প্রেমেরপরশ
পার্ট_30
ডক্টর এর কথা শুনে শুভর মাথা খারাপ হয়ে যায়, মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে পড়ে। এতো কেয়ার করার পরও কিভাবে বেবির ঠান্ডা লাগতে পারে শুভর মাথায় আসে না। হটাৎ করে শুভর মাথা কাজ করে, কাছে থাকা ল্যাপটপ অন করে। যা দেখে শুভর রাগ আরোও বেড়ে যায়। মানুষ খারাপ হলে যে এতো খারাপ হতে পারে শুভর তা জানা ছিলো না।
বেবির ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়েছে শুনে নিরু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শুভ নিরুর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
__ “ যা হয়েছে হয়েছে, এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেনো আমাদের বাচ্চা সুস্থ হয়ে উঠে। ”
__ “ এমন পরিস্থিতি তে তুমি কিভাবে এতো শান্ত আছো শুভ। ”
__ “ কারণ সন্তান আল্লাহ দিয়েছে, বাবুর যদি কিছু হয় সেটাও হবে উনার ইচ্ছে। আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না নিরু। ”
শুভ ভিডিও ফুটেজ সবার সামনে ওপেন করে, ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে,
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে, সামিহা ওয়াশরুমে যায়। তাও পা টিপে টিপে। সামিহার বুক ধক করে উঠে। সামিহা ভাবতেও পারেনি এই ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে সামিহার। এরপর দেখা যাচ্ছে, সামিহা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কেবিনে এসে বেবির বুকের উপর পানি দিয়ে দেয়। শুভ ঘুমিয়ে থাকা তে কিছুই বুঝতে পারেনি। এরপর খুব আস্তে আস্তে সামিহা বেবির উপর বাতাস করতে থাকে। বাতাস যেনো শুভ বা নিরুর কাছে না যায় সেভাবেই করছে।
আর এই জন্যই সদ্যোজাত শিশুর এক রাতে বুকে ঠান্ডা জমে নিউমোনিয়া হয়ে গেল। সাগর আর ওর বাবা মা বোন এই দৃশ্য দেখার পর সাগর সাথে সাথেই সামিহা কে মুখে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। হসপিটালে দায়িত্ব রত মহিলা পুলিশের কাছে দিয়ে দেয় সামিহা কে। সদ্যোজাত বাচ্চা কে মারতে চাওয়ার অপরাধে সামিহার শাস্তি হয়ে যাবে।
এদিকে শায়ান কে ডক্টর রা NICU তে দিয়ে দেয়। সেখানে হিট দিয়ে রাখা হয়েছে বাচ্চা কে। আর বাসার সবাই বাচ্চার জন্য পেরেশানি হয়ে হাটাহাটি করছে, দোয়া করছে।
দুইদিন পর শায়ানের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সুখবর শুনার পর নিরুর বাবা আসে মেয়ের কাছে,
__ “ আজ আমি খুব খুশি হয়েছি রে মা, হোক তোর সৎ মা তবুও তার জ্ঞান ফিরেছে। তোকে দেখতে চেয়েছে, প্লিজ না করিস না আর। ”
__ “ হ্যাঁ বাবা, আমি যাবো, আপুর মৃত্যুর পর আমিই তো তোমাদের সন্তান। মা তো মা ই হয়। আমি অবশ্যই যাবো। ”
শুভর দিকে তাকিয়ে নিরু বলে,
__ “ আমাকে একটু উনার কাছে নিয়ে যাবে প্লিজ, উনার কাছে অনেক কিছুই জানার আছে। ”
__ “ হুম, আমারও মনে অনেক প্রশ্ন আছে। ”
খুব সাবধানে নিরুকে বেড থেকে উঠিয়ে লুতফা বেগমের কেবিনে নিয়ে গেলো শুভ। নিরু গিয়ে দেখে লুতফা বেগম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিরুর দিকে। হয়তো তার চোখ দুটো নিরুকেই খুঁজছিলো এতক্ষণ। এখন যেনো নিরুকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে লুতফা বেগম।
নিরু পাশে গিয়ে বসতেই লুতফা বেগম বলেন,
__ “ তোর বাবা বলেছে, আমার মেয়েটা আর বেঁচে নেই রে। তখন থেকেই তোর সাথে কথা বলার জন্য খুব ছটফট করেছি। তোকে অনেক কিছু বলার আছে। মন দিয়ে শুনবি আর কিছুই বলবি না। ”
__ “ হ্যাঁ আম্মু বলো, তোমার কাছে এই কথা শুনার জন্যই এসেছি। ”
লুতফা চোখ বন্ধ করে দুই মিনিট থাকলেন এরপর বলতে লাগলেন,
__ “ জানিস মা, প্রত্যেক মেয়েই চাই তার হাজবেন্ড তাকে ভালোবাসুক। স্বভাবতই আমিও চেয়েছিলাম আমার হাজবেন্ড এর কাছে ভালোবাসা। বুঝতে পারিনি কখনো যে উনি আমার না। উনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন কিন্তু আমাকে ঠকিয়েছেন উনি। ”
লুতফা বেগম কাঁদছেন, নিরু তখন বলে
__ “ হ্যাঁ আম্মু আমি জানি, এরপর কি বলবেন বলেন। ”
লুতফা বেগম আবার বলতে লাগলেন,
__ “ যখন তোর মা কে নিয়ে উনি খুব সুখে থাকতে শুরু করেন, আমি খুব জ্বলতাম। উনি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা যদি নাই দিতে পারবে কেনো বিয়ে করেছিলো, কেনোই বা আমার কাছে এসেছিলো। এসব ভাবতাম আর কান্না করতাম সব সময়। যখন শুনলাম তুই পৃথিবী তে আসতে চলেছিস, আমার মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আর ক্ষোভে বাতাস দিতে থাকে আমার ননদ। সে সব সময় উল্টো পাল্টা বুঝাতো আমাকে। আমিও ওর কথাতে রাজি হয়ে যায়। ও আমাকে বুঝায়, তোকে আর তোর মাকে মেরে ফেলতে পারলে সব সম্পত্তি হবে আমাদের। আর তোর বাবা তো আমাকে ভালোই বাসে না। তাই উনার জন্য কোন আক্ষেপ হতো না। ”
লুতফা বেগম একটু থামলেন, তখন নিরু বললো,
__ “ আচ্ছা আম্মু, বুঝলাম আব্বু তোমায় ভালোবাসে না। কিন্তু এটা কি ভেবে দেখেছিলে, সে তোমার প্রতি দায়িত্ব বোধ করেই কিন্তু তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো। আব্বু চাইলে তোমাকে ডিভোর্স দিতেও পারতো। তা করেনি, তোমাকে পরিচয় হয়তো দিতে পারেনি আমার মায়ের সামনে। কিন্তু তোমার থাকা খাওয়া সব ব্যবস্থা ই কিন্তু করে দিয়েছিলো। এগুলো তুমি ভাবোই নি, শুধুমাত্র লোভে পড়ে আজ…. ”
নিরু থেমে যেতেই লুতফা বেগম বলেন,
__ “ ভুল করেছি রে মা, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। এই কথা টা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই আজ এই অবস্থা। সেদিন তোর মায়ের কেবিনে আপা ঢুকে বালিশ চাপা দেয় তোর মাকে। তোকেও হয়তো মেরে ফেলতো। কিন্তু তোর বাবা চলে আসে, যখন তোর মায়ের মুখ থেকে বালিশ সরাতে যায় তখন আমি ছবি তুলে নিই। পুরো কাজ দুজন মিলে করেছিলাম। এর শাস্তি আমি পেয়েছি, আমার মেয়েটা কে হারিয়ে। আমি জানতাম রাকিব ওর ক্ষতি করেছে, কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। নিজ মেয়ের এতো বড় ক্ষতির পরও আমি রাকিব বা ওর মায়ের সাথে মিশেছি। কারণ লোভ ছিলো নিরু কে যেখান থেকে পারি খুঁজে বের করা। আর হত্যা করা। এতে সব সম্পত্তি আসবে আমাদের হাতে। লোভে লোভে এতো নিচে নেমে গিয়েছিলাম। আমার মেয়েটাকে তোর বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখ মা আমি যতো অন্যায় করেছি তার শাস্তি পৃথিবী তে পেয়ে গেছি৷ রাকিব আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। জানিনা কতদিন এখানে শুয়ে আছি। ”
খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে লুতফা বেগমের। জ্ঞান ফিরে এই কথা গুলো বলে এক ঘন্টার মধ্যে আবার ও জ্ঞান হারান। নিরু সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে ।এখন শুধু রাকিব কে পেয়ে গেলেই হয়। নিরু উঠে যায়, শুভ ধরে ধরে নিয়ে আসে নিরুর কেবিনে।
কয়েকদিন হসপিটাল এ থেকে শায়ান কে পুরো পুরি সুস্থ করে বাসায় ফিরে আসে নিরু আর শুভ। বাসায় এসেই দেখে সাগর বের হচ্ছে লাগেজ নিয়ে। সাগর কে শুভ জিজ্ঞেস করে,
__ “ আমরা বাসায় আসতেই কোথায় চলে যাচ্ছিস! ”
__ “ তোরা ভালো থাকিস, আমি তুরস্ক চলে যাচ্ছি। সেখানে নতুন যে বিজনেস টা ওপেন করেছি সেটা হ্যান্ডেল করতে চাই। তাছাড়া লাইফ নতুন করে আবারো শুরু করতে চাই। ”
শুভ কে জড়িয়ে ধরে সাগর কাঁদে অনেক্ষণ। এরপর শায়ান কে কোলে নেয় সাগর। কপালে চুমু দিয়ে নিরুর থেকে বিদায় নেয়। রিমি এসে সাগর কে জড়িয়ে ধরে,
__ “ ভাইয়া, আবার কবে আসবে! খুব মিস করবো তোমায়। ”
__ “ পাগলী বোন আমার, আমি ওখানে সেটেল হয়ে যাবো। চিন্তা করিস না, ভিডিও কলে প্রায়ই কথা বলবো। ”
বোনের কাছে বিদায় নিয়ে বাবা মা সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে অনেক্ষণ। এরপর বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ আর রিমি এয়ারপোর্টে গিয়ে বিদায় দিতে আসে সাগর কে।
সাগর চলে যাবার পর রিমির মনে হয় রাকিবের মতো কাউকে দেখলো। রিমি শুভ কে আস্তে করে বলে, ফলো করতে থাকে দুজনে।