#প্রেমসাগরের_উত্তাল_ঢেউ
লেখিকা-লাবিবা নুসরত
||পর্ব-৬||
প্রাচীর চোখ বন্ধ ছিল। ছেলেটার এই চিৎকারে সে চোখ খুলে ফেলল। ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় জাহিনের মুখ দেখে সে আঁতকে উঠলো। কারন জাহিনের চোখ লাল হয়ে আছে। সে চশমা পরে। আড়াল থেকেই দেখা যাচ্ছে লাল রঙা চোখ।
যেই ছেলেটার হাতে ছুড়ি ঢুকিয়েছিল সে মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। বাকি দুটো জাহিনকে দেখে বেশ ভয় পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। আহত ছেলেটাকে না নিয়ে দুইজন এক দৌড়ে চলে গেল।
মাটিতে পরে থাকা ছেলেটাকে জাহিন কলার ধরে দাড় করালো। হাত দিয়ে এখনো রক্ত পরছে। ছুড়িটা জাহিন বের করে ফেলল। এতে রক্ত আরও বেশি পরতে লাগলো। প্রাচী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। জাহিন ছেলেটার কানের কাছে গিয়ে বলল,
“মেয়েদের অসম্মান করার শাস্তি এমনই হয়।”
এই বলে সে ছেলেটাকে ধাক্কা দিলো। কোনোমতে হাতের ব্যাথা নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো সে।
জাহিন প্রাচীর কাছে এসে কিছুটা স্বাভাবিক গলায় বলে,
“এতো রাতে এখানে একা কেন তুমি?”
প্রাচী~”আসলে এক ফ্রেন্ড এর জন্মদিন ছিল। সেখান থেকে আসছিলাম। যাইহোক আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।”
জাহিন~”সেটা পরের কথা। একা কেন?”
প্রাচী নিচু কণ্ঠে বলে,
“আমি জোর করে একা এসেছি।”
জাহিন বিরক্ত হয়ে বলল,
“মেয়েদের নিয়ে এক ঝামেলা। বেশি বোঝে। আচ্ছা আজ যদি আমি না থাকতাম কি হতো বুঝতে পারছো?”
প্রাচী~”আমি আসলে। সরি! আর আসবো না একা।”
জাহিন~”আচ্ছা। এখন আসো। বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসি।”
প্রাচী জাহিনের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর জাহিন বলল,
“সবসময় বাবার শক্তিতে না চলে নিজের শক্তিতে চলার চেষ্টা করবে।”
প্রাচী অবাক হয়ে জাহিনের দিকে তাকালো। সাথে কিছুটা লজ্জাও পেলো। আসলে নিজের উপরেই নিজের রাগ হচ্ছে তার। কেন যে একা আসতে গেলো!
________________________
_____________________
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজালো প্রাচী। মিসেস ইজাজ দরজা খুলে দিলেন। প্রাচীকে দেখে যেন তার জানে পানি এলো। তিনি প্রাচীকে বললেন,
“এতো দেরি কেন হলো তোর? আর একা কেন গিয়েছিলি?”
প্রাচী কিছু বলার আগেই তার চোখ পরলো জাহিনের উপর। বেশ অবাক হলেন তিনি।
“আরে জাহিন? তুমি এতো রাতে? প্রাচীর সাথে?”
জাহিন~”আঙ্কেল মেয়েকে একা একা এই রাতের বেলা বাহিরে যেতে দিবেন না। আজকে আমি না আসলে ছেলে গুলো কি করতো আল্লাহ জানে।”
মিস্টার ইজাজ ~”মানে? কোন ছেলে?”
জাহিন~”রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকটা ছেলে বিরক্ত করছিল।”
মিস্টার ইজাজ ~”আচ্ছা! প্রাচী ভিতরে যাও। জাহিন আসো তুমি?”
জাহিন~”নাহ আঙ্কেল। আজকে যাই। পরে আসবো।”
জাহিন চলে যায়। প্রাচী ভিতরে গিয়ে দেখে লারা বসে আছেন। প্রাচীকে দেখে বলেন,
“আসার সময় হলো তোর? এতো জেদ কেন হুম? কতো করে বললাম গাড়ি নিয়ে যা। শুনলি না!”
ইজাজ পিছন থেকে বললেন,
“শোন প্রাচী মা আর যেন গাড়ি ছাড়া একা বাইরে যেতে না দেখি আমি।”
প্রাচী “আচ্ছা” বলে গাল ফুলিয়ে চলে যায়। নিজের রুমে এসে ড্রেস চেইঞ্জ করে নেয়। আসলেই আজকে একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। একা আসাটা উচিৎ ছিল না। আর জাহিনের উপরেও রাগ হচ্ছে। “এই কথা বাবার কাছে বলার কি দরকার ছিল! আমারই ভুল। আর কোথাও একা যাচ্ছি না। আজ বেঁচে গিয়েছি।”
প্রাচী জলদি করে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পরল।
___________________
কেটে গেলো আরও একটা সপ্তাহ। আজ আয়ুস আর আরোহির বিয়ে। সকাল থেকে সেজে বসে আছে আরোহি৷ আয়ুসরা এখনো আসে নি। আরোহি নিজের ঘরেই বসে ছিল তখনই মিস্টার আরিফ আসেন। তিনি আরোহির বাবা।
মেয়েকে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বসেন।
“আরোহি সত্যি আজ আমি অনেক খুশি। আমার মেয়েটার বিয়ে যে!”
আরোহি~”হ্যাঁ আমিও খুশি!”
মুখে এই কথা বললেও। মনে মনে সে বলে,
“খুশি তো হতেই হবে বাবা! প্রাচীকে যে কষ্ট দিতে পেরেছি! ওদের যেমন অপমান করেছি এতে আমার খুশি আর বেরে গিয়েছে।”
মেয়েকে কিছু একটা ভাবতে দেখে আরিফ বলেন,
“কি হলো? কিছু ভাবছিস তুই?”
আরোহি~”না বাবা।”
আরিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ইজাজের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ। তাই বলে এমন না যে প্রাচীর সাথেও আমার শত্রুতা আছে। মেয়েটার বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে খারাপ লেগেছে। আবার ঠিক তার পাঁচ মাস পর ওই একই ছেলেকে তুই বিয়ে করছিস। ব্যাপারটা আমি তোর জন্য মেনে নিয়েছি।”
আরোহি~”এটা কেমন কথা বাবা? ওদের জন্য আমি নিজের ভালোবাসা বলি দিতে পারি না। তাছাড়া সবসময় দেখেছি ওরা তোমাকে অপমান করতো আর ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইতো না। আর এসব কথা এখন বাদ দাও।”
আরিফ~”আচ্ছা! বাদ দিলাম। আমি এখন যাই। বরযাত্রি এসে পরবে।”
আরিফ চলে গেলেন। যাওয়ার পথে স্ত্রী নিলিমাকে বললেন আরোহির কাছে গিয়ে বসে থাকতে। নিলিমা বেশ শান্ত একজন মহিলা। ইজাজ আর আরিফের মধ্যের ঝামেলা সে একেবারেই অপছন্দ করেন। তবে স্বামিকে অনেক ভয় পান। তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। আর মেয়েটাও হয়েছে স্বামির মতোই। চাচাকে দেখতে পারে না।
নিলিমা আরোহির কাছে গেলেন। মেয়েটার মুখের শয়তানি হাসি দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন যে কিছু একটা ঘটিয়েছে সে।
“আরোহি আমি তোর মা। তোর মনের কথা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। সত্যি করে বল? প্রাচীর বিয়ে ভাঙার সাথে তোর কোনো যোগাযোগ নেই তো?”
আরোহি মুখটা গম্ভীর করে বলল,
“মা এসব কথা একদম বলবে না। ওই মেয়ের চরিত্র ভালো ছিল না তাই আয়ুস আমাকে বিয়ে করছে। তুমি আর বাবা দেখছি ওই মেয়েকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো!”
নিলিমা কিছু বলবেন তার আগেই বাইরে শোরগোল শোনা গেল৷ তার মানে আয়ুস এসেছে। আরোহি বলল,
“মা তুমি যাও। ওরা হয়তো চলে এসেছে।”
____________________________
এইদিকে প্রাচীর বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। বিয়ের কার্ডে আজকের তারিখ লিখা ছিল। আজ তার ভালোবাসা অন্য কারো হয়ে যাবে!
প্রাচী কিছুই ভাবতে পারছে না। বুকের ভিতর যন্ত্রণা হচ্ছে। এতো চেষ্টা করেও আয়ুসকে ভুলতে পারছে না।
প্রাচীর গাল বেয়ে টপ করে জল গরিয়ে পরলো। আনমনে সে বারান্দার ফ্লোরে বসে আছে।
“আচ্ছা আমি নাহয় তোমাকে ভালোবাসতাম না তাই ওই ছবিগুলোকে বিশ্বাস করেছিলে। কিন্তু তুমি তো আমায় ভালোবাসতে! তাই না? তাহলে কিভাবে অন্য একজনের সাথে বিয়ে করছো? আমার কথা কি মনে পরে না তোমার? সেদিন যদি একটা বার আমার কথা ভাবতে! তোমাকে যে কতোটা ভালোবাসি সেটা যদি বুঝতে! আজ হয়তো আমাদের একটা সুখের সংসার থাকতো! কিন্তু আমাকে অবিস্বাস করলে! কেমন লাগবে তোমার যদি এভাবে তোমার ভালোবাসার মানুষটি তোমায় অবিস্বাস করে? নাহ, আমি অভিষাপ দিচ্ছি না! কাকে অভিষাপ দিব বলো? তোমাকে? সেই অধিকার যে নেই! আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। এতো কষ্ট না দিয়ে মেরে ফেলতে পারতে আয়ুস!”
প্রাচী ঢুকরে কেঁদে ওঠে। আয়ুসের কাছে এতো সময় ধরে বলা কথাগুলো আয়ুসের কানে পৌঁছায় নি। আদৌও পৌঁছাবে কিনা তাও প্রাচীর জানা নেই।
সে জানেনা কোন পাপের ফল পাচ্ছে! তার জীবন কি আলোর দেখা পাবে না!
হঠাৎ দরজায় কেউ জোরে নক করে। বারান্দা থেকেই প্রাচী শুনতে পেয়েছে। সে উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুছে দরজা খুলে। মিসেস লারা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানেন মেয়ে এতসময় কান্না করছিল। সেও এখন নিরুপায়। মেয়েকে আর কতো বোঝাবে!
মিসেস লারা প্রাচীকে নিচে আসতে বলে চলে যায়। প্রাচী কিছুক্ষণ পরে নিচে আসে। কেউ নেই সেখানে। লারা সোফায় বসে ছিলেন। ইজাজ ব্যাবসায়ীক কাজে শহরের বাইরে গিয়েছেন। কিছুদিন পরে আসবেন। প্রাচী সেটা জানে না। কারন গতকাল রাত থেকে ঘরের ভিতরেই ছিল সে।
প্রাচী মিসেস লারাকে জিজ্ঞেস করে,
“মা? বাবা কোথায়?”
মিসেস লারা~”শহরের বাইরে গিয়েছে। তোর কি সেদিকে খেয়াল আছে? সারাদিন মন খারাপ করে ঘরে বসেছিলি। তা যার জন্য মন খারাপ। এতো কষ্ট পাচ্ছিস সে কি করছে? বলতে পারিস? আজ অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। আর তোকে কতো বোঝাবো? তুই একটা মানুষ! এতো চিন্তা এতো কষ্ট কেন রাখছিস নিজের কাছে? নিজের প্রতি কি একটুও দয়া-মায়া নেই? নিজের কথা একটু ভাব মা!”
প্রাচী~”তুমি আমাকে কি বলতে চাচ্ছো মা?”
মিসেস লারা~”আমি তোকে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে বলছি। আবার নতুন করে সব শুরু কর!”
প্রাচী~”মা আমি এসব নিয়ে এখন ভাবছি না।”
মিসেস লারা~”তোকে ভাবতে হবে মা। তোর এই অবস্থা আমি আর নিতে পারছি না।”
প্রাচী একটা শ্বাস ফেলে বলে,
“আমাকে একটু টাইম দাও প্লিজ!”
মিসেস লারা মুখে হাসি এনে বললেন,
“নে মা! একটু টাইম নিয়ে নিজেকে বোঝ। সব থেকে জরুরি নিজেকে বোঝা। আর আমাদের সবসময় পাশে পাবি।”
প্রাচী একটা মেকি হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,,,,,,,,,,,,