#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধ্রুবর দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুহানি। নিজের প্রাক্তনকে ৬ বছর পর এভাবে নিজের সামনে দেখে চরম পর্যায়ের অবাক হয়েছে সে। তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে ধ্রুবকে পাইলট বেশে দেখে।
সুহানি যে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে ধ্রুব। মনে মনে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করে না ধ্রুব। বরঞ্চ সুহানিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আপনারা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফ্লাইট টেক অফের টাইম তো প্রায় হয়ে এসেছে। চলুন সবাই।’
বলেই ধ্রুব সবার সামনে দিয়ে হেটে যায়। সুহানিকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। যেন তাকে চেনেই না। সুহানির কিছুটা মন খারাপ হলো ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু সে খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। স্বগোতক্তি করে বলল,
‘অতীতকে আমি অনেক আগেই বিদায় দিয়ে দিয়েছি। এখন আর সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন আমাকে নিজের প্রেজেন্ট এবং ফিউচারের দিকে ফোকাস করতে হবে, নাথিং এলস৷’
অতঃপর সুহানিও প্লেনের মধ্যে উঠে গেল। আজ তার প্রথম দায়িত্ব, সেই কারণে আগে থেকেই উত্তেজনার মধ্যে ছিল। ধ্রুবকে দেখে সেই উত্তেজনার পারদ চড়েছে, তবে সুহানি যথেষ্ট চেষ্টা করল নিজেকে ঠিক রাখার।
সুহানি প্লেনে ওঠার কিছু সময়ের মধ্যেই অন্য একজন এয়ার হোস্টেজ তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘তুমি তো নতুন জয়েন করেছ তাইনা?’
‘জ্বি।’
‘ওকে, নিজের সব দায়িত্ব বুঝে নিয়েছ তো? কোন ভুল যেন না হয়। আমি এখানকার মধ্যে সবথেকে অভিজ্ঞ এয়ার হোস্টেজ মনা ইসলাম। আমার চোখে কিন্তু কিছু এড়াবে না।’
সুহানি মাথা দুলিয়ে বলল,
‘আমি নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করব।’
‘ওকে। দেখা যাক তুমি সবটা সামলাতে পারো কিনা। প্রস্তুত হয়ে নাও। একটু পরেই প্লেন টেক অফ করবে।’
সুহানি মাথা নাড়ালো।
★★★
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার জার্নির পর দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল প্লেন। সুহানি এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আজ প্রথম দিনটাই তার অনেক খা’রাপ গেছে। একজন যাত্রীকে খাবার সার্ভ করার সময় ভুল বশত তার গায়ে জুস পড়ে গেছে। এই নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে সুহানিকে। যাত্রীটি তো যা নয় তাই বলে অপমান করেছে তার উপর মনা ইসলাম সুহানিকে আরো অনেক বেশি কথা শুনিয়েছে। সেসব নিয়ে সুহানির মন সামান্য খারাপ।
তবে সুহানি এত সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। সে মনে করে মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ভুল থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারি, তাই সে এখন এসব নিয়ে বেশি ভাববে না বলে সিদ্ধান্ত নিল। পরবর্তীতে যেন এমন ভুল না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দুবাইয়ে পৌঁছে প্লেন থেকে নেমে সুহানি নিজের সিডিউল চেক করে নিল। তার পরবর্তী ফ্লাইট চার ঘন্টা পর। ততক্ষণ সে ফ্রি আছে। তাই আপাতত রেস্ট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর বাইরে আসতেই দেখতে পেলো ধ্রুবকে। ধ্রুব সুহানিকে দেখে তার দিকেই এগিয়ে আসে৷ সুহানি বিস্ময়ের সাথে ধ্রুবর দিকে তাকায়। ধ্রুব সুহানির সামনে এসে গম্ভীরমুখে বলে,
‘কেমন আছ?’
‘ভালো আছি, তুমি?’
‘আমিও ভালোই আছি। বাট আমি একজন পাইলট সো আমাকে আপনি করে বলবে এবং স্যার বলে ডাকবে। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’
সুহানির রাগ হয়। কিন্তু সে হালকা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে ধ্রুব বলে ওঠে,
‘এত যাওয়ার তাড়া কেন তোমার? ছেড়ে যেতে খুব ভালো লাগে বুঝি?’
সুহানি স্পষ্টভাবে বলল,
‘স্যার, এখানে আমাদের প্রোফেশনালের বাইরে কোন পারসনাল কথা বলতে চাইছি না।’
‘আমিও কোন পারসোনাল কথা বলছি না। বাই দা ওয়ে, এত বছর পর দেখা হলো তো চলো না পাশে কোন কফিশপে যাই।’
সুহানির ধ্রুবর সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছা নেই। তাই সে বলল,
‘সরি, আমার অন্য কাজ আছে তাই আমি যেতে পারব না।’
ধ্রুব নাছোড়বান্দা। সে সুহানির যাওয়ার পথ আটকে বলল,
‘কফি খেতে যেতে বলেছি ডেটে যেতে বলিনি। তাই এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। লেটস গো।’
সুহানি চেনে ধ্রবকে৷ তার জেদ সম্পর্কেও ধারণা আছে তার। ধ্রুবর একরোখা মনোভাব যে বদলায় নি সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারল সুহানি। অগত্যা চলতে লাগল তার সহিত।
★★★
দুবাইয়ের একটি নামী কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে ধ্রুব এবং সুহানি। কফি মগে চুমুক দিয়ে ধ্রুব সোহার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘অবশেষে তাহলে তুমি নিজের ড্রিম পূরণ করেই নিলে সুহা।’
সুহানি সবেমাত্র কফিমগে চুমুক দিতে যাচ্ছিল এমন সময় ধ্রুবর বল সুহা ডাকটা তার কানে এলো। এই ডাকের মধ্যে কি যেন একটা অন্যরকম আকর্ষণ কাজ করে সুহানির। সে ফিরে যায় ৬ বছর আগের সেই কলেজ জীবনে। কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো! কলেজে ভর্তি হয়ে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়েছিল ধ্রুব এবং সুহানি। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তারপর বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। সব কিছু ভালোই চলছিল। তারপর হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড় নেমে এলো তাদের জীবনে। তখন থেকেই সবটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল৷ সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলো। দুজন ভালোবাসার মানুষ একে অপরের থেকে দূরে সরে এলো।
ধ্রুবর ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে সুহানি৷ ধ্রুব সুহানির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘কি ভাবছ এভাবে?’
‘অনেকদিন পর কেউ সুহা বলে ডাকল।’
ধ্রুব মলিন হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘কেন এরমধ্যে কি তোমার লাইফে কেউ আসে নি? আই মিন তুমি অন্য কোন রিলেশনে যাওনি।’
সুহানি তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
‘পার্সোনাল প্রশ্ন করবেন না প্লিজ।’
‘আচ্ছা।’
অতঃপর কিছু সময়ের নীরবতা। নীরবতার রেশ কা’টিয়ে সুহানি বলল,
‘আপনার তো ডক্টর হওয়ার ইচ্ছা ছিল। আজ আপনাকে পাইলট হিসেবে দেখে সত্যি আমি অবাক হয়েছি। আচ্ছা, আপনি ডক্টর না হয়ে পাইলট হলেন কেন?’
‘সেটা আমার পার্সোনাল মেটার। তুমি তো চাও না কোন পার্সোনাল কথা বলতে তেমনি আমিও চাই না।’
সুহানি আর কিছু বলল না৷ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
‘তাহলে এখন উঠি। অনেকদিন পর আপনার দেখা পেয়ে খুব ভালো লাগল।’
ধ্রুব সুহানির দিকে জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার মনে আছে সুহা আজ থেকে ৬ বছর আগের আজকের দিনটার কথা। এরকমই একটা কফিশপে বসে আমাদের সম্পর্কের ইতি টেনেছিলাম আমরা।’
আচমকাই সুহানি কিছুটা দূর্বল হয়ে পরে। অতীতের সেই দিনটা কখনো ভুলতে পারবে না সে। তিক্ত স্মৃতি আমরা হয়তো কখনো ভুলতে পারি না। তবে সুহানি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল আর আগের মতো দূর্বল সুহানি হয়ে থাকবে না। তাই তো কলেজ লাইফের সেই দূর্বল মনের সুহানি আজ এত দৃঢ় মনোভাবাপন্ন হয়েছে। অল্পতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া মেয়েটা এখন কান্না লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। আসলে জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায়। পরপর কিছু বড় ধাক্কা, প্রথমে বিচ্ছেদ, পরে বাবার মৃত্যু সব সুহানিকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তো আজ সুহানি ৬ বছর আগের থেকে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে নিজের। ধ্রুবর দিকে না তাকিয়েই সে বলল,
‘অতীত আমি মনে রাখি না আর রাখতেও চাই না। আমি শুধু সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গড়তে চাই, নিজের মতো।’
কথাটা বলেই সুহানি আর পিছনে না ফিরে চললো নিজের পথে। ধ্রুব অনিমেষ চেয়ে রইল তার পানে৷ স্বগতোক্তি করে বলল,
‘ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগানো নাকি অসম্ভব, কিন্তু আমি এই অসম্ভবকেই সম্ভব করার চেষ্টা করব। অতীতের তিক্ততাকে মিষ্টতায় পরিণত করবোই আমি।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨