#প্রেম_প্রেয়সী
#সূচনা_পর্ব
#আয়েশা_আক্তার
রূপপুর গ্রামে এশার মামা বাড়ি। ছোট সময় মায়ের সাথে এ গ্রামে অনেকবার এলেও বড় হয়ে অনেক পরে এসেছে এখানে এশা। রূপপুর গ্রামটা এশার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এশার মতে এই গ্রামের সাথে নামের বেশ মিল আছে। পুরো গ্রামটা কি অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো! এশার এই ক’দিন সারাদিনই বাতাসে ধানগাছের দোল খাওয়া, পাখিরা কিচিরমিচির, কৃষকদের ধান কাটা, জেলেদের মাছ ধরা এসব দেখেই কেটেছে। এমন ছবির মতো সুন্দর গ্রামের রূপে মুগ্ধ এশা।তার ইচ্ছে করছে বাবাকে বলে, বাকিটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে। তবে ইচ্ছে হলেই কি সবকিছু করা যায়? তার যে ভার্সিটির প্যারাময় ক্লাসগুলো করার সময় হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এশা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সবেই এডমিট হয়েছে। এক সপ্তাহও ক্লাস করেনি। ভার্সিটিতে তার কোনো বন্ধু নেই তাই তার ভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করে না। তারজন্যই এতো বছর পর মামা বাড়িতে পালিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এসেও শান্তি নেই। ভার্সিটি থেকে কল করে করে নাকি মিস্টার ইয়াশ খানকে পাগল করে ফেলেছে প্রফেসর’রা। খেয়ে তো আর কাজ নেই প্রফেসরদের। মিস্টার ইয়াশ খানই হয়তো বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে। ইয়াশ খান এতো হিটলার কেন? এশা মোটেও এমন হিটলার টাইপ বাবা ডিজার্ভ করে না। মোটেও না। এশার এসব ভাবনায় পানি ঢেলে পাশে রাখা মুঠোফোনটা ব্রাইভেট করে উঠলো। এশা এক গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে মিস্টার ইয়াশ খান ওরফে এশার বাবারই কল। কল রিসিভ করে এশা সালাম দেয়,
– আসসালামু আলাইকুম বাবা।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কি ব্যাপার তুমি আসছো না কেন? তোমার প্রফেসর গুলো তো এবার আমায় কিডন্যাপ করবে তোমায় না পেয়ে।
-হুহ, করুক তোমায় কিডন্যাপ তাহলে আমার উপর থেকে জল্লাদ বাপের অত্যাচার একটু কম হয়।
-কি বিরবির করছো? আসবে নাকি আমি এসে তোমায় নিয়ে আসবো?
-তোমায় আসতে হবে না। আমি রেডি হয়ে বসে আছি। মামা বাজার থেকে এলেই বের হবো।
-সত্যি আসবে তো আজ? নাকি আজ-ও মিথ্যা বলছো?
-হ্যাঁ, বাবা সত্যিই। তোমার মেয়ে কখনো মিথ্যা বলতে পারর?
-মোটেই না শুধু ভার্সিটির ক্লাসের ভয়ে অজুহাত দেখিয়ে মামাবাড়ি লুকিয়ে থাকে আমার মেয়ে হা, হা, হা।
-বাবা, মামী ডাকছে আমি বের হয়ে তোমায় কল করবো।
-ওকে সাবধানে এসো।
নাদিরা বেগম রুমে এসে দাঁড়াতেই এশা বাবার সাথে কথা শেষ করে কল কাটে। নাদিরা বেগম হেসে এশার মাথায় হাত রেখে বলে,
-বাবার বড় মেয়েকে না দেখে পাগল হয়ে গিয়েছে বাবা তাইতো বারবার কল দিয়ে যেতে তাড়া দিচ্ছে।
-না, মামী। ভার্সিটির ক্লাস আছে। এই ক’দিনে অনেক গুলো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। আমি তো কাউকে তেমন চিনিও না। তাই আমার জন্য নোটস কালেক্ট করাও কষ্টকর হবে। এরজন্যই বাবা এতো তাড়া দিচ্ছে।
-হ্যাঁ, আবার এসো রুমু-ঝুমু তোমাকে অনেক মিস করবে। বারবার বলছে, মা আপাকে বলো আর কিছুদিন থেকে যেতে।
-আমিও ওদেরকে খুব মিস করবো মামী। ওরা কই?
-ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে। খেতে ডাকলাম আসলো না। তোমার ও তো খাওয়া হয়নি,চলো খেয়ে নিবে।
-হ্যাঁ, চলো আর আমি ওদের ডেকে আনছি তুমি গিয়ে খাবার বাড়ো।
নাদিরা বেগম রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন সবার জন্য খাবার বাড়তে। আর এশা চলে গেলো তার দুই মামাতো বোন রুমু-ঝুমুর ঘরে। রুমু-ঝুমু দু’জনেই জানালা দিয়ে বাইরেের দিকে তাকিয়ে আছে মন খারাপ করে। দু’জনেই সুতি সেলোয়ার-কামিজ পড়া আর চুলে বিনুনি করা। ওরা দু’জন এক বছরের ছোট বড় হলেও ওদের দেখতে একদম জমজ বোনের মতো। দূর থেকে তাদেরকে কেউ আলাদা করতে পারে না। যারা চিনে না তারা কাছ থেকেও আলাদা করতে পারে না। তবে বাবা-মা ভাই আর এশা ওদেরকে দেখলেই চিনে ফেলে যে কে রুমু আর কে ঝুমু। এশা দুজনের পিঠে গিয়ে হাত রাখলো তারপর দু’জনের মাথা সরিয়ে জানালা দিয়ে উকি দিতে দিতে বললো,
-দেখি তো কোন রাজপুত্র দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। যাকে আমার দুই মামাতো বোন এতোক্ষণ ধরে দেখছে।
এশার কথা শুনে রুমু-ঝুমু হেসে উঠলো। তাদের হাসিতে লম্বা বিনুনি করা চুল গুলো খানিক নেচে উঠলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ থাকলো না। দু’জনেই এশা’কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এশারও দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। তবে সে তা কাউকে না দেখতে দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে রুমু-ঝুমু’ কে বলে উঠে,
-তোদের কি আজ বিয়ে? এভাবে কাঁদছিস কেন?
-তোমাকে খুব মিস করবো আপা।(রুমু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে উঠে।)
-আমিও খুব মিস করবো আপা।(ঝুমু)
-আমিও তোদেরকে মিস করবো। স্কুল ছুটি হলে মামাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসবি কেমন?
-বাবা নিয়ে যাবে?
-অবশ্যই নিয়ে যাবে আমি বলে যাবো।
ওদের কথার মাঝখানে নাদিরা বেগম আবার এসে ডাক লাগালো,
– এশা এবারকি তুমিও এদের সাথে কান্নার আসর জমালে? খাবে না নাকি? তোমার মামাতো এখনই এসে পরবে।
-এইতো মামী আসছি আমরা।
ওদের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হাকিম মিয়াও (এশার মামা) বাজার থেকে চলে আসলো। তারপর হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো। এই সুযোগে এশা, রুমু, ঝুমু তিনজন আরো একবার একে অপরকে জড়িয়ে থাকলো খানিক্ষণ। একটু পড়েই যে এশা চলে যাবে গ্রাম ছেড়ে।
_____________________
হাকিম মিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটছে এশা। তার এই প্রথম এত্তো মন খারাপ লাগছে। এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। সে হুমায়ুন আহমেদের বইয়ে পড়েছিলো মেয়েদের কারণে অকারণে মন খারাপ হয়। এই কথা সে বিশ্বাসই করেনি এতোদিন। তবে বুঝি কথাটা এখন তার ক্ষেত্রেও সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেলল!
এসব হাবিজাবি কথা ভাবতে ভাবতেই এশা মামার সাথে নদীর ধারে এসে পৌঁছালো।মামা তীরে থাকা একটা নৌকা দেখিয়ে তাড়া দিয়ে বললো,
-তাড়াতাড়ি উঠে বোস। নৌকা প্রায় ভরে গেছে। এরপর আবার কোনো নৌকা ঘাটে আসবে কিনা সেটাও সন্দেহ।
এশা বিনা প্রতিত্তোরে নৌকায় ওঠার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।কিন্তু যেই নৌকায় পা রাখলো ওমনি পা’টা স্লিপ করে গেলো। একটু হলে নদীতেই পরে যাচ্ছিলো এশা। সে ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু একটা বলিষ্ঠ হাত এশাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর তারজন্যই এশা এযাত্রায় বেঁচে গেলো। এশা চোখ খুলে দেখে এক শ্যাম বর্ণের সুদর্শন পুরুষ এশাকে শক্ত করে ধরে আছে। এশা স্বাভাবিক হওয়ার পর ছেলেটি এশাকে ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। এক বয়স্ক মহিলা শ্যামবর্ণা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-কি বাজান তোমার শখের নৌকা ছাড়বা কহন?
-এইতো চাচি এখনই ছাড়বো।
এশা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। হাকিম মিয়া এশাকে বললেন,
-একটু সাবধানে চলবি তো মা? পোলাড না থাকলে আইজ কি অবস্থা হইতো? আমি তোর বাপ-মা’কে কি জবাব দিতাম?
মামা’র কথার মাঝখানেই। শ্যাম পুরুষ মামাকে ডেকে বলে উঠে,
-চাচা, ভেতরে এসে বসেন। নৌকা ছেড়ে দিলে এবার আপনারা দু’জনেই পরে যাবেন।
হাকিম মিয়া এবং এশা দু’জনেই ভেতরে গিয়ে বসলো। এশা না চাইতেও বারবার তার চোখ শ্যামবর্ণা ছেলেটির দিকেই চলে যাচ্ছে। ছেলেটি এতোক্ষণে নৌকা চালাতে শুরু করেছে। এশা বসে বসে ভাবছে,
” এতোদিন ভাবতাম নৌকার মাঝি হবে মধ্য বয়স্ক মামা-চাচা টাইপ কিন্তু এই পোলা দেখি কেমন বয়ফ্রেন্ড টাইপ।”
বয়ফ্রেন্ড কথাটা মাথায় আসতেই এশা চমকে উঠলো। সে এই প্রথম বয়ফ্রেন্ড শব্দটা উচ্চারণ করেছে। তবে এশার বয়ফ্রেন্ড – গার্লফ্রেন্ড শব্দ দুটো পছন্দ করে না। তার মতে এখনকার তথাকথিত বয়ফ্রেন্ড -গার্লফ্রেন্ড থেকে নব্বই দশকের প্রেমিক প্রেমিকা বেশ ভাল্লাগে। এশা মাঝে মাঝে কল্পনা করে,
এশা নব্বই দশকের এক তরুণী। সে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে গাঢ়ো কাজল, রুমু-ঝুমু’র মতো মাথা ভরতি তেল দিয়ে চুলে বিনুনি করে ভার্সিটি যাবে। তার একটা ব্যাক্তিগত পুরুষ হবে। যে প্রতিদিন না হোক সপ্তাহে একদিন বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবে এশার জন্য। সে খুব ফর্সা হতে হবে এমন না। হোকনা একজন শ্যাম পুরুষ। আবারও “শ্যাম পুরুষ” শব্দ দুটো ভেবে নিয়ে এশা চমকে উঠলো। তার সামনে নৌকা চালানো ছেলেটাও তো শ্যাম বর্ণের। তবে কি….
এতোটুকু ভেবে নিয়ে এশা নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাপর দিলো। একি ভাবছে সে? এই ছেলেকে তো এশা চিনেও না। এশা লক্ষ্য করলো,
তখন কথা বলা বয়স্ক মহিলার পাশে বসা মেয়েটি গিয়ে নৌকা চালানো ছেলেটাকে বললো,
-ভাইয়া তুমি তো অনেক ভালো গান পারো। আজ একটা গাইবে না?
শ্যামবর্ণা ছেলেটি মেয়েটির কথা শুনে হেসে উঠলো। কি সুন্দর ঝলমলে হাসি! হাসির সাথে সাথে ছেলেটার কালো ঘন চুল গুলোও খানিকটা নেচে উঠলো। ছেলেটি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-ভাইয়া কি বোনের আবদার ফেলতে পারে? কখনোই না। তোমার ভাইয়া অবশ্যই গাইবে। তুমি বসো।
ছেলেটি এবার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুর তুললো,
কবির লেখা যত কবিতা
শিল্পীর আঁকা যত ছবি
তোমার তুমির কাছে
হার মেনে যায় যেন সবই।
সাঁঝের বেলা রাঙ্গানো ধুলি
বর্ষাকালের ভরা নদী
তোমার রূপের কাছে
হার মেনে যায় যেন সবই।
তুমি সাগর নীলিমা নও
তুমি মেঘের বরষা নও
তুমি সাগর নীলিমা নও
মেঘের বরষা নও
তুমি শুধু আমারই গয়না
আয়না.. তুমি হৃদয়ের আয়না।
এটুকু গেয়েই থেমে গেলো ছেলেটি। এশা কেমন নেশালো দৃষ্টি নিয়ে সারাক্ষণ ছেলেটার দিকে চেয়ে আছে। ছেলেটিও তার দিকে বারকয়েক আড়চোখে তাকালো কি-না সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এশা। এশা ভাবছে,
“যদি ছেলেটি না তাকিয়ে থাকে। তবে তাকালো না কেন? অবশ্যই তার তাকানো উচিত ছিলো এশার দিকে। শুধু তাকানো কি বলছি একদম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা উচিত ছিল। এশা কি সুন্দর নয়?যথেষ্ট সুন্দরী। মামী বলে এশা একবার সুন্দর করে শাড়ি পড়ে বাইরে বের হলে রাস্তায় ছেলের লাইন লেগে যাবে। মামী তো আর এমনি এমনি বলে না।”
-কিরে কি বিরবির করছিস? নৌকা থেমে গেছে নামবি না?
মামার ডাকে থতমত খেয়ে গেলো এশা। তারপর কোন কথা না বলে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ায় সে। মামা বাস কাউন্টারে এসে গাড়িতে তুলে দেয় এশাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
-কি যেতে পারবি তো?
– হ্যাঁ, মামা তুমি চিন্তা করো না।
– পৌছে আমায় কল দিস কেমন? চিন্তায় থাকবো তোর জন্য।
-চিন্তা কিসের আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি মামা।
-তুই যখন আমার মতো হবি তখন বুঝবি ছেলেমেয়ে যতবড়ই হোক বাবা-মা এর চিন্তা হবেই।
-উফ, মামা তুমি আর বাবা একদম একই রকম কথা বলো।
কিছুক্ষণ কথা বলে এশা মামার থেকে বিদায় নিলো। বাসও ছেড়ে দিলো। হাকিম মিয়া দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ বাসটি দেখা যায়।
চলবে….