প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-১২

0
606

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
দিন গড়িয়েছে। গড়িয়েছে বেশ কিছু প্রহর। আজ সোমবার। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সারাঘর পায়চারি করতে লাগলাম। অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভয়ংকর সুন্দর অধ্যায়ের আগমন ঘটতে চলছে জীবনে। কিছুটা নার্ভাস! গ্রাম থেকে ফিরেছি আজ তিনদিন। তবে ফিরতি পথে শীতল বাতাসের সাথে বিয়ের বাতাস ও গায়ে মাখিয়ে ফিরেছি আমার ধারণা। নয়তো হুট করেই কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সুন্দর ঘটনাটা ঘটবে?
ঘটনাটা গতকালের। সময়টা তখন বিকেল চারটা বেজে কিছু মিনিট! আমি ড্রয়িংয়ের সোফায় বসে টি টেবিলে পা তুলে দিয়ে সিরিয়াল দেখছি। মূলত দেখার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেই এই কাজ! ঠিক তখন সাহিল সাহেব কল করলেন। আমি খুশি খুশি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তিনি উত্তেজিত গলায় বললেন,

‘আমায় বিয়ে করতে আপত্তি আছে কোনো?’

কথাটা বুঝতে পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগলো আমার। সরু চোখ করে বললাম,

‘হঠাৎ এ কথা কেন?’

‘ইয়েস অর নো?’

আমি খুক খুক করে কেশে উঠলাম। বিব্রত বোধ করলাম কিছুটা। কোশ্চেনটা খুব বেশিই ডাইরেক্ট হয়ে গেল না! এভাবে বুঝি কোশ্চেন করতে হয়? মনে মনে বিরক্ত হলাম কিছুটা। বিয়ের মতো এই সিরিয়াস ব্যাপারটা কেন সে সুন্দর করে সাজিয়ে বলতে পারে না? সবসময় এ ব্যাপারে অগোছালো সে। তবুও তার এই অগোছালো প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো আমায়। ছোট করে বললাম,

‘উহু। নেই!’

আমার কথায় ওপাশ থেকে বড় করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল সাহিল। যেন আমার উত্তরের শোনার জন্য তার শ্বাস রোধ হয়ে ছিল! আজিব এত হাইপার হওয়ার কি আছে? আমার মনের প্রশ্নটা মনেই থেকে গেল। তিনি শুধালেন,

‘বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও তবে শুভ্রলতা। আজ রাত টুকুই আছে তোমার হাতে।’

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আমি কিছু বলতে গিয়েও পারলাম না। মুহূর্তেই মেজাজের পারদ শেষ পর্যায়ে উঠে গেল। এই লোকটা কি ইংরেজ শাসকের বংশধর নাকি? নিজের কথা শেষ হলেই কল সংযোগ ছিন্ন করে দেয় যেন তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত! মানে এটা কোন পর্যায়ের অভদ্রতা? রাগে অতিষ্ঠ আমি রুম ছেড়ে বাবার রুমে হানা দিলাম। বাবা তখন কারো সাথে ফোনে কথা শেষ করে সোফায় বসেছেন মাত্র। আমায় দেখতেই থমথমে মুখে বললেন,

‘ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। তোমাকে এখনই ডাকতাম আমি।’

আমি এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশের সোফায় বসলাম। বাবা মানুষটা গম্ভীর ধাঁচের। ছোট থেকে তাকে এভাবেই দেখে আসছি। তাকে হাসতে দেখা যায় খুব কম। ভদ্রতার জন্য মুচকি হাসেন। তবে সেই হাসিতে আমি কখনো প্রাণ খুঁজে পাইনি। মা চলে যাওয়ার পর থেকেই বাবা এমন চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছেন। কিন্তু আজ বাবাকে ভিন্ন লাগছে। তার চেহারায় গম্ভীর ভাব নেই। কেমন নিরব হয়ে আছে তার চোখ জোড়া। আমি পাশে বসতেই বাবা আমার দিকে তাকালেন। মলিন হেসে বললো,

‘আমি আমার মতামত তোমার উপর চাপিয়ে দেব তেমন বাবা আমি নই তনয়া। আমি কেবল তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ এর জন্য তোমার গড়তে চেয়েছি মাত্র। আজ তোমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো সে তোমাদের আরো যত্ন নিয়ে বড় করতো। কিন্তু কি বলবো বলোতো, তোমাদের সে ভাগ্য নেই। সে ভাগ্য নিয়ে তোমরা জন্মাওনি।’

বাবা থামলেন। আমার চোখ ছলছল অরে উঠলো। কথাগুলো অতিব সত্য। সত্যিই আমরা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি। কিন্তু আমরা খারাপ নেই! মাকে ছাড়াও বাবাকে নিয়েই সুখী আমরা।
বাবা থেমে আবারও বললেন,

‘সেসব কথা থাক। সাহিল ছেলেটাকে কেমন লাগে? ওর পরিবার থেকে কল করেছিল। তারা আমার কাছে তোমায় আবদার করেছে। আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলেছি। আমার মেয়ের মতামত ছাড়া তার বিয়ের মতো এতবড় সিদ্ধান্ত একা কিভাবে নেই?তোমার মত কি?’

আমি অশ্রু সিক্ত চোখে বাবার দিকে তাকালাম। কত ভুলটাই না জানতাম এই বাবার সম্পর্কে!
___________

বিয়ে নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল আকাশ সমান। ভারী লেহেঙ্গা, দু হাত ভর্তি মেহেদী, বড় কোনো পার্লার থেকে ব্রাইডাল লুক, পুরো ময়মনসিংহ শহরকে জানিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করা। বর মহাশয় ঘোড়ায় চড়ে আসতে না পারলে সমস্যা নেই। জিপে চেপে আসলেই চলবে। আমার বাড়ি সহ পুরো মহল্লা সাজানো হবে লাল নীল বাহারি আলোতে। কিন্তু আমার এসব স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে আমার বিয়ে হলো ভিষণ নিরবে। পুরো মহল্লা কেন পাশের বাড়ির কুকুরটা অবদি আমার বিয়ের কথা জানতে পারলো না। ভারী লেহেঙ্গার বদলে পড়নে ছিল হালকা গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি। গলায় সাদা পাথরের ছোট হার। কানেও হারের সাথের ছোট দুল। মেকআপ বলতে চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁট হালকা লিপস্টিক। হাত ভর্তি চুড়ির বদলে জায়গা পেয়েছিল সোনার মোটা দুটো বালা। একরাশ মন খারাপ নিয়ে নিজ রুমে বসে ছিলাম। নিচে তখন সাহিলের পরিবারের লোকেদের আপ্যায়নের ব্যাবস্থা হচ্ছিলো। নিসাকে আজ ভিষণ ব্যস্ত দেখাচ্ছে। কখনো ছুটে উপরে আসছে তো কখনো নিচে। যেন বোনের বিয়ের সমস্তটা সে একা হাতে সামলাচ্ছে। বড় ফুপি আসেননি। এভাবে তাকে না জানিয়ে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্তে তিনি রেগে আছেন। ছোট ফুপি ভোরের আলো ফুটবার আগেই এসে হাজির হয়েছেন। সাথে ফুপাও এসেছেন। তাদের স্নায়ু যুদ্ধ শেষে এখন বোঝাপড়া চলছে। ফুপি একবার এসে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। আমার কাজিনরা বর্তমানে দুলাভাইয়ের সাথে খোশ গল্পে মজেছে। আমি একা একা খুব বিরক্ত বোধ করলাম। আমার রঙীন জীবটা বিয়ে হতে না হতেই পানসে হয়ে যাচ্ছে যেন। আমি পাশ থেকে মোবাইল ফোন তুলে ঝটপট টাইপ করলাম,

‘আমি আপনাকে একদমই বিয়ে করতে চাচ্ছি না মহাশয়। আমার মন ছটফটাচ্ছে। এখনই উড়াল দিতে মন চাচ্ছে। আপনিকি বুঝতে পারছেন?’

ম্যাসেজ টা সেন্ড হতেই আমি অস্হির হয়ে রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোকটা কি এমন ম্যাসেজ দেখে রেগে যাবে? বিয়ের মন্ডব থেকে উঠে যেতে যেতে বলবে,’ এই বিয়েটা হচ্ছে না। এমন ম্যানারলেস,ফেল করা, উড়নচণ্ডী মেয়ে আমার যোগ্য নয়!’
আমার ছোট বুকটা শুকিয়ে এলো। এমন বলদের মতো অমন একটা ম্যাসেজ কেন করলাম ভেবে হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। তখনি আমার শরীরের ঘাম ছুটিয়ে ভদ্রলোক ম্যাসেজের জবাব দিলেন,

‘তোমার মনকে কেউ ধরে রাখছে না। কবুল বলা শেষ হলেই উড়াল দিতে পারো। কেউ বাঁধা দিবে না। কেবল জানিও কোথায় উড়াল দিতে চাইছো। পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কেবল আমার!’

___________

সাহিলের পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছয় জন। সাহিল পরিবারের বড়। তার ছোট ভাই সাহিন। বড় ভাইয়ের আগেই বিয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলেছেন। বর্তমানে তার চার মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান আছে। দুই ভাইয়ের আদরের এক ছোট বোন সামান্থা। মেয়েটা আমার বয়সী। তবে দারুন মিষ্টি। আসার পর থেকেই কেমন ভাবী ভাবী করে মাতিয়ে তুলছে আমায়। বাদ বাকি রইল আমার শ্বাশুড় আর শ্বাশুড়ি। শ্বশুড় গত হয়েছেন বছর তিনেক আগে। শ্বাশুড়ি পেশায় একজন ডাক্তার। বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তার কথা চালকলন বেশ নজরকাড়া। কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পর্ন ভদ্রমহিলা ভিষণ মিষ্টি ভাসি। আমাকে বাড়িতে এনে তুলতেই তিনি প্রথমে যে কথাটি বলেছিল তা হচ্ছে,

‘আমি সাহিলের মা। এখন থেকে তুমিও মা বলেই ডাকবে। আমি চাই তুমি আমার ছেলের বউ নয় মেয়ে হয়ে থাকো। সামান্থা আমার মেয়ে হলেও ও কিন্তু অন্যের আমানত যা কেবল আমি দায়িত্ব নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছি। কিন্তু তুমি এ বাড়ির সম্পদ। তাই আমার পেটের মেয়ের থেকে কিন্তু তুমি আমার কাছে বেশি মূল্যবান।’

আমি অপলক দৃষ্টিতে তার কথা শুনেছিলাম। মনে হয়েছিল মায়ের ঘাটতিটা বুঝি এবার তবে পূরণ হতে চললো!
.
.
সাহিলদের বাড়িটা একতলা বিশিষ্ট। বেশ পুরাতন ধাঁচের। বাড়ির সামনে বড় উঠান আছে। উঠানের পাশেই সান বাঁধানো কল পাড়। কলপাড় ঘেঁষে রয়েছে একটা তেঁতুল গাছ। যা বাড়িতে ঢোকার পথে চোখে পড়েছিল। সাহিলের রুমটা একটু পেছনের দিকে। সাদামাটা কক্ষটায় খুব বেশি আসবাবপত্র নেই। একটা বেড, ওয়াল কেবিনেট আর এক সাইডে ছোট টেবিল যা বই পুস্তকে ভরপুর। অন্য পাঁচটা রুমের মতোই এ রুমটাও সুন্দর করে গোছানো। তবে রুমের কোথাও একটা ফুলের চিন্হ অবদি নেই। আমার কপাল বরাবর সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। বাসর সাজানো হয়নি! আমার ভাবনা হয়তো সামান্থা বুঝলো। তাই আস্তে করে বললো,

‘মন খারাপ করো না ভাবী। খুব করে চেয়েছিলাম রুমটা ফুলে ফুলে ভরে দিতে। কিন্তু তোমার যে বর তিনি সাফ সাফ না করে দিলেন। সোজা গলায় জানালেন তার রুম যেন ফুল টুল দিয়ে নোংরা না করা হয়। ফুলে কি রুম নোংরা হয় বলোতো?’

আমি মনে মনে রাগলাম। লোকটার এমন কান্ডে আমার রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে। আসছে আমার গোছালো পুরুষ! কি হতো একটু রুমটা সাজালে? বিষন্ন মন করে চুপটি করে বেডে বসলাম। আজ এই লোক রুমে আসলে আমি নির্ঘাত তাকে ছ্যাকা ট্যাকা দিয়ে বসবো!

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে