প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
704

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৩.
‘সিগারেটে সুখ‌টান দেয়ার অভ্যাস আছে নাকি?’

আমার কথায় ভ্রুকুচু করে তাকালো সাহিল। লোকটা সবে রুমে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা পেরিয়েছে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি ততক্ষনে। শিক্ষক মানুষ এতটা আনপাংচুয়াল কেন হবে? বিয়ের মত সুন্দর দিনটাতে আমার মেজাজের পারদ সীমা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাহিল দরজার খিল এঁটে দিলো। পরনে তার সাদা রঙের পাঞ্জাবি। তার উপর হালকা গোলাপি রঙের কোটি। আমার পরনের শাড়ির সাথে মিল রেখেই এই গেটআপ। লোকটাকে মাত্রই ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। এই সাধারণ পাঞ্জাবিতেই মানুষটাকে অসাধারণ লাগছে। সেট করা চুলগুলোর কয়েকটা ছড়িয়ে আছে কপালে। কি ভিষণ সুন্দর লাগছে তাকে! আমি মুগ্ধ হলাম।
লোকটা ততক্ষনে খুব নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে ঝুঁকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল নাক। আমি চমকলাম। বিদ্যুৎ খেলে গেলো অঙ্গে। আমি চোখ পাতা ঝাপটে তার দিকে তাকালাম। তখন সে তার কালচে লাল ঠোঁট জোড়া প্রসস্থ করে হাসলো। একটু সরে দাঁড়িয়ে বললো,

‘বউ হতে না হতেই তুমি দুষ্ট নজরে দেখতে শুরু করেছ শুভ্রলতা! তোমার সন্নিকটে আমিতো নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছি না!’

আমি লজ্জায় মুড়িয়ে গেলাম। মানুষ ঠিক কতটা অসভ্য হলে এভাবে লজ্জা দিতে পারে? ভাবতেই মনে মনে ফুঁসে উঠলাম।
সাহিল তার হাসি চেপে কাবার্ডের দিকে এগোলো। বললো,

‘লিসেন শুভ্র। আমি টুকটাক স্মোক করি। তোমার সেটা অপছন্দ হলে আমি ছেড়ে দেওয়ার ট্রাই করবো। বাট একটু সময় লাগবে।’

আমি এবার তার দিকে তাকালাম। বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা তখন পিছন ফিরে কাবার্ডে থেকে কিছু বের করতে ব্যস্ত। এমন খবিশ লোককে দুটো কথা শোনানোর পথ থাকতে তা ছেড়ে দিব কেন? আমি ঠোঁট টেনে হাসলাম। শুধালাম,

‘আমি জাস্ট এটাই ভাবছি একজন শিক্ষক স্মোক করেন ব্যাপারটা ঠিক কতটা লজ্জাজনক! আমার বন্ধুরা যদি কখনো সখনো দেখে ফেলে…! ব্যাপারটা ভিষণ ভাবাচ্ছে আমায়।’

এ কথার জবাবে আমি খুব করে চাইছিলাম বর মহাশয়ের চুপসে যাওয়া ছোট্ট মুখটা দেখতে। ঐ একটা রূপ আমি মানুষটার মাঝে দেখিনি। এটা বহু প্রতিক্ষিত একটা ব্যাপার। কিন্তু শেয়াল পন্ডিতের সাথে কি ছাগল কখনো যুক্তিতে পারে? এবার ও তেমন হলো। লোকটা হাসি হাসি মুখে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলো আমার দিকে। মুখে বললো,

‘শিক্ষকের বউ দু বিষয়ে ফেইল করেছে!- এই চরম অসম্মানজনক বিষয় হজম করতে পারলে ওটুকুতে কিসের বাঁধা?’

আমার হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে এলো। তীব্র লজ্জা অনুভব করলাম। অপমানে থমথমে হয়ে এলো মুখ। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। যদি জীবন থেকে ঐ অভিশপ্ত তকমাটা মুছে ফেলতে পারতাম! নিজের বোকামির জন্য আফসোস হলো। কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে কথা বলে অপমান হওয়ার? চোখে জমলো ছোট ছোট জল কণা। যদিও সাহিল মিথ্যা কিছু বলেনি তবুও মনের কোনে অভিমানের ছোট্ট পাহাড় তৈরি হলো। আজ এভাবে না বললেই হতো! মজার ছলে বলা কথাটা এভাবে এসে দাঁড়াবে বুঝতে পারিনি।
সাহিল তখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি চাইলামনা লোকটা আমার মন খারাপ বুঝুক। কিন্তু অবাধ্য চোখের জল টুপ করেই গাল গড়িয়ে পড়লো। অনুভব করলাম গালে কারো উষ্ণ পরশ। সাহিল তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা চোখের জল টুকু মুছে নিয়েছে। পরপর সে আরো একটি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তার পুরুষালি ঠোঁট জোড়া দিয়ে ছুয়ে দিয়েছে আমার অশ্রুতে ভেজা চোখ। আমি তখন পাথরের মতো জমে গিয়েছে। মিশ্র অনুভূতির মাঝে আটকে পড়েছি। দুঃখ পাচ্ছি নাকি হঠাৎ করেই প্রেমিক পুরুষের ছোয়ায় সুখ অনুভব করছি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু প্রেমিক পুরুষটার ভালোবাসার গভীরতা হয়তো আমির অভিমানের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এজন্যই তো খানিক বাদেই দুঃখ, মন খারাপ ভুলে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। নিজকে লুকানোর জন্য ছোট কোনো গর্ত খুজতে লাগলাম। যেখানে লুকালে পুরুষটির চোখে চোখ মেলাতে হবে না।

‘বর অত্যন্ত সরি শুভ্রলতা! আই প্রমিস আমার জন্য তোমায় আর কখনো এভাবে কষ্ট পেতে হবে না। রিয়েলি সরি। মজার ছলে বলা কথা তোমায় আঘাত করবে বুঝতে পারিনি। তোমার শিক্ষক মহাশয় তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত।’

____________

কোনো একদিন কথার ছলে আমি তাকে বলেছিলাম,

‘জানেন তো মহাশয় আমার ভিষণ ইচ্ছা আমার বাসর আমি নিজ হাতে সাজাবো। সবার রুচি ভিন্ন। আমি যেমন চাই তেমনযে অন্যকেউ সাজাতে পারবে এর সম্ভাবনা টু পার্সেন্ট। তাই এই দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে চাই।’

জবাবে তিনি নিরবে হেসেছিলেন। তবে এই অতি সামান্য কথাটুকুও যে তিনি মনে রাখবেন কল্পনা করিনি। যেখানে আমার ইচ্ছার কথা আমি নিজেই ভুলে বসেছি সেখানে অপর কেউ মনে রাখবে ভাবাটা বোকামি। কিন্তু এই অসম্ভব্য বিষয়কে সম্ভব করেছেন আমার বর মহাশয়। তার সাথে হাত লাগিয়ে দীর্ঘ দু ঘন্টা সময় নিয়ে নিজেদের বাসর সাজিয়েছি আমরা। মানুষটার নিরবে ভালোবাসার এই দারুন উদাহরণটায় আমি মুগ্ধ। তিনি কখনো মুখে বললননি তার ভালোবাসার কথা। তবে তার প্রতিটা সুনিপুণ কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিক কতটা ভালোবাসেন তিনি আমায়।
তার পাগলামীর অধ্যায় এখানে শেষ হলেই পারত। কিন্তু হয়নি। আমাকে চমকে দিয়ে তিনি গাঢ় খয়েরী রঙের একটা ভরী লেহেঙ্গা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি তখন রুম সাজানো শেষে বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। তার দিকে তাকাতেই সে প্রশস্ত হেসে বললো,

‘দুঃখিত শুভ্র! কিন্তু আমি সত্যিই চাইনি আমি ব্যতীত অন্য কেউ তোমায় মুগ্ধতা নিয়ে দেখুক। এখন ঝটপট এটা পরে নাও। দীর্ঘ তিনদিন টিউটোরিয়াল দেখে কিভাবে সাজাতে হয় শিখেছি। তোমার বিয়ের সিজটা নাহয় তোমার বর তোমায় সাজিয়ে দিবে!’

আমি বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। এমন শান্ত নিরামিষ টাইপের মানুষটাও যে এমন পাগলামী করতে পারে তা আমার ধারণার বাহিরে ছিল। আমার মন হালকা হয়ে এলো। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে তার চোখে তাকালাম। বললাম,

‘চট করে কনফেস করে ফেলুন তো! ঠিক কোন মুহুর্ত থেকে আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন?’

___________

বিয়ের পরের সময়গুলো রোজকারের মতোই চলতে লাগলো। আমি সাহিলের সাথে ঢাকায় ফিরে এসেছি। এখানে সাহিলের নিজের ফ্লাট রয়েছে। মূলত এটাই এখন থেকে আমাদের ঘর। সাহিল গোছালো ধরণের মানুষ। তার মতো তার ফ্লাটটিও খুব সুন্দর করে গোছালো। একটা ছেলের বাসা এত পরিপাটি হবে তা কল্পনাতিত। আমি সাহিলের বিপরীত ধাঁচের। প্রচন্ড অগোছালো। এক পদের তরকারি রান্না করতে গেলে চার পাঁচটা বাসন নষ্ট করে বসি। তার গোছানো রুমের এখানে ওখানে পড়ে থাকে আমার জামাকাপড়, আসবাবপত্র। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করি সব সামলে নেওয়ার। সে ফিরে আসার পূর্বেই সব কিছু গুছিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাই।
ইতিমধ্যে ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। রোজ সকালে সাহিলের সাথে গেলেও আমায় ফিরতে হয় একা। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সময় কাটে টিভি দেখে বা টুকটাক কাজ করে। আগের জীবনের থেকে বিবাহিত জীবন ভিন্ন। চাইলেই ঘরে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি না। রাত করে আড্ডা দেওয়া হয়না। কোথায় একটা বাঁধা অনুভব হয়।
আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা ভার্সিটির কম বেশি সবাই জানে। তুষার ভাইয়ের সাথে মাঝে দেখা হয়েছিল। সে এখন ফাস্ট ইয়ারের অনন্যা নামের একটি মেয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগে নাকি হাত কেটে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। আমার মায়া হলো তার অমন মুখ দেখে। সে আমায় দেখতেই সরল হাসলো। বললো,

‘বিয়ে করেছ তনয়া? একবার জানাতে। তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনে রেখেছিলাম। দেওয়া হয়নি। বিয়েতে নাহয় উপহার হিসেবে দিয়ে আসতাম। এখন যদি দেই নিবে?’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তুষার ভাই মানুষ হিসেবে খারাপ না। তবে সে মেয়েদের প্রতি দুর্বল ভিষণ। ঠিক কোন মেয়ের প্রতি তার দুর্বলতা নেই তা হয়তো সে নিজেও জানে না। আমি তাকে না করলাম না। বিস্তার হেসে বললাম,

‘কেন নিব না? সিনিয়র ভাইয়া কোনো উপহার দিবে তা ফিরিয়ে দেই কিভাবে?’
.
.
আজকাল শিক্ষকদের সামনে যেতে ভিষণ লজ্জা অনুভব হয়। অতি পরিচিত কোর্স টিচাররা যখন দেখা হতেই এক গাল হেসে বলে,
‘ভাবী কেমন আছেন?’

এর থেকে লজ্জাজনক ঘটনা অর কি হতে পারে? মন চায় এই পৃথিবী থেকে নাই হয়ে যেতে। শিক্ষকদের সর্বদা আমি মামা চাচার নজরে দেখতাম। সেই শিক্ষকরা যখন ভাবী বলে ডাকে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়?এজন্য আমি এখন শিক্ষকদের এড়িয়ে চলি। ক্লাসে পেছনের দিকে সিট খুঁজে বসি। মামা চাচা থেকে হুট করে দেবর বনে যাওয়া শিক্ষকদের কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না আমার ছোট্ট মাথা।
বিয়ের বয়স তিন মাস পেরিয়েছে। আজ ও আমি জানিনা হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল সাহিল। তাকে অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছিলাম দু একবার। জবাবে মহাশয় হেয়ালির সুরে বলেছিল,
‘অমন না করলে রাতারাতি বউ কোথায় পেতাম?’

আজকাল সাহিল ভিষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাসায় একা সময় কাটতে চায়না। তাকে কল করলেই ভদ্রলোক জানান,
‘ব্যস্ত আছি। পরে কল করছি।’

আজ ভার্সিটিতে যাইনি। শরীর সকাল থেকে ভালো নেই। বাবার সাথে কথা হয়েছে। তার শরীরটাও ভালো নেই। ময়মনসিংহ যাওয়া দরকার। নিসাকে মনে পড়ছে খুব। মেয়েটা আজকাল পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে খুব। ছোট করে শ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে নিচে তাকালাম। এখন বিকেল চারটা বেজে কিছু মিনিট। বাচ্চারা বিল্ডিং এর বাহিরে খেলাধুলা করছে। এই বিল্ডিংটা ছয় তলা বিশিষ্ট। প্রতিটা ফ্লোরে তিনটা করে ফ্লাট। এতগুলো প্রতিবেশি থাকতেও আমি ভিষণ একা। আমার সাথে কারো কথা হয়না। হবে কিভাবে? আমি প্রয়োজন ব্যাতীত কখনোই ফ্লাটের বাহিরে যাই না।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে কল করলাম শিক্ষক মহাশয়কে। দু তিনবার রিং হতেই তিনি রিসিভ করলেন।

‘কিছু বলবে শুভ্র?’

‘দ্রুত চলে আসুন। ভালো লাগছে না।’

সাহিল হাসলো। বললো,

‘ব্যস্ত আছি তো বউ। এখনো তিনটা ক্লাস আছে। শেষ হলেই চলে আসবো।’

তার কথায় আমি তীব্র বিরোধিতা করলাম। নাক ফুলিয়ে বললাম,

‘এত ব্যস্ত তবে বিয়ে কেন করলেন? সারাক্ষণ আমায় একা থাকতে হয়। আমার তো বাচ্চা কাচ্চাও নেই যাদের সাথে বসে খেলা করবো।’

সাহিল দুদন্ড সময় চুপ থেকে ধীর গলায় বললেন,

‘তোমার কথার পয়েন্ট কি তবে এটা! তোমার বাচ্চা দরকার এটা বললেই পারো!’

পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগলো কথার মর্ম বুঝতে। বুঝতে পেরে চট করে কল কেটে দিলাম। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। আবেগের বশে বলে ফেলা কথাটা বলা একদম উচিত হয়নি। ইশশ! কি লজ্জা! এই মানুষটা আমায় লজ্জা দেওয়ার কোনো পথ বাদ রাখে না। নিজের গালে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারতে মন চাচ্ছে। মানে একটা মানুষ এত বেক্কল হয় কেমনে? হাউ?

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে