#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
১১.
শহরের তুলনায় গ্রামে শীতের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। একদম হাড় কাঁপানো শীত যাকে বলে। শিশিরে ভিজে আছে নরম ঘাস আর গাছপালার পাতা। শিরশির বাতাসে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কুয়াশা আচ্ছন্ন ভোরে চারদিক ঝিমিয়ে আছে। কেবল হৈচৈ শোরগোল শুরু হয়েছে গ্রামের দক্ষিণ দিকের চৌধুরী বাড়িতে। এই গ্রামে চৌধুরী বংশ দুটো। একটা বাড়ি গ্রামের বাজার থেকে উত্তরে অন্যটা দক্ষিণে। তাই এর নামকরণ ও ঠিক সেভাবেই করা হয়েছে। মূলত এটা বড় ফুপির শ্বশুর বাড়ি। বিয়ের মতো এত বড় একটা কাজ ফুপা চান তার বাপের ভিটেতে দাঁড়িয়েই হোক। আমরা এখানে এসেছি গতকাল বিকেলে। অচেনা একটা গ্রামে এসে ফুপির শ্বশুর বাড়ি খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। এদিকে সন্ধ্যার আজান পড়তেও খুব একটা বাকি নেই। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকালাম। এই শীত শীত পরিবেশে বাজারে দাড়িয়ে থাকার মতো বিরক্তিকর জিনিস আর কি হতে পারে? ফুপিকে কল করা হয়েছে কয়েকবার কিন্তু রিসিভ হয়নি। আমার এই মুহূর্তে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি এসে হানা দিয়েছে আমার কাছে। নিসা কাছের এক দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো। দোকানে থাকা ভদ্রলোককে শুধালো,
‘চাচা এখানে চৌধুরী বাড়িটা কোথায়?’
ভদ্রলোট কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেললেন। বললেন,
‘আপনেরা কোন চৌধুরী বাড়িতে যাইতে চান? উত্তর চৌধুরী বাড়ি নাকি দক্ষিণ?’
এই প্রশ্নে নিসা আমাদের দিকে ঘুরে তাকালো। সে জানতে চাইছে ঠিক কোন দিকের চৌধুরী বাড়িটাতে আমরা যেতে চলছি। বাবাও বোকা চোখে তাকিয়ে। এই দিকের হিসেব তো আমাদের জানা নেই! তাই আমি চট করে বললাম,
‘উত্তর চৌধুরী বাড়িটা কোনদিকে?’
ভদ্রলোক আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে হাতের ইশারা করে বললেন,
‘এই উত্তর দিক বরাবর চলে যান। এদিকেই উত্তর চৌধুরী বাড়ি।’
তারৎএত সুন্দর জবাবে আমরা তখন চমকিত, বিস্মিত চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। এই উত্তর দক্ষিণের হিসেবটাতো অবোলা প্রাণীও বোঝে চাচা! কিন্তু আমরা জানতে চাই বাড়িটা কোথায়??
_____________
ফুপিদের বাড়িটা একতলা। আশপাশে বিভিন্ন ধরণের গাছ। যেন একটা বাগান বাড়ি। আমার ভালো লেগেছে ছাদ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা হিজল গাছটা। কি বিশাল বিস্তৃতি তার! ঝাঁকড়া পাতায় আবিষ্ঠ গাছটির নিচে শান বাঁধানো পাটাতন। বাড়ির উত্তরে একটা পুকুর আছে। তবে সেখানে এখন মাছ চাষ হয়। বাড়ির সদর দরজা বাহারি লাইট দিয়ে সাজানো গয়েছে। চেনা অচেনা আত্মীয়দের ভিড় জমেছে। নিসা আমার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
‘এখানে কেউ আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না আপু। কি ভিষণ অপমান জনক ব্যাপার তাইনা? ছেলের বোন আমরা! উই ডিজার্ভ সাম অ্যাটেনশন!’
আমি ওর কথায় সহমত পোষণ করলাম। এটা সত্যিই অমানবিক!
এর মাঝেই দেখা হলো ফুপার সাথে। আমাদের দেখতেই প্রশস্থ হেসে এগিয়ে এলেন।
‘দুঃখীত ভাই। আপনাদের আনতে লোক পাঠাবো তা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম।’
জবাবে বাবাও হেসে বললেন,
‘কোনো ব্যাপার না দুলাভাই। ছেলের বিয়ে, ব্যস্ত আছেন সেটা বুঝি।’
জবাবে ফুপা এক গাল হাসলেন। ফুপা ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমাদের ড্রয়িং এ বসতে দিলেন। সেখানো আরো অনেক মানুষের ভিড়। মুরুব্বি ধরণের মানুষেরা ঘুরেফিরে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে এরা বিয়ে খেতে নয় ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজতে আসে বেশি। বাবা ফুপার সাথে বেড়িয়ে পরেছেন। ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বাড়িতেই বিয়ে পড়ানো হবে। মেয়েদের বাড়ি এ গ্রামেই। নতুন বউকে রাখা হয়েছে ভাইয়ার রুমে। নয়টার দিকে হুজুর আসবেন। নিসা তার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পরিচিত কেউ নেই নাকি আজিব! আমার গুষ্টির পাগল গুলো কোথায়?
‘তোমার বিয়া হইছে মা?’
আমি কন্ঠ অনুসরণ করে সামনে তাকালাম। মাঝ বয়সী একজন মহিলা পাশের সোফায় বসা। মুখে তার পান। বড় করে হেসে তাকিয়ে আছে। তার সাথে সাথে আশপাশ থেকে আরো দু চারটা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমি অপ্রস্তুত হলাম। মুচকি হেসে বললাম,
‘জ্বি আন্টি। আমি বিবাহিত। আমার দু বছরের একটা বাচ্চাও আছে। আজ সাথে আনতে পারিনি। মেয়েটা তার বাবা বলতে পাগল। বাবাকে ছাড়া কিছুতেই আসবে না!’
আমার এমন ডাহা মিথ্যা কথার পিঠে মহিলা মলিন হাসলেন। বললেন,
‘কি করে তোমার জামাই?’
‘ ভার্সিটির লেকচারার!’
মহিলাটি ছোট করে জবাব দিলো,
‘ওও।’
আমার এমন চটপটে মিথ্যা কথায় তাজ্জব বনে গেলো নিসা। বিষ্ফোরিত নজরে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার এতএত গুনের মাঝে এই সুন্দর অভিনয়ের গুণটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আজ সেটাও স্বচক্ষে দেখে মেয়েটা থমকে গিয়েছে বোধহয়! আমি সেদিকে নজর না দিয়ে ঘরের ভেতরের দিকে হাঁটা দিলাম। অনেক বিশ্রাম হয়েছে এখন বোনের দায়িত্ব পালনের সময় হয়েছে। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা! তাছাড়া ফুপির সাথে দেখা না করলে হয় নাকি?
______________
নিশুতি রাত। আকাশে সুন্দর রূপালি থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে। সাথে ফুরফুরে শীতল বাতাস। আমার গায়ে বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি। শীতের জন্য পাতলা শাল জড়িয়েছি গায়ে। ছাদের উপরটা একদম শান্ত। নিচ থেকে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ আসছে। ছাদের একপাশে বেতের চেয়ার রাখা। আমি সেখানে আরাম করে বসলাম। অতিরিক্ত হৈ হুল্লোড়ের শব্দে মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। এক মগ চা হলে ভালো হতো। কিন্তু এখন সে পরিবেশ নেই। ফুপিকে বলেও লাভ হবে না। সে দারুণ বিরক্ত হয়ে বলবেন,
‘তোর মাথা কি পুরোপুরি খারাপ হলো নাকি তনয়া? বিয়ে বাড়িতে এই ভরা মানুষের মাঝে চা কিভাবে করবো? রান্নাঘরে ঢোকার যো নেই। তাছাড়া বউ মা কে এখন খেতে দিতে হবে। বাচ্চা মেয়েটা সেই দুপুরে অল্প কিছু খেয়েছে। তুই যা না তোর ভাবীর সাথে খানিক গল্প কর। ওমন চাঁদের মতোন রূপ মেয়েটার! দেখলেই তো কথা বলতে মন চায়।’
এসব ভেবে আমি মুচকি হাসলাম। ফুপির মাঝে কিছুটা বাচ্চামো স্বভাব আছে। এজন্যই তো হুটহাট করে মানুষটা রেগে যায়। মানুষটা হয়তো একটু ঠোঁট কাটা স্বভাবের। কিন্তু তবুও ভালো।
আমার ভাবনার মাঝে কল এলো। আমি চট করে সোজা হয়ে বসলাম। হয়তো সাহিল কল করেছে। লোকটার সাথে সকাল থেকে কথা হয়নি। ফোন ব্যাগ থেকে বের করতেই দেখা গেলো এটা ছোট ফুপি। ছোট ফুপি বিয়েতে আসেনি। ফুপার সাথে তার ভিষণ ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার দরুন তারা দুজন ঘরের বাহিরে পা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা বর্তমানে কোয়ারেনটাইনে আছেন।
‘হ্যারে তনয়া তোর বড় ফুপি কেমন মানুষ বলতো?’
‘সেটি তো আমার থেকে তোমার ভালো জানার কথা। তোমার বড় বোন বলে কথা!’
‘সেটা ঠিক বলেছিস। তোর বড় ফুপি মানুষটা স্বার্থপর। নয়তো ছেলের বিয়ে সেখানে আমি উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও একটা কল না করে কিভাবে পারল?’
আমি ছোট করে শ্বাস ফেলে বললাম,
‘আমায় কেন বলছো ফুপি? তোমার বোনকে কল করেই না হয় বলো।’
ফুপি দুসেকেন্ড ভাবলেন। বললেন,
‘এটাও ঠিক কথা। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে আর কাউকে কল করবো না। আমার মন খারাপ। এখন কি মন খারাপ করার বয়স বল? তবুও আমার মন খারাপ। তোর ফুপা তার স্টাডি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আমার সারাদিন টিভি ইর ইউটিউব দেখে কাটছে। এভাবে কি জীবন চলে? আমি এবার নির্ঘাত তোর ফুপাকে ছ্যাকা ট্যাকা দিয়ে বসবো।’
আমি নড়েচড়ে বসলাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
‘সে কি কথা!….’
আমার কথা শেষ হতে দিলেন না ফুপি। বললেন,
‘ওসব কথা ফতা বোঝানোর সময় নেই। তোর ফুপা রুমের দরজা খুলেছে বোধহয়। শব্দ পেলাম! এখন রাখছি।’
চলবে……