#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৭]
-‘ পৃথিবীতে স্বামীরা খারাপ হলেও প্রকৃত বাবারা কখনো তার সন্তানের অনিশ্চিত জীবন চাই না। আর আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে তুমিও প্রকৃত বাবাদের একজনই হবে।’
একথা শুনে রুদ্র কিয়ৎকাল নিশ্চুপ রইল। স্পর্শীকে পূর্বের মতো বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একহাতে ড্রাইভ করছে। কারো মুখে রা শব্দটুকুও নেই অথচ দু’জনের ভেতরটাই এই মুহূর্তে অশান্ত, অদমনীয়। স্পর্শী তার নিজের অজান্তেই সম্পর্কের দোহায় দিয়ে অনেক বড় অংক কষে ফেলেছে। এর পরিণতি হয়তো ভেবেই দেখে নি। তার এমন করার কারণটাও এখন সুস্পষ্ট। স্পর্শী আদুরে বিড়াল ছানার মতো রুদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে শার্টের বোতাম খুঁটরে যাচ্ছে। মুখটা চুপসানো। মনে মনে প্রস্তুত’ও একটা রাম ধমক হজম করার। ওর চুপসানো মুখ দেখে রুদ্র মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে স্পর্শীর কপালে আদর এঁকে শান্তভাবে বলল,
-”খুব ভালোবাসিস আমাকে?’
-‘ভীষণ।’
-‘আজীবন থাকতে চাস আমার সঙ্গে?’
-‘খুব করে চাই। জানো, আমার না বাঁচতে ইচ্ছে করে সুস্থ ভাবে বাঁচা যাকে বলে। তুমি-আমি আমরা মিলে সাজানো একটা সংসার হবে আমাদের। আমি একদিন খুব ভালো বউ
হবো তোমার, নিজের হাতে রান্না করব, সংসার সামলাবো, আমাদের একটা পুচকু হবে, তার যত্ন নিবো, একজন ভালো মা হবো।’
-‘আর?’
-‘আর? উমমম না আর কিছু না। আমার এইটুকুই চাওয়া।’
-‘তারমানে তোর কথা অনুযায়ী সুস্থভাবে বাঁচতে গেল এখন আমাকে রাজনীতি ছাড়তে হবে, তাই তো?’
-‘হুম।’
-‘তাহলে বলব এসব চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেল। যতদিন না আমি নিজে চাইব ততদিন বাচ্চার চিন্তা স্মরণেও আনতে পারবি না। যদি ভেবে থাকিস, আমাদের একটা বাচ্চা হলেই আমার পায়ে শেকল পড়ে যাবে আর রাজনীতি ছেড়ে দিবো তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। যেমন আছিস তেমনই থাক তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কখনোই কমবে না। তবে বার বার রাজনীতি ছাড়ো, রাজনীতি ছাড়ো, করে এসব কাহিনি সৃষ্টি করিস না। প্রতিটা মানুষের ভালো লাগা মন্দ লাগা বলে কিছু ব্যাপার থাকে। আমার কাছে রাজনীতি ভালো লাগার একটা দিক, আমি রাজনীতে যুক্ত ছিলাম আছি আর তাইই থাকব।
তাছাড়া আমি যেমন তোর সমস্ত ভালো-মন্দ মিলিয়ে হৃদয়ে
ঠাঁই দিয়েছি তবে তুই কেন পারছিস না? কেন অহেতুক চিন্তা করে আমাকে দমিয়ে রাখতে চাস? মোদ্দাকথা, এ নিয়ে পূর্বে আমাদের কথা হয়ে গেছে তাই কথা না বাড়ানোই প্রয়োজন দেখছি না। ‘
-‘থাকবা আমার সঙ্গে আর বাচ্চার সিদ্ধান্ত তুমি একা নিবে?’
-‘ ঠিক তাই।’
-‘তাহলে তুমি নিজে নিজেই প্রেগনেন্ট হয়ে নিজের বাচ্চা নিজে পয়দা করিও।’
-‘বেহুদা কথাবার্তা যত বলবি কম বলবি তত মাথা ঠান্ডা থাকবে। আর যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আর হ্যাঁ
আরেকটা কথা, প্রয়োজনের তুলনায় লেবু যত চটকাবি তত তিতা লাগবে। বেস্বাদে মুখটা বিষিয়ে যাবে, গা গুলাবে। তাই আগে প্রয়োজন অনুযায়ী মাপ বুঝে নেওয়া জুরুরি।’
-‘এসব যখন বলো তখন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়, আমার ম/রে যেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা আমার চাওয়ার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?’
-‘আছে বলেই সমস্ত কাজ ফেলে ঘুরতে বের হয়েছি।’
-‘কাজ, কাজ আর কাজ, এত কিসের কাজ তোমার? কাকে এত ব্যস্ততা দেখাও তুমি? চোখের সামনে আছি বলে গুরুত্ব দিচ্ছো না, যখন সত্যি সত্যি থাকব না, তখন বুঝবা ঠিক কি ছিলাম। এখন আমি যেমন তোমার প্রতিটা কথায় দগ্ধ হচ্ছি, একদিন তুমিও আমাকে না পেয়ে আফসোসে ডুবে হাজার আকুতি করলেও তোমার প্রেম প্রার্থনা শোনার মানুষ থাকবে না। আজ যেমন আমার কথা শুনছ না তখন আমিও শুনবো না তোমার কথা।’
-‘বরাবরই আমার ইমোশন অকেজো তাই তোর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে কাজ হচ্ছে না, সরি। রাজনীতি ছাড়া বাদে অন্য
অপশন থাকলে বল।’
-‘আমি কনসিভ করতে চাই। তারপর আমার বাচ্চাকে নিয়ে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই।’
-‘তোর বয়স অনুযায়ী চিন্তা ভাবনা খাপে খাপ। তবে আমার রাজনীতি নিয়ে যখন এতই সমস্যা তখন আমি রাজনীতিই ছেড়ে দিবো, তবে শর্তসাপেক্ষে। যদি তুই সেই শর্ত মেনে নিস তবে তোর কথামতো সব হবে, প্রমিস।’
-‘কী শর্ত? ঝটপট বলো আমি সব শর্তে রাজি।’
-‘আজ অবধি কোনো পরিস্থিতিতেই মেয়েলি কোনো কেসে নিজেকে জড়ায় নি। তবে রাজনীতি ছেড়ে দিলে আমি পাক্কা
মেয়েবাজ হবো, মেয়েবাজ বুঝিস? প্লে বয়। উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে, নিত্যনতুন মেয়ের সঙ্গে লিপ্ত হবো। আর কোন মেয়ের শরীর কীভাবে হাতাবো প্রমাণসহ দেখবি তুই। আই মিন সাক্ষী থাকবি সেই সঙ্গে…! ”
রুদ্রর কথা শুনে স্পর্শী শক্ত হাতে খামচে ধরল রুদ্রের শার্ট।
পরক্ষণেই ডুকরে কেঁদে উঠল নিষ্ঠুর পুরুষটার বুকে মুখ লুকিয়ে। এই কোন আজাব নেমে এলো তার জীবনে? এক বিপদ থেকে উদ্ধার হতে চাইলে আরেকটা বিপদের দ্বারে পড়তে হচ্ছে। রুদ্র কীভাবে বলতে পারছে এসব কথা? তার কি বুক কাঁপছে না বিবেকে বাঁধছে না? রুদ্র নির্লিপ্তভাবে ড্রাইভ করছে। তার মুখভঙ্গি অত্যন্ত গম্ভীর। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেও রুদ্র বিচলিত হওয়া দূর টু শব্দ অবধি করল না। তখন স্পর্শীই বলল,
-না, না, থামো, থামো প্লিজ! আচ্ছা ঠিক আছে রাজনীতিই করো তবুও আমার হয়ে থেকো। তোমার বুকে অন্য নারীকে সহ্য করতে পারব না আমি। আজ প্রমিস করছি জীবনেও রাজনীতি ছাড়ার কথা বলবো না তোমাকে। তোমার যখন যা মন চাই তাই করিও তবুও অন্য নারীতে আসক্তি হইয়ো না, প্লিজ।’
-‘যদি শর্তের হেরফের হয় তখন?’
-‘হবে না, প্রমিস, প্রমিস, প্রমিস।’
-‘চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বস। এই আলোচনার রেশ ধরে সুন্দর মুহূর্তটুকু নষ্ট করিস না। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে গেঁথে নে স্বার্থের এই পৃথিবীতে ক্ষমতা আর টাকা ছাড়া সব তুচ্ছ। এই দুটো ছাড়া মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। যার পকেটে টাকা আছে তার সন্মান আছে। বনের রাজারও কিন্তু ক্ষমতা বুঝে রাজত্ব করে পুরো বনে। ক্ষমতার জোরে থাবা বসায় অসহায় প্রাণীর উপরে, সেখানে আমি তো আমিই। আর হ্যাঁ বেবি কনসিভের ব্যাপারটা ভুলে যা নয়তো তোকে ছুঁয়ে দেখা তো দূর বাসায় আসাও বন্ধ করে দিবো।’
স্পর্শী একটা কথাও বলল না, কাঁদলোও না, শুধু নিশ্চুপ হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। রুদ্র গাড়ি থামাল এক পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টের সামনে। পাকিং লটে গাড়িটা পার্ক করে স্পর্শীকে নিয়ে গেল বিল্ডিংয়ের আট নং ফ্লোরে। স্পর্শী স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছে রুদ্র পিছু পিছু। যেন কিছুই হয় নি তাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক। রুদ্রও এখন হেসে হেসে কথা বলছে, এটা-ওটা দেখাচ্ছে। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। রুদ্র হঠাৎ’ই তার হাঁটার গতি কমিয়ে তার হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। স্পর্শী খুব অবাক হলেও রুদ্র তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না। আট নং ফ্লোরে এসে স্পর্শী দৃষ্টি বুলিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে। খুব সুন্দর করে সাজানো ভেতরটা।
কিন্তু ভেতরে একটা মানুষেরও আনাগোনা নেই সব টেবিল ফাঁকা। এই নিয়ে তেমন কিছু ভাবল না সে কারণ রুদ্র তাকে
আউল ফাউল কোনো জায়গায় আনবে না। তার উপরে এই টুকু বিশ্বাস আছে। অতঃপর রুদ্রর ইশারায় কর্ণারে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসতেই এক ওয়েটার ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়ে এসে অর্ডার নিয়ে নিল। সব স্পর্শীর পছন্দের খাবার। সেটা দেখে স্পর্শী মনে মনে হাসল। মনের ঘরে আঘাত হেনে তার পছন্দের খাবার এনে মলম লাগানো হচ্ছে।একটুপরেই আরেকজন এসে অনেকগুলো লাল টকটকে গোলাপ আর চকলেট দিয়ে গেল।পূর্বের জন যেতে না যেতেই এক মেয়ে ওয়েটার উপস্থিত হলো। মুখভর্তি তেলতেলে হাসি সমেত এক ডালা কোণ আইসক্রিম হাতে তুলে দিলো। স্পর্শী কথা না বলে মুখে হাসি এঁটে সেগুলো নিয়ে টেবিলে রেখেছে। সে বুঝে গেছে এসব রুদ্রেরই কাজ। সে রুদ্রর মুখোমুখি বসে ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচ ভেদ করে রাস্তায় চলা গাড়ি দেখছে।জ্যামে কতশত গাড়ি আঁটকে আছে। তারা যখন গাড়ি করে এলো এত জ্যাম ছিল না। সে যখন একমনে এসব ভাবছিল তখন
রুদ্র ওর বাম হাতটা টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে স্বর্ণের রিং পরিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু এঁকে বলল,
-‘রাগ করেছিস?’
-‘নাতো।’
-‘রাজনীতি আর কনসিভের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’
-‘বিনিময় কি পাবো?’
-‘সম্পূর্ণ আমিটাকে।’
-‘আচ্ছা।’
তারপর রুদ্র তার কথা দ্বারা স্পর্শীকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকল। মজার মজার সব গল্প শুনাতে থাকল।খাবার এলে নিজেই স্পর্শীকে সার্ভ করে দিলো। এক পর্যায়ে রুদ্রর
একটা কথা শুনে স্পর্শীও খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মায়াবী মুখে খুশি ঝিকমিকিয়ে উঠল। অভিমান সরে গিয়ে
চোখে ফুটল একরাশ লজ্জা। কারণ রুদ্র এসব সব কথা বলছিল না চাইলেও লজ্জারা তাকে ঘিরে ধরছিল। মানুষটা যে চরম লেভেলের বেহায়া তা পুনরায় প্রমাণ পেল।অতঃপর
খাবার পর্বে শেষ করে তারা গাড়ি নিয়ে অনেক জায়গা ঘুরে মজা করল, দু’জন টুকটাক কেনাকাটা করল, যা আবদার করল রুদ্র কিনে দিলো, এই প্রথম রুদ্র তাকে এভাবে সময়
দিচ্ছে, সবটা যেন স্বপ্নের মতোই। রাত যখন সাড়ে বারোটার কাছাকাছি তখন রুদ্র জানাল তারা আজ বাসাতেই ফিরবে না। হতবাক স্পর্শী কিছু বলার আগেই রুদ্রর ফোনে একটা কল এলো। হুম, হ্যাঁ, তে কথা সেরে কল কেটে পুনরায় তাকে নিয়ে গেল আরেক জায়গায়। আর সেখানে গিয়ে ই স্পর্শীর সব কথা ফুরিয়ে গেল, বিষ্ময়ে অবশ হয়ে এলো তার মস্তিক,
অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো কথা গুছাতে পারলো না
তখন শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর মুখের দিকে।
To be continue………….!!