#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৭
#আয়েশা_আক্তার
আজ লাবণ্যর চেকআপ ডেইট। নাস্তার পর্ব শেষ করেই লাবণ্য আর মেহেদী বেরিয়ে পরে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ইরফানের ক্যাবিনের সামনের করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলো তারা। হঠাৎ করে লাবণ্য’র মনে হলো, ক্যাবিনের ভেতরে পরিচিত কন্ঠস্বর। মনের ভুল ভেবে ক্যাবিনের দরজার সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে সে৷ কিন্তু একই কন্ঠ আবার শুনে কৌতুহল বশত ক্যাবিনের ভেতরে উঁকি দেয় লাবণ্য। উকি দিয়ে যা দেখলো। তা দেখতে পাবে ভাবতেও পারেনি লাবণ্য। সে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে ভেতরে। লাবণ্য’র দাঁড়িয়ে যাওয়া অনুসরণ করে মেহেদী জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো?
লাবণ্য মেহেদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাত উঠিয়ে ইশারা করে সামনে। তারপর অস্ফুটে উচ্চারণ করে,
-সাদাফ।
লাবণ্য’র কথা শুনে মেহেদী ভেতরে তাকায়। সেই সাথে ভেতরের মানুষ গুলোও দৃষ্টি পাত করে ওদের দিকে। দরজার দু’পাশের সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কতদিন পর দেখা!
এশা ছুটে এসে লাবণ্য’কে জড়িয়ে ধরতে গেলে লাবণ্য বাঁধা দিয়ে পেটের দিকে ইশারা করে। এশা এতোক্ষণ খেয়াল না করলেও এখন বলে,
-আপু তুমি প্রেগন্যান্ট? জানো আমরা লন্ডনে এসেই তোমাকে খুঁজেছি। রাস্তায় বের হলেই আমি আশপাশে তোমায় খুঁজি। হঠাৎ যদি দেখা হতো।
লাবণ্য কিছু বলতে যাবে তখনই ডক্টর নাঈম এসে হাজির হয়। মেহেদীকে এখানে দেখে নাঈম জিজ্ঞেস করে,
-কি ব্যাপার তুই এখানে? কই আমাকে বলিসনি তো?
– আরে, তোর ভাবিকে গাইনী ডক্টর টিনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। তোকে বলা হয়নি কারণ ভেবেছিলাম তোর সাথে তো দেখা হবেই। কিন্তু তোর সাথে দেখা হওয়ার পূর্বেই তোর ভাবীর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তাই আর তোর ক্যাবিনে যাওয়া হয়নি।
নাঈম এবার লাবণ্য’র দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-কেমন আছেন ভাবি?
-অনেক ভালো, আপনি?
-শরীরের কি অবস্থা? আর এরা সবাই আপনার বন্ধু?
-না, ওইযো তালগাছটা আমার বন্ধু। তার পাশের জন আমার ছোটবোন, তালগাছের ওয়াইফ।
-বাহ, কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেলো সবার! (নাঈম)
তারপর সবাই একসাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। ডক্টর নাঈম মেহেদীর বন্ধু। নাঈম ইরফানের শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চলে যায়। তার ঠিক দুইদিন পরে হাসপিটাল থেকে রিলিজ পায় ইরফান। সাদাফ এশার বিয়েতে কেউ থাকতে পারে নি৷ তাই আজকে সাদাফের ফ্ল্যাটে সবার৷ দাওয়াত। ইরফান- তানহা, লাবণ্য -মেহেদী, সাদাফ -এশা তিন জোড়া কাপল একসাথে আড্ডায় মেতেছে। সেই সাথে খাওয়া দাওয়া, গান তো আছেই। কেমন একটা পিকনিক পিকনিক ভাব এসেছে সবার মধ্যে। এটা মানতে হবে বন্ধুদের সংস্পর্শে থাকলে সবাই বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে শুরু করে হোক সে বড় কিংবা ছোট। তখন বয়সের পার্থক্য কোনো মেটার নয়। বন্ধু মানেই, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গা। যেখানে কোনো ফর্মালিটির স্থান নেই।
__________________________
ঢাকার অদূরে ছোট্ট একটা শহরে দুই রোমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে মোহনা আর হৃদয়। হৃদয় একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করছে। হৃদয় মোহনার দুটো দুই বছর বয়সী টুইন বেবিও আছে। তাদের নাম, হৃধ এবং হৃধি। হৃধি হয়েছে হৃদয়ের মতো আর হৃধ হয়েছে মোহনার মতো। এরজন্যই হয়তো বলা হয়, ছেলেরা মায়ের মতো হয়। আর মেয়েরা বাবার মতো হয়। হৃধ শান্ত স্বভাবের তাই তারজন্য কোনো কষ্ট করতে হয় না মোহনার শুধু খাওয়ার সময় খাওয়া আর ঘুমের সময় ঘুম পাড়ালেই সব ঠিক। কিন্তু হৃধি সুযোগ পেলেই তোলপাড় শুরু করে। কখনো ওয়াশরুমের কল ছেড়ে পানিতে ভিজে, কখনো বা দরজা খোলা থাকলে সিঁড়িতে চলে যায়, আবার কখনো সুযোগ পেলেই জিনিসপত্র ভেঙে একাকার করে ফেলে। এই যেমন এখন গ্লাস দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে টিভির গ্লাস ভেঙে ফেললো। মুহুর্তে টিভি কালো হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। কাঁচের গ্লাস এবং টিভির গ্লাসের ঝনঝন শব্দ শুনে মোহনা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। টিভিতে কার্টুন দেখছিলো হৃধ হঠাৎ করে টিভি অফ হয়ে যাওয়ায় কান্না শুরু করে সে। একবার টিভি দিকে তাকাচ্ছে আর একবার বোনের দিকে তাকাচ্ছে সে। টিভি ভেঙে খুশি হলেও ভাইয়ের কান্না দেখে মন খারাপ হয়ে যায় হৃধির। সে ভেবেছে ঢিল ছুঁড়ে নতুন একটা খেলার আবিষ্কার করবে এবং তার ভাই খুশি হয়ে সে খেলায় যোগ দিবে। কিন্তু উল্টো হৃধ কেঁদে ফেলায় হৃধি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মোহনা এসে টিভির অবস্থা দেখে ছুটে আসে। তারপর ছেলে এবং মেয়ে দু’জনের শরীর পরীক্ষা করে দেখে কোথায় ব্যথা পেয়েছে কি না। কারো গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন না পেয়ে মোহনা শান্ত হয়৷ ওদেরকে খেলনা দিয়ে বারান্দায় দিয়ে এসে সাবধানে গ্লাসের টুকরো গুলো উঠিয়ে পরিষ্কার করে নেয় মোহনা।
সন্ধ্যা হতেই হৃদয় অফিস থেকে ফিরে আসে। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই আগে ছেলে এবং মেয়েকে আদর করে দেয়। মোহনা শরবত নিয়ে এসে হৃদয়ের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
-কতদিন বলেছি, বাইরে থেকে এসেই বাচ্চাদের সাথে মিশবি না। ওরা অসুস্থ হয়ে যাবে, কত রকমের জীবাণু নিয়ে আসিস বাইরে থেকে তুই।
– আমার বাচ্চাদের আমি আদর করলে তোর হিংসা হয় মোহ? তুই বললে আমি তোকেও আদর করতে রাজি আছি।
মোহনা লজ্জা পায়। মনে মনে বলে, এই ছেলেটা আর ভালো হবে না। বাচ্চাদেরকে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে হৃদয় শরবতটা একটানে খেয়ে নেয়। তারপর মোহনার কানের কাছে মুখ এনে বলে,
-লজ্জা পেলে তোলে একদম লাল টুকটুকে আপেলের মতো লাগে। আর তুই তো জানিস আপেল আমার কতটা প্রিয়।
মোহনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই হৃধি হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-বাবা, তুমি তি আমাল আম্মুতে কিসি দিত্তো? আমাতেও দাও।
হৃদয় চোখ বড় বড় করে মেয়ের দিকে তাকায়। সে তো জাস্ট মোহনার সাথে কথা বলছিলো। আর তার মেয়ে এটা কি বললো! হৃদয়ের অবস্থা দেখে মোহনা হেসে ফেলে বলে,
-যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। মুখে কোনো কথা আঁটকায় না।
-ওই বাবা আমালেও কিসি তাও। (হৃধি)
মোহনা হৃদয়কে ইশারায় ওয়াশরুমে যেতে বলে। মেয়ের পাশে বসে বলে,
-বাবা ফ্রেশ হয়ে কিসি দিবে সোনা। বাবার সাথে জার্ম আছে, আর জার্ম তোমাকে অ্যাটাক করলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে আর খেলতে পারবে না।
মোহনার কথা শুনে হৃধি মাথা নাড়ায়।
______________________
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ করে হৃদয় ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি অন করতে গিয়ে দেখে টিভির অবস্থা নাজেহাল। ডেকে উঠে মোহনাকে৷ মোহনা বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে এদিকেই আসছিলো। হৃদয়ের ডাক শুনেই বুঝতে পারে যে কেন ডেকেছে হৃদয়? মোহনা এসে দাঁড়াতেই হৃদয় প্রশ্ন করে,
-টিভির এই অবস্থা কেন?
-হৃধি…
-সারাদিনে দুটো বাচ্চাও সামলাতে পারিস না? (মোহনা কথা শেষ করার আগেই হৃদয় ধমকে সুরে বলে উঠে।)
হৃদয়ের কথা শুনে মোহনার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। সেখানে এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পর হৃদয় তাদের শোয়ার ঘরে এসে দেখে বিছানায় শুধু হৃধ আর হৃধি। মোহনা নেই। তাই সে বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। মোহনা আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয় ধীর গতিতে এগিয়ে যায় মোহনার কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে মোহনার খোঁপা করা চুলগুলো মুক্ত করে দেয়। সেকেন্ডে কালো কেশরাশি মোহনার পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। মোহনা এখনো আগের মতোই নির্বিকার। একটুও নড়ছে না। হৃদয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মোহনার চুলে নাক ডুবিয়ে দেয়। ফিসফিস করে বলে,
-সরি, মোহ পাখি। তুই তো জানিস টিভিটা মাত্র গতমাসেই কিনেছি। আবার নতুন একটা টিভি কিনতে গেলে কতগুলো টাকা দরকার!
প্রতিত্তোরে মোহনা কিছু বলে না। হৃদয় মোহনার চুল থেকে মুখ সরিয়ে কাঁধে থুতনি রাখে। আবারো বলে উঠে,
– সরি তো, আর কতক্ষণ অভিমান করে থাকবি?
-আমি অভিমান করিনি। মোহদের অভিমান করতে নেই। তুই ঠিকই বলেছিস আমি বাচ্চা সামলাতে পারি না। কিন্তু তুই নিজেও জানিস হৃধি তোর মতো রগচটা কারো কথা শুনে না।
-আমি রগচটা?
-হ্যাঁ, তুই রগচটা দেখেই মেয়েটাও তোর মতো হয়েছে। হৃধকে দেখ একদম আমার মতো শান্ত।
-আচ্ছা পরেরবার থেকে বেবিদেরকে বলে দিবো আমার মতো হইস না বাপ। তোর মায়ের মতো হইস।
-পরেরবার মানে?
-আমি তো চাই আমাদের আরো দুটো টুইন বেবি হোক।
মোহনা হৃদয়ের বুকে আঘাতের চেষ্টা করে বলে উঠে, – ফাজিল।
-মোহ, তুই কিন্তু আমায় এখনো বন্ধুর নজরে দেখছিস। এটা কি ঠিক বল?
-মানে?
-আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়ে গেছে। আর তুই এখনো আমায় বন্ধুর নজরেই দেখিস। এবার তো একটু জামাই জামাই নজরে দেখ।
-কিভাবে জামাই জামাই নজরে দেখতে হয়?
-এখন থেকে আমায় তুমি তুমি করে বলবি। তাহলেই হবে।
-আচ্ছা, তুই বুঝি আমায় বউ বউ নজরে দেখিস?
-অবশ্যই, সেই প্রথম দেখাতেই তো তোকে আমি বউ বউ নজরে দেখা শুরু করেছি।
-তাহলে তুই আমায় তুই করে বলিস কেন? নিজে আগে বন্ধু থেকে জামাই হ। তারপর আমায় বলবি।
– ধুর, থাক তোকে বউ হতে হবে না। তুই হলি আমার প্রেয়সী। প্রেম প্রেয়সী। যাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পায়।
সমাপ্ত