প্রেম শহরে পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
1821

@প্রেম শহরে
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু

আরদি গিয়ে দেখে আয়ন তখনো জেগে ফোনে কিছু একটা করছে। রুমে প্রবেশ করে সে নিচু স্বরে বলল, “দুঃখিত! তখন রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে চড় মেরেছি আমি। আ’ম স্যরি!”

কথাটা শুনতে পেয়ে আয়ন না তাকিয়ে বলল, “প্রবলেম নেই। যাও তুমি এখন।”

আরদির গায়ে লাগলো শেষ কথাটা। স্যরি বলতে এসেছিল সে, থাকতে আসেনি। ‘যাও তুমি’ বলার কী দরকার?

চেয়ার বসে আরদি বলল, “কিছু কথা ছিল।”
-“বলো।”
-“এমন ভাব করছেন যেন আমার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যাবে।”
-“যাবে না। ”

হাসি হাসি মুখ করে তাকা ছেলেটার এমন গম্ভীর কথা শুনলে যে কেউ বিরক্ত হবে। আরদিও হচ্ছে, কিন্তু সেটা চেপে রেখে বলল, “আপনি এখন কী করছেন?”
-“ফোন টিপছি।”
-“তা বলছি না। মালেশিয়া থেকে আসলেন কখন?”
-“দু’তিন মাস আগে। কেন?”
-“আঙ্কেল-আন্টি কোথায়?”
-“গ্রামের বাড়ি, রুচির বাসায় থাকছি আমি।”

রুচি মানে আরদির সেই বান্ধবী যে আয়নের কাজিন হয়। তিন বছর আগে তার বিয়ে হয়ে যাওয়া বর্তমানে যোগাযোগ নেই। মৃদুস্বরে আরদি বলল,”রুচি কেমন আছে?”
-“ভালো।”
-“এখানে জব করছেন আপনি?”
-“হুম।”
-“সত্যি করে একটা কথা বলবেন?”
-“সত্য বলতে মানতে পারবে?”
-“আমার জন্য অপেক্ষা করেন?”
-“‌আমি ‘হ্যাঁ’ বললে পরিস্থিতি পালটে যাবে?”

আরদি চুপ করে রইল। চোখের জলগুলো বিনা বাধায় গড়িয়ে পড়ছে। অনেক বড়ো ভুল করেছে সে। একদিকে সাগর অন্যদিকে আয়ন!

আয়ন বলল, “আমি বলেছিলাম আরদি, একদিন না একদিন আমি ফিরে আসবো। তুমি কথা দিয়েছিলে অপেক্ষা করবে।”
-“৬ বছরে যে পরিস্থিতি পালটাবে না কে জানতো? আমি শুনেছিলাম আপনি মালয়েশিয়া সেটেল হয়ে যাচ্ছেন। আপনার অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে। ”
-“বাচ্চাদের মতো কাঁদবে না আরদি।বাচ্চা-বাচ্চা কথাও বলবে না। যে কেউ এসে যা-তা বলল আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে?”
-“আমার আগেও তো আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিল অনেকজন তাই…”
-“তুমি আমার লাইফে আসার পর আমি কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি বসন্ত রাণী। ”

চোখের জল মুছে নিলো আরদি। সবটা দোষ তার! হাতের দিকে তাকিয়ে আরদি রিং’টা খুলে ফেলল। তা দেখে আয়ন বাঁকা হেসে বলল,” বিয়েটা তুমি নিজের ইচ্ছায় করছো না?”
-“অনিচ্ছা ছিল না। সাগরকে বিয়ে না করার কোনো কারণ ছিল না৷ ”
-“এখন আছে?”
-“হয়তো।”
-“তোমার বাবার সামনে গিয়ে বলতে পারবে বিয়েটা তুমি করতে পারছো না?”

নিশ্চুপ হয়ে গেল আরদি। এই সাহসটা তার নেই। কিন্তু সাগরের সাথে সারাজীবন অভিনয় করাটাও সম্ভব না। সময় আছে এখনো! কিছু না বলে আরদি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। খুব বিশ্রী একটা পরিস্থিতি দাঁড় হয়েছে। হয় মরণ নয় বাচন!

.
দু’ তিনটা তিন এমনিই কেটে গেল। খুব বাজে দিন কেটেছে। আয়নের সাথে এর মাঝে একবারও কথা হয়নি। সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আরদির শরীরের অবস্থাও ভালো না। সেদিন আরদির সাথে দেখা করতে রুচি এলো। তাকে দেখতে পেয়ে আরদি স্বস্তি পেল, এই বুঝি আয়নের কোনো খোঁজ পাবে।

রুচিকে দেখে আরদি বলল, ” একা এলি? বাচ্চা কই তোর?”
-“মায়ের কাছে।”
-“তুই মোটা হয়ে গেলি কেন হঠাৎ? ”
-“হঠাৎ? কত বছর পর দেখেছি বল তো?”

দাঁত খেলিয়ে হাসলো আরদি। সময়টা হুবহু আগেকার দিনের মতো। রুচি যখন তার বাড়িতে আসতো চুপি চুপি আরদি আয়নের খোঁজ নিতো। আজও তাই করলো। আস্তে ধীরে সে বলল, “তোর ভাই কোথায় রে?”
-“ও তো চলে গেছে। ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি তোর কাছে এলাম। তোর তো মনেই নেই আমাকে।”
-“চলে গেল কেন?”
-“তুই কিছু জানিস না? ভাই যাওয়ার আগে তোকে বলেনি?”
-” না তো।”
-“ভাইয়ের তো বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে মামা’রা। সামনের ১০ তারিখে বিয়ে।”
-“মানে?”

ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো আরদি। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে চিরদিনের জন্য তার রাজকুমারকে হারিয়ে ফেলা। অন্য কোনো নারী তার রাজকুমারের উপর অধিকার দেখাবে। অন্য কেউ তাকে জড়িয়ে ধরবে, তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাবে। কী করে মেনে নিবে আরদি এসব?

-“উনি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করছে রুচি?”
-“উপায় নেই। মেয়েটার সাথে অনেক আগে থেকে বিয়ে ঠিক ছিল।”

আরদি চুপ হয়ে গেলে রুচি বলল, “আয়ন ভাই তোকে অনেক ভালোবাসে রে। ভাই বাইরে থাকলেও তোর প্রতিটা খবর সে জানতো। তুই কী করছিস, কার সাথে ঘুরছিস।”

এই কথাটা আরদি বুঝতে পেরেছে। না হয়, বিয়ের কথাবার্তা হওয়া মাত্র আয়নের ফেরার কথা না। রুচি আবার বলল,”তুই কোনোদিন খোঁজ করবি ভেবে ভাই নিজের আইডি, ফোন নাম্বার সবটা একই রেখেছে।”
-“বুঝতে পেরেছি আমি।উনি বিয়েটা করবেন তাই না?”
-“তুই কী সাগরের সাথে বিয়েটা ভাঙতে পারবি?”

আবারো চুপ হয়ে গেল সে।রুচি কিছুটা কঠিন স্বরে বলল,”তুই কী এখনো ভয়ে চুপসে থাকবি? তোর বর্তমান সিদ্ধান্ত কিন্তু ভবিষ্যতের ফল। তুই যদি ভাইয়ের কাছে ফিরে যাস তাহলে সব নিয়ম ভেঙে ভাই তোকে আপন করে নিবে।”

রুচির প্রতিটা কথা আরদির মস্তিষ্কে গেঁথে রইলো। রুচি চলে যাওয়ার পর আরদির মা বলল,”আমি তোকে কোনো হেল্প করতে পারবো না আরু। তুই যদি বিয়েটা করতে না চাস তাহলে সবটা তোকেই করতে হবে।

আর এর মাঝে তার বাবার সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু আয়নের কথা বলতে পারেনি। এর মাঝে আয়ন একবার কল রিসিভ করেছিল। তিন- চার মিনিট কথা হয়েছে। তারপর আর কোনো খবর পায়নি।

৮ তারিখ আরদি সাগরের সাথে দেখা করার জন্য সেই কপিশপে অপেক্ষা করছে। সাগর আশা মাত্র সে সব ভয় কাটিয়ে বলল, “সাগর, আমি বিয়েটা করতে চাই না”

এমন কথায় সাগর হতভম্ব হয়ে গেল। মৃদু স্বরে বলল, ” মানে?আমার পুরো পরিবার পছন্দ করে।এনগেজড হয়ে গেছে, তোমার পরিবার রাজী।”
-“আমি…অন্য একজনকে ভালোবাসি।”
-“ফাজলামো করছো? দু’দিন আগেও রাজী ছিলে আর এখন আরেকজনকে ভালোবাসো?”
-“বাবার দিকে তাকিয়ে আমি রাজী ছিলাম। এমনভাবে বাবা বলেছিল যে না করতে পারিনি। আর তখন…”
-“কিচ্ছু জানি না আমি। আমার পরিবার সব পরিকল্পনা করে রেখেছে।”
-“তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবে না সাগর।”
-“সেটা আমার বিষয়। তোমার পরিবারকে বলো বিয়ে ভাঙতে।”
-“সাগর তুমি বুঝতে পারছো না। আমাদের তিনজনের কেউ সুখী হতে পারবো না। ”
-“তোমার বাবা যদি বলে বিয়েটা তবেই ভাঙবে।”

সাগরের সাথে কথা বলে কোনো ফল হয়নি। এদিকে মাও বলে দিয়েছে কোনো সাহায্য করবে না। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ‘বিয়ে করবো না’ বলার সাহস হচ্ছে না। পরদিন রাতে আয়ন কল করে বলল, “বসন্ত রাণী, তোমার রাজকুমারের রাজ্যের রাণী অন্য কেউ হচ্ছে। হলুদ ছিল আজ! তোমার জন্য আমি ছয়টা বছর অপেক্ষা করেছি। তোমার পরিবারকে একবার বলেই দেখো না। ভোর হলেই আমি অন্যকারো হয়ে যাব। ”

খুব কাঁদল আরদি সেদিন। কাঁদতে কাঁদতে একসময় তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “বাবা, আমি…আমি বিয়েটা করবো না।”

আরদির বাবা বেশ রাগী স্বভাবের। রেগেমেগেই তিনি বললেন,”কী বললে তুমি? এনগেজড হয়ে গেছে তোমার। এ-সময় যদি এমন কথা বলো তাহলে পাত্রপক্ষকে কী জবাব দিবো।”

আরদির কান্নার বেগ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কেঁদেই সে বলল, “স্যরি বাবা। কিন্তু আয়নকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না।”
-“আয়ন মানে ঐ ছেলেটা।”
-“বাবা আমি তোমাকে সব বলছি।”

ততক্ষণে বাড়ির সবাই রুমে উপস্থিত হলো। আরদি কিশোরী কাল থেকে সমস্ত কথা নির্ভয়ে সবার সামনে বলল। সব শোনার পর বড়ো চাচা বলল, ” অসম্ভব বিয়ে ভাঙাটা৷ ওদের সামনে আমরা ছোটো হয়ে যাব।”

এর মাঝে আরদির ভয়ংকর একটা কথা বলে বসলো।বলল,”আমি কিন্তু বিয়ের দিন পালিয়ে যাবো বড়ো চাচা।”

সবার মাঝে খুশি আক্তার চোখে জল নিয়ে আছেন। তিনি ভাবতেও পারেননি মেয়ে এত বড়ো কান্ড করে বসবে। তিনি স্বামীকে মেয়ের সুখের কথাটা বুঝালেন। সবাই আলোচনার পর বড় চাচা বললেন,”আয়নের পরিবারকে আসতে বলো, পাত্রপক্ষই তো আসে।”

.
আয়নের ফোনে ভোরে সাগরের কল আসতো। সাগরের মূল কথা ছিল এরকম, “কংগ্রেস ভাই! তুই পারলি। আরদি মুখ ফুটে সবার সামনে সবটা বলেছে।তোর ভালোবাসার জোর আছে বলতে হয়।”

সাগরের সাথে যখন আরদির বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল তখনই আয়নের সম্বন্ধ নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ আয়নের পরিবারকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়। আরদির বাবাকে সবকিছু বললে তিনি বলেন “আরদি তোমাকে বিয়ে করতে চাইলে তবেই বিয়েটা হবে। বিয়ের কাজকর্ম শুরু আগে আরদিকে সেটা বলতে হবে।আমার মানসম্মান ডুবে যাওয়ার সময় নয়।”
সাগরের সাথে কথা বলার পর সে রাজী হয় এই শর্তে যে আরদি নিজ থেকে আয়নকে বিয়ে করবে বললে সাগর সরে আসবে।

সবটা আয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ীই হয়েছে। আরদির বাবাকে বলে এনগেজমেন্টে সে ছিল। আয়নের বিয়ে নিয়ে রুচি বলা কথাগুলোও মিথ্যা ছিল। সবটা জানার পর আরদি রাগ করতে গিয়েও করতে পারেনি। তার ভালোবাসাটা ফিরে পাওয়ার জন্য কত পাগলামিই না করেছে।

বিয়ের রাতে আয়ন বলল,”বসন্ত রাণী, আপনার রাজকুমারটা তাহলে আমিই হলাম।”
-“আমার পুরো পৃথিবীতে চিৎকার করে জানাতে ইচ্ছে করছে ‘আমি সুখি’! ”
-“প্রেম শহর কী জানো?”
-“প্রেম করার সময় একবার বলেছিলে।”
-“প্রেম শহরে তারাই যায় যারা প্রেমে পড়ে। প্রেমের মর্ম বুঝে। শহরটা তাদের জন্য তৈরি।”
-“চলো তাহলে পালাই। ”
-“কোথায়?”
-“প্রেম শহরে! ”

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে