প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-০১

0
811

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.
‘আপু বাবা তোর জন্য ভুরিওয়ালা সরকারি চাকুরিজীবী পাত্রর খোঁজ পেয়েছেন। বর্তমানে আমি তোকে এটা জানাতে কল করেছি যে ভদ্রলোক খুব ডেস্পারেটলি তোর সাথে মিট করতে চাচ্ছে।’

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ভদ্রলোকের কি আগে বিয়ে টিয়ে ছিলো নাকি এটাই প্রথম?’

আমার কথায় নিসা খিলখিল করে হেসে ফেললো। মশকারা করে বললো,
‘থাকলে বিয়ের জন্য এত তোরজোর করত না। নেই বলেই তো অভাব ফিল করছে।’

আমি মাথা নাড়লাম। কথায় যুক্তি আছে। বাবার ঠিক করা এই পাত্রের সাথে দেখা করার জন্য আমারও আগ্রহ জমলো আকাশ সমান। ভদ্রলোক দেখতে কেমন না দেখলে কেমনে হয়?

সকাল দশটা বেজে এক মিনিট। আমি সবে বেড ছেড়ে নামলাম। সকালের নাস্তা আজও আমার কপালে নেই। হলে ব্রেকফাস্ট টাইম আটটা। নয়টার সময় হলেও কিছু একটা পাওয়া যেত। এখন গেলে রুমলী খালার বাজখাই গলার ধমক ছাড়া কিছুই জুটবে না। আমি আপাতত বাবার ঠিক করা পাত্রের সাথে দেখা করা নিয়ে এক্সাইটেড। আমার পরিবারের অতি অসাধারণ একটা রীতি রয়েছে আর তা হলো সরকারি চাকুরিজীবী ব্যাতিত কন্যাদান নিষিদ্ধ। এই রীতিটা প্রচলন করেছিল দাদাজান। এখন পর্যন্ত সেই রীতি অনুসরণ করেই বংশ আগাচ্ছে। যদিও আমার ভিষণ রকম ইচ্ছা আছে এই রীতি ভেঙে বেকার কোনো ছেলেকে টুপ করে বিয়ে করে নেওয়ার। দেশে যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে! বেকার ছেলেগুলো বিয়ের জন্য মেয়ে না পেলে বংশ আগাবে কিভাবে?
.
.
ঝামেলা হলো আউটফিট সিলেকশনের সময়। এত জামাকাপড়ের ভারে কোন জামাটা পরবো ভেবে কুল পাচ্ছি না। পাত্রের সাথে দেখা করতে গেলে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে হয়। এটাই ভদ্র সমাজের নিয়ম। এই নিয়মের হেরফের করা উচিত নয়। ভদ্রলোকের হার্টে সমস্যা আছে কিনা যাচাই করার জন্য হলেও সুন্দর লাগা চাই!

এপ্রিল মাঝামাঝি সময়। গ্রীষ্ম তার দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। রৌদ্রের তাপ যেন বেড়েই চলছে। খা খা রোদে গলা বুক শুকিয়ে আসছে। চারদিক থেকে গাড়ির হর্নের শব্দে মাথা ধরে আসার অবস্থা। ব্যাগে করে চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বের হতে পরের বার থেকে। আমি বর্তমানে শাহবাগের জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনে দাঁড়িয়ে। এখানেই আমাকে আসতে বলা হয়েছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন টুকটাক অদ্ভুত কান্ড আমার জীবনে হরহামেশাই ঘটতে থাকে। আমাকে ঘিরে সব অদ্ভুত প্রজাতির বসবাস। আমার পুরো গুষ্টির মধ্যে আমিই একমাত্র স্বাভাবিক প্রাণী। অনেক খুঁজে আমার বাবা তার মতোই এক অদ্ভুত প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন। সেই প্রাণীর সাথে দেখা করতেই আমি এখন লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভদ্রলোকের প্রতি ইন্টারেস্ট আমার বেরেই চলেছে।
বিরক্ত চোখে আশপাশে তাকালাম। ভদ্রলোক নিশ্চই টাইম মেইনটেইনের দিক থেকে ভিষণ কাঁচা নয়তো বিয়ের জন্য পছন্দ করা রমণীকে এভাবে দাড় করিয়ে রাখে? আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল মোবাইলের শব্দে। হাতে চেপে ধরে রাখা ফোনটাতে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। বিরক্তি চেপে রেখে কল রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে খুব নরম কন্ঠে এক পুরুষালী গলা বলে উঠলো,

‘অত্যন্ত দুঃখিত মিস শুভ্র শাড়ি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম আপনাকে। ডান সাইডের ক্যাফেতে চলে আসুন। অপেক্ষা করছি।’

কল কেটে যাওয়ার পরও কানে ফোন চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। যে লোকের কথা এত সুন্দর গোছালো সে আর যাই হোক ভুরিওয়ালা বুড়ো টাইপ হবেনা শিওর আমি।
খুব সহজে প্রেমে পড়ে যাওয়া টাইম মেয়ে আমি না। তবুও এবার হোঁচট খেয়েছি হয়তো। ব্যাপারখানা অনেকটা পা পিছলে কাঁদায় পড়ার মতোই। তবে লোকটা মিস শুভ্র শাড়ি কেন সম্মোধন করলো? পরক্ষণে খেয়াল হলো আমার পরণে শুভ্র রঙের শাড়ি। গোটা শাড়িটাই শুভ্র। এই তো কিছুদিন আগে ভার্সিটির ফ্রেসার রিসিভশন উপলক্ষে সকলে মিলে শুভ্র রঙের জামদানী কিনেছিলাম। অজ ড্রেস খুঁজতে গিয়ে এটা চোখে পড়লো। লোভ সামলাতে না পেরে জড়িয়ে নিলাম গায়ে। শাড়ির প্রতি দুর্বলতা আমার অনেক আগে থেকেই।
গ্রন্থাগারের ঠিক পাশেই কফিতা নামক ছোট্ট একটা ক্যাফে। আগে কখনো নজরে আসেনি ক্যাফেটা। ধপধপ পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। কাল বিলম্ব না করে সাদা রঙের শার্ট পড়া লোকটির অপজিটে বসে পড়লাম। না তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘আপনার নাম?’

ভদ্রলোক হয়ত ভরকাল। আমি পাত্তা দিলাম না। ধীরে সুস্থে মুখ উঁচু করে তাকালাম। ভদ্রলোক গাড় চোখে চেয়ে আছেন। তবে ভদ্রলোকের থেকে অবাক বোধহয় আমি একধাপ বেশি হলাম। শ্যাম বর্ণের লোকটি দেখতে সুদর্শন। কেবল সুদর্শন বললে ভুল হবে অতীব সুদর্শন। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মেদহীন সুঠম দেহ। ভদ্রলোক চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আলতো হেসে বললেন,

‘আমারো আপনার নাম জানা নেই মিস। আপনার থেকেই না হয় শুরু হোক।’

আমি ঝটপট উত্তর দিলাম,

‘প্রশ্নটা আমার ছিল। তাই উত্তর দেওয়াটা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে শিক্ষক মহাশয়।’

আমার সম্মোধনে হাসলেন লোকটি। মুচকি হেসে বললো,

‘চা নাকি কফি?’

‘আপনি কি খাচ্ছেন?’

‘চা!’

‘তবে আমার জন্যও তাই!’

কথাটা বলে থামলাম। এভাবে চটপট করে কথা বলর জন্য কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। পাত্রীকে হতে হয় লাজুক! নম্র স্বভাবের। এমন চটপটে স্বভাব প্রকাশটা বেমানান। আমি আড় চোখে তাকালাম। লোকটা নিশ্চই মনে মনে আমায় নিয়ে ঠাট্টা করছে! মনঃক্ষুণ্ণ হলাম। নিজের ব্যক্তিত্য হারানোর মতো অসহ্য অনুভূতি হলো। আমার ভাবনাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা আবারো চমৎকার করে হাসলো। আমি না চাইতেও মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। এতক্ষণ মনে মনে ঠিক করে নেওয়া পদক্ষেপ ভুলে অপলক দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছুটা হিংসা হলো। পুরুষদের কেন এত সুন্দর হতে হবে? এই যে আমি তাতে মুগ্ধ হচ্ছি এই দায়ভার কে নিবে?

‘আমি সাহিল মাহমুদ। পেশায় একজন শিক্ষক।’

আমি চায়ের কাপে ছোট করে চুমুক বসালাম। সাহিল কৌতুহল চোখে চেয়ে আছে। আমার তাকে বলতে ইচ্ছা হলো, আপনি একটা নিজস্ব নাম দিন আমার সাহিল। আমি সেই নামকে নিজের করে নিব। কিন্তু বলা হলো না। নিজের ভাবনা চিন্তায় নিজেই বিব্রত বোধ করলাম। এখানে আসার পর থেকেই এমন এলোমেলো ভাবনার‌ উদয় হচ্ছে। এগুলো অন্যায়! আমি সাহিলের দিকে তাকালাম। শুধালাম,

‘আপনি ভিষণ বড় অন্যায় করে ফেলেছেন শিক্ষক মহাশয়। নাম না জেনে পাত্রির সাথে দেখা করতে আসার মতো অন্যায়ের জন্য আপনার কারাবাস হওয়া দরকার।’

বরাবরের মতোই সে হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। আমিও মুচকি হেসে বললাম,

‘আমি তনয়া আহসান। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। বাবার দুই মাত্র মেয়ে। মা নেই। ব্যাস এতটুকুই।’

সাহিলের মুখভাব বদলালো। ছোট করে বললো,

‘আমার বাবা নেই। দু বছর হলো মারা গেছেন।’

আমি নির্মল হেসে বললাম,

‘আমার মায়ের চেহারাটা ও আমার মনে নেই। খুব ছোট ছিলাম। বোনটার বয়স ছিল ছয় মাস মাত্র।’

বেদনা পর্বের এখানেই ইতি টানল সাহিল। হয়ত এ বিষয়ে সে আর কথা বাড়াতে চাইছে না বলেই। দুজনের মাঝে কিছুটা নিরবতা চললো। আমিই কথা এগিয়ে নিতে বললাম,

‘আসলে এই মুহূর্তে বিয়ের কথা ভাবছি না আমি। বাবার মন রাখতেই এখানে আসা।’

কথাটা বলার পর মনে হলো খুব অগোছালো ভাবে কথা বলে ফেলেছি। এমন কথা নিশ্চই এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক পছন্দ করেননি! হয়তো মনে মনে রাগ ও করেছেন। ভদ্রলোক তার কথা বলার ধরণেই বরংবার তার স্ট্রং পার্সোনালিটির প্রকাশ করেছেন। আমার মন খারাপ হলো। আর যাই হোক এমন সুদর্শন পুরুষকে আঘাত করার চিন্তা আমার ছিল না। আর না নিজেকে এভাবে আবুল বানানোর! আমার ভাবনার মাঝেই সাহিল বললেন,

‘ইট’স ওকে মিস শুভ্রলতা। আপনার মনের বিরোধীতা করার বিন্দুমাত্র সাহস নেই আমার। সুন্দরী রমণীদের ইচ্ছের কদর করা পুরুষদের কর্তব্য।’

শেষের কথাটা কিছুটা মজা করেই বললো তিনি। আমার আবারো মন খারাপ হলো। কেন হলো জানা নেই। কিন্তু আমার মন খারাপ করেছে ভিষণ। এই সুদর্শন পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করে আমার হৃদয় ভেঙে পড়েছে। লোকটা কি দারুন করে সব কিছু সামলে নিচ্ছে। আর আমি?

‘আজ তবে আসি! টেক বেস্ট অফ লাক মিস!’

সাহিল উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

‘ ‘শুভ্রলতা’ নামের অর্থ কি?’

সাহিল ঘুরে দাঁড়ালো। তার সেই মুগ্ধকর হাসি হেসে বললো,

‘এটা নাহয় কখনো চলার পথে দেখা হলে বলবো।’

সাহিল চলে গেলো। সে চলে যেতেই স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলাম। এতক্ষণ যেন দম ধরে বসেছিলাম। ফোনের ক্যামেরা অন করে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলাম। চোখের কাজল খানিকটা লেপ্টেছে। আমার অস্বস্তির পাল্লা ভারী হলো। এতসব অঘটন আজই কেন? কেনন??
তবে লোকটার ভিতর মুগ্ধ করার মতো অসাধারণ ক্ষমতা আছে। সুপারন্যাচারাল পাওয়ার! এসব পুরুষ ভয়ংকর। এদের চারপাশ প্রেম নামক জাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। বেখায়ালে এগুলেই ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা চুড়ান্ত। এসব পুরুষের থেকে দূরত্ব রেখে চলা উত্তম। তবে লোকটা সত্যিই অসাধারণ!

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে