প্রেমের মেলা পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
752

#প্রেমের_মেলা
শেষ_পর্ব
#বর্ষা
ইনায়া হসপিটালের বেডে সুয়ে আছে।আশিয়ান ইনায়ার হাত ধরে কেঁদেই চলেছে। ইনায়া চোখ বেয়ে নিরব অশ্রু ঝড়ছে আর মুখে ভেসে আছে তাচ্ছিল্যময় হাসি।সেদিন নিজের মনের অহরহ প্রশ্নে আশিয়ান মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে রুপান্তরিত হয়েছিলো।যে পশু যৌন ক্ষুধার্ত।ইনায়া বুঝে ওঠার পূর্বেই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।ইনায়া অসহায় ছিলো একজন পশুর ন্যায় আচরণকারী পুরুষের শক্তির কাছে।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইনায়া জ্ঞান হারিয়েছিলো।তারপর জ্ঞান যখন ফিরলো তখন থেকেই একদম নিশ্চুপ সে।না,একটা কথাও সে এখনো অব্দি মুখ খুলে বলেনি।সেই যে নিশ্চুপ হলো মেয়েটা।

”জান আমাকে ক্ষমা করে দেও।জান প্লিজ জান।আমি আমার মাঝে ছিলাম না তখন। আমার ভয় হচ্ছিলো তোমায় হারিয়ে ফেলার।জান আই লাভ ইউ।জান প্লিজ টক উইথ মি”

ইনায়া চুপই রইলো।আশিয়ান বুকে একফালি কষ্ট নিয়ে কেবিন ত্যাগ করলো।একটু পর ইশান এসে পাশে বসে ইনায়ার।ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

”ইয়ু,আমার সাথে কথা বলবি না?”

ইনায়া তাকায়।তবে এবারও কথা বলে না।একে একে ফাবিহা সারওয়ারের পর যখন ইসরাক খান আসেন তখন ইনায়া ক্যানোলা হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাপাইয়ের ওপর।তার হাত থেকে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে।ইনায়াকে দ্রুত একজন নার্স ঘুমের ঔষধ দেন। কেননা ইনায়া অনেক উত্তেজিত হয়ে কান্না করছিলো।ঘুমানোর পূর্বে অস্পষ্ট স্বরে সে বলে,

”পাপাই…”

ওয়েটিং রুমে চেয়ারে বসে আছে আশিয়ান,ইশান, ফাবিহা সারওয়ার।লিফট থেকে বেরিয়ে আসেন ইসরাক খান।ইনায়ার কেবিন পাঁচতলায়।আর ওয়েটিং রুম নিজ তলায়। জাপানিজ হসপিটাল এটা। নিয়মগুলো দেশীয় হসপিটাল থেকে অনেকটাই অন্যরকম।

ইসরাক খান চুপসে থাকা মুখশ্রীতেই বলেন,”আমার বেটা আমাকে ডেকেছিলো..তবে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে ”

আশিয়ান খুশি হয় ইনায়া শেষমেশ কিছু তো বলেছে তা শুনে।তবে আহত হয় ইনায়ার উত্তেজিত হয়ে পড়ার ঘটনা শুনে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে ইনায়া কেন এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছে!

দিন চারেক পর,,,,

হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে ইনায়া।পাপাইয়ের ওভজার্ভেশনে থাকবে সে আরো কিছুদিন তাইতো স্বামীর বাড়ি না গিয়ে বাপের বাড়ি আসা। ফাবিহা সারওয়ার মেয়ের যত্নে যেন ত্রুটি না হয় তার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখছেন।ইশানও বোনের যত্নে একদমই ত্রুটি রাখছে।চকলেট, তেঁতুল,ফুচকা,বেগুনি,বার্গার,পিৎজা,চাইনিজ কতকিছুই না এনে দিচ্ছে।তবে তেমন কিছুই ইনায়া খায়নি চকলেট ছাড়া।

মেয়েকে নিয়ে নিরালয়ে বসেছেন ইসরাক খান।প্রশ্ন এখনো আছে যে মেয়ে কি বলতে চেয়েছিলো সেদিন!তবে আজও ইনায়া কিছুই বলে না।ইনায়া জানে যে ইসরাক খান ওই ঘটনা জানতে পারলে আশিয়ানকে একদমই ছাড়বেন না।উপরি কন্টাক্টের সহযোগিতায় আশিয়ানের এদেশ থেকে সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিবেন।অর্থাৎ মেরিটাল রেপ কেসে হাজতে ঢোকাবেন।ইনায়ার আইন সম্পর্কে বেশ ধারণা আছে কেননা সেও তো তেমনই একজন।

ফাবিহা সারওয়ারকে ইনায়া বলেছিলো আশিয়ানের সাথে তার কি সমস্যা হয়েছে তা। ফাবিহা সারওয়ার এখানে তেতে উঠলেও মুহূর্তেই মোমের মতো গলে ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

”ইনায়া মা তুমি বুঝদার মেয়ে।আমি তোমাকে বেশি কিছু বলবো না।তবে এটা বলবো যে আশিয়ান তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাছাড়া এ সমাজ তোমাদের ডিভোর্স হলে আশিয়ানের কর্মকে দোষারোপ করবে না বরং তোমাকেই দোষারোপ করবে।তোমার জীবনটা বিভৎস করে তুলবে। আরো তো রয়েছে সমাজের নিচু মানসিকতার মানুষদের কুৎসিত প্রস্তাব!মা আমি তো একা ছিলাম আমি বুঝি”

ইনায়া ভাবে।পরে ঠিকই বুঝতে পারে সমাজ আসলে কেমন!তাইতো ইনায়া আর আগায়নি।সে হয়তো প্রসাশনের সদস্য বলেই। কেননা যখন লোকবল জানতে পারবে ইনায়া প্রসাশনের সদস্য তখন কথা উঠবে,

”নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারে এক নির্দোষ ব্যবসায়ীকে হাজতে পুরেছে সেহরিশ খান”

সময় সত্যিই চলমান।দেখতে দেখতেই সময় রুপ বদলায়।বদলায় সম্পর্কের ভীত।আবার অনেক সময় সম্পর্ক এক থাকলেও, মাহাত্ম্যের মাঝে আসে ব্যাপক পরিবর্তন।তেমনি অনেক পরিবর্তন এসেছে সম্পর্কগুলো মাঝে।এসেছে নতুন কয়েক জন। নতুন প্রজন্ম।আটবছর অতিক্রান্ত হয়েছে।কম তো নয় সময়।আবারো শীতের আগমন হয়েছে।এইতো আর কিছুদিন পরই নয়তম বিবাহ বার্ষিকী আসছে ইনায়া,আশিয়ানের।

ইনায়া কাঁধে ব্লেজার ঝুলিয়ে বা’হাতে লাগেজ টেনে ফুল এটিটিউডে অতিক্রম করছে এয়ারপোর্ট।তারই পেছন পেছন আসছে আরো দু’জন। পাঁচ কি ছয় বছরের একটা ছেলে আর আশিয়ান। তাদের হাতেও লাগেজ।তবে ইনায়া কিন্তু আগের তুলনায় আরো সুন্দর হয়েছে।

”মাম্মাম”

বাচ্চাটার ডাকে ইনায়া পেছন ফিরে।বাচ্চাটা ছুটে গিয়ে ইনায়ার পা ধরে।ইনায়া নিচু হয়ে বসতেই ইনায়ার গালে টুকুস করে চুমু খায় বাচ্চাটা।ইনায়া ফোনে কাউকে বলে,

”আই উইল বি ব্যাক আফটার সাম টাইম”

ইনায়া ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাচ্চাটার গালে চুম্বন করে জড়িয়ে ধরে বলে,

”বাবাই তোমাদের তো আরো দু’দিন পরে আসার কথা ছিলো!আজ কিভাবে?”

”সারপ্রাইজ”

আশিয়ানের কথায় ইনায়া মুচকি হাসে। আশিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

”কোথায় ছিলে তোমরা দেখলাম না যে”

”আমরা পেছনের দিকে ছিলাম।তাই হয়তো খেয়াল করোনি জান”

ইনায়া আশিয়ানকে আর কিছু না বলেই বাবুটার সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বেরিয়ে যায় এয়ারপোর্ট থেকে।আশিয়ান প্রতিবারের মতো এবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কেননা আটবছর যাবৎ জৈবিক চাহিদা পূরণ হলেও মানসিক চাহিদাটা অপূর্ণ।ইনায়া একদিন অধিকার দেখিয়ে কথা বলেছিলো।আশিয়ান ধমকে উঠেছিলো সেই কারণে। কেননা অনেক পুরুষই আছে যে যারা নিজেদের ওপর অন্য কারো অধিকার দেখানো পছন্দ না।তেমনি আশিয়ানও। তাইতো সেদিন ধমকে উঠেছিলো সে।তবে ভাবেনি যে তাই হবে ইনায়ার তার প্রতি দেখানো শেষ অধিকারবোধ।

”আহান বাবাই,দুইদিন বাদে তো তোমার তিতির জন্মদিন।তাকে কি গিফট দিবে তুমি?”

আহান মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”মাম্মাম আমরা না তিতিরকে একটা মাম্মাম গিফট করবো।তুমি ছাড়া তো আমি একটুও থাকতে পারিনা।তাহলে তিতির কিভাবে থাকবে?”

ইনায়া ঠোঁট কামড়ে নেয়।তিতির হলো ইশান আর রিনির মেয়ে।হ্যা রিনি আর নেই।মেয়েটা তিতিরকে জন্ম দিতে গিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।রিনির ইচ্ছে ছিলো নরমাল ডেলিভারি করাবে। তাইতো ব্যথা ওঠার অপেক্ষায় ছিলো।তবে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বেবি না হওয়ায় ইমার্জেন্সিতে সিজার করা হয়।রক্তক্ষরণ হয় অনেক বেশি।তাইতো আর বাঁচানো যায়নি মেয়েটাকে!বছর তিনেকের তিতিরটা মা মা করে।তবে মায়ের চেহারাটা ছাড়া কিছুই বোঝে না।

ইসরাক খান মেয়েকে দেখেই এগিয়ে যান।আহান লাফ দিয়ে নানার কোলে উঠে গাল টেনে ধরে বলে,

”গ্র্যান্ডপা,আমি চলে এসেছি।”

ইসরাক খানও মেয়ের একমাত্র অংশটাকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসা দেন।ফ্লাটে ঢুকতেই তিতির সোনা ছুটে আসে।পিপি,পিপি করে ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে।আহান তার নানুর কোল থেকে নেমে ছুটে এসে বলে,

”তিতির তুমি আমায় আর পাপাইকে আগে না দেখে আমার মাম্মাকে আগে দেখেছো বলে এই চকলেটটা তোমার জন্য ”

ইনায়া হেসে দেয় ছেলের কথায়।আশিয়ানও হাসে।ইনায়া আর আশিয়ান একে অন্যের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন কিংবা বছর খানেক বাদে হাসে।ইনায়া খোলামেলা বলে,

”আশিয়ান দেখেছো তোমার ছেলে তোমার চেয়েও বেশি আমায় ভালোবাসে”

”বাসবেই তো!আমার বোন যে ভালোবাসার মতোই মানুষ ”

ইশান সদর দরজা প্রবেশ করতে করতেই বলে।তবে আহান ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে না তার মামুকে।কেননা ইনায়া তাকে এতোটুকু বুঝিয়েছে যে আহান যেন কখনো তিতির আগের ইশানের কোলে ওঠার চেষ্টা না করে কেননা আহান বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা পেলেও তিতির তো শুধু তার পাপাইয়ের ভালোবাসাই পায়। আমাদের ছোট্ট আহানও তা বোঝে।কথায় আছে, বুঝদার বাবা-মা চাইলেই বুঝদার সন্তান গড়তে পারে!

ইশান তিতিরকে কোলে নিয়ে এদিকে এসে বসতেই আহান করে বলে,

”মামু আমি তিতিরকে বিয়ে করবো বড় হয়ে”

আহানের কথায় ইনায়া হেসে দেয় শব্দ করে।আশিয়ান ক্ষেপে আহানের হাত ধরে টান দিয়ে বলে,

”এই ছেলে তুমি এগুলো কার কাছে শিখেছে। থাপড়ে ঠিক করবো তোমায়”

ইসরাক খান,ফাবিহা সারওয়ার টি টেবিলে নাস্তা রাখে হাসতে হাসতে।ইনায়ার হাসির প্রবলতা আরো বেড়েছে।ইশানও হাসছে।আর তিতির সে তো তার পাপাইয়ের হাসিটা গভীর ভাবে দেখছে। চার বছরের ছোট্ট তিতির সোনা যে খুব অল্প সময়ই তার পাপাইকে হাসতে দেখেছে।তবে আজকের হাসিটা প্রাণবন্ত।যা ছোট্ট তিতিরের হৃদয়ে দাগ কেটেছে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে