প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৭

0
669

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৭]

-‘জানি। আর এই খারাপ মানুষটার সঙ্গেই তোকে থাকতে হবে, ভালোবাসতে হবে। বাকিটা পথ এই খারাপ মানুষটার সঙ্গেই পাড়ি দিতে হবে।’

একথার প্রত্যুত্তর করলো না স্পর্শী। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকানোর বৃর্থা চেষ্টা করলো। তবে শেষ রক্ষা হলো না তার নেত্র বেয়ে গড়িয়েই দু’ফোঁটা অশ্রুকণা।।চাপা কান্না আঁটকানোর দমকে সে হেঁচকি তোলার মতো ফুঁপিয়ে উঠল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁটে দাঁতের দাগটাও ফুঁটে উঠেছে। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে স্পর্শীর কান্না দেখে রুদ্র রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। এই মুহূর্তে কড়া কথা বলবে না সিদ্ধান্ত নিলো। তবে কিছু কথা না বলেও থাকতে পারবে না তাই স্পর্শীর কান্নারত মুখপানে দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আজ কয়েকটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। যে কথাগুলোয় একটা শব্দও মিথ্যা নয়। বরং আমার দিক থেকে সদাসত্য।
বিয়ের আগে ভুলেও কখনো তোর দিকে কু- নজরে তাকায় নি, কখনো না। এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তোকে ওড়না ছাড়া দেখলেও দৃষ্টি সংযত করে নিয়েছি। এমন ভাব করেছি তোকে দেখিই না। এমনও হয়েছে আমি বসে আছি তোর হাত থেকে কিছু পড়ে গেল। তুই সাবধানতা অবলম্বন করা দূর উপুড় হয়ে সেটা তুলে নিয়ে নিজের কাজে মন দিতি।কে
সামনে আছে, কার নজর কেমন কখনো পরখও করিস নি।
উপুড় হয়ে জিনিস তোলার ফলে ফলস্বরূপ কী ঘটতো আশা করি বলা লাগবে না। তবে প্রথম যেদিন এই ঘটনার সম্মুখীন
হয়েছিলাম সেদিন নিজেকে ছোট লাগছিল। অথচ এখানেও আমার দোষ ছিল না। তারপর থেকে যখন’ই বুঝতাম এমন
ঘটনা ঘটবে/ঘটতে পারে তখন’ই তোকে ধমকে থামিয়েছে নয়তো নিজেই সরে গেছি। অথচ তুই এই ধমাকানোর কারণ
হিসেবে দাঁড় করেছিস তোকে অকারণে বকাবকি করি। সহ্য করতে পারি না তোকে। আর এসব কেন করতাম জানিস?
কারণ তখনো আমাদের সম্পর্ক ছিল চাচাতো ভাই-বোনের।
আর ভাই-বোনের সম্পর্ক হচ্ছে পবিত্র একটা সম্পর্ক। হোক সেটা চাচাতো ভাই-বোনের। এসব ভেবেই ভুলেও নোং/রা চিন্তার ঠাঁই দেই নি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। এক সম্পর্কের রেশ ধরে আরেকটা মজবুত সম্পর্কে পর্দাপণ করেছি।বর্তমান সম্পর্কের জোরে তুই আমার, মানে
পুরোটাই আমার। তোকে বৈধভাবে আমার নামে দলিল করা হয়েছে।এখন তোর উপরে পরিপূর্ণ অধিকার আছে আমার।
এখন আমার সামনে ওড়না না পোশাকহীনভাবে থাকলেও সেটা হালাল। তাই বলছি সম্পর্কের মানে বোঝার চেষ্টা কর। সন্মান দিতে শিখ। মস্তিষ্কে এটা গেঁথে নে আমিই তোর সব।
পেছনে ফেলে আসা ঘটনাগুলো এখন অতীতমাত্র। অতীত ভেবে বর্তমান নষ্ট করিস না। সেই সঙ্গে এটাও মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নে, প্রতিটা ঘটনার পেছনে একটা হেতু থাকে। তবে সর্বদা যে সেই হেতু নেগেটিভ কিছু’ই হবে এটা ভাবা মূর্খতা।
এতদিন আমাকে চাচাতো ভাই রুপে জেনেছিস এবার স্বামী রুপে রুপান্তরিত হতে দে। সম্পর্ক তো কোনো দ্রুতগামী ট্রেন নয় যে, বুলেট গতিতে শরীক না হলে মিস হয়ে যাবে।’

-‘আগের সম্পর্কটাই ভালো ছিল। এই সম্পর্কের বোঝা টানা খুব কষ্টকর। তাছাড়া তুমি চাচাতো ভাই হিসেবে বেস্ট হলেও স্বামী হিসেবে খুব’ই খারাপ। মোদ্দাকথা, স্বামী চরিত্র তোমার জন্য বড্ড বেমানান।’

-‘স্বামী হিসেবে এমন কোনো আদেশ করেছি তোকে? নাকি তুই স্বামী হিসেবে সেই সন্মানটুকু দিয়েছিস?আমি তো বলছি না মনের বিরুদ্ধে জোর করে বউয়ের অধিকার পালন কর। এটাও বলছি না আমার অধিকার আমাকে বুঝিয়ে দে। তবে এত হাইপার হচ্ছিস কেন তাই তো বুঝছি না।’

-‘সত্যিই বুঝছো না নাকি না বোঝার ভাণ করছো?’

-‘যা বলবি ঝেড়ে কাশ।’

-‘কিছু না। আমাকে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমি থাকবো না এখানে।’

-‘আর কিছু? ‘

-‘না।’

-‘এই অনুরোধ গ্রহনযোগ্য নহে, ধন্যবাদ। ‘

একথা বলে রুদ্র এঁটো থালা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর স্পর্শী
নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে দেখল। কী বলবে, কী করবে, বোধগম্য হচ্ছে না তার। যাকে কখনোই তেমন নজরে দেখেই নি তাকে নাকি স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে হবে? তার সঙ্গে এক রুমে এক বিছানায় থাকতে হবে। অপরিচিত কেউ হলে ব্যাপারটা এত কঠিন লাগতো না। রুদ্রকে দেখলেই অস্বস্ত্বিতে আকঁড়ে ধরছে। রাগে শরীর পিলপিল করছে। না চাইলেও মুখ দিয়ে যাচ্ছে তাই বেরিয়ে যাচ্ছে। পরে নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তখন ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রুদ্র রুমে ফিরে এলো। পরনে শার্ট খুলে বিন ব্যাগের উপর রেখে গালি গায়ে ঘুরে ফিরে কীসব নিলো। তারপর শুভ্র তোয়ালে গলায়
জড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। এখানেই আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করার মতো, এখানে রুদ্রর জায়গা অচেনা কেউ হলে তার সামনে চট করে শার্ট খুলে সে লজ্জা পেতো। মুখে রক্তিম আভা দেখা দিতো। কিন্তু এতবার রুদ্রকে খালি গায়ে দেখছে যে ফিরে তাঁকাতেও ইচ্ছে করে না। লাজলজ্জা
তো দূরের কথা। যেখানে নতুন অনুভূতি নিয়ে সংসার জীবন শুরু করার কথা। সেখানে বিরক্তির ছাড়া কোনো কিছুই তার নজরে পড়ছে না। এসব নানান ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর চিন্তা ভাবনা করেই ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়াল।।অতিরিক্ত কান্না ফলে চোখ, মাথা, ব্যথায় টনটন করছে। এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। একথা ভেবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে
নিলো রুদ্রর ঝকঝক তকতকে রান্নাঘর। তারপর প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে চা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করলো।
রুদ্র গোসল সেরে রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে স্পর্শী রুমে নেই। বেলকনিতে উঁকি মেরেও দেখে নেই। চায়ের স্মেল আসছে। সম্ভবত তারই রান্নাঘর থেকে। সে ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখে স্পর্শী চা বানাচ্ছে।ওকে দেখে রুদ্র ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে খেতে বসলো। হটপটে খাবার রাখা। রুদ্র নিজে রান্না করার সময় পায় না তাই একজন রাধুনি আসে। রাধুনি মাঝবয়সী এক পুরুষ। রান্নার হাত চমৎকার। আজকে মেনু
সর্ষে ইলিশ, আলু ভাজা, ঘন ডাল আর ভাত। সঙ্গে আছে
একফালি লেবু। ওকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে স্পর্শী মুখ ভেংচিয়ে কাপে চা ঢালছে। পানি বেশি দেওয়াতে এক চা বেশি হয়েছে। সেটা দেখে স্পর্শী গমগমে সুরে বলল,

-‘এক কাপ চা রেখে গেলাম। কেউ চায়লে খেতে পারে।’

-‘ভাতের প্লেটেই ঢেলে দে। ভাতের সঙ্গেই মেখে খায়। ‘

-‘এজন্যই কথা বলতে ইচ্ছে করে না।’

-‘কে বলতে বলেছে?’

-‘তুমি আসলেই যাচ্ছে তাই।’

একথা বলে স্পর্শী চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। টিভি অন করে বসে তার পছন্দের সিরিয়াল দেখতে থাকল।
কিন্তু মন বসলো না। একের পর এক চ্যানেল পাল্টে দেখার মতো কিছুই পেলো না। বিরক্ত নিয়ে উঠে যেতেই নজর গেল রুদ্রর ফোনের দিকে। চট করে মনে পড়ে গেল আম্মুর সঙ্গে কথা বলে নি। তাছাড়া কেঁদে কেঁটে আম্মুকে ম্যানেজ করতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। মনে মনে এসব ভেবে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-‘আম্মুর সঙ্গে কথা বলবো ফোনের লক খুলে দাও।’

-‘ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ না করে ফোনটা এদিকে নিয়ে আয়।’

-‘তুমি পিন বলো আমি খুলতে পারবো।

-‘বলা যাবে না।’

উক্ত কথা বলে দৃষ্টি তুলতেই দেখে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখের বিরক্তের ছাপ। তাকে দেখে ফোন নিতে হাত বাড়াতে গেলে স্পর্শী খোঁচা মেরে বলল,

-‘তুমি ভদ্র পুরুষ কোনো মেয়ে তোমার সামনে উপুড় হয়ে কিছু তুললেও তুমি তাকাও না। তাহলে ফোনের মধ্যে কী আকডুম বাকডুম রেখেছো যে পিন বলতে ভয় পাচ্ছো?’

-‘বেশি বুঝতে গেলে এমন থাপ্পড় দিবো সারাজীবনের জন্য তোতলা হয়ে যাবি। আর ফোনে পিন নয় পাসওয়ার্ড দেওয়া।আমি বললেও তোর গোবরভর্তি মাথায় মনে রাখতে পারবি না। তাই অহেতুক কষ্ট না করে ফোনটা আমাকে দে।’

-‘না, তুমি বলো আমি লক খুলবো।’

-‘ W O B.’

এমন বেখাপ্পা পাসওয়ার্ড দেখে স্পর্শী বিরক্তমুখে তাকিয়ে বেডরুমে চলে গেল। তারপর একে একে ফোনের মেসেজ , স্টোর, মেসেঞ্জার, ইন্সট্রাগ্রাম, WhatsApp থেকে শুরু করে যত এ্যাপ আছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু তেমন কিছুই পেল না। তারপর হতাশ হয়ে ধৈর্য্যসহকারে আরো কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে ওর আম্মুকে কল দিলো। কিন্তু মরিয়ম বেগম কল ধরলেন না। বেশ কয়েকবার কল দিয়েও কাজ
হলো না দেখে মন খারাপ করে ইউটিউবে নাটক দেখায় মন দিলো। ওদিকে, রুদ্র খেয়ে প্লেট ধুতে রান্নাঘরে ঢুকতেই চোখ চড়কগাছ। মেঝেতে চিনি ও পানি ফেলে একাকার অবস্থা।
রান্নাঘরের অবস্থা দেখে মুহূর্তে তার মেজাজ বিগড়ে গেল।
এসব স্যাঁতেস্যাতে কাজকারবার মোটেও পছন্দ নয় তার।ফ্ল্যাটে একা একা থাকলেও কখনোই নোংরা করে রাখে না ঘরদোর, রান্নাঘর। অথচ এই মেয়ে দুই মিনিট বৃন্দাবন করে গেছে। তবে এটা যে স্পর্শীর ইচ্ছাকৃত কাজ বুঝতেও বাকি রইল না তার। কারণ চিনি পানি ফেলে হলুদ গুড়ো ছিঁটানো।
চায়ে হলুদের গুঁড়ো দেওয়ার প্রয়োজন নেই নিশ্চয়ই! তাহলে হলুদের কৌটা খুললো কে আর ছিঁটালো কে? কান্নাকাটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মেয়েটার শয়/তানি বুদ্ধি উদয় হয়েছে।এ মেয়ে যে তাকে জ্বালিয়ে, খাঁটিয়ে, মা/রবে সেটাও অবগত সে। এভাবেই তাকে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলার প্রচেষ্টায় থাকবে যাতে সে বিরক্ত হয়ে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এ বলে এই মেয়ের বুদ্ধি নেই? ষোলোআনা বুদ্ধি আছে শুধু দুষ্ট বুদ্ধি সংখ্যা একটু বেশি এই আর কী। তারপর নিজেই সব টা পরিষ্কার করে রুমে গিয়ে দেখে ফোনে নাটক দেখছে। ওকে দেখে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।
আর রুদ্র সিলিং ফ্যান বন্ধ করে এসি অন করে পাশেই শুয়ে বলল,

-‘যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবি। আগ বাড়িয়ে রান্নাঘরে যাবি না। মনে থাকবে?’

-‘হুম।’

-‘ফোনের কাজ শেষ করে চার্জে দিবি। আমি ঘুমালাম।’

একথা বলে রুদ্র চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। কিন্তু কেন জানি ওর মনে হচ্ছে স্পর্শী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কিছু বলবে? নাকি অন্য কোনো সমস্যা? একথা ভেবে চোখ খুলে দেখে সত্যি সত্যিই স্পর্শী দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। ওকে তাকাতে দেখে স্পর্শী ফোনটা এগিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। নাটক দেখবে না। ভালো লাগছে না কিছু। এ প্রথম রুদ্রের পাশে শুয়েছে। অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। তখন রুদ্র চোখজোড়া না খুলেই বলল,

-‘এত ধারে শুলে পড়ে যাবি। সরতে সরতে ওইদিকে যাচ্ছিস কেন? তাছাড়া আমি তোর পাশে শুয়েছি কাছে তো যায় নি। নাকি এভাবেই নিমন্ত্রিত জানাচ্ছিস কাছে যাওয়ার?’

To be continue…….!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে