#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ১৩(বোনাস পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধ্রুব আজ অহনা খন্দকারের মুখোমুখি। স্বীয় মায়ের থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব চাই তার৷ রাগে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেছে। ধ্রুবর পানে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলেন অহনা খন্দকার। কিন্তু খুব সহজেই নিজেকে সামলে নিলেন। প্রস্তুত হলেন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার।
ধ্রুব তার মাকে রাগী কন্ঠে সুধালো,
‘কেন এমন করলে তুমি আম্মু? নিজের অতীতের জন্য তুমি আমাকে আর সুহাকে আলাদা করলে! এমনটা করে কি লাভ পেলে তুমি?’
‘বেটা আমার কথা শোনো।’
‘আর কি শুনব আম্মু? তোমার আর কি বলার আছে?’
‘আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি বেটা। আমাকে সুহানির কাছে নিয়ে চল বেটা, আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো। যাতে সবটা আবার স্বাভাবিক হয়।’
‘কি স্বাভাবিক হবে আম্মু? তুমি কি পারবে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ৬ টি বছর ফিরিয়ে দিতে? নাকি আমাদের কষ্টের দাম দিতে পারবে? ভাগ্য ভালো আমরা দুজনেই এখনো অবিবাহিত। যদি সুহানি বা আমার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যেত তখনো কি তুমি সব ঠিক করতে পারতে?’
অহনা খন্দকার কুমিরের কান্না শুরু করেন। বলতে থাকেন,
‘স্বার্থপরতা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল বেটা। আমি ঠিক ভুলের সমীকরণ টা বুঝতে পারিনি। একবার শুধু আমায় সুহানির কাছে নিয়ে চলো৷ আমি প্রয়োজনে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবো।’
ধ্রুব হতবিহ্বল হয়ে তাকায় নিজের মায়ের দিকে। তার অভিব্যক্তিই এমন ছ যে কেউ ধারণা করতে পারবে না এটা সত্য নয় অভিনয়। ধ্রুবও পারলোনা। বরঞ্চ অহনা খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘আমি সুহাকে নিজের সাথেই নিয়ে এসেছি। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হয়তো অনেক জোর করতে হবে ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ানোর জন্য। কিন্তু থ্যাংকস গড যে, তুমি সবটা নিজ থেকেই বুঝতে পেরেছ। এখন আমি অনেক রিলিফ ফিল করছি।’
‘আমি এক্ষুনি সুহানির কাছে যাচ্ছি। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আমায়।’
কথাটা বলেই অহনা খন্দকার নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। চোখের জল মুছে বলেন,
‘মাঝে মাঝে বৃহৎ স্বার্থে এমন ছোট ছোট ত্যাগ মেনে নিতেই হয়। আমিও নাহয় আজ ঐ সুহানির কাছে ক্ষমা চাইলামই! কিন্তু এত সহজে সুহানিকে সুখী হতে আমি দেবো না। একবার শুধু পরিস্থিতিকে আমার ফেভারে আসতে দাও তারপর আমিও সবকিছুর হিসাব নেবো।’
ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ড্রয়িংরুমে চলে আসেন অহনা খন্দকার। সোফায় বসে অপেক্ষমাণ থাকা সুহানি তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। অহনা খন্দকার প্রস্তুত হন নিজের ইগোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। সুহানির সামনে এসে নিজের মনের সাথে ল’ড়াই করে তার সামনে হাতজোড় করে বলেন,
‘আমাকে ক্ষ’মা করে দিও সুহানি। আমি অতীতে তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তোমাকে অনেক বা’জে কথা বলেছি, ধ্রুবর থেকে তোমাকে দূরে যেতে বলেছি। সত্যিই আমি মা হিসেবে অনেক খারাপ। আমার ছেলেটা এতগুলো দিন শুধুমাত্র আমার জন্য অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। আমি অতীত তো বদলাতে পারব না কিন্তু আজ মন থেকে নিজের কৃতকর্মের জন্য হাতজোড় করে তোমার থেকে ক্ষমা চাইছি। পারলে আমায় মা’ফ করে দিও। আর ফিরে এসো আমার ধ্রুবর জীবনে। ওর জীবনটা আবার রঙিন করে দাও।’
সুহানি আজ প্রাণোচ্ছল হাসি দেয়। হৃদয় জুড়িয়ে দেয় সেই হাসি। আজ যেন সে এতদিনের এত গ্লানি এত অপমানের প্রলেপ পেল। তার মন থেকে আজ বড় একটা বোঝা হালকা হলো। সুহানি অহনা খন্দকারের হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলল,
‘আমার মনে আপনার জন্য আর কোন অভিযোগ নেই। আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন ক্ষ’মাশীল হতে। শুধু তাই নয়, তিনিই আমাকে বলেছিলেন কোনদিন যদি আপনি আমার কাছে ক্ষমা চান তাহলে যেন আমি আপনাকে মাফ করে দেই। আমি সেই কথা মেনে নিয়েছিলাম। তাই আজ মন থেকে মাফ করলাম আপনাকে। এখন ধ্রুবর জীবনে ফিরে আসতেও আমার আর কোন বাঁধা নেই।’
অহনা খন্দকার সুহানিকে আলিঙ্গন করেন। বলেন,
‘আজ আমার সত্যি খুব শান্তি অনুভব হচ্ছে।’
কিছু সময়ের মধ্যে ধ্রুবও চলে আসে সেখানে। সুহানি ও অহনা খন্দকারকে এভাবে দেখে সে অনেক খুশি হয়। তবে অভিমানী সুরে বলে ওঠে,
‘বাহ, নিজের ছেলেকে ফেলে হবু বৌমাকে আদর করা হচ্ছে।’
অহনা খন্দকার বলে ওঠেন,
‘তুমিও চলে আসো, হিংসুটে কোথাকার।’
অতঃপর ধ্রুবও এসে জড়িয়ে ধরেন তাকে। সবার একাগ্রতায় খুব সুন্দর একটি দৃশ্যের সাক্ষী হয় ধীরাজ। দোতালা থেকে দৃশ্যটি দেখে তার অধরের ফুটে ওঠে স্মিত হাসির রেখা। অতঃপর সে বলে,
‘এই খুশির জন্য আমি আরো অনেক বড় সেক্রিফাইজ করতেও রাজি আছি।’
এদিকে অহনা খন্দকারের মনে চলছে অন্য ভাবনা। তিনি ভাবছেন কিভাবে পরিস্থিতিকে নিজের আওতায় আনবেন। সুহানি ও ধ্রুবকে এক করা তার উদ্দ্যেশ্য নয়। বরঞ্চ তিনি চান তার দুই ছেলেকেই নিজের পছন্দমতো মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে।
★★★
ধ্রুব ও সুহানি একসাথে বসে আছে একটি রেস্টুরেন্টের মধ্যে। আজ পুনঃমিলনের খুশি উপভোগ করছে দুজনে। ধ্রুব সুহানির হাতে হাত রেখে বলে,
‘জানো সুহা, আমি ঠিক এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম। যেদিন তুমি আর আমি আবার সব বাধা ডিঙিয়ে এক হবো।’
সুহানি স্মিত হাসে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে। ধ্রুব হঠাৎ করে সুহানির সামনে হাটু গেড়ে বসে। অতঃপর বলে,
“Will you marry me?”
সুহানি মুখের হাসি বজায় রেখে জবাব দিতে যাবে এমন সময় কি মনে করে যেন চুপসে যায়। সুহানির থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ধ্রুব উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,
‘কি হলো কিছু বলছ না কেন?’
‘আমি এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না ধ্রুব।’
‘কেন?’
‘আমার বাবা মারা গেছেন, এখন ভাই আর ভাবি আমার অভিভাবক। তাদের অনুমতি না নিয়ে আমি তোমার সিদ্ধান্তে রাজি হতে পারি না।’
‘ওহ এই ব্যাপার। আগে বলবে তো। কোন ব্যাপার না। তুমি চলো আমার সাথে। আমি এক্ষুনি তোমার ভাই ভাবির সাথে কথা বলতে চাই। আমি তো ছেলে হিসেবে খা’রাপ না। তারা নিশ্চয়ই নারাজ হবেন না!’
সুহানি দ্বিধা প্রকাশ করে বলে,
‘আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছি না। একেই ভাইয়াকে আমি আমার এয়ার হোস্টেজ হওয়া নিয়ে মিথ্যা বলেছি তার উপর এখন আবার বিয়ে…’
‘তুমি কোন চিন্তা করো না সুহানি। আমি আছি তো। আজ তুমি ওনাদের সব সত্য বলবা। চলো আমার সাথে।’
ধ্রুবর কথায় সুহানি ভরসা পায়। অতঃপর তার সহিত যেতে লাগে।
★★★
সুহানিদের নারায়ণগঞ্জের বাসায় ড্রয়িংরুমে সোফার মধ্যে বসে আছে ধ্রুব ও সুহানি। তাদের মুখোমুখি বসে আছে মিরা। মিরা ধ্রুবর দিকে কফি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না। এই কফিটা খান, সীমান্তর ফেরার সময় হয়ে এসেছে।’
মিরা কথাটা বলতে না বলতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। মিরা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পায় সীমান্ত এসেছে। মিরা স্মিত হাসি দিয়ে বলে,
‘তুমি জলদি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসো। অনেক জরুরি কথা আছে।’
সীমান্ত অনেক টায়ার্ড ছিল। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। অতঃপর ড্রয়িংরুমে চলে আসে। ধ্রুব ও সুহানিকে দেখে অবাক হয়। সুহানির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুই হঠাৎ এভাবে না জানিয়ে চলে এলি!’
‘কেন আসতে পারি না? তোমার মনে নেই তুমি আমাকে বলেছিলে আমার পছন্দমতো ছেলেকে তোমার সামনে নিয়ে আসতে আজ আমি তাই করেছি।’
বলেই ধ্রুবর দিকে তাকায় সুহানি। সুহানির দৃষ্টি অনুসরণ করে সীমান্তও ধ্রুবর দিকে তাকায়।
ধ্রুব সুহানির হাতে হাত রেখে ভরসা দেয়। মিরাও চোখের ইশারায় শান্তনা দেয়। তাই সুহানি সাহস নিয়ে বলে,
‘তোমাকে একটা সত্যও জানানোর ছিল। আমি কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি না আমি একজন এয়ার হোস্টেজ।’
সহসাই সীমান্তর মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। ক্রোধের সহিত সুহানির দিকে তাকায় সে। চিৎকার করে বলে,
‘তুই আমাকে এভাবে ঠকালি কেন?’
ধ্রুব বলে ওঠে,
‘প্লিজ কাম ডাউন, ওর পুরো কথাটা আগে শুনুন।’
‘তুমি সেই ছেলেটা না, ধ্রুব। যার জন্য আমার বাবা মা’রা গেছিলেন। সুহানি তুই একে তো আমাকে এতবড় ধোকা দিলি তার উপর এই ছেলেটাকে বিয়ে করতে চাস!’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨