প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৬

0
676

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৬]

-‘কে রে বা*?’

-‘বা* না, তোর মায়ের একমাত্র জামাতা।’

-‘আমি এখন ঘুমাব কেউ যেন না ডাকে।’

-‘অসময়ে ঘুমনো বের করছি তাড়াতাড়ি দরজা খুল।’

-‘খবরদার বলছি কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবা না। যেখানে গিয়েছিলে তুমি সেখানে যাও। কাজ না পেলে তোমার এমলি আছে না? তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকো তবুও আমাকে ডাকবে না। আমি তোমার কেউ ছিলাম না, এখনও নেই।’

-‘নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের কাছে যেতে বলছিস। এবার ইতিহাসের পাতায় তোর নামটাই আগে থাকবে। শোন, কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে, ঝটপট রেডি হয়ে নিচে আয় আমি ওয়েট করছি। ঠিক পনেরো মিনিট দিলাম এর মধ্যে যদি রেডি হতে না দেখি তখনই বুঝবি আমি কী জিনিস।’

-‘তুমি কি জিনিস নতুন করে জানার দরকার নাই। যতটুকু জেনেছি ততটুকুই যথেষ্ট।

-‘ঠিক পনেরো মিনিট।’

-‘বলছি তো, আমি এখন কোথাও যাব না, মানে যাব না।’

অপর পাশ থেকে রুদ্রর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। স্পর্শী ভালো করে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলো আসলেই রুদ্র আছে নাকি চলে গেছে। যখন বুঝল সত্যিই নেই তখন রাগ ঝাড়তে চেঁচিয়ে বলল,

-‘তখন নিয়ে গেল না এখন আসছে ভালোবাসা দেখাতে। তোর ওই ভালোবাসায় পিঁপড়া ধরবে বে/য়াদব পুরুষ মানুষ।
কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না, একটু ভালোবাসেও না, সুন্দর করে কথা বলা তো আরো দূর, এখন আবার আসছে থ্রেট দিতে। তোর মতো থ্রেট ওয়ালাকে আমি বলে বিয়ে করেছি নয়তো জীবনেও বিয়ে হতো তোর।’

রাগে গজগজ করতে করতে স্পর্শী উঠে রুমের লাইট অন করল। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে একাকার অবস্থা। এই অবস্থায় বাইরে গেলে লোকে কি বলবে, ধুর ভাল্লাগেনা,নিয়ে তো যাচ্ছিসই কান্নার আগে নিয়ে গেলে কি হতো? ভিলেনের মতো শুধু থ্রেট দিতে পারে, ভিলেন একটা। অতঃপর নিজের মনমতো রুদ্রকে ঝেড়ে গালে হাতে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। না আজকের রাগ আপাতত
এইটুকুই থাক বেশি হয়ে গেলে তখন আবার তাকেই সাফার করতে হবে। পূর্বের রাগ ভুলে সে নাক টেনে চোখ টোখ মুছে
আস্তে করে রুমের দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দেখে রুদ্র দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্কল করছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা যেন বলিউডের কোনো হিরো। তাকে দরজা খুলতে দেখে রুদ্র ঠোঁটে ভিলেনী হাসি এঁটে ভ্রুঁজোড়া নাচাচ্ছে। যার মানে দাঁড়ায়, ‘যাবি না তো দরজা খুললি যে, এই রাগ!’ ওকে দেখে স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তারমানে সে এখানে ঘাপটি মেরে তার কথা শুনছিল?যাহ্ এখন কি হবে?
পূর্বের মতো কান ধরিয়ে না রাখলেই হয় তার আগে পালাতে হবে। একথা ভেবে দরজা আঁটকানোর আগেই রুদ্র চট করে রুমের ঢুকে নিজে দরজা আঁটকে দিলো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,

-‘ আমি বে/য়াদব পুরুষ? কি বে/য়াদবি করেছি? না করেই যখন অপবাধ দিলি এবার নাহয় করেই দেখায়? তুইও বুঝ, বে/য়াদব পুরুষ আসলে কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।’

-‘বে বে বেড়াতে যাব না? যাই রেডি হ হ হয়ে আসি।’

-‘আমার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। তোকে বেয়াদবির মাত্রা বুঝাতে ইচ্ছে করছে তাই যাওয়া-যাওয়ি ক্যান্সেল।’

-‘ওহ! তাহলে তুমি যাও আমি এখন ঘুমাব।’

-‘আমি থাকলে সমস্যা কি? চল, আমিও তোর সঙ্গে ঘুমাব। এতে আমার কাজটাও সহজ হবে।’

-‘আমার সঙ্গে ঘুমাতে হবে না এমলির কাছে যাও। তোমাকে
আদরে সোহাগে ডুবিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। সত্যি সত্যি আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, মাথা ব্যথা করছে, এখন যাও আর নিজের কাজ করো গিয়ে। আর তুমি না গেলে আমিই নাহয় চলে যাচ্ছি।’

একথা বলে যেতেই রুদ্র হেঁচকা টানে বুকে ফেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্পর্শী ছাড়াতে চাইলে রুদ্র আরো শক্ত করে ধরে বলল,

-‘এত রাগ করলে চলবে?’

-‘আমি কারো উপরে রেগে নেই।’

-‘তাহলে কেঁদে কেটে চোখ মুখ কি করেছিস?’

-‘আমার স্বামী আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে না অথচ অন্য মেয়ের সঙ্গে বসে রসের আলাপ সারবে। আর আমি এসব শুনে দাঁত বের করে হাসব? ছাড়ো আমাকে, ধরবে না তুমি, যার কাছে গিয়েছিল তার কাছেই যাও।’

-‘এমলি বর্তমানে দেশে নেই। তোকে রাগানোর জন্যই তখন এমলির কথা বলেছি।’

-‘কেন বললে? আমাকে রাগাতে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে? শান্তি পেয়েছো তো এবার?একটু বেড়াতে যেতে চেয়েছি তাই কত বাহানা। সব কাজ ঠিকই করো শুধু আমার বেলাতেই তোমার কাজ আর কাজ।’

-‘নির্বাচনের সময় দম ফেলারও সময় নেই, বিকাল বেলা মন টিকছিল না বলেই কাজ ফেলে তোকে আনতে গিয়েছিলাম। রোজ তো যেতে পারি না, পারবোও না। তাছাড়া এই সময়ে সবাইকে নিরাপদ রাখতে বাসাতেই থাকতে বলছি। কে কখন ক্ষতি করে ফেলে বলা যায়? আর এসব যদি তুইই না ভাবিস তাহলে কিভাবে হবে, এত অবুজ হলে চলবে?’

-‘এতকিছু জানি না আমি, আমার ঘুরতে ইচ্ছে করছে নিয়ে চলো, ব্যস। আর যাব নাই বা কেন আমার জলজ্যান্ত একটা তুমি আছো, তোমার আমি আছি, বাসাতে গাড়ি আছে, তাই কোনো অজুহাত চলবে না।’

-‘আপনার কাছে জলজ্যান্ত একটা আমি আছি তা বুঝলাম।
কিন্তু এই আমিটার যত্ন নেন, একটু বোঝার চেষ্টা করেন? শুধু শুধু অহেতুক রাগ করে কান্না করি উল্টে আমাকেই কষ্ট দিতে পারেন।’

-‘রাগ দেখালাম বলেই তো কাজ ফেলে ছুটে এলে নাহলে কী আসতে? আসতে না তো।’

-‘তোর ঘটে কি কখনোই সুবুদ্ধি হবে না? আমি চলে আসাতে বেচারা কাফির উপর দিয়ে কত চাপ যাচ্ছে, জানিস? তাকে এখন সবকিছু একা হাতে সামাল দিতে হবে।’

-‘বোনের খুশির জন্য ভাই একটু কষ্ট করুক। তাছাড়া ভাইয়া যদি জানে তুমি আমাকে নিয়ে বের হয়েছো তাই খুশিই হবে। এখন আমি যাই, ঝটপট রেডি হয়ে আছি।’

একথা বলে স্পর্শী সাইড কেটে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
ওর যাওয়া দেখে রুদ্র মিটিমিটি হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
এক্ষুণিই বলল যাব না, হ্যান-ত্যান, আরো কত কি, মুহূর্তেই সব রাগ গলে জল। একটুপরে স্পর্শী দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখে রুদ্র রুমে নেই।সে হাফ ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে
কালো রঙের একটা থ্রিপিচ পড়ে তৈরি হতে ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে বসে পড়ল। স্কুল থেকে ফিরে সে রোজ গোসল সারে আজকে কান্নাকাটির জন্য দেরি হয়ে গেল। অবেলায় গোসল করতে দেখলে মরিয়ম বেগম বকবে থাকবে। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে সে হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে কাঁটা দিয়ে চুল বেঁধে নিলো। তারপর কপালে ছোটো একটা কালো টিপ পরে চোখে টানল কাজলের রেখা।ঠোঁটে লাগল স্টবেরী ফ্লেবারের লিপবাম। একহাতে স্বর্ণের ব্রেসলেট আগে থেকেই পরা আছে। এখন অন্যহাতে ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একগোছা কালো চুড়ি পরল। কানে কালো পাথরের টপ। গলাতে স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে কালো পাথরের চমৎকার লকেট। এই সেট টা দাদীমা কিনে দিয়েছিল তাকে। সে টুল থেকে উঠে একটুদুরে গিয়ে দাঁড় নিজেকে পরখ করে মিষ্টি করে হাসল। যার মানে সাজটা একেবারেই মনমতো হয়েছে খুব খারাপ লাগছে না দেখতে। তারপর ওড়না দুই কাঁধে ফেলে ছড়িয়ে নিতেই কেউ বলে উঠল,

-‘ ম্যম,দয়া করে যদি একটু তাড়াতাড়ি করতেন খুব উপকার হতো। রাত বাজে সাড়ে ন টা, ফিরে আসতে হবে তাই না?’

-‘হুম, হুম, কেন নয়? হয়ে গেছে আমার, চলো চলো।’

একথা বলে স্পর্শী আগে আগে গটগট করে বেরিয়ে গেল।
রুদ্র হাফ ছেড়ে তার পিছু পিছু গেল। তারপর দু’জন বিদায় নিয়ে বাইরে এসে বাইকের জায়গায় গাড়ি দেখে স্পর্শী ঠোঁট উল্টো রুদ্রর দিকে তাকাল। বাইকে যেতে চেয়েছিল সে। রুদ্র তার দিকে না তাকিয়ে চুপ করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল। এর মানে গেলে গাড়িতেই যেতে হবে নতুবা ক্যান্সেল।
স্পর্শী রাগে গজগজ করে উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই উঠল।
গাড়ির জানালা খোলা। বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে তার খুশির ঝলক মাখা চোখে মুখে। বেহায়া ওড়না উড়ছে বড্ড অবাধ্যভাবে। না গাড়িতে করে যেতেও খারাপ লাগছে না বরং এতদিন পর রাতে এভাবে ঘুরতে পেরে খুশি লাগছে। সেই খুশি উপড়ে পড়ছে তার স্নিগ্ধ বদনে। রুদ্র আপনমনে ড্রাইভ করছে। স্পর্শী সিটে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রভরা ওই দূর আকাশের দিকে। নির্লজ্জ চাঁদটাও যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। স্পর্শী চাঁদটার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে কিছু ভেবে বলে উঠল,

-‘রুদাশার কি খবর? সেও কি দেশের বাইরে?’

-‘না, সে আপাতত রুমবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। সে কোথায় তা অজানায় থাক। আর শিহাব ভাই মানে রুদাশার হাজবেন্ডের রিকুয়েষ্টে ওর নামের সব কেস উয়িথ ড্রো করেছি। এইকথা
সে নিজেও জানে না। তবে শিহাব ভাই যেমন মানুষ তাকে মানুষ না বানিয়ে রুম থেকে বের করবে বলেও মনে হয় না।’

-‘বন্দি রেখে কাউকে পরিবর্তন করা আদৌও সম্ভব?

-‘সম্ভব, তবে সঠিক টেকনিক খাটাতে হবে। আমার বিশ্বাস এ কাজটা শিহাব ভাই খুব ভালো করে পারবে।’

নিজের কথা শেষ করে রুদ্র চট করে স্পর্শীর চুলের কাঁটা খুলে পেছনের সিটে ছুঁড়ে মারল। স্পর্শীর শ্যাম্পু করা চুল অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগল জোরালো বাতাসে। তখন রুদ্র সামনে দৃষ্টি রেখেই স্পর্শীকে আদেশ করল তার দিকে সরে এসে কাঁধে মাথা রাখতে। এত সুন্দর মুহূর্তে স্পর্শী কেন জানি অবাধ্য হতে পারল না। সে রুদ্রর কথামতো সরে এসে আস্তে করে রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখল। তখন রুদ্র একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘পেট কাপড় বেঁধে প্রেগনেন্ট সাজার কাহিনি কি? আসলে তোর মনে কি চলছে খোলাসা কর বল। আমি কোনো মজা করছি না তাই আশা করবো তুইও মজা করার কথা মাথায় আনবি না। তাছাড়া আমাকে এই মুহূর্তে ছুঁয়ে আছিস। আর আমাকে ছুঁয়ে যদি মিথ্যা বলিস তাহলে আমি মারা গেলেও যেতে পারি। এখন তুই ভাব সত্যি বলবি নাকি মিথ্যা বলবি।’

-‘ পৃথিবীতে স্বামীরা খারাপ হলেও প্রকৃত বাবারা কখনো তার সন্তানের অনিশ্চিত জীবন চাই না। আর আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে তুমিও প্রকৃত বাবাদের একজনই হবে। ‘

To be continue………!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে