#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৯]
-‘তোমার জন্য উপহার রেখে গেলাম। ধন্যবাদ দিতে হবে না। এই রুদ্র সস্তা কারো ধন্যবাদ গ্রহন করে না।’
রুদ্রর করা মেসেজ দেখে এমিলি হাসছে। কিছুক্ষণ আগেই রুদ্রর দেওয়া উপহার এসে পৌঁছেছে তার নিকট। নিজের স্বামীর নিথর দেহ দেখে তার কষ্টও হচ্ছে না, কান্নাও পাচ্ছে না। কেন জানি নিজেকে হালকা হালকা মনে হচ্ছে। এতদিন এই সম্পর্কের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত সে। রাজনীতিতে
যুক্ত হওয়ার শর্তে ইলিয়াসকে বিয়ে করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল। আর এই শর্ত দিয়েছিল ইলিয়াসের বাবা ইসমাইল হোসেন। তখন উনি মন্ত্রী, হাতে পাওয়ার ছিল, অর্থের কমতি ছিল না। তখন দুবাই ফেরত এমিলি বাংলাদেশে এসেই প্রেম পড়েছে এক দাপুটে ছেলের। তার চলতে বলনে ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছে সে। কিন্তু ইলিয়াস তাকে পছন্দ করে জানায় তার বাবাকে। ইসমাইল হোসেন সরাসরি প্রস্তাব দেন তাকে।
ততদিনে ওই দাপুটে নেতার খোঁজ মিলছিল না কোনোভাবে।
পরে মরিয়া হয়ে নেতার সন্ধান পেতে সেও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইলিয়াসকে বিয়ে করে। বাবা মা ও জন্মভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে স্থায়ী হয়। ইসমাইল হোসেনের পুত্র বধূর পরিচয় বহন করে রাজনীতিতে ঢুকে। তারপর দিন যায়,মাস যায়, খুঁজেও পায় তার মনপুরুষটাকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার নাম ‘রুদ্র।’ নামের মতো তার মধ্যে দাপুটে ভাব আছে, কথা ও কাজের তেজ আছে। মোদ্দাকথা রুদ্রও নেতা। যদিও তখনো কেউ জানতো না এমিলির মনের কথা।
তারপর দলের এক লোক সবটা জানিয়ে দেয় ইলিয়াসকে।
আর ইলিয়াম জিজ্ঞাসা করায় অকপটে সেও স্বীকার করে।
এভাবে দিন চলতে থাকে আর ইলিয়াসের অত্যাচার বাড়তে থাকে। একথাও সত্য সে ইলিয়াসকে স্বামী হিসেবে মানতেই পারেনি। সবসময় মনে হয়েছে ইলিয়াস তার বোঝা। রুদ্র না মা/রলে হয়তো সেই মে/রে দিতো। এমিলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে এসব ভাবছিল।তখন কল এলো তার ফোনে। কল রিসিভ করতেই কেউ একজন বলল রুদ্র বিয়ে করেছি তাও আবার চাচাতো বোনকে। ওরা দু’জন চট্টগ্রামেই আছে। একথা শুনে এমিলি তার কার্ল করা চুল কানের পাশে গুঁজে সদ্য পরা শুভ্র শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে হাসিহাসি মুখে জবাব দিলো,
-‘নজর রাখো। তবে আমি না বলা অবধি কিছু করতে যেও না। নয়তো রুদ্রের হাতেই মা/রা পড়বে। সে কেমন তা বলতে হবে না নিশ্চয়ই। রুদ্রকেও হিংস্র করবো সুযোগ বুঝে, এখন নয়।’
_______/\____________/\_____________/\___________
-‘ইয়া আল্লাহ! এই অসভ্য পুরুষের মুখে লাগাম দাও আমি ফকিরের হাতে কড়কড়া বিশ টাকা দিবো।’
একথা বলে স্পর্শী দৌড়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্রকে দু’টো গালিও দিলো। তারপর মনে মনে আফসোস করতে থাকল ওই বে/হায়া পুরুষটাকে নিয়ে। যার কথায় সামান্য রাখ ঢাক নেই মুখে যা আসে বলে দেয়। অপরজন কে কী ভাবলো সেই ধারও ধাঁরে না। এভাবে
বলে লজ্জা দিয়ে কী মজা পায় কে জানে।তবে ছোটো থেকে দেখে আসছে রুদ্র এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের। একবার রুদ্রর মামাতো বোন রুদ্রর খাৎনা ছবি দেখে খুব হাসছিল। হাসতে হাসতে রুদ্রকে রাগাতে বলেছিলেন, ‘ ছিঃ! ছিঃ! রুদ্রর ইয়ে কাঁটা রে রে।’
একথা শুনে রুমভর্তি মানুষের সামনেই সে জবাব দিয়েছিল, -‘দুলাভাই কেঁটেছিল বলেই তো তুমি তাকে বিয়ে করেছিলে। এখন আমার বেলায় ‘কাঁটা রে রে’ বলে হাসছো কেন তাই তো বুঝছি না।’
ওর এমন কাঁট কাঁট জবাবে উনার কথা এবং হাসি বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় নতজানু হয়ে বেচারি কোনোমতে পালিয়ে বাঁচে। তারপর থেকে উনি আর এই বাসাতে আসে নি। রুদ্রর এমন জবাব শুনে অনেকে ভয়ে কিছু বলে না। সন্মানের ভয় তো সবারই আছে। বর্তমানে এর আরো করুণ অবস্থা। যত দিন যাচ্ছে বয়স বাড়ছে ততই যেন তার কথাবার্তার লাগাম খুলে যাচ্ছে। এইতো মাস ছয়েক আগের ঘটনা। শুক্রবারের দিন। বাসায় সবাই উপস্থিত থাকায় পিঠা বানানো হয়েছিল।
বিকালবেলা পিঠা খেতে খেতে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। রুদ্রও সোফায় বসে ফোন টিপছিল। কথায় কথায়
দাদীমার ভাইয়ের কথা উঠল। দাদীমার দুই ভাই। হেলাল ও বেলাল। হেলাল ছোট থাকতে পানি ডুবে মারা গেছে।বেলাল
বেঁচে আছেন, পেশায় উনি গরুর ব্যবসায়ী। একমাত্র ছেলে
বিধায় দাদীমার মা বলতেন ‘আমার একা পুতের চার বিয়া দিমু আমি। চার বউয়ের মোট ছালপাল হইব আটাশখান। হক্কলের ঘরে ছাল পাল থাকব আটটা কইরা।’
এইটুকু শুনেই রুদ্র ফোন থেকে চোখ না সরিয়ে বলেছিল,
-‘দাদীমা তোমার আম্মা সাতের ঘরের নামতা চুজ না করে সরাসরি দশের ঘরের নামতা চুজ করলেই পারত। চার সাতে আটাশ না করে সরাসরি চার দশে চল্লিশ করলেই তো রেকর্ড করতে পারত তোমার ভাইজান। আমি সেইসময় থাকলে এই বুদ্ধি দিতাম। ইস! দেরিতে পৃথিবীতে এসে মস্ত বড় ভুল গেছে আমার।’
ওর ত্যাঁড়া কথা শুনে বাকিরা হেসে উঠলেও দাদীমা মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় বলতে থাকলেন। তারপর বেলাল মায়ের কথা রাখতে সত্যি সত্যিই চারটা বিয়ে করেছিল। তবে তার
ছেলে মেয়ের সংখ্যা মোট বিশ জন। সকলের ঘরে পাঁচটা করে ছেলে মেয়ে। একথা শুনে রুদ্র আবার ফোঁড়ন কাটল,
-‘সেই সময় কী কোনো কাজ করতো তোমার ভাই?’
-‘তখন কুনো কামই করতো না। আমার বাপের মেলা জমি আছিল। হেই খালি জমি বেঁচতো আর খাইতো।’
-‘বাহ্! এজন্যই বউয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতে পারতো আর প্রতিবছর ট্রেনের বগির মতো বাচ্চা আমদানি করতো। তবে
কাজকাম করলে পারত না উনার শ্রাদ্বীয় আম্মাজানের কথা রাখতে। যেমন আমার বাবা- চাচারা পারে না। একটা বউ সামলেই উনাদের কাল ঘাম ছুঁটে যায়।’
রুদ্রর কথা শুনে তখন স্পর্শীর বাবা ফিসফিস করে বললেন,
-‘ওদিকের বাঁশ ওদিকেই মানাচ্ছিল। শুধু শুধু এদিকে ঘুরানোর কি দরকার ছিল বাপ?’
ছেলের কথা শুনে বড় বাবাও মুখ কাচুমাচু করছিলেন। এটা রুদ্র নিজেও খেয়াল করে বাবাকে সিরিয়াসভাবে বলেছিল,
-‘আমি আরো তিন চারটা ভাই বোনের প্রয়োজন অনুভব করছি। এত বড় বাসা, এত টাকা পয়সা, জায়গাজমি,এসব ধ্বংস করা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি সেই দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে মোটেও ঠিক করো নি। তোমার টাকা পয়সা ধ্বংস করার জন্য হলেও আমি খুব তাড়াতারি বিয়ে করবো, সাত বাচ্চার বাবা হবো।ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, এদিকে, ওদিকে, যেদিকেই তাকাবো ছানারা ডেকে উঠবে বাবা! বাবা! বাবা! তবেই না মনে হবে আমি যোগ্য পুরুষ, যোগ্য বাবা।’
একথা বলে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
-‘এটাও তো ক’দিন পর চলে যাবে। তখন যা থাকবে সব তো আমারই। তোমরা সবাই বুড়ো বুড়ি হয়ে যাবে। বাঁতের ব্যথায় কাতরাবে, ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করবে। তখন আমি কথা বলার জন্য লোক ভাড়া করতে যাবো নাকি? তখন এই বাসা হাসি খুশি থাকবে না মলিন হয়ে যাবে বাসার পরিবেশ।
এসব কথা চিন্তা করা উচিত ছিল তোমার। তুমি চরম ভুল করেছো বাবা, চরম ভুল।’
সেদিন মান সন্মানের ভয়ে বড় বাবাও কিছু বলতে নি। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন সহধর্মিণীর দিকে। আর বড় মা যেন চোখের ভাষায় বোঝাচ্ছিলেন, একে শুধরানোর তার কাম্য নয়।’
পূর্বের কথা স্মৃতিচারণ করে স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল গেস্ট রুমের দিকে। দুপুরের দিকে গেস্ট রুমের দরজা খোলা থাকলেও এখন তালা মারা। কাজ টা কার বুঝতে বাকি রইল না। অথচ সে ভেবেছিল রুদ্র বের হলেই তলপি তলপা গুছিয়েই গেস্ট রুমে চলে যাবে। অন্তত রাতের ঘুমটা যেন শান্তিপূর্ণ হয় এই আশায়। কারণ রুদ্রর পাশে শুতে খুব অস্বত্বি হয়। ঘুমাতে পারে না মনে হয় রুদ্রর গায়ের উপর তুলে দিবে। আর রুদ্র ফুটবলের মতো তাকে শট মারবে। কিন্তু তার এ পরিকল্পনায় রুদ্র ছাঁই ঢেলে দিলো।
চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে। রুদ্র এখনো বের হয় নি রুম থেকে। সে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে মন দিয়ে আজান শুনলো। আজান শেষ হতেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরল। চোখ বুলিয়ে খাবারের সন্ধানও করলো।
কিন্তু তেমন কিছুই নজরে পড়লো না। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। দুপুরে ভাত আর চা চা পান করেছিল তারপর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি। অথচ বাসায় থাকলে ঘুরে ফিরে কতকিছুই না খায়। না খেলে আম্মু জোর করে খাওয়ায়। আম্মুও তাকে ভুলে গেল। কল করে না, কথাও বলে না। সবাই মিলে যুক্তি করে পর করে দিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রিজের কাছে এগিয়ে গেল। মস্ত বড় দানব আকৃতির ফ্রিজে হাতি ঘোড়া রেখেছে নাকি দেখা দরকার। দুই পাল্লায় ফ্রিজ খুলে পুরো ফ্রিজে চোখ বুলিয়ে হাসল। বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ, মিষ্টি, কেক, পানীয়সহ নানান রকমের জিনিসে ঠাঁসা। সবগুলোই ওর পছন্দের। রুদ্র মিষ্টি পছন্দ করে না। ওর ঝাল জিনিস পছন্দ। যাক গে, এসব ভেবে মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগের দরকার নেই। তারপর সে প্রতি প্যাকেট থেকে একটা করে মিষ্টি খেয়ে
ডাইনিং টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরি নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। রেড ভেলভেট কেক। তখন সে খেয়াল করল কেকের উপর বড় বড় করে লেখা, ‘ Welcome to my life.’
কেকের উপরে লেখাটা দেখে ভাবারও সময় পেল না সে। এর আগেই রুদ্র রুম থেকে চেঁচিয়ে বলল,
-‘এখানে আমার কালো শর্ট রেখেছিলাম। ওই শর্টের কোমরে নীল রং দিয়ে ইংলিশে লেখা ছিল, ‘PERFECT BOSS.’ ওটা দেখেছিস? কই পাচ্ছি না আমি এসে খুঁজে দিয়ে যা।’
জবাবে স্পর্শী কিছুই বললো না। তবে শক্ত করে ছুরি ধরে কেকের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ কেক কাটে সুখ মুহূর্তের কথা স্মরণীয় করে রাখতে। কেক কাটার সময় অনেকে ভিন্ন ধরনের উয়িশ করে। আর স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু স্বরে
বলতে বলতে কেক কাটল,
-‘শর্ট তোর, পরিস তুই, আর খুঁজে দিবো আমি? তোর কোন শর্টে কী লেখা তাও মুখস্ত করে রাখতে হবে আমাকে? রুদ্র রে রুদ্র, এই যে আমি কাটছি এই কেকটা কেক না রে, কেক না, এটা তোর গলা।’
To be continue……..!!