#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৪]
-‘আমিই তোর মা আর তুই আমার কলিজা। রুদ্র আমাকে ওয়াদা করেছে,কেউ নাকি তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, কেউ না, কখনো না। রুদ্র আছে না রুদ্র, সে আর আমি কাউকে কাড়তেই দিবো না। আমরা আছি না, আমরা তোকে খুব ভালোবাসবো, এভাবে শক্ত করে বুকের মধ্যে আগলে রাখব।’
একথা বলতে বলতে উনার শ্বাসরোধ হয়ে আসতে লাগল। জোরে জোরে নিঃশব্দ নেওয়ার কারনে স্পর্শীর ঘুমটা ভেঙে সজাগ হলো। মাকে জোরে শ্বাস নিতে দেখে ব্যাকুল হয়ে মা!মা! করে ডেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল মায়ের রুমে।
তারপর ড্রেসিংটেবিলের ছোট ড্রয়ার থেকে ইনহোলার নিয়ে সেটা পুরো দিলো মায়ের মুখে। দুই থেকে তিনবার ইনহোলার পুশ করতেই ধীরে ধীরে মরিয়ম বেগমের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হতে লাগল। অতঃপর স্পর্শী নিজে না কোনো কথা বলল আর না মাকে বলতে দিলো। শুধু শক্ত করে মাকে জড়িয়ে বিরবির করে ‘তুমি আছো বলেই আমার পৃথিবী এত সুন্দর।’
একথা বলে নীরবে অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে ঘুমে তলিয়ে গেল। স্পর্শীর নিঃশ্বাস ভারী হতে দেখে মরিয়ম বেগম ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালেন। আর ভাবতে লাগল স্পর্শীর ছোটো
বেলার একটা ঘটনার কথা। তখন শীতকাল। প্রচন্ড শীতও পড়েছিল সেবার। শীতের দিনে স্পর্শীকে রোদে বসিয়ে উনি রুমে এসেছিলেন ফিডার নিতে। গোসলেন পরপর খাবার না দিলে কেঁদে কেঁটে একাকার করে মেয়েটা। একথায় ছোটো থেকেই তার পেট ভরা থাকলেই তার পৃথিবী রঙিন। সামান্য ক্ষুধাও সহ্য করতে পারে না সে। একহাতে ফিডার আর অন্য হাতে একটা আপেল নিয়ে আসার পথে শুনতে পান স্পর্শীর কান্নার আওয়াজ। কান্না শুনে উনি দৌড়ে গিয়ে দেখেন পড়ে গিয়ে মুখ কেঁটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে মেয়েটার। তার কান্না শুনে ততক্ষণে সবাই ছুটে এসেছে। উনি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুখ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। বড় মা আর উপায় না পেয়ে স্পর্শীর মুখে সরিষার তেল ঘষে দিলেন। রক্ত পড়া কমে গেল। কিন্তু ক্ষত স্থানে সরিষার তেল দেওয়াতে জ্বলতে শুরু করলো। ছোট্টো স্পর্শী ছটপট করে কাঁদতে থাকল অনেক সময়। কেউ ওকে কোলে নিতে চাইলোও গেলো না। মায়ের কাঁধে’ই মাথা রেখে ফুঁপাতে ফুঁপাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। যেন মা থাকলেই হবে। তারপর ঘুমের ঘোরে ওর মুখে ফিডার দিলে টান দিয়ে গিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। ঠোঁটের অনেকখানি ফুলে গেছে।
মুখের ব্যথায় দুইদিন খেতেই পারে নি মেয়েটা, শুধু কাঁদতো। আর মেয়ের কান্না দেখে উনিও কেঁদে ফেলতেন।আর উনারা মা ও মেয়ে যখন কাঁদতো রুদ্র তাকিয়ে দেখতো। এমনিতেই রুদ্রু স্পর্শীর দশ বছরের বড়। আর রুদ্র তখন অনেক কিছু বুঝতো। ছোট্টো স্পর্শী তার বই খাতা টেনে ছিঁড়ে ফেললেও মারা তো দূর ধমকাতোও না। শুধু রাগী রাগী দৃষ্টি তাকালেই স্পর্শী ঠোঁট উল্টো কেঁদে রাগ করে উল্টো ঘুরে বসতো। ফলে
তারই রাগ ভাঙাতে দোকানে নিয়ে গিয়ে চকলেট আর চিপস কিনে দিতে হতো। একবার হয়েছি কী, স্পর্শী তার দাদীমার পানের বাটা থেকে জর্দ্দা নিয়ে খেয়ে বমি টমি করে একাকার অবস্থা। যেমন চঞ্চল মেয়ে তেমনি শাস্তির শেষ নেই। সেদিন রুদ্র রেগে দাদীমার পান খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষনা করে পানের বাটা লুকিয়ে রেখেছিল। এছাড়া খেলতে খেলতে স্পর্শী ওর বড় মায়ের শখের ফুলদানী ভেঙে খাটের নিচে লুকিয়েছিল। পরে তাকে খুঁজে খুঁজে খাট নিচে থেকে বের করে আনা হয়। বড় মা তার কান্ডে মন খারাপ তো দূর চোখ পাকিয়ে তাকান নি পর্যন্ত। কারণ চঞ্চল মেয়েটা এই বাড়ির প্রাণ। আর উনিও খুব বেশি ভালোবাসেন স্পর্শীকে। তাছাড়া স্পর্শী কোনো না কোনো কান্ড ঘটাবেই ঘটাবে। একবার প্রচন্ড জ্বরে এসেছিল
তার কোনোভাবে জ্বর ছাড়ছিল না। পরে ডাক্তারের পরামর্শে হসপিটালের ভর্তি করা হয়েছিল। হসপিটালে থাকবে না বলে সে কী কান্নার স্পর্শীর। হাতের কেনোলা যে কতবার খুলেছে তার ইয়াত্তা নেই। আবার যখন কেনোলা লাগাতো তখন খুব কাঁদতো। মেয়ের সঙ্গে উনিও কেঁদে বুক ভাসাতেন। তারপর তিনদিন হসপিটালে থেকে বাসায় ফিরলেন উনারা। ধীরে ধীরে স্পর্শী সুস্থ হতে লাগল সঙ্গে তার দুষ্টুমিও ফিরে এলো। বাসাটাও মেতে উঠল তার দূরন্তপণায়।
স্পর্শীর তখন চার বছর বয়স। একদিন দাদীমার বড় বোন বেড়াতে এলেন। উনি কয়েকদিন থেকে স্পর্শীর দুরন্তপনা দেখে খাওয়ার টেবিলে বললেন,
-‘ও মরিয়ম তুমি দেহি মাইয়া নিয়াই পইড়া থাকো সারাক্ষণ। আগে চাকরি করতা মাইয়া আসার পর নাকি চাকরি ছাইড়া দিছো? এত মাইয়া, মাইয়া, করলে চলবো নি বাঁছা? নিজের ভবিষ্যত নিয়াও তো ভাবতে হইবো। মাইয়া বড় হইবো তারও বিয়া দিতে হইবো। তখন তো মাইয়া তোমার কাছে থাকবার পারবো না। তখন কী করবা? বয়স হইলে শরীরের ক্ষয় হয়, চোখের জ্যোতি কমে। তহনের চিন্তা ভাবনা কইরা আখের গুছাইয়া না রাখলে হইবো? শূন্যহাতে থাকলে শ্যাষ বয়সেও কাছে বসার মানুষ পাইবা না।’
একথা শুনে মরিয়ম বেগম থম মেরে বসে রইলেন। আসলেই তো স্পর্শী বড় হচ্ছে তারও বিয়ে দিতে হবে। পরের ঘরে চলে যাবে মেয়েটা। তখন চাইলেও মেয়েকে কাছে রাখতে পারবে না। সেই মুহূর্ত থেকে উনি এসব একথায় ভাবতে লাগলেন।
সবসময় এসব চিন্তায় উনার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকল।
উনি এসব ভাবতেন আর মনমরা হয়ে কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতেন। কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করে একদিন রুদ্র সকলের সামনে জিজ্ঞাসা করল,
-‘মেজো মা কিছু হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরেই দেখছিস তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছো। স্পর্শী তো সুস্থ আছে তাহলে কাঁদছো কেন?’
রুদ্রর মুখে এই কথা উনি অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এ ব্যাপারটা বাকিরাও খেয়াল করেছে তাই সমস্যা খুলে বলতে জেঁকে ধরলেন। উনি বাধ্য হয়ে কেঁদে কেঁদেই বললেন উনার মনের ভাবনা। ভবিষ্যতে কথা ভেবে কাঁদতে দেখে সকলে হাসলেন, সাধ্যমতো বুঝালেন মেয়েদের জন্মই অন্যের ঘর আলোকিত করার জন্য। আজ অথবা কাল স্পর্শীও অন্যের ঘরের বাতি হবে। তার নিজের একটা সংসার হবে। ব্যস্ততা বাড়বে। তখন চাইলেও যখন তখন আসতে পারবে না। যদিও আসে তাও ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসবে। আসলে মেয়েদের জীবনই এমন। বড় মা, দাদীমা এমন নানান কথা বলে বোঝাচ্ছিলেন উনাকে। উনাদের উক্ত কথাগুলো কেন জানি রুদ্রর পছন্দ হলো না। বিয়ের পর ছোট্টো স্পর্শী ক্ষণিকের অতিথি হবে? সে নাকি চাইলে যখন তখন এই বাসায় আসতে পারবে না।
কথাটা কেন জানি সে মানতে পারল না। তাই বিরক্তি সুরে বলল,
-‘না, আমাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে শুধু আমাদের ঘরই আলোকিত করবে। স্পর্শীকে অন্যের ঘর পাঠাবো না আমি।’
ছেলের কথা শুনে বড় মা হেসে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘তা কী করে আঁটকাবি শুনি?’
-‘আমিই বড় হয়ে স্পর্শীকে বিয়ে করবো। তারপর আমাদের এই বাসায় থেকে যাবে ও। তখন ওকে অতিথিও হতে হবে না আবার সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে। আর স্পর্শী চলে যাবে ভেবে মেজো মাও আর কাঁদবে না।’
রুদ্রর কথা শুনে সবাই খুব হেসেছিল। কিন্তু রুদ্র সিরিয়াস ভাবেই ব্যাপারটা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল। তারপর তারা দু’জন বড় হতে লাগল। সময় অতিবাহিত হলো সুখে দুঃখের টানাপোড়ানে। সেদিনের পর থেকে রুদ্র স্পর্শীর অভিভাবক হয়ে উঠল। ছোট ছোট ব্যাপারগুলো রুদ্র মত দিতো। সঠিক আর ভুলের পার্থক্য বুঝাতো। কিন্তু দুষ্টু স্পর্শী সেসব বুঝতে
চাইতো না বরং তাকে যখন যা নিষেধ করা হতো ঘুরে ফিরে সে ওই কাজটাই করতো। এজন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হতো, এখনো হয়। দুটোতে শরীরে বড় হলেও এখনো ছোটদের মতো ঝগড়া করে। অথচ গতমাসের শেষের দিকে রুদ্রর বয়স সাতাশ হলো আর স্পর্শীর ষোলো।
আর স্পর্শীর মাঝে এই পরিবর্তন এসেছে রুদ্রের জন্মদিনের দিন। সেদিন বাসা মেহমানে ভর্তি ছিল। সকলের হইহট্টগোল
মেতে ছিল চারিপাশে। তখন নিকট আত্মীয়দের একজন আলোচনা করছিল, ‘ওকে হসপিটাল থেকে কিনে এনেছিল। খুব কষ্টে মানুষ করেছে ওর পালিত মা।আজ দেখো কত বড় হয়েছে। একেই তো বলে রাজকপাল। দেখ, ভাগ্য গুনে রাস্তা থেকে একবারে রাজপ্রাসাদে ঢুকে গেছে।’
একথা শুনে স্পর্শী ছুটে যায় দাদীমার কাছে। কিন্তু মেহমান থাকায় জিজ্ঞাসা করে না কোনোকথা। তারপর রাতে যখন
মেহমানরা চলে গেল তখন সকলের সামনেই কথাটা উঠালো সে। তখন রুদ্র সেখানে উপস্থিত ছিল না। তখন দাদীমা সত্য লুকিয়ে মিথ্যাের আশ্রয় নিয়ে থমথমে মুখে বলেন রুদ্র দত্তক নেওয়া সন্তান। তাকে নাকি হসপিটাল থেকে আনা হয়েছে। তবে দত্তক নেওয়া বাচ্চাটি এতিম ছিল না তার সবাই ছিল।
কিন্তু কিছু কারণে তাকে তার পরিবার হসপিটালে ফেলে গিয়েছিল। তারপর তাকে এই বাসায় এনে বড় করা হয়। এই কথা শুনে সে বিশ্বাস করে নেয়। আর রুদ্র বাসায় ফিরলে তাকে আলাদা করে ডেকে জানানো হয় পুরো ঘটনা। সেকথা শুনে রুদ্র জানায়, ‘সে নয় স্পর্শীই পালিত সন্তান।’ একথাটা যেন স্পর্শীর কানে কোনোভাবে না যায়৷ সে এই কঠিন সত্য সহ্য করতে পারবে না মেয়েটা। স্পর্শীর সত্য লুকাতেই রুদ্র নিজের গায়ে লাগিয়েছে পালিত সন্তানের তকমা। তবে বড় মা ব্যাপারটা মানতে চাচ্ছিলেন না পরে বড় বাবা আর রুদ্র বোঝানোর পর মেনে নিয়েছে। পুরনো কথা স্মৃতিচারণ করে উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। উনার শূন্য কোল পরিপূর্ণ হয়েছে।
আল্লাহর রহমতে অমুল্য সম্পদ পেয়েছে উনি এজন্য মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো শুকরিয়া করতে কার্পণ্য করে না।
___ ‘এক সপ্তাহ পরের ঘটনা’___
বিকালবেলা স্পর্শী ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। টিভিতে চলছে হিন্দি মুভি। ড্রয়িংরুমে আপাতত সে ছাড়া কেউ নেই।
তখন পাশে থাকা ফোনের রিং বেজে উঠল। মুখভর্তি বার্গার নিয়ে পাশ ফিরে তাকাল সে। ফোনের স্কিণে বড় বড় অক্ষরে
রুদ্র আর ফোনটা তার বড় মায়ের। কল দেওয়া ব্যক্তির নাম দেখে মুখে বিরক্তি ভাব এনে টিভিতে মনোনিবেশ করলো। কিন্তু পরপর ফোনটা বাজতে দেখে বিরক্তির মাত্রা বেড়েই গেল। একপর্যায়ে কলটা রিসিভ করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,
-‘কল রিসিভ হচ্ছে না মানে বুঝতে হবে ফোনের আশেপাশে কেউ নাই। এই কমন সেন্সটুকুও নেই দেখছি। যায় হোক কে বলছেন, কাকে চান?’
-‘ এই যে কমনসেন্সের ঠেলাগাড়ি কল রিসিভ করে ভদ্রতা সূচক সালাম দিতে হয় এটা জানেন না? আর ‘কে বলছেন, কাকে চান।’ এ আবার কেমন কথাবার্তা?মানে আগে যতটুকু ভদ্রতা জ্ঞান ছিল সবটুকুও গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিস?’
-‘আর কিছু বলবেন?’
-‘হুম, আম্মুকে বল নাবিলের গাড়িতে আমার সব জিনিসপত্র
পাঠিয়ে দিয়েছি। সব যেন দেখে শুনে নামিয়ে নেয়। আর হ্যাঁ
আজ রাতের বাসে সিলেট যাচ্ছি পরশুদিন বাড়ি ফিরবো।’
-‘জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন কেন সেটাই তো বুঝলাম না।’
-‘তোকে এত বুঝতে হবে না। যতটুকু বলেছিল ততটুকু গিয়ে বল আম্মুকে, রাখছি এখন।’
একথা বলেই রুদ্র কল কেটে দিলো। আর স্পর্শী মুখ ভেঁচি দিয়ে ছুঁটলো বড় মায়ের রুমে। যেতে যেতে মনে মনে ফন্দি এঁটে নিলো। রুদ্রর কথাগুলো বলতে বলতে সুযোগ বুঝে বড় মায়ের হাতের বানানো আচরের বয়ামটা হাপিস করে দিবে।
কিন্তু সে হয়তো জানতো না বড় মাও তার জন্য কত বড় এক চমকের ব্যবস্থা করে রেখেছে। যে চমকের কারণে তার হাসি মুখ মলিনতায় ছেঁয়ে যাবে।
To be continue……!