#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৩]
-‘আমার রুমের দরজা খোলা থাকবে। রাতের খাবার খেয়ে
ভদ্রমেয়ের মতো সোজা এই রুমে চলে আসবেন। লজ্জায় পড়ি মরি করে যেন অন্য রুমে যাওয়া নাহয়।’
-‘সবার সামনে দিয়ে তোমার রুমে আসতে লজ্জা লাগে।’
-‘ কেন, লজ্জা লাগবে কেন? আমি কি পাশের বাসার অচেনা পরপুরুষ?’
-‘ তা না আসলে..! ”
-‘আসলে নকলে আপনার কাছেই রাখুন। শুধু যতটুকু বলছি ততটুকুই করে আমাকে ধন্য করুন।’
-‘দাদীমাকে বলেছিলাম আজ দাদীমার সঙ্গে ঘুমাব।’
-‘এখন গিয়ে বল আমার সঙ্গে ঘুমাবি।’
-‘ইশ! বাজে দেখায় না ব্যাপারটা?’
-‘দেখাক।’
একথা বলে রুদ্র শার্টের বোতাম খুলে বিছানার উপর বসল।
ঘামে ভিজে গেছে ওর পরনের শার্ট। কপাল, ঘাড়সহ কানের পাশ দিয়ে বেয়ে ঝরে যাচ্ছে সরু ঘাম। রুদ্রকে ঘামতে দেখে
স্পর্শী শরবতের গ্লাস রুদ্রর হাতে ধরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল দাদীমার ঘরে। দাদীমা মনের সুখে পান বানাচ্ছেন আর গুনগুন করতে গান গাইছেন। উনার সামনে টিভিতে চলছে জলসার রোজকার সিরিয়াল। স্পর্শীকে পাশে বসতে দেখে দাদীমা একনজর তাকিয়ে টিভি দেখায় মন দিলেন। এ সময় কথা বলতে আগ্রহী নন তিনি। স্পর্শী কাজ না পেয়ে নিজেও টিভি দেখাতে মন দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মনের মধ্যে অশান্তি নিয়ে টিভি দেখা যায়? উফ রে! বিরক্ত আর বিরক্ত।
স্পর্শীকে উশখুশ করতে দেখে দাদীমা কিছু বলার আগে সে হনহন করে বেরিয়ে এলো। বড় মা আর তার মা খাবার এনে টেবিলে রাখছে। স্পর্শীর বাবা আর বড় বাবা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন আর কীসব আলোচনা করছেন। সবাই কিছু না কিছু ব্যস্ত। স্পর্শী রান্নাঘরের সামনে গিয়ে কিছু করার উদ্দেশ্যে দাঁড়াল ঠিকই কিন্তু কোনো কাজই চোখে পড়ল না।
ফলস্বরূপ নখ কামড়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে বড় মা আর ওর মায়ের মুখে মুখে তাকাচ্ছে। মেয়েকে মুখের দিকে বারংবার তাকাতে দেখে মরিয়ম বেগম জিজ্ঞাসা করলেন কিছু লাগবে না কি? সে পরপর মাথা নাড়িয়েছে অর্থাৎ কিছুই লাগবে না এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। খাবার টেবিল সাজানো হয়ে গেলে
সবাই এসে যে যার চেয়ার টেনে খেতে বসেছে৷ বড়দের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা চললেও স্পর্শী আর রুদ্র তারা খাওয়াতে মগ্ন মাঝেমধ্যে দু’জন দু’জনের দিকে তাকাচ্ছে, চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।মরিয়ম বেগম স্পর্শীর মাছের কাটা বেছে দিচ্ছেন আর সে খাচ্ছে। গালগল্পের মাঝেই রুদ্র
খাওয়ার প্রায় শেষের পথে। ছেলেটা ছোটো থেকেই এত দ্রুত খায় যেন হাজারটা কাজ মাথায় নিয়ে খেতে বসে। ধীরেসুস্থে খেলে মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে। রুদ্রর খাওয়া শেষ। এঁটো বেসিনে হাত ধুয়ে রুদ্র তার মাকে বলল,
-‘আম্মু, আমি রুমে যাচ্ছি এক মগ কফি পাঠিও তো।’
-‘আচ্ছা যাও, পাঠাচ্ছি আমি।’
একথা বলে রুদ্র স্পর্শীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। রুদ্র যেতেই স্পর্শীও ছাদে যাওয়ার পায়তারা আরম্ভ করলো। কিন্তু খাওয়া শেষ না করে ওষুধ না খেলে মরিয়ম বেগম উঠতে দিচ্ছে না। ততক্ষণে বড় মা খেয়ে চুলার উপরে কফির পানি বসিয়েছেন। স্পর্শী যখন দেখলো রেহাই নেই তখন বেজার মুখে খাবার শেষ করে ওষুধ খেয়ে বড় মায়ের কাছে গেল। বড় মাকে কিছু বলতে হলো না উনি মুখ দেখে সব কিছু বুঝে মুচকি হাসলেন। তারপর কফির মগ স্পর্শীর
হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাবধানে যেতে বললেন। স্পর্শীও এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা রুদ্রর রুমে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল। ওর হাঁফ ছাড়া দেখে রুদ্র কান থেকে ফোন সরিয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে আদেশ করলো রুমের দরজা আঁটকে দিতে। ওর কথামতো স্পর্শী তাই করে ঘুরতেই রুদ্র বলল রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইটটা অন করে দিতে। তারপর একগ্লাস পানি দিতে, এরপর বিছানা ঝেড়ে দিতে, বেলকনির দরজাও আঁটকে দিতে, এসির পাওয়ার বাড়াতে, ফোনটা চার্জে দিতে,
এভাবে একের পর এক কাজ করিয়ে বসতেই রুদ্র পুনরায় কিছু বলার আগে স্পর্শী খ্যাঁক করে বলে উঠল,
-‘এসব করতে ডেকেছো আমায়? আমি তোমার চাকর?’
-‘তা নয় তো কি?’
-‘তুমি আমাকে চাকর বললে? আমি তোমার চাকরর! নিজে ডেকে এনে এখন এসব বলে অপমান করছো? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি আমি আর আসবই না তোমার রুমে।’
একথা বলে চলে যাওয়ার আগেই রুদ্র উঠে তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ভ্রুঁকুটি করে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে স্পর্শীর নাক টেনে ধরে বিছানায় বসাল। তারপর আলমারী থেকে অনেক বড় একটা বক্স বের করে স্পর্শীর সামনে রেখে পাশে শুয়ে পড়লো। এত বড় বক্স দেখে স্পর্শী আড়চোখে একবার তাকাতেই রাগ গলে জল হয়ে গেল।কৌতুহলবশত বক্স খুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।বক্সের মধ্যে অনেকগুলো শাড়ি গয়নাসহ মেয়েলি সাজগোছের জিনিস। স্পর্শী হাঁটমুড়ে বসে একটা করে জিনিস বের করছে নেড়ে চেড়ে দেখে একগাল হেসে পাশে রাখছে। সবকিছু বের করে দেখে এখানে আটটা শাড়িও আছে। শাড়ি গুলোর রং এক একটা একেক কালার।
শাড়ির গুলোর নাম না জানলেও শাড়িগুলো তার খুব পছন্দ হয়েছে। সবগুলো শাড়ি দেখে স্পর্শী সোনালি পাড়ের সিঁদুরে লাল শাড়িটা নিজের গায়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে।
শাড়ি এত সুন্দর দেখেই পরতে ইচ্ছে হচ্ছে।যদিও শাড়ি টাড়ি পরতে পারে না তবুও কেন জানি এই মুহূর্তে মন টানছে।আগ বাড়িয়ে শাড়ি পরতে লজ্জা লাগছে। কিয়াৎক্ষণ ধরে শাড়িটা
গায়ে ধরে যখন রাখতে যাবে তখন রুদ্র বলল,
-‘যা শাড়িটা পরে আয়। লিলিপুটকে শাড়িতে কেমন দেখায় দেখি।’
-‘কার কাছে যাব?’
-‘থাক, কারো কাছে যেতে হবে না এদিকে আয় আমি পরিয়ে দিচ্ছি।’
-‘তুমি শাড়ি পরাতে পারো?’
-‘না, ইউটিউব দেখে শিখে নিতে কতক্ষণ।’
-‘ কিহ!’
-‘এত চেঁচানোর কি আছে? এদিকে আসতে বলছি আয় নতুবা খবর আছে তোর।’
-‘কিন্তু ব্লাউজ নেই তো শাড়ি কেমনে পরবো?’
-‘ব্লাউজ ছাড়াই পরাবো, আয়।’
একথা শুনে স্পর্শী শাড়িটা নিয়ে একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুদ্রর কাছে নাকি শাড়ি পরবে, কি লজ্জা! কি লজ্জা!
তাও নাকি ব্লাউজ ছাড়া। এ অসভ্য পুরুষটার মুখের লাগাম
কি দিন দিন খুলে যাচ্ছে? হোক না বিয়ে করা বর তাতে কি?
বর হলে কী সব লজ্জা খুঁইয়ে তার কাছে শাড়ি পরতে হবে?
না, না, একাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় এরচেয়ে বড় মা অথবা তার মায়ের কাছে যাওয়া উত্তম। উনারা এতরাতে শাড়ি পরতে দেখে হয়তো হাসবেন লজ্জা দিবেন তবুও ওই বেহায়া রুদ্রর থেকে এই ঢের। শাড়ি হাতে বের হতেই সে তার মায়ের সামনে পড়ে। মরিয়ম বেগম নতুন শাড়ি হাতে দেখে জিজ্ঞাসা করেন,
-‘ঘুমাস নি এখনো আর তোর হাতে এটা কার শাড়ি?’
-‘ভাইয়া দিয়েছে।’
-‘পরতে বলেছে নাকি দেখতেই দিয়েছে?’
-‘না মানে আসলে…।’
মেয়েকে লজ্জায় নতজানু হয়ে তোতলাতে দেখে মরিয়ম বেগম ঠোঁট চেপে হাসলেন। তারপর স্পর্শীকে রুমে নিয়ে গিয়ে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে চুলে খোঁপা করে একটা লাল ফুল গুঁজে দিলেন। তারপর কথা বাড়িয়ে মেয়েকে অহেতুক লজ্জায় না ফেলে নিজের কাজে মগ্ন হলেন। মাকে ব্যস্ত হতে দেখে স্পর্শী শাড়ি ধরে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে রুদ্রর রুমের দিকে যেতেই বড় বাবার মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। উনার পেছনে বড় মাও ছিলেন তা খেয়াল করে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরাতে লাগল আর মনে মনে দোয়া করল যেন কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করে। লজ্জায় তার গাল দুটো আরো লাল হয়ে উঠেছে। বড় বাবা আর বড় মা একে অন্যের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বিনাবাক্যে তাকে যেতে সাইড দিলো। স্পর্শী থুতনী বুকের সঙ্গে ঠেঁকিয়ে নত মস্তকে কিছুদূর যেতেই শুনতে পেল উনাদের হাসির শব্দ। উনাদের হাসির শব্দে সে নিজেও হেসে ফেলল। কেন জানি বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। না রুদ্রকে এসব বুঝতে দেওয়া যাবে না নয়তো তাকে পঁচিয়ে খুব মজা নিবে, এসব ভেবে সে নিজেকে সামলে রুদ্রর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারল। রুদ্র উপুড় হয়ে হয়ে আছে। পাশে পড়ে আছে রেখে যাওয়া শাড়িগুলো। রুদ্রর চোখজোড়া বন্ধ তার পা ঝুলছে বিছানার বাইরে। এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল নাকি কে জানে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে রুদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাশে বসেছে। রুদ্র চোখ খুলে স্পর্শীকে দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। সম্মুখে বসে থাকা স্পর্শীর মাথা থেকে পা অবধি পরখ করে আলমারি থেকে আরেকটা বক্স বের করে স্পর্শীর মুখোমুখি বসল। বক্সের ভেতর আরো অনেক বক্স। সবগুলোই গয়নার বক্স। সে এক একটা করে সব বক্স খুলতেই দেখা গেল বাহারি ডিজাইনের সব গয়না। কি সুন্দর ইউনিক ডিজাইন! কৃত্রিম লাইটের ঝলকানিকে গয়নাগুলো চকচক করছে। বিয়ের কণে সাজাতে মাথা থেকে পা অবধি যেসব গয়না লাগে সব আছে এখানে। গয়নার সব বক্স খুলে
রাখায় বিছানাজুড়ে শুধু গয়না আর গয়না।এতগুলো স্বর্ণের গয়না দেখে স্পর্শী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বিশেষ কোন উপলক্ষবিহীন এত গয়না দেওয়ার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না তার। ততক্ষণে রুদ্র স্পর্শীকে গয়না পরানো শুরুও করেছে। স্পর্শীর পরনের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সিম্প্যাল কিছু গয়না পরাতেই স্পর্শী বলল,
-‘এগুলো সব আমার? কিন্তু কি উপলক্ষে দিলে? আমার জন্মদিন আসতে তো অনেক দেরি।’
-‘বউকে গয়না দিতে উপলক্ষ লাগবে?’
-‘না, তা না কিন্তু হঠাৎ এত গয়না তাই বলছি আর কি।’
-‘মন চাইল তাই। তাছাড়া সাদামাটাভাবে বিয়ে হয়েছে মনে মনে হয়তো এই নিয়ে আফসোস করিস এজন্য..।’
-‘আফসোস থেকে যদি এতসব কিছু পাওয়া যায় তবে আমি সারাজীবন আফসোসে ডুবে মরতে চাই। আর তুমি আমাকে আফসোস করতে দেখে এতএত শাড়ি গয়না দিবে, ওকে?’
-‘শখ কতো মেয়ের, খেয়ে আর কাজ নেই আমার।’
-‘তুমিই তো বললে।’
-‘মোহরানার টাকা পরিশোধ না করে বউকে নাকি স্পর্শ করা ঠিক না। তোর মোহরানার টাকা আলমারিতে আছে তাছাড়া বিয়েতে বউকে যেসব হাজিবাজি দিতে হয় সবকিছু দিলাম। এবার বউ আমার, স্পর্শও আমার।’
-‘কিহ্! তারমানে তুমি আমাকে স্পর্শ করতে এসব দিলে?’
-‘ তোর পেটে ব্যথার কি অবস্থা?’
-‘জোরে হাঁটলে চিনচিন করে উঠছে।’
-‘এছাড়া আর কোনো সমস্যা? ‘
-‘না, রিপোর্টে যে কি আসবে চিন্তা হচ্ছে খুব।’
-‘রিপোর্টে যা আসে আসে ওসব নিয়ে তোকে ভাবা লাগবে না। তোর কাজ, খাবি, দাবি, ঘুরবি, ফিরবি আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি, ব্যস এইটুকু করলেই আমি ধন্য।’
-‘হুম, আচ্ছা শোনো আরেকটা কথা। তুমি এতকিছু থাকতে বাজপাখি মার্কায় ভোটে দাঁড়ালে কেন আর কিছু পেলে না?’
-‘ বাজপাখি খারাপের কি হলো?’
-‘এটা না নিয়ে একেবারে বদনা মার্কা নিতে। মিছিলে তোমার ছেলেপেলেরাও গর্ব করে বলতে পারত, তোমার ভাই আমার ভাই, রুদ্র ভাই! রুদ্র ভাই! রুদ্র ভাইয়ের মার্কা কি? বদনা ছাড়া আবার কি।’
একথা বলে স্পর্শী খিলখিল করে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে রুদ্র তাকে কাছে টেনে শুয়ে পড়ে গলায় মুখ ডুবাতেই স্পর্শীর হাসি থেমে গেল। চোখ মুখ খিঁচে শ্বাস আঁটকে অনড় হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর রুদ্র তার গলায় একটা বাইট দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘পেট ব্যথার কারণে আজও ছাড়া পেয়ে গেলি। নয়তো ঠিক এ মুহূর্তে উন্মাদের মতো আদরের আলপনা আঁকতাম তোর সর্বাঙ্গে। একটু একটু করে বুঝাতাম ব্যাকুলতার মাত্রা। তবে এই ছাড় আর বেশিদিন পাবি না; যথাশীঘ্রই ধরা দিতে হবে আমাকে কাছে, এখন থেকেই নাহয় প্রস্তুত হ।’
To be continue…….!!