#প্রেম_প্রেম_খেলা(শেষ পর্ব)
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
অহনা ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছে।সে আনমনে ভাবতে লাগলো যার ভাগ্যে যে লেখা নাই তার প্রতি মানুষের কেনো এতো আকর্ষণ তৈরি হয়?যাকে মানুষ কোনো দিনও ভালোবাসতে পারবে না তাকেই কেনো মানুষ ভালোবেসে ফেলে?ভালোবাসা এমন বিষাদ ময় কেনো?এই অসম্ভব ভালোবাসাগুলোর শেষ পরিনতি গুলো এমন কষ্টদায়ক কেনো হয়?
চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেছে।অনিল দুই মগ কফি হাতে নিজেও এগিয়ে আসলো ছাদে। আর অহনাকে বললো, কি দেখতিছিস এভাবে?
–আমার ভাগ্যে কি লেখা আছে সেটা দেখার ট্রাই করছি।
অনিল তখন হাসতে হাসতে বললো তাই?তা কি দেখতে পেলি?
অহনা তখন বললো,পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না।কেমন যেনো আবছা আবছা লাগছে।
অনিল তখন বললো ধর কফির মগ টা নে।তারপর একটা চুমুক দিয়ে ভালো করে দেখ।দেখবি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।এই বলে অনিল কফির মগ টা অহনার হাতে দিলো।
অহনা কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো, তেমন একটা ভালো হয় নি কফিটা।কেমন যেনো লাগছে।
অনিল তখন বললো, আমি বানিয়ে আনলাম।আম্মু কাজে ব্যস্ত আছে।
অহনা তখন বললো ফাস্ট টাইম বানালেন তাই না?
–হ্যাঁ।
অহনা তখন বললো সেইরকমই মনে হচ্ছে।তবে এটা আমার ভাগ্য যে আপনার তৈরি ফাস্ট কফিটা আমি খেতে পারছি?
অনিল তখন বললো আমারও ভীষণ ভালো লাগছে জীবনের ফাস্ট বানানো কফিটা তোকে খাওয়াতে পেরে।
তারপর দুইজন কিছুক্ষন চুপচাপ থাকলো।আর কফির মগে চুমুক দিতে লাগলো।
হঠাৎ অহনা বললো, আচ্ছা ভাইয়া ভালোবাসার সঙ্গা দিতে পারবেন?ভালোবাসা জিনিস টা আসলে কি?
অনিল তখন বললো, একে অপরের উপর ট্রাস্ট থাকতে হবে।যত বিপদ,বাধা বিপত্তি আসে না কেনো দুইজন দুইজনার হাত কখনোই ছাড়া যাবে না।একে অপরের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে থাকতে হবে।আরো অনেক কিছু আছে।আমি এর থেকে বেশি কিছু জানি না।
অহনা তখন বললো, আচ্ছা আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?
–কি?
বলেন তো একজন মানুষ জীবনে কতবার প্রেমে পড়তে পারে?
অনিল তখন হাসতে হাসতে বললো,একজন মানুষ বার বার প্রেমে পড়তে পারে যতদিন না সে তার মনের মতো জীবনসঙ্গী খুঁজে না পায়।যখন কেউ তার পারফেক্ট জীবনসঙ্গী কে পেয়ে যায় তখন আর দ্বিতীয় বার প্রেমে সে কখনোই পড়বে না।যদি পড়ে যায় তখন ধরে নিতে হবে প্রথম জনকে সে ভুলে গেছে।
অহনা তখন অনিলের দিকে তাকিয়ে বললো আপনি কতবার প্রেমে পড়েছেন?
অনিল তখন নির্ধিদ্বায় বললো অনেকবার।
অহনা অনিলের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।আর বললো সিরিয়াসলি?
অনিল তখন বললো হ্যাঁ।তবে মানুষ টি একজনই।যার প্রেমে আমি অনেকবার পড়েছি।
অহনা তখন বললো আপনি আমার কথা বলছেন তাই না?
অনিল কোনো উত্তর দিলো না।
অহনা তখন বললো কিন্তু আমি কাকে ভালোবাসি সেটা শুনবেন না?
অনিল সেই কথা শুনে ছাদ থেকে চলে গেলো।কারণ সে আন্দাজ করতে পারছে যে অহনা আদ্রিয়ানের কথা বলতে চাচ্ছে।অহনা যে আদ্রিয়ান কে ভালোবেসে ফেলছে সেটা অনিল বুঝতে পারছে।সেজন্য অহনার মুখে তার ভালোবাসার মানুষের নাম শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই তার।
অহনা অনিল কে এভাবে চলে যাওয়া দেখে বললো, এই যে অনিল ভাইয়া? চলে যাচ্ছেন কেনো?
কিন্তু অনিল আর পিছন ফিরেও তাকালো না।
🖤
আজ টুশু,অর্পা আর সনিয়া এসেছে অহনার মামার বাড়িতে।অহনা নিজে ইনভাইট করেছে তাদের।কি জন্য ইনভাইট করেছে সেটা বলে নি অহনা।শুধু বলেছে সারপ্রাইজ আছে।
এদিকে হঠাৎ আদ্রিয়ান এসে উপস্থিত হলো অহনার মামার বাড়িতে।কারণ অহনা নাকি তাকেও ইনভাইট করেছে।আদ্রিয়ান কে দেখে টুশু,অর্পা আর সনিয়া বেশ খুশি হলো।তারা ভাবলো শেষমেশ তাহলে অহনা আদ্রিয়ান কে তার মনের কথা বলবে।আর আদ্রিয়ান ও নিশ্চয় অহনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।আজ তাদের কে যে করেই হোক মিলিয়ে দিতেই হবে তাদের।
অনিল অফিস থেকে ফিরে সবাইকে দেখে একদম সারপ্রাইজড হয়ে গেলো।বিশেষ করে আদ্রিয়ান কে দেখে।অনিল আদ্রিয়ান কে দেখামাত্র হ্যান্ডশেক করলো।আর বললো কেমন আছেন আদ্রিয়ান?
আদ্রিয়ান হেসে উত্তর দিলো জ্বি ভালো আছি।
হঠাৎ আদ্রিয়ান বললো,
বেস্ট অফ লাক অনিল।আর কনগ্রাচুলেশনস।
অনিল বেশ অবাক হলো।হঠাৎ আদ্রিয়ান এভাবে বলছে কেনো?
টুশু,অর্পা আর সনিয়াও অবাক।তারা সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
হঠাৎ মেরুন কালারের চুমকি বসানো একটা গাউন পরে অহনা আসলো সবার সামনে।তাকে বরাবরের মতো আজও বেশ সুন্দর লাগছিলো।অহনার পিছে পিছে তার মামা আর মামিও ছিলো।
অহনার মামি হঠাৎ অনিলের হাতে একটা রিং দিয়ে বললো বাবা অহনাকে পড়িয়ে দে।
অনিলের হাত পা কাঁপছিলো।তার মা কি বলছে এসব?
অহনা তখন বললো কি হলো পড়িয়ে দিন?
টুশু,অর্পা আর সনিয়া তা দেখে অহনাকে বললো,কি করছিস অহনা?অনিল ভাইয়া কে তুই বিয়ে করছিস?
অহনা হেসে হেসে বললো,হুম।
টুশু, অর্পা আর সনিয়া তখন আদ্রিয়ানের কাছে গিয়ে বললো, আপনি জানতেন আজ অহনা আর অনিলের এনগেজমেন্ট?
আদ্রিয়ান ও হেসে হেসে উত্তর দিলো হ্যাঁ,সেজন্যই তো এসেছি আমি।
টুশু অর্পা আর সনিয়া আর কিছু বললো না কাউকে।তবে তারা ভীষণ কষ্ট পেলো।তারা চেয়েছিলো অহনা আর আদ্রিয়ান সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাক।তাদের চাওয়াতেই তো আর সব হবে না।যেখানে অহনা আর আদ্রিয়ান ই চাইছে না এক হতে।
একজন কি সুন্দর বিয়ে করতে যাচ্ছে আর আরেকজন নাচতে নাচতে বিয়ে খেতে এসেছে।
অনিল কে চুপচাপ থাকা দেখে আদ্রিয়ান বললো,কি হলো অনিল?পড়িয়ে দাও।এতো লেট কেনো করছো?জানোই তো শুভ কাজে দেরি করতে নাই।
অনিল সেই কথা শুনে অহনার দিকে তাকিয়ে বললো কিন্তু অহনা তুই না?
–আমি কি?
অনিল বলতে ধরে আর বললো না।
অহনা তখন বললো আপনি কি নিয়ে চিন্তা করছেন তা আমি ভালো করেই জানি।আপনি মনে মনে ভাবছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা?আর এই বিয়ে টা কি আমি নিজের ইচ্ছাতেই করছি না আমাকে মামা মামি জোর করে রাজি করিয়েছে?
অনিল তখন বললো হ্যাঁ।এই প্রশ্নগুলোই আমি করতে চেয়েছি?
অহনা তখন বললো আমি স্বজ্ঞানে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।মামা মামি কেউ আমাকে জোর করে নি।তবে এটা সত্যি যে এখনো আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারি নি।বিয়ের পর থেকে ভালোবাসা শুরু করবো।এতে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে রিং টা আমাকে পড়িয়ে দিতে পারেন।
অনিল সেই কথা শুনে বিসমিল্লাহ বলে অহনার হাতে রিং পড়িয়ে দিলো।কিন্তু অনিল যখন রিং পড়াচ্ছিলো অহনা চোখ বন্ধ করে ছিলো।অনিল রিং পড়ানোর সাথে সাথে অহনা সবাইকে বললো আমি একটু আমার বাবা মা ভাই আর বোনকে দেখিয়ে আসি রিং টা।ওকে।এই বলে অহনা দৌঁড়ে তার রুমে প্রবেশ করলো।
অন্যদিকে আদ্রিয়ান ও এক এক করে সবার থেকে বিদায় নিলো।কারণ তার আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা শো আছে।অহনা ইনভাইট করেছিলো বিধায় তাকে আসতে হয়েছে।
আদ্রিয়ান হাসিখুশি মুখে চলে গেলো।
🖤
সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ মিনিট।আদ্রিয়ানের শো স্টার্ট হয়েছে।উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন কিছুক্ষনের মধ্যেই উপস্থিত হবে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী আদ্রিয়ান। যিনি তার সুরেলা কন্ঠে ভরিয়ে দেবে আপনাদের মন।
আদ্রিয়ান গিটার হাতে উপস্থিত হলো।সে সবার উদ্দেশ্যে বললো,আজ আমি যে গানটা গাইবো সেই গানটা এখনো আমি রিলিজ করি নি।আর এই গানটা রিলিজ করার ইচ্ছাও নাই।আজ শুধুমাত্র আপনাদের উদ্দেশ্যে গানটি গাইবো আমি।এই বলে আদ্রিয়ান শুরু করলো তার গান।
“প্রেম প্রেম খেলা খেলতে খেলতে,
পড়েছি প্রেমে তোমার,
আমি অসহায়ের মতো চেয়ে আছি শুধু
তোমাকে বলার নেই কোনো অধিকার।
এটা প্রেম নাকি মায়া?
আজও জানি না।
এরকম ভালোবাসা কেনো আসে জীবনে
যে ভালোবাসায় পূর্নতা মেলে না?
আদ্রিয়ানের চোখে জল টলমল করছে।তবুও সে কাঁদলো না।তবে সে বুঝতে পারছে মোহনাকে সে পুরোপুরি ভুলে গেছে।নতুন করে অহনার প্রেমে পড়ে গেছে আদ্রিয়ান।
এটা কি ধরনের ভালোবাসা ভাবতেই আদ্রিয়ানের নিজের প্রতি নিজের রাগ হতে লাগলো।সে কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি মোহনাকে ভুলে গেলো? সে যাকে একসময় পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো তারই আপন বোনকে কি করে নতুন করে ভালোবাসার কথা ভাবছে?
না সে কিছুতেই ভুলবে না মোহনাকে।তার মনে সে অহনাকে আসতেই দেবে না।আদ্রিয়ান তার ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে লাগলো।
অন্যদিকে অহনা নিজেও আদ্রিয়ানের লাইভ দেখছে।আদ্রিয়ানের গান শুনে তার চোখ দিয়েও টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।কারণ সে যে অনেক আগেই আদ্রিয়ানের প্রেমে পড়ে গেছে।আদ্রিয়ানের সাথে প্রেমের অভিনয় করতে গিয়েই সে দূর্বল হয়ে পড়েছে আদ্রিয়ানের প্রতি।কিন্তু তার যে আদ্রিয়ানের প্রতি প্রেম প্রকাশ করার কোনো ক্ষমতা নাই।আদ্রিয়ানের উপর শুধু যে মোহনার অধিকার আছে।আর তাকে ভালোবাসার অধিকারও শুধু মোহনার।সে বোন হয়ে কি করে তার বোনের প্রেমিক কে এভাবে ভালোবাসতে পারে?
যে ছেলে একসময় তার বোনের প্রাণ ছিলো,যার প্রতিটা নিঃশ্বাসে শুধু আদ্রিয়ানের নাম লেখা ছিলো সেই আদ্রিয়ানকে অহনা কখনোই ভালোবাসতে পারে না।এখনো মোহনার ডাইরির পাতা খুললে অহনার বুক টা ধক করে ওঠে।একটা মানুষ কি করে এতো ভালোবাসতে পারে তার প্রেমিক কে।
মোহনার শেষ চিঠিটা অহনার মন থেকে কিছুতেই সে মুছতে পারছে না।মোহনা লিখেছে,
প্রিয় আদ্রিয়ান,
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তোমার কথা মনে পড়ে আমার কতবার?আমি উত্তরে বলবো আমার চোখের পাতা নড়ে যতবার।
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তোমাকে ভালোবাসি কত?
আমি উত্তরে বলবো,আকাশে তারা আছে যত।
তোমাকে অনেক মেয়ে ভালোবাসলেও আমার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না।কারণ তুমি যে শুধু আমার ভালোসাতেই পূর্ণ।
যদি পৃথিবীকে ধবংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধ বাধে,
যদি কমে যায় কভু আলো আকাশের ঐ চাঁদে
সেদিনও তুমি শুধু আমারই থাকবে।
আর আমি যদি তোমার আগে মারা যায়,মাটির নিচে গিয়ে আমি অপেক্ষায় থাকবো প্রিয়।আমি জানি তুমি তখনো আমার হয়েই থাকবে।
মোহনার এই রকম একটা আবেগঘন চিঠি পড়ে সে কি করে আদ্রিয়ান কে ভালোবাসতে পারে?সেজন্য নিজের মনের কথা নিজের মনে রেখে সে হাসি মুখে অনিল কে বরণ করে নিলো।
তবে অহনা অনিল কে বিয়ে করলেও আদ্রিয়ান আর কাউকে বিয়ে করে নি।অহনার প্রতি সে কিছুদিন দূর্বল হলেও শেষ মেষ নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ করে।
অহনা আর আদ্রিয়ান দুইজনার কেউই জানে না যে প্রেম প্রেম খেলা খেলতে খেলতে দুইজন দুইজনকেই ভালোবেসেছিলো।কিন্তু তাদের এই ক্ষনিকের ভালোবাসা আর পূর্নতা পেলো না।সারাজীবনের জন্য তা অপূর্ণই রয়ে গেলো।এটাই হয়তো তাদের দুইজনের ভাগ্যে লেখা ছিলো।
সমাপ্ত