বুঝি না তোমার মত শান্ত-ভদ্র মাইয়ার বাচ্চা এমন শয়তান কেমনে হয়?

শান্ত কণ্ঠে ধমক দিল ঝুমঝুমি।
-” খালা তোমাকে অনেকবার বলেছি বাচ্চাদের শয়তান বলতে নেই। বাচ্চারা হলো ফেরেশতা। তাছাড়া দুষ্টুমি তো বাচ্চারাই করবে বড়রা তো না। বড় হলে আমার মেয়েও আমার মত ই স্ট্রং হবে।

হালিমা আমতা-আমতা করল। এক গাল হাসি দিল। বলল, মুখের চোটে আইয়া পড়ছে। তুমি মা কষ্ট পাইও না। ঝিনুক দুষ্টামি করলেও ও অনেক ভালো। আমারে কত সুন্দর নানু কয়। পরান্ডা জুড়ায় যায়।

ঝিনুক খিলখিল করে হেসে হালিমার পিছনে শাড়ির আঁচল টানতে লাগল। ঝুমঝুমি সেদিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ওকে রুমে নিয়ে যাও আমার মাথাটা ধরেছে। একটু একলা থাকি।
-” আইচ্ছা।

আজ অনেকগুলো দিন পর পুরনো ছবিগুলো দেখল ঝুমঝুমি। জমিদার বাড়িতে তুলা ছবিগুলো। তৃষ্ণা-নীরার ছবিতে হাত বুলিয়ে ওদের অস্তিত্ব অনুভব করায় চেষ্টা করল। কতগুলো বছর হলো প্রিয় বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ নেই, কথা নেই। অভিমানে যোগাযোগ বন্ধ করেছে দুজন। নিরবে অতীতের দেওয়ালে তালা ঝুলিয়ে সন্তপর্নে রুমে ঢুকল ঝুমঝুমি। ঝিনুক হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। নিষ্পাপ মুখোশ্রী, আদর-আদর আদল, গাল দুটো ফোলা-ফোলা, গোলাপী ঠোঁট, বড়-বড় পাঁপড়িতে ডাকা টানা চোখ,বাঁশির মতো নাক, ঠোঁটের বাজে চমৎকার কালো ছোট্ট তিল। খুব যত্নে বানানো মোমের পুতুল। ঝুমঝুমি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে শান্তির নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজলো। সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই পালিয়ে গেল। চোখের পাতায় ঘুমেরা হানা দিল। চোখ বুজতেই চোখের সামনে আষাঢ়ের হাসজ্যোল মুখ ভেসে উঠল। অভিমানী কণ্ঠ শুধায়, আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি ভালো আছো তেজপাতা? তুমি খুব খারাপ। তুমি আমায় ভালোবাসোনি?

##চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে