প্রেমসরনী পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
1624

#প্রেমসরনী
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৭(অন্তিম পর্ব)

‘আকাশ আছে বলেই চাঁদের সৌন্দর্য্য অনুভব করা যায়। সে’ই আকাশকেই যদি অপমান করো সে’ই ব্যথা আকাশের চেয়ে বেশি চাঁদের লাগে কারণ একমাত্র চাঁদ জানে- আকাশ তার কতটা জুড়ে আছে। আমিও সেই চাঁদের মতো আমার আকাশের জন্য আমি নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি।
~ সেই প্ৰিয় আকাশ না থাকে যদি,,!
তাহলে আমিও হারিয়ে যেতে রাজি~
আমার আকাশ হলো আমার নিহুপাখি। আমার নিহুপাখির কোনো অস্তিত্ব না থাকলে তাহলে এই দুনিয়া’য় আমারো কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’

কথাগুলো রাহান নিহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
এরপর রাহান গিয়ে পারভীন বেগমের সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পারভীন বেগমের হাত দুটো রাহান মুষ্টিবদ্ধ করে নিল এরপর মায়ের হাতে চুমু খেল।

এতক্ষন রাহানের কথাগুলো শুনে পারভীন বেগম নিজের কান্নাগুলোকে আটকিয়ে রাখতে পারলেও রাহান পারভীন বেগমের সামনে এসে তার হাতে চুমু খেতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

-‘আমার চোখে আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। তুমি তো এমন ছিলে না মা! তবে আজ কেন! কীসের এতো পার্থক্য মা! নিহিও আমাদের তিশার মতো মেয়ে। আমি জানি আমার মা চাইলেই সবকিছু পারবে! একজন মা তার সন্তানের জন্য সবকিছুই করতে পারে। তুমিও আমার জন্য পারবে। এসবকিছু ভুলে যাও মা। তুমি সব পারবে। উপরে তুমি যেমনই রাগী দেখাও না কেন, আমি জানি তুমি ভেতরে এমন নও-তার চেয়ে দ্বিগুন নরম মনের মা তুমি। তুমি তোমার উপরের খোলসটা চাইলে ছুড়ে ফেলে ভেতরের নরম মনের খোলসটাকে সবার সামনে উপস্থাপন করো। এতো ভালো মনের মানুষটাকে উপরে এমন শক্ত মানাই না মা!’

রাহানের কথাগুলো পারভীন বেগম আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। আসলেই তো! নিহির সাথে এই মেয়েটার সাথে তার এতো কীসের শত্রুতা! নিহির মা তো কোনোদিন তিশাকে তার মতো এমন নজরে দেখেনি! তবে সে কেন এই পরীর মতো মেয়েটাকে এতো ভিন্ন নজরে দেখতো!
এসব ভাবতেই পারভীন বেগমের চোখ-জোড়া আবারো ভিজে এলো।
রাহান উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে পরম যত্নে মায়ের চোখ-জোড়া মুছে দিল।

-‘তোমাকে এমন মানাই না, মা। হাসো। কতদিন মন থেকে হাসো না তুমি মা! আজ থেকে এই মুখ থেকে যেন আর হাসিটা মুছে না যায়। তুমি জানো মা? তোমার হাসিটা আমার কতটা প্রিয় হাসি!’

রাহানের কথা শুনে পারভীন বেগম কান্নারত চোখে হেসে দিল।
এরপর পারভীন বেগম গুটি গুটি পায়ে নিহির দিকে এগিয়ে গেল। আজ অপরাধবোধে তাকে ঘিরে ধরেছে। পারভীন বেগম আজ নিহিকে ভালোভাবে পরখ করে নিচ্ছে। পরীর মতো কত্ত সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটাকে পারভীন বেগম এতদিন কীভাবে এতো মারতে পারলো! ভাবতেই অনুশোচনায় ঘিরে ধরছে পারভীন বেগমকে।

-‘আমাকে ক্ষমা করে দিস নিহু মামনি!’ কথাগুলো বলতে গিয়ে পারভীন বেগমের ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। তিনি কথাটা বলতে গিয়েই বুঝতে পারলো কতটা অন্যায় করেছে এতদিন মেয়েটার সাথে!

নিহি’র মনে হচ্ছে এই সব স্বপ্ন। যেন চোখ খুললেই সব মিথ্যা হয়ে যাবে! চোখ খুলতেই নিচে থেকে চাচির চিল্লাচিল্লি শুনবে এতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠার জন্য। নিচে যেতেই চাচির চড়-থাপ্পড় খাবে নিহি!

রেহেনা খালা এসে নিহিকে চিমটি দিতেই নিহির ঘোর ফিরলো।
-‘আহঃ খালা! চিমটি ক্যান দিলে?’
-‘এইগুলো তোর স্বপ্ন নই, বাস্তবেই হচ্ছে তাই চিমটি দিয়েছি। তুই স্বপ্ন ভেবে তোর সামনে যে মেডাম তোর কোনো উত্তর না পেয়ে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে সেই খবর কী আছে!’

নিহি সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল,, আসলেই তো,, সামনে তারই চাচি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
নিহি আর কিছু না ভেবে চোখের পানি মুছে হাসিমুখে পারভীন বেগমকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। পারভীন বেগমও পরম মমতায় নিহিকে বুকে আগলে নিল।

তিশা এতক্ষন দূরেই দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কথাগুলো শুনছে। সে নিজেও এসব উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে নিজেকে নিহির জায়গায় বসিয়ে উপলব্ধি করতেই সব অপরাধবোধ এসে একসাথে ঘিরে ধরলো ,নিহির এই বাসায় পুরোপুরি অধিকার থাকতেও সে নিঃশব্দে সব অত্যাচার মেনে নিয়েছিল। নিহিও তো তিশারই মতো একই মেয়ে, তবে কেন এতো পার্থক্য!

-‘মা, তোমার অন্য মেয়েকে পেয়ে আমাকে তো ভুলেই গিয়েছো!’ তিশা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠলো।

পারভীন বেগম হাসিমুখে তিশাকে ইশারায় ডাকলো। তিশা এগিয়ে যেতেই দুজনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো।
-‘আমায় মাফ করে দিস নিহু।’ তিশা নিহির দিকে তাকিয়ে মলিন স্বরে বলল।
-‘আরে দূর পাগলী! বোনের সাথে রাগ করে থাকা যায় না-কি?’
নিহির কথা শুনে তিশার মলিন চেহেরাটা মুহূর্তের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল।

রেহেনা খালাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পারভীন বেগম তাকে ডেকে নিয়ে তার কাছ থেকেও মাফ চাইলো। রেহেনা খালা তো এতেই খুশি। সে তো এটাই চেয়েছিল যে-সবাই যেন একসাথে মিলেমিশে থাকে। তার খুশির আর সীমা রইল না।

একটু দূরেই রাহান দু’হাত বুকে গুঁজে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইল। এতদিন পর তার পরিবারে সুখ ফিরে এলো মনে হচ্ছে। তার আর কিছু চাই না! এটাই যে অনেক!

—————-

সামনের সোমবার নিহি-রাহানের বিয়ের দিন। নিহি তো বেজায় খুশি – যে তারই স্বপ্নপুরুষের সাথে বিয়ে! এই যেন স্বপ্নের চেয়েও কম নই।

রাতে তিশা হাসি হাসি মুখ করে এসে খবর দিল যে- তার রাহান ভাইয়া নিহিকে ছাদে ডেকে পাঠিয়েছে।

-‘কী ব্যাপার তিশু! এতো খুশি খুশি লাগছে ক্যান তোরে!’ নিহি তিশার হাসি হাসি মুখ দেখে ভ্রু-কুঁচকে সন্দীহান কণ্ঠে বলল।

-‘তোরে মা না জানে মতো করে ডেকে দিলে আমাকে গিফট দিবে বলেছে ভাইয়ু, তাই। এখন তুই যা।’

-‘এতো রাতে ছাদে ক্যান?’ নিহি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠল।

-‘সেটা না হয় গেলেই দেখতে পারবি।’

নিহি আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ছাদে যেতেই নিহি আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। নিহি আরেকটু এগিয়ে যেতেই এক কোনে রাহানকে ধোয়া উড়াতে দেখতে পেল। আজ পূর্ণিমা রাত। চাঁদটা ভীষণ সুন্দর কিরণ দিচ্ছে। চাঁদের আলোয় নিহির এতটুক বুঝতে অসুবিধা হলো না যে- রাহান স্মোকিং করছে।

-‘আপনি স্মোকিং করেন?’নিহি একটু এগিয়ে গিয়ে রাহানের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।

রাহান এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহির কণ্ঠস্বর শুনে সিগারেটটা শেষবারের মতো লম্বা টান দিয়ে নিচে ফেলে পায়ে পিষে দিল।

-‘ হ্যাঁ, যখন মা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল তখন প্রথম প্রথম নিজেকে মানিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম- যে হয়ত প্রথম প্রথম সবাইকে ছেড়ে ;তোমাকে ছেড়ে আছি বলেই এমন লাগছে কিন্তু দিন বাড়তেই বুঝতে পেরেছি- যে না, তোমার প্রতি এটা আমার মোহ ছিল না। মা-তিশার সাথে কথা বলতে পারলেও তোমার সাথে পারতাম না। তখন তোমার প্রতি অনুভূতি’গুলো এই ধোয়াতেই উড়িয়ে দিতাম। তখন থেকেই এই আসক্তিটা!’

-‘তো এখন ফেলে দিলেন যে!’

-‘এখন তো তুমি আসছো। যখন তুমি থাকো না তখন এটাই একমাত্র আমার সঙ্গী।’

-‘এটি আপনার অসময়ের সঙ্গী, আমাকে পেয়ে এটাকেই ফেলে দিয়েছেন। এটা তো ভালো না,,!’

-‘কী ব্যাপার! আমার চেয়ে বেশি এটার প্রতি টান তোমার! আচ্ছা, আমার বন্ধুরা স্মোকিং কোরকে তাঁদের বৌ,প্রেমিকা’রা রেগে যায় আর তুমি কিছুই বললে না যে! আরো এটার প্রতি এক্সট্রা টান!’ রাহান সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে ভ্রু-কুঁচকে কথাগুলো বলল।

-‘আমার চয়েস ভিন্ন। ছেলেদের একটু-আধটু স্মোকিং না করলে মানাই না-কি! আমি তো ভেবেছিলাম আমার হাসব্যান্ড স্মোকিং না করলে আমিসহ একসাথে প্রথমবারের মতো ট্রাই করবো। কে কতোটা সহ্য করতে পারব দেখবো কিন্তু এখন আপনি তো আগে থেকেই করছেন তাহলে আমার কী হবে! আমিও আজ ট্রাই করবো, আমাকে একটা দিন প্লিজ?’ নিহি রাহানের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে কথাটা বলল।

নিহির কথা শুনে রাহান হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না! তার নিহি যে এখনো বাচ্চায় রয়ে গেছে কে বলবে!

-‘আর ইউ জোকিং নিহু?’

-‘না, আমাকে একটা দিন ভাইয়া প্লিজ…’

-‘তোমার এখন এমন বাচ্চামো স্বভাবগুলো যায় নাই নিহু। ভাগ্যিস এখানে এখন কেউ ছিল না ;নাহলে তো তোমার এমন বাচ্চামো কথাবার্তা শুনে সবাই আমাকে বাল্যবিবাহ করছি বলে জেলে ঢুকাই দিবে। তখন আমার বিবাহিত জীবনের বদলে বৌহীন-ভাবে জেলে থাকতে হতো।’

-‘আরে ভাইয়া দেন না।’ নিহি ঠোঁট উল্টিয়ে রাহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাহান আর না পারতে পকেট থেকে বেনসন বের করে নিহির হাতে দিল।

-‘পৃথিবীতে আমিই একমাত্র হবুবর মনে হয় ;যে নিজেরই হবুবৌ-য়ের হাতে সিগারেট খাওয়ার জন্য তুলে দিচ্ছে। কী কপাল আমার!’

নিহি রাহানের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে সাহসী ভাব নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে এক টান দিতেই কেশে তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ছুড়ে দূরে ফেলে দিল। তা দেখে রাহান হেসে দিল।

-‘যেটা করতে পারো না, সেটা করতে যাও ক্যান।’

নিহি কাশির জন্য কথা বলতে পারলো না। কাশি উঠার ফলে তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগল। রাহান নিহির পাশে এসে তার চোখ মুছে দিয়ে এক হাতে নিহিকে আগলে নিল। তারপর চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে নিহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘তুমি এই বিয়েতে রাজি তো নিহু?’

নিহি’র কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে রাহান নিহির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই নিহির লজ্জা-রাঙা মুখটা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হতেই রাহানের ঠোঁটের কিনারায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে তার উত্তর পেয়ে গিয়েছে। সেদিন প্রথমবারের মতো রাহান নিহির রুমে যেতেই নিহির পড়ার টেবিলের নীল-মলাটের ডায়রিটা তার চোখ এড়ালো না। সে আসার সময় সেটা হাতে করে নিয়ে এসেছিলো এবং তার অনুভূতি আর নিহির অনুভূতি একই ;এটা ওই ডায়রি থেকেই জানতে পেরেছিল। এরপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই সম্পর্কটাকে হালাল করার জন্য মা’কে এই প্রস্তাব দিয়েছিল কারণ সে এক বাসায় থেকে সম্পর্কতাকে হারাম করতে চায়নি, নিহিকে তার সাথে একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল।

নিহি রাহানের দিকে দৃষ্টি দিতেই রাহানের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে মুচকি হাসিটা দেখে নিহির মনে হল যেন সে এই পৃথিবীর সব চাইতে সুখী ব্যক্তি। নিহি অনেকের কাছ থেকে শুনেছিল, সুখ না-কি ক্ষণস্থায়ী। নিহি ভেবে পায় না ;তার কপালে এতো সুখ সইবে তো!

-‘আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবেন না তো!’ নিহি রাহানের দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে বলে উঠল।

রাহান গিয়ে নিহিকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরতেই রাহানের তুটনি নিহির কাঁধে স্পর্শ হতেই নিহি কেঁপে উঠল। রাহান নিহিকে দুহাতে পিছন দিক থেকে নিজের বুঁকের মধ্যে আবদ্ধ করে নিয়ে চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।

-‘এই যে! আজকের এই পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী করে তোমাকে কথা দিলাম- এই রাহানের জীবন যতদিন থাকবে ততদিন নিহুপাখিকে সাথে নিয়েই রইব। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই বুকে নিহির নামই কোদায় করে রইবে। ভালোবাসি যে অনেক,, আমার নিহপাখিটাকে।’

রাহানের কথা শুনে নিহি’র গায়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। জীবনে আর কী’ই বা চায় নিহির! একটা সুন্দর পরিপূর্ণ জীবনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে