#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২২
#আয়েশা_আক্তার
এক সপ্তাহ পর,
আজ লাবণ্য আর মেহেদী চলে যাবে লন্ডনে। বন্ধুরা সব এসে এয়ারপোর্টে ভির জমিয়েছে। সবার চোখেই আজ অশ্রু চিকচিক করছে। করবে নাই বা কেন? লাবণ্য যেমন মিষ্টি দেখতে। তেমন মিশুকে তার স্বভাব। বন্ধুরাই যেন তার প্রাণ। বিশেষ করে মোহনা এবং লাবণ্য এক আত্মার দুটি প্রাণ। তাইতো মোহনার আজ এতো বেশি কষ্ট হচ্ছে। মোহনা আর লাবণ্য একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। মাইকে সুন্দর এক নারী কন্ঠ কিছু একটা এনাউন্স করতে মোহনা লাবণ্যকে ছেড়ে দাঁড়ায়। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,
-বিদেশে গিয়ে আমায় ভুলে যাবি না তো লাবু?
-কখনোই না। তুই আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে ভালো মেয়ে! আর ভালো মেয়েদের কি ভুলে যাওয়া যায়?
মোহনা কথা বলতে পারে না। সমানে হেঁচকি তুলেই যাচ্ছে। লাবণ্য হৃদয়ের সামনে গিয়ে বলে,
-মোহকে কখনো কষ্ট দিস না হৃদয়। মেয়েটা ছোট থেকেই অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছে। তুই ওকে সুখে রাখিস।
হৃদয়ের চোখেও পানি টলমল করছে। সে মোহনার হাত ধরে বলে,
-তোর কথা অবশ্যই রাখবো। তুই ভালো থাকিস ভাইয়ার সাথে। দোয়া রইলো, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সুখের অধিকারীনী মেয়েটা যেনো তুই হোস।
হৃদয় আর কথা বলতে পারলো না। দু’হাতে চোখ মুছে সরে দাঁড়ায়। একটু দূরে মেহেদী ছয়জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বন্ধু দলটির দিকে চেয়ে আছে। তার চোখ জোড়াও ছলছল করে উঠছে বারংবার। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ এক সম্পর্কের স্বাক্ষী হয়েছে আজ মেহেদী। মনে বলতে থাকে, “সবার জীবনেই যেন এমন এক বন্ধু দল থাকে।” তাহলে আর কেউ বন্ধু হীনতায় ভুগবে না।
লাবণ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সাদাফের দিকে। সাদাফ নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে অন্যদের মতো কাঁদতে পারে না। তবে কেন যেনো আজ চোখ দুটো বড্ড জ্বলছে। লাবণ্য ফুপিয়ে বলে উঠলো,
-নিচের দিকেই চেয়ে থাকবি? আমায় বিদায় দিবি না?
কথাটুকু বলেই লাবণ্য হুহু করে কেঁদে উঠে আবার। সাদাফ কান্নারত লাবণ্যর দিকে চেয়ে বলে উঠে,
-ভালো থাকিস লন্ডনে। আর একদম আমাদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবি না। শোন, আমাদের মধ্যে থেকে কারো সামান্য অসুস্থ হলেও কিন্তু আমি তোর ডাক্তার জামাইকে লন্ডন থেকে তুলে আনবো৷ দুলাভাই ডাক্তার থাকতে আমরা কেন অন্য ডাক্তারের পেছনে ছুঁটবো?
সাদাফের কথা শুনে কান্নার মাঝেও সবাই হেসে ফেলে। ও মূলত শেষবার বন্ধুদের একসঙ্গে হাসির মুহুর্তটা ক্যাপচার করতেই কথাগুলো এভাবে বলেছে। সবাই হেসে উঠতেই, সাদাফ প্রীতমের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে মেহেদীর হাতে দিয়ে বললো,
-এইযে দুলাভাই, আমাদের বন্ধুদের একসঙ্গে হাসি কান্নার মুহুর্তটা ক্যাপচার করে দিন তো।
মেহেদী হাসি মুখে ক্যামেরাটা নিয়ে ওদের সবার কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দী করে দিলো। আবারো মাইকে সুন্দর নারী কন্ঠের ধ্বনি উচ্চারিত হয়। সাথে সাথে একদল বন্ধুদের বুকে ব্যথাও তীব্রতর হয়। সাদাফ মেহেদীর হাত থেকে ক্যামেরা নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরে মেহেদীকে। জড়িয়ে ধরে মেহেদীও। সাদাফ কাঁপা কন্ঠে বলে,
-আমার বন্ধুকে ভালো রাখবেন ভাইয়া। ও ভীষণ ভালো মেয়ে।
-ইনশাআল্লাহ, তোমরাও ভালো থেকো। আর তোমার বন্ধুকে সুখী করার দায়িত্ব আমার। আমি সেটা যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করবো।
বন্ধুদের পালা শেষ করে, মেহেদী’র পরিবার এবং লাবণ্য’র পরিবার থেকে আবারো বিদায় নিয়ে মেহেদী এবং লাবণ্য পা বাড়ায় বিমানের দিকে। পা বাড়ায় বন্ধু দলের প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ গৃহের দিকে।
________________________
সাদাফ ছাঁদে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। বার কয়েক এশাকে কল করে না পেয়ে আকাশ দেখায় মন দিয়েছে সে। মুঠোফোনটা বেজে উঠতেই আকাশ দেখায় ব্যাঘাত ঘটে সাদাফের। ফোন স্ক্রিনে প্রেয়সী নামটা জ্বলজ্বল করতেই ঠোঁটে হাসি ফোটে সাদাফের৷ সে কল কেটে কল ব্যাক করে। মনে মনে খুশি হলেও এমন ভাবে কথা বলে যেন এশা বুঝতে পারে সাদাফ অভিমান করেছে। এশা ফিসফিসিয়ে বলে জিজ্ঞেস করে,
-অভিমান নাকি রাগ?
-জানি না।
-শুনো।
-বলো।
-ভালোবাসি।
সাদাফ হেসে ফেলে। হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলে উঠে,
-আমিও ভালোবাসি।
-হ্যাঁ, তবে আমি বেশি।
-কখনোই না, আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসি।
-না, আমি।
-আমি।
-হ্যাঁ তুমিই, এবার বলো সবসময় এভাবেই ভালোবাসবে তো?
সাদাফ হেসে বলে উঠে, -মোটেও না।
এশার খানিক মন খারাপ হয়। সে কন্ঠ অন্য রকম করে জিজ্ঞেস করে, -কেন?
সাদাফ ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়, – কারণ আমি তখন আরো বেশি বেশি ভালোবাসবো তাই।
এশা খিলখিলিয়ে হেসে বলে, – তুমি একটা পাগল।
-হুম, তোমার জন্য।
এশা কিছু বলে না খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। সাদাফ এশার হাসিটা মুগ্ধ হয়ে শুনে জিজ্ঞেস করে,
-এতো সুন্দর করে হাসতে নেই প্রেমে পড়তে মন চায়।
-মন চায়?
-হ্যাঁ।
– তারমানে তুমি এখনো প্রেমে পড়োনি?
-প্রথম দেখাতেই পড়েছি। এ পর্যন্ত কতবার হিসেব নেই। তবে এতো প্রেমে পড়া ভালো না।
-কেন?
– বিয়ের পর বেশি বেশি প্রেম করবো তাই।
– তাহলে বিয়ে করছো না কেন?
-চলো আজই বিয়ে করে ফেলি?
-আজ!
-হুম, আজ।
-কিভাবে?
-বাবা-মা কে গিয়ে বলবো, আমি এখনই এশা’কে বিয়ে করতে চাই। বউকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না।
– লজ্জা নাই তোমার?
-একটুও না।
-পাগল।
___________________
দীর্ঘ ৯ ঘন্টা জার্নির পর লাবণ্য আর মেহেদী লন্ডনের মাটিতে পা রাখে। এয়ারপোর্টে ঝামেলা মিটিয়ে বের হতেই তারা দেখতে পায়, কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাদের জন্য। মেহেদী আর লাবণ্য পেছনের পাশাপাশি সীটে উঠে বসতেই ড্রাইভার হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
-অনেক দিন পর আসলেন স্যার। কেমন আছেন? আর ম্যাডাম কিন্তু অসম্ভব সুন্দর।
লন্ডনে এসেও কেউ বাংলায় কথা বলছে শুনে লাবণ্য অবাক হয়ে যায়। মেহেদী হেসে জবাব দেয়,
-মুরাদ চাচা, কতবার বলেছি আমাকে স্যার বলবেন না। আর ওকেও ম্যাডাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দু’জনেই আপনার ছেলেমেয়ের মতো। আপনি কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?
-আলহামদুলিল্লাহ, তয় আপনাগো দু’জনকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেলাম।
-ড্রাইভার কথা শেষ করে গাড়ি চালাতে শুরু করে। লাবণ্য ফিসফিস করে মেহেদীকে জিজ্ঞেস করে,
-উনি বাংলা কিভাবে জানে?
-এই গাড়ীটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দিয়েছে। আর মুরাদ চাচাকেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার ড্রাইভার হিসেবেউ নিয়োগ দিয়েছে। মুরাদ চাচা অনেক ভালো মানুষ। উনিও আমাদের বাংলাদেশেরই। তাই উনার সাথে আমার ভালো একটা সম্পর্ক আছে।
-অহ, আচ্ছা।
বলেই লাবণ্য বাইরের দিকে আগাতে যায়। ঠিক তখনই মেহেদী বাম হাতে লাবণ্য’র কোমড় আঁকড়ে ধরে। লাবণ্য’র চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ইশারা করে বলে ড্রাইভার আঙ্কেল দেখে ফেলবে। মেহেদী এক টানে লাবণ্যকে একদম নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে,
-মুরাদ চাচা গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত। বিয়ের এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেলো আমি ঠিকঠাক ভাবে বউয়ের কাছেই যেতে পারলাম না।
-মানে? রাতে কার সাথে ঘুমিয়েছো?
-শুধু রাতেই তো একসাথে ঘুমিয়েছি। দিনের বেলা তো তোমাকে খুঁজে ও পাওয়া যায় না। এখন এই আন্টি, তখন ওই আন্টি, একটু পরে প্রতিবেশী। আর তোমার বন্ধুদের কথা নাই বললাম। শত হোক তারা আমার বউয়ের বন্ধু বলে কথা। তাদের জন্য একটু ছাড় দেওয়াই যায়। কিন্তু প্রতিবেশী গুলো একের পর এক বউয়ের সাথে এমন ভাবে চিপকে ছিলো যে আমার বউটাকে সারাদিনে দেখার সৌভাগ্যও হয়নি এ কয়দিনে।
লাবণ্য হেসে ফেলে বলে,
-বাচ্চাদের মতো হিংসে করছো তুমি।
-একমাত্র তোমার জন্যই আমি হিংসুটে। তবে এখন থেকে সবসময় তোমাকে আমার সামনে বসিয়ে রাখবো।
-আর হসপিটাল?
-যতক্ষণ বাসায় থাকবো ততক্ষণ সুপার গ্লু দিয়ে আমার সাথে আটকে রাখবো তোমায়।
মেহেদীর কথা শুনে লাবণ্য হুহু করে হেসে উঠে। ড্রাইভার মুরাদ নবদম্পতির হাসিতে নিজের মনেও সুখ অনুভব করে।
চলবে….