প্রেমের বৈঠা গেছে খুলে পর্ব-০৫

0
684

#প্রেমের_বৈঠা_গেছে_খুলে (০৫)

#নূন_মাহবুব

-” অঙ্কন ভাই তোমার নিজের ছেলে না।তার সাথে তোমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই তাই না বড়মা?”

-” কি সব আবোল তাবোল বকছিস অজান্তা? বাবু আমার নিজের ছেলে।তোকে এসব কথা কে বলছে ?”

-” এই কাগজ টা।জানো এটা কিসের কাগজ? জন্মনিবন্ধনের কাগজ। যেইখানে অঙ্কন ভাইয়ের নামের জায়গা অঙ্কন চৌধুরী নয়, অঙ্কন তালুকদার দেওয়া।আর বাবা তুহিন তালুকদার আর মা নাজমা তালুকদার।আজ যখন তুমি আর দাদীমা গল্প করছিলে তখন সবটা শুনেছি আমি।তখন‌ই আমার মনে সন্দেহ জাগে।আর এই লকারের সমস্ত জিনিস অঙ্কন ভাইয়ের সেইটা আমি আগে থেকেই জানতাম।তাই তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে আমি লুকিয়ে তোমার থেকে চাবি নিয়ে এই তালাবদ্ধ ঘরে এসেছিলাম।ব্যাস এইখানে এসে দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে গেল। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে গেল। এরপর ও তুমি নিশ্চয় বলবে না যে অঙ্কন ভাই তোমার নিজের ছেলে।”

-” হ্যাঁ বাবুর সাথে আমার র’ক্তে’র কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু নিজে জন্ম না দিলে কি মা হ‌ওয়া যায় না?সেই ছোটবেলা থেকে বাবু কে আমি মাতৃস্নেহ দিয়ে বড় করেছি। আমি ভাবতে ও পারি না বাবু আমার রক্ত নয়।”

-“কিন্তু তুমি বড় বাবা চায়লেই তো অঙ্কন ভাই কে দত্তক নিতে পারতে?”

-” তোর বড় বাবার সাথে আমার রিলেশন করে বিয়ে হয়।যা তোর দাদু মানলেও দাদীমা মেনে নিতে পারেনি।পরে সে শর্ত দেয় আমি যদি বিয়ের বছরেই তার বংশের প্রদীপ জ্বালাতে পারি তাহলে সে আমাকে মেনে নেবে।আমাকে ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে হবে। কিন্তু সাত বছর চেষ্টার পরেও কোন সন্তানের মুখ দেখতে পারি নি আমি।কতো ডক্টর কবিরাজ দেখিয়েছি । কিন্তু দিনশেষে শূন্য হাতে ফিরেছি। অবশেষে অষ্টম বছরে আল্লাহ আমার দিকে মুখ তুলে চান। আমি কনসিভ করি। কিন্তু প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল। যেদিন আমার ডেলিভারির ডেট ছিলো, সেদিন হঠাৎ ইমতিয়াজদের জরুরী একটা কাজ পড়ে যায়। অবশ্য ইমতিয়াজ যেতে চায় নি। আমি আম্মার উপর ভরসা করে ইমতিয়াজ কে জোর করে পাঠিয়েছিলাম। এইটুকু বলে থামলেন নাতাশা চৌধুরী।”

-” তারপর কি হলো বড় মা?”

-” আমাকে ওটিতে নেওয়া হলো। আমার মেয়ে হয়েছিলো । কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল আমার ছেলে সন্তান হয়েছে।তবে জীবিত নয়,মৃত সন্তান। প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়ি আমি। কিছু দিন পরে যখন সুস্থ হয় তখন ডক্টর জানিয়ে দেয় আমি কখনো মা হতে পারবো না। একথা শুনে তোর দাদীমা ইমতিয়াজ কে বলে আমাকে ডিভোর্স দিতে। কিন্তু ইমতিয়াজ আমাকে ডিভোর্স দেয় না।এতে আম্মা ইমতিয়াজের উপর ও রেগে যায়।”

-“তারপর?”

-” আমরা কুসুমপুর এতিমখানার সন্ধান পাই। সেখানে গিয়ে বাবু কে মনে ধরে আমার। আমি তাকে দত্তক নিতে চাই। কিন্তু তোর দাদীমা নিতে নারাজ ছিলো।তার এক কথা দত্তক নিলে ঐ ছেলের ঠাঁই হবে না চৌধুরী মঞ্জিলে।আম্মার কথা অনুযায়ী বাবু কে দত্তক নিতে পারি না।বাবু তখন বাচ্চা ছেলে ছিলো। কিছু বোঝার বয়স হয় নি তখন।ও জানে আমরাই ওর বাবা মা। কিন্তু এখানেই থেমে থাকে নি। বাবু কে চৌধুরী মঞ্জিলে আনার পর এতটুকু বাচ্চাকে বারবার প্রাণে মে’রে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।কে বা কারা এমন করেছে আমরা বুঝতে ও পারি নি‌।পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে বাবু কে কানাডা পাঠিয়ে দেই আমার বোনের কাছে।আর বাবু বিডি তে ফেরার সময় তো তুই চৌধুরী মঞ্জিলে ছিলি।এর পরের ঘটনা তোর অজানা নয়।

-” হ্যাঁ। কিন্তু একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”

-” কোন বিষয়?”

-” স্কুল কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় তো বিভিন্ন কাগজপত্র লাগে‌। সেইখানে ও অঙ্কন ভাই তার আসল বাবা মার নাম দেখে নি?”

-” আমরা টাকা দিয়ে নকল কাগজ পত্র বানিয়ে ছিলাম। যেইখানে আমার আর তোর বড় বাবার নাম ছিলো।তোর কাছে একটা অনুরোধ তুই বাবু কে এই বিষয়ে কিছু বলবি না। কিছু কথা না হয় অজানাই থাক।”

-” তুমি চিন্তা করো না বড়মা। আমি অঙ্কন ভাইকে কখনো এই বিষয়ে কিছু বলবো না।”

-” নাতাশা চৌধুরী অজান্তার কপালে চুমু দিয়ে বললো,লক্ষী মেয়ে আমার।”

___________________________________

-” রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে,এখনো বাবু ফিরলো না।ফোনটা ও বন্ধ বলছে।জানি না কোথায় আছে এই ছেলেটা ?”

-” তুমি শুয়ে পড়ো বড়মা।আমি আছি তো।আমি অপেক্ষা করছি অঙ্কন ভাইয়ের জন্য।”

-” ঠিক আছে। তুই খেয়ে নে ।আর বাবু আসলে খাবার দিস।”

-” হ্যাঁ রে বাবা দিবো। তুমি যাও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।”

-” আচ্ছা যাচ্ছি আমি।”

-“অজান্তা না খেয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে রেখে এসে সোফায় বসে অঙ্কনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষা করতে করতে সবে অজান্তার চোখ লেগে এসেছে এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে।অজান্তা দরজা খুলে দেখে অঙ্কন এসেছে। কিন্তু তাকে অনেক বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। এলোমেলো চুল, গায়ে পরিধানকৃত শার্ট ও এলোমেলো , লাল চোখ,মনে হচ্ছে কান্না করার ফলে এমন হয়েছে। অঙ্কন দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, এখনো ঘুমোস নি কেন?”

-” ছিঃ ছিঃ ছিঃ! অঙ্কন ভাই আপনি সিগারেটে খেয়েছেন?এতো টা অধঃপতন ঘটেছে আপনার?”

-” মাই লাইফ মাই রুলস । আমার যা খুশি তাই করবো।তোর কোন প্রবলেম আছে?আর তোর প্রবলেম থাকলে ও আমার কিছু যাই আসে না বলে অজান্তা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের রুমে চলে যায় অঙ্কন।”

-” অজান্তা দরজা বন্ধ করে দিয়ে কিচেনে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত করে নিয়ে আসে অঙ্কনের জন্য। কিন্তু রুমে এসে দেখে অঙ্কন রুমে নেই।তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছেন। অজান্তা সোজা গিয়ে অঙ্কনের ঠোঁট থেকে সিগারেট টান দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে বলে,কি সমস্যা আপনার?”

-” তোর সব জিনিসপত্র আমার রুমে কেন?”

-” তো কোথায় থাকবে?”

-” আই ডোন্ট নো।”

-“আপনি হয়তো জানেন না । কিন্তু আমি ঠিকই জানি।বরের জিনিসপত্র যেইখানে থাকবে ,ব‌উয়ের জিনিসপত্র ও সেইখানে থাকবে এটাই স্বাভাবিক তাই না?”

-” অঙ্কন কিছু বলার আগেই অজান্তা বললো, অন্য ছেলেরা অফিস থেকে ফিরে ব‌উকে জরিয়ে ধরে ক্লান্তি দূর করে। কিন্তু আপনি তো সাধু সন্ন্যাসী।ব‌উয়ের ধারেকাছে ও ঘেঁষবেন না।তাই আপনার জন্য ঠান্ডা শরবত করে এনেছি।নিন শরবত পান করে কান্তি দূর করুন।”

-” নো নিড।”

-” অবশ্যই প্রয়োজন আছে।”

-” তুই কিন্তু একটু বেশি বকছিস অজান্তা। আমার সামনে থেকে যা নয় তো একদম গু’লি করে মাথার খু’লি উড়িয়ে দিবো।”

-” থাক ভাই খু’লি উড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি ফ্রেশ হন,আপনি উপরে আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

-“অজান্তা খাবার নিয়ে এসে দেখে অঙ্কন শাওয়ার নিয়ে লুঙ্গি পরেছে।যা দেখে অজান্তার হাসি কিছুতেই থামছে না।অজান্তা কে হাসতে দেখে অঙ্কন ধমক দিয়ে বললো, ফ্রিতে সার্কাস দেখেছিস নাকি?”

-” আপনি লুঙ্গি পরেছেন?আগে তো কখনো আপনাকে লুঙ্গি পরতে দেখি নি।”

-” কেন তুই কি চোখে কম দেখিস ? লুঙ্গি আমি প্রতি রাতেই ঘুমোতে যাওয়ার আগে পরি। তুই নিশ্চয় আমার সাথে ঘুমাস না যে তাই দেখতে পাবি।আর গরমকালে লুঙ্গি মানেই এসি। লুঙ্গি থাকলে এসি চালানোর কোন প্রয়োজন হয় না।এখন বেশি কথা না বলে খাবার রাখ ,আর বিদায় হ।”

-” অজান্তা অঙ্কন কে খাবার দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।সে ও রাতে খায় নি।মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে ক্ষুধায় হরতাল শুরু হয়ে গিয়েছে।অজান্তা ভাবছে, আমাকে একটু খাইয়ে দিলে অঙ্কন ভাইয়ের কি জাত মান চলে যেতো?অজান্তার মুখের কথা মুখে থাকতেই অঙ্কন জিজ্ঞেস করলো, রাতে খেয়েছিস তুই?”

-“ব্যাস এইটুকু কথায় অজান্তার মনে যেন প্রেমের বৈঠা বয়তে শুরু করলো।অজান্তা অনেক টা অভিমানী স্বরে বললো, আমার ক্ষুধা নেয়।”

-” আমি জিজ্ঞেস করেছি খেয়েছিল কি না? ক্ষুধা আছে কি নেই এটা জিজ্ঞেস করি নি।”

-” বেশ অপমান বোধ করে অজান্তা।অজান্তা ভাবছে রুম থেকে বেরিয়ে যাবে । কিন্তু তার আগেই অজান্তা কে অবাক করে দিয়ে অঙ্কন এক লোকমা খাবার অজান্তার মুখের সামনে তুলে ধরে।যা দেখে খুশি তে অজান্তার চোখে পানি চলে আসে।অজান্তা আবেগে আপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,আমাকে ভালোবাসেন অঙ্কন ভাই?”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে