#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ৮ ]
#বর্ষা
ইনায়া গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রক্ত যেন চোখে উঠেছে।এতো পরিমাণ লাল তার চোখজোড়া যা অন্তরে ভয় ঢোকাতে যথেষ্ট।ইনায়া ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে ফাবিহা সারওয়ারের দিকে। ফাবিহা সারওয়ার চেঁচিয়ে বলেন,
”তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে উল্টা পাল্টা কথা বলার?কতটুকু জানো তুমি আমার সমন্ধে?”
ইয়ানা গাল থেকে হাত সরিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
”আপনার ব্যাপারে যতটুকু আগে জানতাম সব ভুল জানতাম!আমি তো শুনেছিলাম মায়েরা নাকি সন্তানদের গন্ধে তাদের চিনতে পারে!কই আপনি তো চিনলেন না?”
ফাবিহা সারওয়ার আরচোখে তাকিয়ে বলে,
”কি বলতে চাইছো তুমি?কে তুমি?”
”আমি ইনায়া সেহরিশ খান ডটার অফ ইসরাক খান ”
ফাবিহা সারওয়ারের চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।হাত আগে বাড়িয়ে দিতে গিয়েও বাড়ায় না।ঢোক গিলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।ইনায়ার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
”তা তোমাকে আমার সমন্ধে এগুলো তোমার বাবা বলেছে!ভালোই বলেছে ওর থেকে আর কি আশা করা যায়!প্রতারক”
ইনায়া এতক্ষণ নিজের জন্য করা প্রত্যেকটা অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে কেননা সে চায় না নিজের হাতেই আবারো সব শেষ করতে।তবে প্রাণপ্রিয় পিতার অপমান কখনোই সহ্য করা যায় না।
”স্টপ ইট মিসেস ফাবিহা সারওয়ার,জাস্ট স্টপ ইট।আমার পাপাইকে প্রতারক বলার সাহস হয় কি করে আপনার?নিজেই তো অন্য পুরুষের হাত ধরে ইশানকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন!আবার আমার পাপাইকে বলছেন প্রতারক!তা আমার পাপাইয়ের থেকে কি বেশি দিয়েছে ওই লোকটা?”
ইনায়ার গালে আবারো চড় লাগায় ফাবিহা সারওয়ার। তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
”বাহ,তোমার বাবা তো তোমাকে অনেক সুন্দর শিক্ষা দিয়েছে?বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও তো শেখাতে পারেনি ”
”ইনায়া সেহরিশ খান মানুষ বুঝে কথা বলে।যে যেমন আচরণ করে,সে ঠিক তেমন আচরণই ফেরত পায় ইনায়ার থেকে।মাইন্ড ইট”
”ইনায়া…”
”চিৎকার করবেন না মিসেস ফাবিহা সারওয়ার ”
”মা’কে নাম ধরে বলতে লজ্জা করছে না”
”যে নারী তার তিনমাসের বাচ্চা ফেলে চলে আসতে পারে তাকে অন্তত ইনায়া মা বলে মানে না।আপনি ইশানকে নিয়ে আসতে পারলেন,তবে ইনায়াকে আনতে পারলেন। অসাধারণ ”
”ইনায়া তুমি আমাকে ভুল বুঝছো”
”তাহলে আমাকে সঠিক ভাবান ”
”আমি চাই না তোমার নিকট তোমার পাপাই ছোট হোক!”
ইনায়া মাথায় হাত দিয়ে এদিক ওদিক কয়েকবার তাকায়।তারপর ঠোট কামড়ে হাসে।মাথা দু’দিকে ঝাঁকিয়ে বলে,
”আপনি তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন পাপাইকে।সেই ভালোবাসার মূল্যায়নেই অন্তত পক্ষে পি.এ. জেনির কথা মেনে না নিয়ে পাপাইয়ের কথা মেনে নিতে পারতেন।অন্তত পক্ষে তাহলে আমার আর ইশানের জীবনটা এমন হতো না।একটা হাসিখুশি মিষ্টি পরিবার থাকতো”
ফাবিহা সারওয়ার অবাক নয়নে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
”তুমি এগুলোও জানো?”
”সবই জানি।তবে একটা বিষয় বুঝলাম না আপনার চিন্তা অনুযায়ী পাপাই প্রতারক হলে আপনিও তো তাই। আপনি তো সত্যিকারই কোনো এক পুরুষের হাত ধরে চলে এসেছিলেন, ইশানের ডেড বলে পরিচয় করিয়েছেন।আমার পাপাই তো এমন কিছু করেনি।”
”ইনায়া আমি ফ্রড নই। একজন ভাইয়ের হাত ধরে বোন হিসেবে আমি বেরিয়েছিলাম।”
ফাবিহা সারওয়ারের কন্ঠে তীব্র ব্যথা ইনায়া অপলব্ধি করে। ইনায়ারও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।সে তো এতো আগে কিছু এক্সপোস করতে চায়নি।সে তো সব প্রশ্নের উত্তর আগে জানতে চেয়েছিলো।তবে বাধ্য হলো।ইশান যে যোগাযোগ বন্ধ করেছে তার সাথে।ভাইয়ের রুক্ষ ব্যবহার তাকে পড়াচ্ছে। তাইতো আজ ফাবিহা সারওয়ারের অফিসে এসেছে ইনায়া।কেবিনে বসেই মা-মেয়ে কথাগুলো বললো।সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ার সুবিধার্থে কথোপকথনগুলো ঘরের মাঝেই সীমাবদ্ধ।প্রথমের চড়টা ইনায়া খেয়েছিলো ফাবিহা সারওয়ারের অফিসে আসার জন্য।আর দ্বিতীয় চড়টার কারণ আমরা সকলেই জানি।
”আজ চলি”
”ইনায়া আজ বাসায় আসবে”
”কেন?”
”মেয়ের সাথে গল্প করার আছে।মায়ের কথা মেয়ে রাখবে?”
”মেয়ে মনে করলে ফেলে এসেছিলেন কেনো সেদিন?”
”বাসায় এসো তোমাকে অনেক কিছুই দেখানোর আছে”
ইনায়া বেরিয়ে আসে। পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে অনেক কাঁদে।জীবনটা সে সিরিয়াস কখনো নেয়নি কেননা জীবনের বাস্তবতা কাদায়।তাইতো সবার সহিত এতো প্রাণবন্ত ইনায়া থাকলেও একান্তে জীবনটা বারবার কাদে।সবাই তো চায় একটি হাসি খুশি মিষ্টি পরিবার।তবে ইনায়ার ভাগ্যে পিতার ভালোবাসা থাকলেও মাতার ভালোবাসা জোটে নি।আবার ইশানের কপালে মায়ের ভালোবাসা থাকলেও বাবার ভালোবাসা জোটে নি। সে সবই বোঝে কিন্তু এখনো যে সত্যি সব তার সামনের আসেনি।প্রমাণগুলো এখনো অগোছালো।আগে যে সব কালেক্ট করতে হবে তারপর না…
★
আশিয়ান সিঙ্গাপুর নেমেছে অনেকক্ষণ।শরীরটা ওর ম্যাজম্যাজ করছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে চাইছে।রুমান কিছুই বুঝতে পারছে না যে কি হচ্ছে।দ্রুত এয়ারপোর্ট ডক্টরের সরণাপন্ন হয় ওরা।ডক্টর একটু চেক করেই বলে দেয় কেউ কিছু ইনজেক্ট করেছে আশিয়ানের শরীরে।হাত ছোট্ট একটি ছিদ্র।এতো ছোট ছিদ্র সুচ দিয়েই সম্ভব।ডক্টরের পরামর্শ এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছোটে ওরা।
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে মাস্ক দাঁড়া আবৃত মুখের কেউ একজন হাসছে। অট্টহাসি। কয়েকজন ফিরে তাকিয়েছে।তবে মানুষটা আর লক্ষ্য করতে পারেনি।আকা বাঁকা কদম ফেলে বেরিয়ে গেছে এয়ারপোর্ট থেকে। বিড়বিড় করে বলছে,
”যাকে আমি ভালোবাসি,তাকে আমি না পেলে আর কেউ তাকে পাওয়ার ক্ষমতা রাখে না ”
আশিয়ানের পিছুপিছু নিজেই সেই রাস্তার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।সে চলে যেতেই এয়ারপোর্টে আড়ালে লুকিয়ে থাকা কেউ ফোন দেয় কাউকে।খুব ধীমে গলায় বলে,
”ম্যাম স্যারকে একটা মেয়ে ইনজেকশন পুশ করেছে যার ফলে স্যারের অবস্থার অবনতি হতো”
”তুমি কি করছিলে তখন…এক সেকেন্ড হতো মানে?”
”ম্যাম আমি মেয়েটার মতিগতি হালকা বুঝতে পেরেছিলাম তাই ওই মেডিসিন রিমুভ করে তাতে পানি দিয়েছিলাম।আর পানি পুশের কারণেই হয়তো এখন তার একটু খারাপ লাগছে।”
”দোয়া কর তাই যেন হয় নয়তো তোমার খবর আছে।আর আমার ভয়ে যদি ফোন অফ করো সমস্যা নেই।আমার আসল রাজস্ব কিন্তু সিঙ্গাপুর ভুলে যেও না”
লোকটা ভয়ে ঢোক গেলে।খবর দিতে গিয়েও বিপদ সংকেত পেলো।খবরির কাজটা করে বেশ টাকা নয়তো কি আর এনার হয়ে কেউ খবরির কাজ করে। মানুষের শখ অব্দিই আছে এনার হয়ে কাজ করার। কিন্তু যারা কাজ করে তারা রেহাই খোঁজে।
আশিয়ানকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই স্বাভাবিক অনুভব হয় তার।বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কিছু টেস্ট করে।বাড়ি ফিরে ইনায়াকে কল দেয়।তবে প্রেয়সীর নিকট খুব সুক্ষ্ণ ভাবে গোপন করে তার অসুস্থতার কথাগুলো।
”জান আমি বাড়িতে পৌঁছে গেছি।”
”আমি জানি”
”কিভাবে?”
”সিক্রেট,তবে শুনুন এখন রেস্ট করুন।আমি পরে কল দিবনি ”
”আমার রেস্টের প্রয়োজন নাই। তুমি কি আমায় ইগনোর করছো”
”ধুর পাগল।আমি তো আপনার কথা ভেবেই বললাম।শুনুন একটা কথা বলি”
”বলো জান”
”ভালোবাসি”
”কাকে?”
”বুঝেও যে অবুঝ তাকে ”
ইনায়া কল কেটে দেয়।মোবাইলটা জড়িয়ে রাখে।কিছু একটা ভেবে তার মুখের হাসিটা দীর্ঘ স্থায়ী আর হয়না।ইনায়ার কাছে হসপিটাল থেকে কল আসে।আড়ালে দাঁড়ায়।ফোন রিসিভ করে,
”রিপোর্টে অবস্থা বেশি ভালো না,দ্রুত অপারেশন করতে হবে।তাও বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র দশ পার্সেন্ট ”
”অপারেশন না করালে কতদিন সময় আছে”
”একমাস অথবা পনেরো দিন”
”ওহ,ঠিক আছে”
”পরিবারকে জানালে হয় না?ব্রেন টিউমারের লাস্ট পর্যায় এটা।আরো আগে জানলে হয়তো বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকতো!প্লিজ পরিবারকে জানাও”
”আমাকে বলতে হবে না।আপনি আর কোনো চিকিৎসায় বাঁচানো সম্ভব কিনা!তা খোঁজেন”
ইনায়া ফোন রেখে দেয়। চোখজোড়া ছলছল করছে।সামনে তাকাতেই দেখতে পায় ইশান রিনির সাথে কোথাও একটা যাচ্ছে।কি হাসিখুশি দুজন! থাকুক না নিজেদের মতো ইনায়াও পারবে ভাইকে ছাড়া একলা চলতে।আর তো কয়েকটা দিন তারপর তো আর ফিরবে না সে এদেশে।না ফেরার দেশ হবে এটা!
ইনায়া ক্লাসে গিয়ে আশিক,রুমানার পাশে বসে।আশিক ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে। কেননা এই মেয়ে ভার্সিটিতে আসলেও তাকে সহজে ক্লাসে টানা কয়েকদিন দেখা ভারী মুসকিল।তবে আজ চারদিন যাবৎ সে গোছালো হয়েছে।ক্লাস করছে।
”কিরে তোর শরীর খারাপ নাকি আজ চারদিন টানা ক্লাস করছিস?”
”আর কয়েকটা দিনই তো,তারপর তো সারাজীবনের জন্য চলে যাবো।তাই এখান থেকেই নিজেকে একটু গোছানোর চেষ্টা ”
রুমানা উত্তর পেয়ে কেন যেন খুশি হতে পারে না। কেননা বন্ধুকে ছাড়া তারা থাকবে কিভাবে! বন্ধু যদি বিদেশ গিয়ে ভুলে বসে তাদের তখন কি হবে! রুমানার পাশপাশি পূর্ব থেকেই ইনায়ার মন খারাপ দেখে আশিক হাস্যকর অনেক কথা বলে।হেসে দেয় দুজনকেই।স্যার প্রবেশ করায় থেমে যায় ওরা সহ ক্লাসের বাকি সবাই।
চলবে?