প্রেমের_পরশ
পার্ট_24
জামিয়া_পারভীন
আফজাল হোসেন এতোটুকু বলেই থেমে যান, দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। নিরু তখন জিজ্ঞেস করে,
• “ এরপর কি হলো নানুর, বলো বাবা। ”
আফজাল হোসেন বলেন,
“ হুম বলছি, সেদিন থেকেই দুর্যোগ শুরু হয়। লুতফার কথাতে নিরুর নানু আসমত চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনও বুঝতে পারিনি উনি কেনো অসুস্থ হয়েছেন। যখন হসপিটাল এ নেয়া হলো, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
ডক্টর বললেন,
“ হার্ট এটাক হয়েছে।”
উনি কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। নিলাশা কাছে যেতেই উনি জানিয়ে দেন লুতফা আমার স্ত্রী আর রুবি আমার মেয়ে। নীলাশা চিৎকার করে বলে ওঠে,
“ এসব মিথ্যা অপবাদ, আমি বিশ্বাস করিনা। ”
লুতফা এমন কঠিন পরিস্থিতি তেও বলে দেয়,
“ বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি তোমার ননদ না, তোমার সতীন। রুবির মাথায় হাত রেখে উনাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলো উনি পারবেনা। কারণ নিজ মেয়ের মাথায় হাত রেখে মিথ্যে বলা যায়না। ”
আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। লুতফা কে চড় মেরে বলি, “ হ্যাঁ রুবি আমারই সন্তান। ”
নীলাশা এই ধকল সহ্য করতে পারেনি, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলো, কোন রকম ধরে বেডে শুইয়ে দিই। আসমত চৌধুরীর প্রাণ কখন বের হয়ে গিয়েছে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। নীলাশার জ্ঞান ফিরে আসতেই ওর বাবার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে, কিন্তু আসমত চৌধুরী আর উঠেনি কখনো। নীলাশাও আর কখনো কথা বলেনি।
বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটা নির্বাক হয়ে যায়, খুব যত্ন নিতাম ওর। প্রেগন্যান্সির সময় এতো দুর্যোগ ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমি বাসায় নার্স রেখে দিই, ওর দেখাশোনা করার জন্য। এরপর আসে সেইই দিন, ওর ব্যথা উঠে। আমি ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়, বেবির অবস্থা ভালো ছিলো না বিধায় সিজারের ব্যবস্থা করা হয়। তিন ঘন্টা পর আমার ঘর আলো করে নিরুর জন্ম হয়। নীলাশা অজ্ঞান ছিলো, জ্ঞান ফিরছিলো না। খুব টেনশন এ ছিলাম।
এরপর, পুরো একদিন পর নিলাশার জ্ঞান ফিরে, একটু সুস্থ হলে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়। আমি ওর পাশে গিয়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। সে শুধুই তাকিয়ে ছিলো, কোন কথা বলেনি আমার সাথে। শুধু ওর হাত দুটো আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিলো। আমি আমাদের বেবি কে তার সামনে দিতেই, সে বেবির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ও খুব আস্তে করে বলে,
“ বেবির নাম রাখবে নিরুফার জাহান ”
আমি বলি,
“ তোমার ইচ্ছেই শেষ ইচ্ছে। ”
ও আর কথা বলেনি, নিরুকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর নিরু কে আমার হাতে দিয়ে দেয় । ও ঘুমিয়ে গেছে, অসুস্থতার জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া থাকতো ওকে। আমি নিরুকে নিয়ে বাইরে যায়, আমার বোন কে ডেকে নিরু কে দিই। বোন সেদিন আবদার করে বসে,
“ ভাই তোর মেয়েটা তো অনেক সুন্দরী হবে রে, দিবি ওকে বড় হয়ে আমার ছেলের বউ হতে। ”
আমি বুঝি নি, ও এমন আবদার কেনো করেছে। আমি হেসে বলি,
“ আগে বড় হোক। ”
ফার্মেসির দিকে গিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে এসে নিলাশার রুমে যায়, গিয়ে দেখি নিলাশার মাথার উপরে বালিশ চাপা দেয়া আছে।
বালিশ সরিয়ে নিলাশার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠি। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে আছে , তাড়াতাড়ি করে ওর হাত ধরতেই দেখি ওর হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে।
চিৎকারের সাথে সাথে লুতফা ঘরে ঢোকে, আমি অবাক হয়ে বলি,
“ তুমি এখানে কি করছো? ”
সে হেসে বলে,
“ তুমি বিয়ে করে বউ নিয়ে মজা করবে, আর আমি সারাজীবন দেখে দেখে ফুলবো। এটা হবার নয়, তোমার নিলাশা মরে গেছে আর ওকে হত্যা করেছো তুমি। ”
আমি রেগে গিয়ে ওকে চড় মারি, এরপর বলি,
“ কি যা তা বলিস অসভ্য মেয়ে, আমি কেনো ওকে হত্যা করবো? ”
লুতফা খুব জোরে হাসে, এরপর একজন কে আসতে বলে। ফিল্মে কয়েকটা ছবি দেখায়, আমি নিলাশার মাথা থেকে বালিশ সরানোর সময়। ছবিটা এমন মুহুর্তে তোলা দেখে মনে হচ্ছিলো, আমি নিলাশা কে হত্যা করছি বালিশ চাপা দিয়ে।
আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি, এই ছিলো আমার কপালে। আমি জানিনা কেনো এই শত্রুতা, হয়তো স্ত্রীর অধিকার আদায় করতে চেয়েছিলো, তাও নিজ স্বামী কে ফাঁসিয়ে।
লুতফা তখন বলে, “ ছবি কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না তুমি ওর হত্যাকারী। শুধু ওর মেয়েটা কে হত্যা করে ফেলো। আর না হয় ওই মেয়ে কে এতিমখানা তে দিয়ে এসো। ”
বাধ্য হয়ে আমার কলিজার টুকরো নিরু কে এতিমখানা তে দিয়ে আসি। ওর সব খরচ আমি দিতাম, লুকিয়ে রাখতাম নিরুকে। কেউ যেনো নিরুকে হত্যা করতে না পারে। এরপর থেকে লুতফার সাথে এক ঘরে শুধুই থাকতাম কিন্তু আর কখনো ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর রুবি তো সন্তান, চেষ্টা করেছি ভালোবাসার। জানিনা কতোটুকু ভালোবাসতে পেরেছি।
আফজাল হোসেন কাঁদতে থাকে খুব, নিরু শুভর পাশ থেকে উঠে গিয়ে আফজাল হোসেন কে জড়িয়ে ধরে, আর রুবি মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে ।
শুভ কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ তার জানা নাই। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বলে,
“ আগেও নিরুকে হত্যা প্লান করা হতো নিরুর এই সম্পত্তির জন্য । আর এখনও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। যদিও আশা করি রুবি ভাবী আর এই কাজ করবে না। কিন্তু রাকিব এই চেষ্টা করতেই থাকবে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া ওর শাস্তি হবে কিভাবে। ”
নিরু তখন বলে ওঠে,
“ আমার মৃত্যু যদি এখনি লিখা থাক্ব এখনই হবে, কিন্তু যদি না লিখা থাকে তাহলে কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। প্লিজ এই নিয়ে কেউ টেনশন করবেন না। ”
নিরু ঘরে চলে যায়, একটু কাঁদা দরকার মেয়েটার। এতো গুলো সত্য জানার পর কাঁদলে মন হালকা হবে ভেবে শুভ নিরুকে একাই ছেড়ে দেয়।
রুবি তখন সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“ আমার ভুলের জন্য আমি খুব অনুতপ্ত, মাফ করে দিবেন সবাই। আমার মা যে অন্যায় করেছে, তার শাস্তি সে পাচ্ছে। আমার সৎ মা কে তো একেবারেই হত্যা করে ফেলেছে আর নিজেও এখন আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। আমি খুব চাইতাম আমার মা যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু এখন আর চাইনা। ”
রুবিকে কান্না থামাতে বলে শুভ,
“ আহহহহ! ভাবী, কারোও মৃত্যু কামনা করতে নেই, যাই হোক উনি আমাদের সাক্ষী। উনি বেঁচে থাকলেই রাকিব আর ওর মা কে ধরা সহজ হবে। ”
শুভ সবার সাথে কথা শেষ করে রুমে যায়, নিরু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শুভ গিয়ে বলে,
“ আর কেঁদো না প্লিজ, কাঁদলে যে আমাদের অনাগত বেবি কষ্ট পাবে। তুমি কি তা চাও? ”
নিরু তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে শুভ কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ আমি চাই আমার অনাগত বেবি যেন অনাথ হয়ে বড় না হয়। ওর সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করি। ”
চলবে……..