#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ১০ ]
#বর্ষা
হসপিটালে এসেছে ইনায়া।ডক্টর জাহিদের সাথে মিটিং। তাসকিন নামের ওই বদলোকটাও এই হসপিটালেই কর্মরত তা ইনায়া আজই জেনেছে। হঠাৎ ইনায়ার চোখ পড়লো তাসকিন আর স্নিদ্ধার দিকে।স্নিদ্ধা হয়তো প্রেগন্যান্ট। তাসকিন কি সুন্দর আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছে।স্নিদ্ধাও খুশি এতে।তবে মেয়েটা যদি স্বামীর মাস দুয়েক আগের কুকৃত্তির কথা জানতে পারে তবে কি আদৌ এই ভালোবাসা টিকবে!
স্নিদ্ধা দূর থেকে ইনায়া দেখেই চিনে নেয়। তাসকিনকে রেখে একপ্রকার ছুটে চলে আসে ইনায়ার দিকে।ইনায়া অনেকটাই অবাক হয়। কেননা সে তো ভেবেছিল স্নিদ্ধা ওকে চিনবে না।স্নিদ্ধা চুমুতে মুখ ভরিয়ে দেয়। তাসকিন ইনায়ার সাথে স্নিদ্ধা এতো সুশীল ব্যবহারে রীতিমত অবাক এবং ভীত।স্নিদ্ধা তাসকিনকে ডেকে বলে,
”তাসকিন তোমাকে বলেছিলাম না, ছোটবেলায় যখন সিঙ্গাপুর ছিলাম বাবার কাজের সূত্রে তখন একটা পুচকি আমায় খুব ভালোবাসতো।এই যে দেখো সেই পুচকিটা।আমার পুচকি বোনটা দেখেছো কত বড় হয়েছে?”
স্নিদ্ধার কথায় তাসকিন তড়তড় করে কাঁপতে থাকে। তাহসিন ফালতু এক বাহানায় কেটে পড়ে।স্নিদ্ধা আর ইনায়া ওয়েটিং এর জায়গায় বসে গল্প করতে শুরু করে।
”আমি কিন্তু অভিমান করেছি ইনায়া তুই আমাকে কি করে ভুলে গেলি? তুই বাংলাদেশে এসেও আমার সাথে কেন মিট করলি না?”
ইনায়া বাচ্চাদের মতো ফেস করে কিছুক্ষণ ভাবুক ভঙ্গিমায় থাকে।স্নিদ্ধা ইনায়ার ভাবুক ভঙ্গিমা দেখে হেসে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
”কিরে কি এতো ভাবছিস?”
”ভাবছি তুমি কি আমায় তোমার নাম্বার দিয়েছিলে নাকি এড্রেস দিয়েছিলে যে আমি যাব ”
স্নিদ্ধা কপাল চাপড়িয়ে বলে,”একদমই ভুলে গেছিলাম।চল তবে আজ আমাদের বাসায় ”
ইনায়ার মুখ শুকিয়ে আসে।মুচকি হাসে।বলে,
”আজ নয় তবে অন্য একদিন সারপ্রাইজ দিতে যাবো। তুমি আমায় ঠিকানা আর তোমার নাম্বার দিয়ে দেও বুঝলে?”
স্নিদ্ধা তাই করে।সে তো ছোট্ট থেকে দেখছে এই মেয়েকে কথার বাইরে এক কাজও করার যায় না।যেখানে না বলে সেখানে নাই থাকে।আর যেখানে হ্যা বলে সেখানে যদি উত্থাল পাত্থাল করা ঝড়ও থাকে সেখানেও তার হ্যা এর নড়চড় হবে না যদি আল্লাহ না চায়।স্নিদ্ধা ইনায়ার দিকে একটা চকলেট বাড়িয়ে দেয়।তাসকিন তাকে কিনে দিয়েছিলো আসার সময় কয়েকটা চকলেট।তা থেকেই স্নিদ্ধা একটা চকলেট বাড়িয়ে দেয় ইনায়ার দিকে।ইনায়া চকলেটটি নেয়।
ইনায়ার সিরিয়াল চলে আসায় ইনায়া উঠে দাঁড়ায়।বিদায় জানিয়ে ডক্টর জাহিদের কেবিনে যায়। স্নিদ্ধাকে নিয়ে তাসকিন বেরিয়ে যায়।দূর থেকে সে স্নিদ্ধা আর ইনায়ার ওপর নজর রেখেছিলো যাতে ইনায়া মুখ ফসকে কিছু বলে ফেললে সে যেন তৎক্ষণাৎ সব সামাল দিতে পারে তাই।তবে ইনায়াকে উঠতে দেখে তাসকিন চাইনি আর সময় স্নিদ্ধা হসপিটালে থাকুক কেননা সমস্যা হতে পারে।তাসকিনের সাথে ইনায়ার পরিচয় কিছুদিন আগেই।তবে খুবই ওড পরিস্থিতিতে।তাসকিন মাতাল হয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছিলো।তার পাশে ছিল অচেনা এক রমনী।যার সাথে সে অবৈধ কাজও করতে চেয়েছিলো গাড়ি রাস্তার কিনারায় পার্ক করে।মেয়েটাও সায় দিচ্ছিলো।তবে ইনায়া চলে আসায় আর সম্ভব হয়নি।
ফ্লাসব্যাক,,,,,
ইনায়া কার ড্রাইভ করে মাঝরাতে কোথাও থেকে আসছিলো।ঠান্ডা বেশ পড়েছে তবে গ্লাস লাগানো থাকায় ভেতরে বসে এতোটা শীত সে উপলব্ধি করতে পারেনি। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে বেসামাল এক গাড়ি সামনে গিয়ে থামে। বেসামাল গাড়ি দেখে ইনায়া তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামিয়ে ফেলেছিলো।বেশ জোরে ঝাঁকির স্বীকারও হয়েছে।তবে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে মোবাইলে ফ্লাশ জ্বালিয়ে বাইরে বের হয় ইনায়া।এলাকাটা নির্জন। অবশ্য সুন্দরও বটে। চারপাশের পরিবেশ যেন শহরের বুকে ছোট্ট এক গ্রামের সৃষ্টি করেছে।
সামনের গাড়ির কাছে যেতেই ইনায়া বুঝে যায় অবৈধ কোনো সম্পর্ক হয়তো হচ্ছে এখানে।ইনায়া বুদ্ধি করে মোবাইলে পুলিশের গাড়ির সাউন্ড বাজায়।গাড়ির মাঝে যেন কিছু একটা হয়। শব্দ থেমে যায়।ইনায়া গাড়িতে নক করতেই মাতাল অবস্থায় দুলতে দুলতে অর্ধবস্ত্রহীন লোকটা নিজেকে ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসে।ইনায়া দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। তাসকিনের চোখে তখন ছিল কামুকতা।সে ইনায়াকে স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে আসতেই ইনা গলার বামপাশে জোরে প্রহার করে।তাসকিন জ্ঞান হারায়।ভেতরে থাকা মেয়েটা হিল হাতে নিয়ে ছুটে পালিয়েছিলো।ইনায়া এই নোংরা মানুষটিকে নিজের সাথে নিবে না বলে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে এড্রেস দিয়ে দেয়।এমনকি ওয়াইফের পরিবর্তে সিস্টার লেখা নাম্বারে কল করে তাসকিনের কথা জানিয়ে দেয়। কেননা কোনো স্ত্রীর সামনে তার স্বামীর নোংরা চরিত্র যদি চলে আসে তবে সে স্ত্রীও খারাপ পথে কিংবা খারাপ সঙ্গে জড়াবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কিছুদিন আগে আবারো দেখা হয়েছিলো ইনায়ার সাথে তৃষ্ণার।সঙ্গে ছিল তাসকিন।তখনই তাসকিন জানতে পারে তৃষ্ণার মুখে যে সেদিনের মেয়েটা আর কেউ নয় বরং ইনায়া ছিলো। তাসকিন লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল,ক্ষমা চেয়েছিলো!
(ফ্লাসব্যাক শেষ)
ডক্টর জাহিদের কেবিনে গিয়ে ইনায়া জিজ্ঞেস করে,”ফাইল রেডি আছে?”
জাহিদ অবাক হয়।চোখ তুলে ইনায়াকে দেখে অবাকতা হারিয়ে যায়। বহুদিনের পরিচয়।এই মেয়ে একেক সময় একেক চরিত্র পালন করে।তাই জাহিদ জিজ্ঞেস করলো,
”কোন চরিত্রে এখন?”
”প্রফেশনাল”
জাহিদ মুচকি হাসে।কাউকে ফোন করে ফাইলগুলো পাঠিয়ে দিতে বলে।তারপর ইনায়াকে বলে,
”একটু বসুন ম্যাম। আপনার ফাইলগুলো আসছে”
”হঠাৎ ম্যাম বলছেন?”
”প্রফেশনাল ক্ষেত্রে আমি যদি ম্যাম না বলে যদি অসম্মান করি,তবে তো জেলেও পাঠাতে পারেন”
”জাহিদ ভাই সেটা দুই বছর আগের ঘটনা। তুমি এখনো মনে রেখেছো!”
”ভুলবো কিভাবে? যেভাবে বলেছিলি ”
ফ্লাসব্যাক,,,,,
”এক কদমও লড়বেন না?সামনে আগাতে নিলেই আই উইল বি সুট ইউ ”
মেয়েলী কন্ঠে রুখে দাঁড়ায় জাহিদ।ভয়ে ভয়ে হাত উঁচু করে পেছনে ফেরে।চমকে ওঠে।বয়স কতই বা হবে বছর বিশেক বা তার একটু বেশি।এই মেয়ের হাতে বন্দুক ভাবা যায়?জাহিদ পোড়া বাড়ীটার সামনের বাড়িটাতেই বেড়াতে এসেছে।তবে এই পোড়া বাড়ীটা নাকি রহস্যময়ী তা শুনেই এখানে আসা।তবে এভাবে ভাসবে বোঝেনি তখন সে।
”আরে আরে কি করছো?বন্দুক নামাও।এটা খেলার জিনিস না।বাসায় গিয়ে ঘুমাও।রাত বিরাতে মেয়েদের বাইরে থাকতে নেই ”
”এখন আপনার থেকে শিখতে হবে কি করবো আর কি করবো না।আর আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে তুমি করে বলার”
ইনায়া গুলি চালায় হাওয়ায়।জাহিদ ভয়ে লাভ দেয়।ইনায়ার সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকার এভাবেই। তারপরের সাক্ষাৎ ছিলো ভদ্র মোতায়েন।ইনায়া তার আচরণের জন্য সরি বলেছিলো।আর তারপর ইনায়া ভাই বানিয়েছিলো জাহিদকে।আর জাহিদও বোনের চোখেই দেখে।তাইতো এতো রিস্ক নিয়ে এতো বড় একটা কাজ করছে সে। অবশ্য এই মিশন সফল হলে দেশের অনেক চোরাই চক্রের সন্ধান মিলবে। এবং দেশে অনৈতিক ভাবে মেডিসিন বিক্রির ব্যবসাটাও থমকে যাবে।
ইনায়ার ফোন আসায় ইনায়া জাহিদের দিকে তাকিয়ে এক্সকিউস মি বলে একটু সাইডে দাঁড়ায়। সিঙ্গাপুরের এক খবরীটা কল দিয়েছে।কয়েকদিন আশিয়ানের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না।আশিয়ানকে অনলাইনে একদমই পাওয়া যাচ্ছে না। তাইতো আবারো খবরীদের এক্টিভ করা।
”ম্যাম স্যারকে থ্রেট করে এলি নামক এক মেয়ের সাথে স্যারকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে!”
”হোয়াট”
ইনায়া চেঁচিয়ে ওঠে।জাহিদ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে,”কিছু হয়েছে ইনায়া?”
ইনায়া মাথা নেড়ে না বোঝায়।তারপর লোকটাকে ধিমা স্বরে বলে,”আশিয়ান কি রাজি?”
”স্যারের ওপর মামলা করা হবে স্যার যদি বিয়েটা না করে তবে।আর তাছাড়া স্যার যখন কোমায় ছিলেন তখন এনারাই স্যারের বিজনেস টেক-কেয়ার করেছে। অবশ্য স্যার এনাদের পূর্বে অনেক বড় ফেবার করেছিলো।তবে এই লোকেরা তা ভুলে স্যারকে থ্রেট করছে!”
”আমি কি জিজ্ঞেস করছি আর তুমি কি বলছো?”
”সরি ম্যাম।তবে স্যার রাজি। শুধু মাত্র জেলে যাওয়ার জন্য নয় বরং আপনার সিকিউর লাইভের জন্যও”
”আমার লাইভের জন্য মানে?”
”ওনারা আপনাকে মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দিয়েছে”
ইনায়ার সামনে যেন বেষ্ট অফ দ্যা ফালতু জোক বলা হয়েছে পৃথিবীর।ইনায়া হাসতে হাসতে বলে,
”বনে থেকে বাঘের সাথে আর নদীতে থেকে কুমিরের সাথে লাগতে নেই-উক্তিটা হয়তো এরা ভুলে বসেছে। এদের মনে করিয়ে দেও।আমার কি আরও বলতে হবে যে কি করতে হবে?”
”নো,ম্যাম।আমি বুঝেছি”
ইনায়া ফোন রেখে হাসতে হাসতে পেছনে তাকাতেই দেখে জাহিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে।ইনায়া তা দেখে মুচকি হাসে।তবে কিছু বলে না।শুধু মাথায় একটু ম্যাসাজ করে কেননা ব্যথা করছে।জাহিদ চিন্তিত হয়ে বলে,
”কিরে মাথা ব্যথা করছে নাকি?”
”হুম, আচ্ছা ফাইলগুলো আসতে হয়তো দেরি হবে আমি উঠি।তোমার তো আরো রোগী আছে হয়তো”
”আরে কোথায় যাচ্ছিস?মা তোকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে।আর শোন আজ আর রোগী নেই।আমি আজ বেশি রোগী দেখবো না বলে আগেই অথোরিটিকে জানিয়ে রেখেছিলাম।”
চলবে?
#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ১১ ]
#বর্ষা
ফাবিহা সারওয়ার অফিসে ফাইল দেখছিলেন। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত এক নাম্বার থেকে কল পেয়ে তার হাত কাঁপতে থাকে।চোখে অশ্রুরা বাসা বাঁধে।তবে কল কেটে দেয় সে। ঠোঁট কামড়ে বড় বড় শ্বাস নেয়।আবারো কল আসে।কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বৃথা তবুও সবোর্চ্চ চেষ্টা কান্না থামিয়ে ফোন রিসিভ করে।নাম্বারটা এখনো সেভ করাই যে আছে।তবে এতোগুলো বছর পর হঠাৎ কল আসলো!
দুই পাশেই নিরবতা। নিরবতা ভেঙে ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠ শোনা গেল।ইসরাক খান বলে উঠলেন,
”আমার মেয়ের জীবন ভিক্ষা চাইছি দেবে আমায়?”
ফাবিহা সারওয়ারের অন্তর যেন কেঁদে উঠলো।ভয়েরা জেঁকে বসলো। ফাবিহা সারওয়ার ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
”কি হয়েছে ইনায়ার?”
ইসরাক খান যেন চমকালেন।তবুও স্বাভাবিক থেকে বললেন,
”আ..আমার মেয়েটা আর কয়েকদিনের অতিথি ”
”আরে যেভাবে বলেছিলে ভয় পেয়ে গেছিলাম।ইনায়া বলেছিলো ওর বিয়ে ঠিক করেছো”
ইসরাক খান এবার আর নিজেকে কান্নাভেজা কন্ঠে আটকে রাখতে পারেন না। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠেন। ফাবিহা সারওয়ার এবার সত্যিই অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।যেন আত্মা বেরিয়ে আসবে এবার। ফাবিহা সারওয়ার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন,
”ইসরাক বলো আমার মেয়ের কি হয়েছে?”
ইসরাক খান কাঁদতে থাকেন।জবাব দেন না।ইসরাক খানের কান্না দেখে এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না ফাবিহা সারওয়ার। কেঁদে দেন।বলেন,
”ইসরাক প্লিজ”
”ইনায়া ব্রেন টিউমারের লাস্ট স্টেজ।আমাকে আজই সে যে হসপিটালে টেস্ট করেছিলো সেখান থেকে ফাইলগুলো মেইল করেছে।”
ইসরাক খানের কথা শোনামাত্রই ফাবিহা সারওয়ার ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে চেয়ার থেকে পড়ে না।নিচে বসেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।মা বেঁচে থাকাকালীন মেয়ে থেকে দূরে থেকে বাঁচতে পারে,তবে মেয়ে যখন কাছে থাকে এবং মেয়ের অসুস্থতার খবর যখন মায়ের হৃদয়ে আঘাত হানে,সেই আঘাত কি করে একজন মা সহ্য করবেন!নারীরা যে কোমলমতী হৃদয়ের অধিকারীনি,বাইরে তারা যত শক্ত খোলসেই আবৃত্ত থাকুক না কেন!
”ইসরাক আমার মেয়ে কি মা..”
”খবরদার ফাবিহা ভুলেও একথা বলবে না।আমার ইনায়ার কিছু হবে না।”
ইসরাক খান ধমকে বলে ওঠেন।যদিও সে জানেন যে এখন তার সাধ্য নেই ইনায়াকে বাঁচানোর কেননা লাস্ট স্টেজ।ডক্টররা একমাসের মতো সময় দিয়েছেন।এর আগেও হারিয়ে যেতে পারে ইনায়া।ইসরাক খান নিজেকে শক্ত করে বলেন,
”ফাবিহা আমি তোমার কিংবা আমার জন্য ফোন করিনি।আমি ফোন করেছি আমার মেয়ের ইচ্ছে পূর্তিতে।আমার মেয়ে চায় একটি সুন্দর,মিষ্টি পরিবার।আমি অসম্পূর্ণ তুমিহীন আর ইশানকে ছাড়া এই পরিবার তাকে দিতে।প্লিজ আমার মেয়ের জন্য ফিরে আসো।প্লিজ”
”তুমি ইশানকে কিভাবে চেনো ”
”শুধু জেনে রাখো ইনায়াই আমাকে আমার ছেলের পরিচয় দিয়েছে! শুধু তোমার কাছে একটাই চাওয়া আমার মেয়েটার ইচ্ছে পূরণ করো”
ফাবিহা সারওয়ার আর কিছুই বলেন না।বলার আর কিছুই নেই তার নিকট।কল কেটে উঠে দাঁড়ান। বিধ্বস্ত হয়ে আছেন তিনি। ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসেন তিনি।সকাল এগারোটা বাজে।দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছোটেন।
★
ভার্সিটিতে আজকেও সেই আগের মতোই দেরি করে এসেছে ইনায়া।শরীরটা হয়তো তার দূর্বল।কেমন ফোলা ফোলা চোখ মুখ, হঠাৎ হিজাব করা শুরু!মেয়েটা ছটফট ছটফট করছে।যেন কারো আসার অপেক্ষায় সে!ইনায়া এক ক্লাস করে বের হয়ে ক্যান্টিনে যাওয়ার পথেই দেখা হয় ফাবিহা সারওয়ারের সাথে। এতো জন শিক্ষার্থীর সামনেই ইনায়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন।
ইশান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার মা কিভাবে? কিভাবে ইনায়ার সাথে ভালো ব্যবহার করছে,জড়িয়ে ধরছে তা ভেবে পায় না।ইশান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।
ফাবিহা সারওয়ার ইনায়ার গালে হাত দিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন,
”ইনায়া কি শুনছি আমি এগুলো ”
”কি শুনছেন”
”তো..তোমার নাকি ব্রেন টিউমার?”
”হুম।লাস্ট স্টেজ ”
ইনায়া প্রশস্ত হেসে উত্তর দেন। ফাবিহা সারওয়ার আবারো জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে।ইনায়ার চোখে তখন অন্যরকম কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে।ইশান অবাক হয়ে গেছে মায়ের কথা শুনে।ছুটে এসে মা’কে ইনায়ার থেকে ছাড়িয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
”মম তুমি তুমি কি বললে…ইনায়ার ইনায়ার কি হয়েছে?এই ইয়ু বল”
ইশান মা’কে ছেড়ে ইনায়া ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে। ইনায়া মুচকি হাসে।এই হাসি যেন সাধারণ হাসি নয় বরং রহস্যঘেরা হাসি।ইনায়া ইশানকে ছাড়িয়ে অনেকটা পিছিয়ে যায়।বলে,
”জ্বি,তোর মম ঠিকই বলেছে।আমি আর কয়েকদিনের অতিথি তোদের কাছে”
ইশান যেই ছেলেটা ইনায়াকে কয়েকদিন যাবৎ বড্ড অবহেলা করেছে সেই ছেলেটাই আজ বোনের এদশা শুনে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কাঁদতে শুরু করে।অভিমান কি শুধু মেয়েরা করতে পারে!ছেলেরাও পারে।ইশান অভিমানের বসে নিজের রাগকে প্রকাশ করেছিলো এতদিন।তাই ইশান রাগের বসে নিজের চুল টেনে ধরে।ইনায়া ইশানকে দাড় করিয়ে চোখ মারে।ইশান অবাক হয়ে যায়।ইনায়া ইশানকে একটু উঁচু হয়ে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলে।তবে এতক্ষণে এখানে একটা মেলোড্রামা হচ্ছে আর সেখানে দর্শক থাকবে না তা হয়! হয় না।
”অনেক ড্রআমআ হয়েছে এখানে এখন চলো এখান থেকে”
ইনায়ার কথায় ইশান ইনায়াকে ধরতে নিলে রিনি করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। ফাবিহা সারওয়ার তা দেখে মুচকি হেসে রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
”আরে পাগলি ননদীর সাথে হিংসে করো না। ইশানের বোন ইনায়া।বুঝলে”
রিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।যখন বুঝতে পারে সে কি বুঝে কি করে ফেলেছে তখন আফসোস করে নিজের বুদ্ধিহীনতার কারণে। অবশ্য যেকোনো মেয়েই তার পুরুষের জন্য জেলাস হবেই।তা সেই পুরুষটা ওনাকে ভালোবাসে কিংবা না বাসে।নারী জাতি তার শখের পুরুষের জন্য ছ্যাচড়া পদবীটা গ্রহণেও কখনো পিছপা হয়না।
★
আশিয়ান এয়ারপোর্টে এসে ঝামেলা করছে।চোখ তার ছলছল করছে।যেন এখনই বাচ্চার মতো কান্না করা শুরু করবে। আশিয়ান আগেই টিকেট বুক করেছিলো।তবে এনারা নাকি ইমার্জেন্সিতে টিকেট অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছেন। কালকের ফ্লাইট ছাড়া আজ আর ফ্লাইট নাই। আশিয়ানের নিকট যেন এখন এক একটি মুহূর্ত এক যুগের সমান।আশিয়ান এয়ারপোর্টেই বসে পড়ে।চোখ মুখ মুছতে থাকে।তখনই হঠাৎ একটা ফোন এগিয়ে দেয় কেউ তার দিকে।
”স্যার,প্লিজ ম্যামের সাথে একবার কথা বলুন”
আশিয়ান লোকটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয় আবার পুরোপুরি অবাক হয় না বললেও চলে কেননা লোকটা তাকে বহুদিন ফলো করে।আশিয়ান ফোন কানে দেয়।
”এইযে পাগল প্রেমিক,ফোন ফেলে কোথায় ছুটেছেন?একবার ফোন করবেন তো”
ইনায়ার কন্ঠস্বর কানে ভাসতেই আশিয়ান যেন আরো ভেঙে পড়ে।যেই মেয়ে ওকে এতবড় সমস্যা থেকে উদ্ধার করেছে। সেই মেয়ের নিকট নাকি আর কয়েকদিনের সময় আছে মাত্র। কিছুক্ষণ আগেই তার কাছে কয়েকটা ছবি পাঠানো হয়েছে।ইনায়ার রিপোর্ট আর কি হয়েছে তা ডক্টর আশিয়ানকে জানায়।আশিয়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। কেননা কাল যে মেয়ে থ্রেটের ওপর থ্রেট দিয়ে আশিয়ানকে বাঁচিয়েছে,ঠিক সেই মেয়েই নাকি এখন এতো দূর্বল হয়ে পড়েছে যে কয়েকদিনের ব্যবধানে পৃথিবী ছাড়বে!
”জান আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,তুমি আমায় কেন জানাওনি এতবড় সত্য?জান আমার কষ্ট হচ্ছে।জান আমি তোমায় ছাড়া মরে যাবো ”
”এই যে পাগল শুনুন,আমাকে ভরসা করেন?”
”হুম”
”তাহলে শুনুন আমি যা বলছি।মন দিয়ে শুনবেন কিন্তু”
”বলো”
”আমি…..”
আশিয়ান কাঁদতে কাঁদতেও হেঁসে দেয়।আশিয়ান কল কেটে লোকটার হাতে ফোন ফেরত দেয়।আশিয়ান কান্নার মাঝেই হাসতে হাসতে চুলগুলো এলোমেলো করে আঁকাবাঁকা হেঁটে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে।গাড়িতে উঠে ফোনটা হাতে নেয়।এলির ম্যাসেজ,,,,
”প্লিজ সে হার টু ফরগিভ মি”
আশিয়ানের কালকের কথা মনে পড়ে যায়।আশিয়ান বারে ড্রিংক করছিলো।তখন এলি এসে আশিয়ানের ব্যবহার করার চেষ্টা করে কেননা আশিয়ান মাতাল হয়েছিল।তখনই ইনায়ার কয়েকজন লোক এসে ইচ্ছে মতো মারধর করে এলিকে।আর ভয়ংকর এক থ্রেট দেয়।যাতে এলি এবং এলির বাবা ভয়ংকর রকম ভয় পেয়ে যায়। অবশ্য এলি এখন হসপিটালাইজড কেননা মারের পরিমাণ অনেক বেশিই ছিল।আশিয়ান বাড়ি গিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে চারপাশে তাকায়। ইনায়ার ছবিতে ভরপুর কক্ষটা। হাস্যোজ্জল ছবিগুলো দেখে মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলতে থাকে,
”তুমি আমার সেই ভালোবাসা যার শুরুতে আমি নই,তবে যার সাথে জীবনের শেষটা অব্দি থাকতে চাই।তোমার স্মৃতিগুলো আমার তখনকার,যখন তুমি আদৌ ছিলে না আমার।তুমি আমার আসক্তিময় ভালোবাসা,যেই ভালোবাসায় তোমার এই ভয়াবহ প্ল্যানগুলো বারবার আমায় আঘাত করে তোমার অজান্তেই।তবে তোমার দুষ্টু-মিষ্টি ভালোবাসা বারবার আমায় আমার মাঝেই গুলিয়ে দেয়।”
চলবে?