#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
সুহানিকে স্বীয় বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে ধ্রুব। সুহানি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কিন্তু তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। ক্রমশ ধ্রুব তাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছে। গায়ের জোরে না পেয়ে সুহানি এবার চেচিয়ে বলে ওঠে,
‘ছাড়ুন আমায়! কেন এসেছেন আপনি এখানে? আজ তো আপনার এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা।’
ধ্রুব মৃদু হেসে বলে,
‘সেই জন্যই তো এসেছি।’
‘মানে?’
ধ্রুব নিজের পকেট থেকে একটি ডায়মন্ড রিং বের করে। এনগেজমেন্ট উপলক্ষে এই রিংটা কিনেছিল সে। রিংটা সুহানির হাতে পড়িয়ে দেয় ধ্রুব। সুহানি হতবিহ্বল হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে কি করবে সেটা তার মাথায় আসছিল না। ধ্রুব সুহানির হাতে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
‘ধ্রুব শুধুই সুহানির। তুমি কি করে ভাবলে আমি অন্য কাউকে আপন করে নেবো?’
সুহানি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
‘কিন্তু…’
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই ধ্রুব হাত দিয়ে চেপে ধরে সুহানির মুখ।এরপর বলে,
‘আমি সব সত্য জেনে গেছি সুহানি। ধীরাজ আমায় সব বলেছে।’
সুহানির কাছে এবার সবটা স্পষ্ট হয়। ধ্রুব পুনরায় সুহানির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুমি কেন ৬ টা বছর আমার কাছ থেকে সবকিছু গোপন রাখলে সুহা? তুমি জানো না এই দূরত্ব কতটা পো’ড়াচ্ছিল আমায়। তুমি হীনা এক একটা দিন আমার কাছে এক হাজার আলোকবর্ষের সমান ছিল।’
সুহানি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে লুটিয়ে পড়ে ধ্রুবর বুকে। ফুপিয়ে কেঁদে বলে,
‘আমিও অনেক ক’ষ্ট পেয়েছি ধ্রুব। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে আমি অসহায় ছিলাম।’
ধ্রুব আলতো করে সুহানির মুখটা নিজের কাছে নিয়ে এসে তার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে দাও সুহা। এখন আমরা আমাদের সুন্দর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সাজাব।’
সুহানির মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে, আবার হঠাৎ করেই কর্পুরের মতো মিলিয়ে যায় সেই হাসি। সুহানি ধ্রুবর থেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরে এসে বলে,
‘যতক্ষণ না পর্যন্ত অহনা খন্দকার অতীতের করা অন্যায়গুলোর কারণে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন ততদিন আমি তোমার কাছে যেতে পারব না ধ্রুব।’
ধ্রুব সুহানিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে ,
‘এখন আর কোন চিন্তা করো না তুমি সুহা। আমি আম্মুকে বোঝাবো। আম্মু তোমার কাছে ক্ষমা চাইবেই।’
সুহানি খুশি হয়ে যায়।
★★★
অর্পা আজাদ চৌধুরীর সহিত উপস্থিত হয়েছে অহনা খন্দকারের সামনে। অর্পাকে দেখেই অহনা খন্দকার বলে ওঠেন,
‘অর্পা মা তুমি। এসো এসো আমার কাছে এসো। কিছু বলতে চাও?’
‘ইয়াহ! আপনার সাথে আমার অনেক জরুরি একটা কথা আছে।’
‘হ্যাঁ, বলো কি বলবে।’
‘আমি আপনার বড় ছেলে ধ্রুবকে বিয়ে করতে পারবো না।’
অহনা খন্দকার চমকান। বিস্ময়ে পরিপূর্ণ তার মুখের অববয়। তিনি উদ্বীগ্ন হয়ে শুধালেন,
‘কেন অর্পা? কোন সমস্যা হয়েছে কি? তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো। কিন্তু এভাবে বিয়েটা ভেঙে ফেলার কথা বলো না।’
অর্পা বিরক্তির সাথে মুখ থেকে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে বলে,
‘আসল সমস্যা এটাই যে আমি আপনার বড় ছেলে ধ্রবকে না ছোট ছেলে ধীরাজকে বিয়ে করতে চাই।’
অহনা খন্দকারের মাথায় যেন বিনা মে’ঘে বর্জ্যপাত হয়। তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে থাকেন। আজাদ চৌধুরীকে অর্পা আসার সময়ই সব বলে দিয়েছে। তাই তিনি অহনা খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
‘আমার মেয়ে যেহেতু আপনার ছোট ছেলেকে পছন্দ করে তাই বিয়েটা তার সাথেই দিতে চাই।’
অহনা খন্দকার রেগে গিয়ে বলেন,
‘এসব কি না’টক হচ্ছে? আমি অর্পাকে আমার বড় ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছিলাম আর এখন আপনারা এসে বলছেন আমার ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিতে! মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি? এসব চলবে না।’
আজাদ চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন,
‘আমি ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়ের সকল আবদার পূর্ণ করেছি। এবারো তার অন্যথা হবে না। আপনি যদি আপনার ছোট ছেলের সাথে অর্পার বিয়ে দিতে না চান তাহলে আমাদের কোম্পানি আপনার কোম্পানির সাথে সকল কন্ট্রাক্ট বাতিল করবে। আপনাকে কিছু সময় দিচ্ছি। ভেবে দেখুন কি করবেন।’
কথাটা বলে তিনি অর্পাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘এসো আমার সাথে।’
অর্পা তার বাবার সাথে যেতে থাকে। যেতে যেতে বলে,
‘তোমার কি মনে হয় ড্যাড? অহনা খন্দকার কি রাজি হবেন?’
আজাদ চৌধুরী বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলেন,
‘রাজি না হয়ে যাবেন কোথায়। আমাদের কোম্পানি যদি ওনার কোম্পানির সাথে সকল ডিল আর কন্ট্রাক্ট বাতিল করে তাহলে তো ওনাকে পথে বসতে হবে।’
এদিকে অহনা খন্দকার যেন অকুল পাথারে পরে যান। এখন তার শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। নিজের তিল তিল করে গড়ে তোলা অবস্থান ধরে রাখার জন্য আপাতত আজাদ চৌধুরীর কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তার হাতে অন্য কোন উপায় নেই। তাই নানান ভাবনা চিন্তা শে’ষে তিনি ধীরাজের রুমের দিকে অগ্রসর হন।
★★★
ধীরাজ সবেমাত্র ধ্রুবর সাথে ফোনে কথা বলল। ধ্রুব বাসার দিকেই আসছে। এখানে এসে সে অহনা খন্দকারের সাথে যা বোঝাপড়া করবে।
এরমধ্যে অহনা খন্দকার ধীরাজের রুমে এসে বলে,
‘তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে ধীরাজ।’
‘হুম বলো।’
অহনা খন্দকার কিছুটা ভেবে বলেন,
‘তুমি চাও তো যে আমি সুহানির কাছে ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করে নেই?’
‘হ্যাঁ আম্মু। একমাত্র তুমিই পারো সবকিছু ঠিক করতে। সুহানি আপু একমাত্র তখন ধ্রুব ভাইয়ার জীবনে ফিরবে যখন তুমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবে।’
‘বেশ আমি ক্ষমা চাইবো সুহানির কাছে। ধ্রুব ও সুহানির বিয়েতেও আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।’
‘কি শর্ত?’
‘তোমাকে আজাদ চৌধুরীর মেয়ে অর্পাকে বিয়ে করতে হবে। তাহলেই আমি তোমার সব কথা মেনে নেব।’
ধীরাজ বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে যায়। বলে ওঠে,
‘এটা কেমন শর্ত আম্মু?’
‘আমি যা বলছি তাই।’
‘এটা হতে পারে না। আমি মানব না এই শর্ত।’
‘তাহলে আমিও ম”রে গেলেও সুহানির কাছে ক্ষমা চাইবো না। আর না ধ্রুব ও সুহানি কখনো এক হতে পারবে।”‘
ধীরাজ অস্ফুটস্বরে বলে,
‘আম্মু…’
অহনা খন্দকার মিনমিনে স্বরে বললেন,
‘তোমাকে আমি ভাবার সময় দিচ্ছি। তুমি ভেবে দেখ কি করবে।’
ধীরাজ ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,
‘সুহানি আপু ঠিকই বলেছিল তুমি মা হিসেবে একদম জ’ঘন্য।’
‘আমি এমনই বেটা। আমার কাছে সবার আগে আমার নিজের স্বার্থ।’
ধীরাজ আর কোন উপায় খুঁজে পেল না। সে চায় যে করেই হোক সুহানি ও ধ্রবকে এক করতে। তাই নিজের জীবনে অনেক বড় একটি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল ধীরাজ। মেনে নিলো তার মায়ের শর্ত। অহনা খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘বেশ, তাহলে তোমার স্বার্থই চরিতার্থ হোক। তোমার স্বার্থপরতায় নাহয় আমিই নিজেকে ব’লি দিলাম। তাও অন্তত ভাইয়া সুখী হোক।’
অহনা খন্দকার ধীরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়।’
বলেই তিনি হাসিমুখে বিদায় নেন। অহনা খন্দকার চলে যেতেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে ধীরাজ। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে জল বেরিয়ে আসে। একজন পুরুষ সাধারণত অল্পতেই কাঁদে না। তাদের অশ্রু বর্ষণ তখনই হয় যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।
ধীরাজ সেই ছোটবেলা থেকে অনেক আত্মত্যাগ করেছে শুধুমাত্র ধ্রুবর জন্য। ধ্রুব সুহানিকে পাওয়ার জন্য নিজের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে আর ধীরাজ নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে ধ্রুবর সেই স্বপ্নকে আকড়ে ধরেছে শুধুমাত্র নিজের ভাইকে খুশি করার জন্য। কেননা, তাদের বাবার ইচ্ছা ছিল তাদের দুইভাইয়ের একজনকে অন্তত ডাক্তার বানানোর।
আর আজ আরো একবার ধ্রুবর খুশির জন্য নিজের জীবনের সবথেকে বড় ত্যাগ করে দিল ধীরাজ।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨