প্রেমের_পরশ
পার্ট_23
জামিয়া_পারভীন
নিরু ড্রইং রুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখে ক্যান্ডেল জ্বালানো আছে ঘরের মেঝেতে, লাভ শেপ আকৃতি তে। লাভ শেপ এর মাঝে শুভ দাঁড়িয়ে আছে, সামনে টেবিল, মাঝে একটা চকলেট কেক। নিরু ক্যান্ডেল পার করে শুভর কাছে যায়, তখন শুভ মুখে আবৃত্তি করে শোনায় নিরুকে,
“ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন ।
ফুলেরা ফুটেছে হাসি মুখে
বাড়ছে ভ্রমরের গুঞ্জন,
পাখিরাও গাইছে নতুন সুরে
জানাতে তোমায় অভিনন্দন ।
নদীতে বইছে খুশীর জোয়ার
বাতাসে সুভাশিত কলরব,
তোমাকে নিয়েই মাতামাতি আজ
তোমার জন্যই সব ।
জীবনে হও অনেক বড়
পৃথিবীকে করো ঋণী,
গাইবে সবাই তোমার জয়গান
রাখবে মনে চিরদিনি ।
জীবন হোক ছন্দময়
সপ্নগুলো রঙিন,
ভালোবাসায় ভরে উঠুক
তোমার জন্মদিন ।।
জন্মদিন শুভ জন্মদিন !! ”
নিরু নিজের বার্থডের কথা নিজেও ভুলে গিয়েছিলো। শুভর কাছে সারপ্রাইজ পেয়েছে। এছাড়া নিরু এর আগে কখনো জন্মদিন পালন করেনি, সেই জন্য এই আবেগ টা অনেক বেশি নিরুর কাছে। নিরু শুভ কে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলে,
• “ আমার জন্য এমন সারপ্রাইজ রাখবে! আমি কল্পনা ও করিনি। ”
শুভ নিরুর কপালে কিস দিয়ে, পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। বক্স থেকে ডায়মন্ডের রিং, ডায়মন্ডের রঙ ছিলো নীল । রিং বের করে নিরুর হাতে পড়িয়ে দেয় শুভ। নিরু এবারো অবাক হয়ে যায়, হাসি প্রকাশ করতে না পেরে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
• “ কি হলো পাগলী, কাঁদছো কেনো? ”
• “ এতো সুখ কপালে সইবে তো শুভ, তোমার মতো এতো ভালো হাজবেন্ড, মা বাবার মতো শ্বশুর শাশুড়ি। বোনের মতো ননদ। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তোমরা। এই রিং, কেক, মোমবাতি, এসব কিছুই না। তোমরা থাকলেই আমার জীবন স্বার্থক। ”
• “ এভাবে বলোনা, তোমার জন্য আমি পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে গিয়েছি নিরু। আমি আগে এতো টাও ভালো ছিলাম না। আমার রাগের জন্য বাসার কেউ কোন কথা বলার সাহস পেতো না। খুব ভয় পেতো আমাকে, রিমি বাদে। রিমি আমার কলিজার টুকরো বোন। কিন্তু তোমাকে যতই দেখেছি, তোমার রূপের সৌন্দর্যে আমি বিমোহিত হয়েছি। যতই দেখেছি তোমার চোখের দিকে, তোমার চোখের মায়া আমায় খুব কাছে টেনেছে। ওই চোখ এ যাদু আছে, তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা আমি । তোমার জন্যই আমি চেঞ্জ হয়ে গিয়েছি। ”
• “ তুমি আমার চোখের প্রেমে পড়েছিলে আর আমি তোমার খালি বুকের উপর লোমের প্রেমে পড়েছিলাম। ” বলেই নিরু ভেঙচি কাটে, কি বলতে কি বলে ফেলেছে।
• নিরুর কথায় শুভ হেসে ফেলে, “ সব বাদ দিয়ে খালি বুক টাই ভালো লাগলো ম্যাম! ”
• “ উঁহু! তোমার লোমশ বুকের উপর মাথা রাখতে আমার খুব ভালো লাগে । এছাড়া ওখানে তোমার হার্টবিট শুনতে পাই। তোমার প্রতিটি হার্টবিট যেন নিরু বলে ডাকে। খুব ভালো লাগে আমার এটা। ”
শুভ নিরুর হাতে চুমু দিয়ে বলে,
• “ চলো কেক কাটবে!”
কেক কাটার সময় শুভ উইস করে,
নিরু কেক কেটে শুভকে খাইয়ে দেয়, শুভ নিরুকে খাইয়ে দেয়। দুজনে আরো ও গল্প করার পর নিরু বায়না ধরে ছাদে যাবে, তখন শুভ বলে,
• “ তুমি প্রেগন্যান্ট না হলে সব এরেঞ্জমেন্ট ছাদেই করতাম। নেক্সট টাইম তোমার সব আবদার পূরন করবো৷ বুঝেছো পাখি। ”
এবার নিরু শান্ত হয়ে রুমে আসে, শুভ সব পরিষ্কার করে রুমে আসে। দেরি করে ঘুমানোর জন্য দুজনেরই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়।
বেলা ১১ টাই নিরুর ঘুম ভাঙে, নিচে মনে হলো খুব কথার শোরগোল শুনা যাচ্ছে। নিরু শুভকে উঠিয়ে দেয়, দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিচে যায়। নিরুর বাবা এসেছেন।
বাবার কাছে নিরু এগিয়ে যেতেই নিরুর বাবা নিরুকে কিছু কাগজ ধরিয়ে দেয়,
• “ এগুলো কি বাবা! ”
• “ তোমার আমানত এতোদিন আমার কাছে গচ্ছিত ছিলো, আজ তোমার জিনিস তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। ”
• “ আমার জিনিস মানে? কিসের কথা বলছো তুমি? আর আমাকে তুমি করেই বা বলছো কেনো! ”
• “ বলবো সব ” একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, “ এখানে সাইন করে দাও। ”
নিরু সাইন করেই দেয়, এরপর নিরুর বাবা সবার উপস্থিতি তেই বলে,
• “ আজ থেকে আমার মেয়ের যতো সম্পত্তি ছিলো সব তার কাছে হস্তান্তর করে দিলাম। নিয়ম এটাই ছিলো, ওর ১৮ বছর বয়স হলে ও সব সম্পত্তির মালিক হবে। আসলে আমার নিজের বলতে কিছুই ছিলো না। সব আমার নিলাশার বাবার ছিলো, সেই সূত্রে ই নিলাশার হয়, এখন নিরুর। ”
নিরু অবাক হয়ে শুনছে, হটাৎ করে জিজ্ঞেস করে,
• “ আমার মা সম্পর্কে একটু বলবে বাবা! রিকুয়েস্ট রাখলাম। ”
• “ হ্যাঁ মা, আজ বলতেই এসেছি। ”
বাসায় সবাই আছে, শুভ, সাগর, নিরু, রুবি, রিমি, শুভর বাবা আর মা। সবাই সোফাতে গোল হয়ে বসে তখন আফজাল হোসেন নিজের না বলা গল্প বলতে শুরু করেন।
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম, কোনরকম সংসার চলে যেতো আমার। একটু বড় হবার পর যখন খরচ বেড়ে যায়, তখন টিউশনি করেই চলতাম। এরপর ভার্সিটিতে ভর্তি হই, সেখানেই প্রথম দিন নিলাশার সাথে পরিচয় হয় আমার। নিলাশা অনেক ধনী বাবার সন্তান হলেও কখনো বুঝিনি সে ধনী ঘরের মেয়ে। খুব সিম্পল ভাবে নিজেকে সব সময় প্রেজেন্ট করতো। প্রেম টা কিভাবে যেনো হয়েই গিয়েছিলো, কেউ বুঝিনি। কেউ কাউকে কখনো ভালোবাসি কথা টা বলিনি। গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করি, জব খুঁজতে থাকি। ঘুষের বাজারে দিবে কে চাকুরী? নিলাশা একটা কম্পানির নাম বলে, সেখানে ইন্টারভিউ দিতেই জব টা হয়ে যায়, বাসায় গিয়ে সুখবর দিতেই, মা বলেন,
• “ বাবা আফজাল, অনেক পড়াশোনা করলে, অনেক তো হলো, এবার আমার সৈ কে রাখার কথা পূরণ করো। ”
• “ কি কথা আম্মা ”
• “ আমার সৈ কে কথা দিয়েছিলাম, ওর মেয়ে কে বউ করে ঘরে তুলবো। এখন তো চাকুরী পেয়েই গেলি, বিয়েটা এবার করেই নে। ”
• “ কিন্তু!”
• “ তুই যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি। ”
আমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করে নিই, নিলাশা কে লুকিয়ে। বয়সের দোষ এ নিলাশার মন ভুলে গিয়ে লুতফা কে কাছে টেনে নিয়েছিলাম একদিন, সেই সন্তান রুবি। এরপর নিজের ভুল ভাঙলে খুব অনুতপ্ত হই। নিলাশা কে তাও কিছুই বলতে পারিনি।
একদিন জব করার সময় নিলাশা অফিসে আসে, আমার কাছে এসে খুব কান্নাকাটি করে। কেনো তাকে কষ্ট দিচ্ছি, কেনো অবহেলা করছি, অনেক অভিযোগ ছিলো তার। খুব খুব রাগ হয়ে যায় আমার, নিলাশা কে চড় মেরে বলেছিলাম,
• “ কখনো তোকে বলিনি, ভালোবাসি। কিসের অধিকার দেখাচ্ছিস তুই। তুই আমার অফিসে আর আসবি না। আমি তোর সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চাইনা। ”
• নিলাশা খুব অবাক হয়ে বলে, “ আমার বাবার অফিসে আমি আসবো না তো কি তুমি থাকবে? কখনো অহংকার করিনি তুমি কষ্ট পাবে বলে, সব সময় তোমার মন যুগিয়ে চলতে চেয়েছি। আর তুমি আমার সাথে আজ এমন করলে। ”
বস বের হয়ে আসেন, নিলাশা বসের বুকে বাবা বলে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। আমি কি করতে পারতাম আমার জানা ছিলো না। নিলাশার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, আমি চাকুরী হারানোর ভয়ে নিলাশার পায়ে ধরে বলি,
• “ প্লিজ নিলাশা, ক্ষমা করে দাও, আমি কখনো বুঝিনি তোমায়। ”
নিলাশা ছিলো সরল মনের মেয়ে, সে আমার বুকে অনেক কাঁদে। অফিসেই বস আমাদের বিয়ের ডেট ঘোষণা করে দেন। তখন নিলাশা কে বলি,
• “ নিলাশা, প্লিজ এক বছর প্রেম করি, এরপর যদি বিয়ে করি। ”
নিলাশা ভাবে আমি রোমান্স করতে চাচ্ছি। হ্যাঁ আমি নিলাশা কে ভালোবাসতাম, কিন্তু লুতফার জন্য সব এলোমেলো হয়ে যাচছিলো। নিলাশার সাথে এক বছর প্রেম করে ওকে বিয়ে করে ওদের বাসা তেই শিফট হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর আমার মা মারা যান, আর আমার বোন ওর স্বামী কে তালাক দিয়ে চলে আসে।
লুতফা কে তখন সব কিছু বলি, আমার প্রেম, বিয়ে সব কিছুই। ওকে শর্ত দিইই, ওদের বাসায় নিয়ে গিয়ে রাখবো কিন্তু বোন পরিচয় এ থাকতে হবে। তখন রুবির বয়স এক বছর ছিলো।
এছাড়া সবাইকে কাছে রাখার আর কোন অপশন ছিলো না। লুতফা কে ডিভোর্স দিলেও পারতাম কিন্তু রুবির জন্য দিতে পারিনি।
আমার আর নিলাশার বিয়ের চার বছর হতে চললেও নিলাশা মা হতে চাইতো না। প্রেগ্ন্যাসি কে খুব ভয় করতো সে। অনেক বুঝিয়ে ও রাজি হয়েছিলো, নিরু তখন পেটে আসে। একদিন লুতফা নিলাশার বাবা কে সব বলে দেয়, এত্ব উনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
চলবে…………