@প্রেম শহরে
#পর্ব_০২
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু
শপিং করতে গিয়ে সেদিন আয়ন সবার সাথে পরিচিত হয়। মিশুক ছেলেটা মুহুর্তে সবার মন জয় করে নেয়। আরদির বাবা তাকে বলল,”আয়ন, আমার নিজের ছেলে নেই। এনগেজমেন্টের কিছু দায়িত্ব আমি তোমাকে দিবো। পাত্র পক্ষের সবটা তুমি খেয়াল রাখবে।”
ব্যস! আয়নকে আর বাধা দেয় কে? এনগেজমেন্টের পরিকল্পনা করার মাঝে আয়নও উপস্থিত ছিল। দুই পরিবারের সবাই তাকে সাধারণভাবেই গ্রহণ করেছে। কেউ তো আর জানে না ছেলেটা তাদের মেয়ের প্রাক্তন ছিল।
এনগেজমেন্টের দিন আয়ন তাড়াতাড়িই আরদির বাড়িতে উপস্থিত। স্বভাবমতোই সে হেসে কাজকর্ম করছে। আরদি শুধু তাকিয়ে দেখছে। আয়ন কী খুব খুশিতে আছে বলেই হাসছে? নাকি কষ্ট আড়াল করতে হাসছে?ধুর! সেও কী ভাবছে। আয়নের কষ্ট কেন হবে? কেমন যেন আয়নের সব পুরনো কথা আরদির মাথায় ভর করেছে। মন চাইছে আবার সেই সময়টায় ফিরে যেতে। কিন্তু সে জানে এই ইচ্ছেটা পাপ!
আরদির মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে আয়ন বলল,”কী ভাবছো এভাবে?”
-“কিছু না।”
-“গতকাল রাতে কী হয়েছে জানো?”
-“কী হয়েছে?”
-“নদী মানে সাগরের কিউট বোনটা আমাকে কল করেছিল। ”
-“ও কেন কল করবে?”
-“প্রায় দু’ঘন্টা কথা বলল।”
আরদি সন্দিহান দৃষ্টিতে আয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। গতরাতে তো তিনটা অবধি আয়ন তার সাথে কথা বলেছে। নদী কখন কল করল?
প্রশ্নটা আয়ন ধরতে পেরে বলল, “তোমার সাথে কথা শেষ করার পরই কল দিলো।”
-“রাত ৩ টায় নদী কল করেছে? কী বলল কল করে?”
-“ও কে ঘুম পাড়িয়ে দিতে বলেছে।হা হা হা!”
-“অসহ্য!”
আরদি রেগেমেগে চলে যেতে লাগলো।আয়ন তখনও হাসছে। আরদি তার মায়ের রুমে গিয়ে দেখল মা শাড়ি পছন্দ করছে। কঠিন স্বরে বলল, “মা, তুমি কী শুরু করেছো বলবে?”
-“কী শুরু করলাম?”
-“আয়নকে তুমি আমাদের বাসায় কেন ডেকেছো? এক্সকে কেউ এনগেজমেন্টের দায়িত্ব দেয়?”
-“আস্তে বল, তোর বাবা শুনতে পেলে কী করবে?উফ!”
বিরক্তি নিয়ে তিনি দরজা আটকে দিলেন। আরদির রাগ তখনও পড়েনি। তার মা বলল,”আয়নকে আমি রাখিনি। তোর বাবা রেখেছে। আর ছেলেটা ভালোই।”
-“ভালো না ছাই! অসভ্য একটা।”
-“তোকে কিছু বলেছে?”
-“নদীর সাথে লাইন করতে চাইছে। ভাবতে পারো তুমি, কতটা নির্লজ্জ। ”
-“নির্লজ্জ কেন হবে? নদী সাথে তো ভালোই মানাবে।”
-“ঐ চিকনার সাথে আয়নকে কীভাবে মানাবে?তুমি পাগল হয়ে গেছো?”
আরদির মা বুঝতে পারলো মেয়ের রাগ আকাশ ছোঁয়া। কখনো সে কারো বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে কিছু বলে না। এতটা রাগ সে আগে দেখায়নি। সবসময় ভীতু হয়ে থাকতো। ক’দিনে ভয়টা যেন পাচ্ছে না।
শীতল কণ্ঠে তার মা বলল,”আচ্ছা তুই ওর কথা বাদ দে। এনগেজমেন্টের কী পরবি তুই? শাড়ি না লেহেঙ্গা? ”
-“ঘোড়ার আন্ডা পরবো আমি। আমার জায়গায় তুমি করো বিয়েটা। সবাই খারাপ হয়ে গেছে, যা-তা… ”
বিড়বিড় করতে করতে আরদি বের হয়ে গেল। আরদির মা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মেয়েটা কী দ্বিতীয়বার দুর্বল হয়ে পড়ছে?
.
সন্ধ্যার দিকে সাগরের বাড়ির সবাই উপস্থিত হলো। আরদি নজরে রাখলো আয়নকে। বেশ লক্ষ্য করছে সে, সুন্দর সুন্দর মেয়েদের আশেপাশেই আয়নকে দেখা যাচ্ছে। নদী আশা মাত্র দৌড়ে গেল স্বাগত জানাতে। একবারের জন্যও আরদির দিকে তাকায়নি। সব মেয়েদের সাথে ফ্লাট করছে কিন্তু একবারও আরদিকে বলেনি “তোমাকে দেখে আমার বেহুশ হওয়ার উপক্রম!”
এর মাঝে সাগর তার বেশ প্রশংসা করেছে। এসব একবারের জন্যও আরদির মন ছুঁয়ে যায়নি। অথচ আয়নের হাসিতেই সে কেঁপে উঠে।
রিং পরানোর সময় আরদি খেয়াল করেছে আয়ন আশেপাশে ছিল না। এরপরে দেখলো কোথা থেকে মিষ্টি এনে নদীকে খাইয়ে দিয়েছে। বিষয়টা বেশ গায়ে লেগেছে আরদির। মাথা ব্যথা করছে বলে সে আড্ডার মহল থেকে বেরিয়ে এলো। ফোন নিয়ে ইচ্ছেমতো কল করল আয়নকে। সে দেখেছে আয়ন ইচ্ছে করেই কল কেটে দিচ্ছে। মেয়েদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত সে।
আরদির মা আড্ডা মহলে গিয়ে আয়নের উদ্দ্যেশে বলল, ” আয়ন, তোমার রুমে আমার ব্যাগটা রাখা আছে। একটু এনে দাও তো।”
সম্মতি জানিয়ে আয়ন তার রুমে গিয়ে ব্যাগটা খুঁজতে লাগলো। পরক্ষণে মনে হলো কী রকম ব্যাগ? বেরোতে যাবে তখন দেখলো আরদি তার রুমে ঢুকছে। রুমে প্রবেশ করেই সে আয়নকে থাপ্পড় দিলো। হুট করে এমনটা হওয়ায় আয়ন হা করে রইলো। এবারে বলল মুখ খুলে আরদি বলল, ” বার বার ফোন করছি অথচ ফোন কেটে দিচ্ছেন। কেন? বিরক্ত করছিলাম আমি? মেয়েদের সাথে আড্ডা দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন? নদীকে মুখে সামনে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন। তার রূপের প্রশংসা করলেন। আমি দেখতে সুন্দর না? একবারও তো আমার প্রশংসা করেননি।”
বলতে বলতে সে কেঁদে উঠলো। কেঁদে কেঁদে আরো অনেক কিছু বলছে যা অস্পষ্ট! আয়ন একটু কঠিন হয়ে বলল,” তোমার এত গায়ে লাগছে কেন? কিছু হও তুমি আমার? নিজে তো ঠিকই বিয়ে করে নিচ্ছো আরদি।”
বাক্যটা শুনে আরদি থেমে গেল। এক নজর সে আংটির দিকে তাকালো। পরে খেয়াল করলো আয়ন তাকে নাম ধরে ডেকেছে। এটাও তাকে স্বস্তি দেয়নি। ‘বসন্তরাণী’ই তো ডাকে সবসময়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বের হয়ে এলো। তার মস্তিষ্ক জানে যা করছে ভুল। কিন্তু মন বলছে যা করছে সব ঠিক।
আরদি ঘুমাতে এসে দেখল তার মা আগে থেকে বসে আছে। তার মা সবসময় হাসি-খুশি থাকে। এজন্য বোধ হয় নাম হয়েছে ‘খুশি আক্তার’। আরদি হতাশ মন নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার মা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তুই কী আয়নকে ভালোবাসিস আরু?”
আরদির চোখের কোণায় তখনও বিন্দু বিন্দু জল। মন আর চোখের জল দু’টোই অবাধ্য। জল আটকাতে চেয়েও সে আটকাতে পারছে না। শীতল কণ্ঠে সে বলল, “আয়নকে চলে যেতে বলো মা। ”
-“হ্যাঁ, চলে যাবে তো।”
উঠে এসে আরদি তার মায়ের কোলে মাথা রাখলো। বেস্টফ্রেন্ডের সাথে যেমনটা নিজের দুঃখ ভাগাভাগি করার যায় তেমনি ভাবে সে তার মা’কে বলল, ” কিশোরীকালে আমি আয়নকে ভালোবাসিনি মা। ওর কথার জালে আটকে গিয়েছিলাম। প্রেম-ভালোবাসা এসবের মানেটা ও শিখিয়ে ছিল। ও কোনো মেয়ের সাথে কথা বললে তখন রাগ লাগতো। রাগ লাগতো এই ভেবে যে ‘আমার বয়ফ্রেন্ড কেন অন্য মেয়ের সাথে মিষ্টি করে কথা বলবে?’। কিন্তু বিশ্বাস করো, মন থেকে রাগটা আসতো না। অধিকার থেকে আসতো। ব্রেকাপ হওয়ার বছরখানেক পর বুঝি ওটা ভালোবাসা ছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোথাও না কোথাও আমি…ও ঠিক করছে না। কোনো মেয়ের সাথেই ও কে মানাবে না। আমি…আমি জানি না…”
আরদির অস্থিরতা বেড়ে গেল। তার মা আলতো করে বলল,” শান্ত হ তুই। এতটা হাইপার হোস না। ”
-“ও তো রাজকুমার তাই না মা? রাজকুমারের পাশে যে সে মেয়েকে কী মানায়? রাজকুমারের পাশে তার পছন্দের মানুষকেই মানায়। বসন্ত রাণীকে মানাবে। নদী, সূচি, রুমি এদের কাউকে মানাবে না।তুমি বলো মা মানাবে না।”
-“হ্যাঁ, মানাবে না।”
-“তবুও কেন এমন করছে?”
-“তুই কী বিয়েটা করতে চাস না আরু?”
চুপ হয়ে গেল আরদি। এই উত্তরটা তার জানা নেই। তার মা আবারো বলল, “আরু, তুই চাপা স্বভাবের বলে তোর বন্ধুটা সবসময় আমি হতে চেয়েছি। একজন বন্ধু হয়েই তোকে বলছি নিজের মনকে শান্ত কর। নিজেকে সময় দেয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। মনে একজনকে বসিয়ে সংসারটা অন্যজনের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কষ্টকর।”
-“ও…আয়ন বলেছে ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
-” মাথা ঠান্ডা কর। কাঁদিস না আর! ”
-“কাঁদছি কই?কাঁদছি না তো।”
-“তোর এনগেজড হয়েছে সবে, সবটা শেষ হয়নি এখনো। কবুল বলার আগ অবধি সময় তোর কাছে।আশা হারাস না আরু।”
অশান্ত মনটা কিছুটা শান্ত হলো আরদির। আয়নের সাথে প্রেমের সময় একবার সে প্রশ্ন করেছিল তাকে বসন্ত রাণী কেন ডাকে? উত্তরে আয়ন বলেছিল, ” সাদা-কালো জীবনটাকে বসন্তের নভশ্চরের ছুঁয়া লাগিয়ে তুমি রঙিন করে দিয়েছো। আমার রাজ্যের তুমিই রাণী। তোমার জায়গাটা কেউ নিতে পারবে না।”
-“আমার রাজকুমারের জায়গাও নিতে পারবে না।”
কথাটার গভীরতা তখন উপলব্ধি করেনি সে। কিন্তু আজও আয়নের জায়গাটা সত্যি কেউ নিতে পারেনি। হেসে উড়িয়ে দেওয়া প্রতিটা কথার গভীর অর্থ আজ উপলব্ধি করতে পারছে সে।
রাত গভীর হলে আরদি নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি তাক করলো। প্রতিদিন আয়ন ইচ্ছে করে তাকে কল দিয়ে বিরক্ত করতো। এপার-ওপার হাজারো কথা বলতো। খুব করে চাইছে আজ নাম্বারটা থেকে কল আসুক, ভুল করে হলেও আসুক। পরক্ষণে আরদির মাথায় এলো সে তাকে চড় মেরেছে। আর আয়নও তাকে কঠিন কথা বলেছে। আগে একবার এমন কঠিন কথা বলেছিল ব্রেকাপের সময়। আয়নের রাগী ভাবটাকে সে বরাবরই ভয় পায়। নিশাচর পাখির মতো সে রুম ত্যাগ করে আয়নের রুমে দিকে রওনা হলো। সে জানে আয়ন আজ তার বাড়িতে আছে।
চলবে..